নোমান ও নিঝুম

নোমান ও নিঝুম

নোমানের আজ কলেজ জীবনের শুরু.. স্কুল শেষ করে, আজ সে কলেজের দোড়গোড়ায়… নিজেকে বেশ বড় বড় মনে হচ্ছে তার..বড় বড় দাদাদের মত হাবভাব নিয়ে, স্টাইলিশ ব‍্যাগ, চুলে জেল লাগিয়ে, সুন্দর জামা-কাপড় পড়ে কলেজে ঢোকে…যেন বিশ্বের সব থেকে সুন্দর, স্মার্ট ছেলে সেই.. এমন ভাব তার হঠাৎই নোমানের পাশ দিয়ে একটা গাড়ি, কলেজে ঢোকে… গাড়িটাকে ঘিরে ধরে কলেজের ছেলেমেয়েরা.. অপরূপ সুন্দরী এক মেয়ে সেই গাড়ি থেকে বের হয়.. মেয়েটি তার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে নিজের ক্লাসের দিকে চলে যায়। নোমান সে সবকিছু স্থির দৃষ্টিতে দেখতে থাকে.. মেয়েটির রূপে সে এতই মোহিত হয়ে যায় যে, তার বাকশক্তি কাজ করে না.. কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই সমস্ত ঘটনাটি ঘটে যায় মেয়েটি চলে যাবার পর,

নোমান নিজের ক্লাসের দিকে যেতে থাকে..ক্লাসে ঢুকে, সে চমকে ওঠে.. সেই ক্লাসেই মেয়েটি তার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে বসে আছে। তা দেখে নোমান ভাবে হয়তো বা সে অন‍্য কোনো ক্লাসে ঢুকে গেছে। তাই সে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যায়… বেরিয়ে গিয়ে নোটিশ বোর্ডে দেখে যে, প্রথম বর্ষের জন‍্য, গ‍্যালারি ১.. নোমান ক্লাসের সামনে গিয়ে বারবার, ভালো করে দেখে gallery-1.. তারপরও ক্লাসের ভিতরে গিয়ে দেখে মেয়েটিকে.. নোমান, আর বেশি কিছু না ভেবে, এক জায়গায় গিয়ে বসে পরে.. ক্লাসে স্যার ঢোকে.. সবার নাম ধরে ধরে ডেকে, স্যার সবার সাথে পরিচয় করে নিতে থাকে.. নোমানের বুঝতে বাকি থাকেনা যে, মেয়েটির নাম নিঝুম, সে তার সাথে, তারই ক্লাসেই পড়ে।।

নিঝুম, অত্যন্ত স্বাধীনচেতা মেয়ে.. কোন কিছুর তোয়াক্কা করেনা.. সে নিজের জীবন, নিজের পছন্দমতোই কাটাতে ভালোবাসে.. তার জন্য লোক তাকে নিয়ে, কি ভাবে!! তা বিবেচনা করার প্রয়োজন বোধ করে না.. বড়লোক পিতার একমাত্র সন্তান সে.. যখন যা চায়, সবকিছুই সাথে সাথে পূরণ হলেও, তার মধ্যে যেন এক অদ্ভুত একাকীত্ব বিরাজ করে.. বাড়ি থেকে, বাবা-মায়ের থেকে, নিজের থেকে, যেন পালিয়ে বেড়াতে চায় সে.. খুব সুন্দর গান গায় সে, কিন্তু তা কেবল নিজের জন্যই.. সবকিছু থেকে যখন মুক্তি চায়, মন যখন খারাপ থাকে, যখন কারও সঙ্গে তার ভালো লাগে না, তার শ্বাস বন্ধ করে নিতে চায়, তখন সব ছেড়ে, একা একা গলা ছেড়ে গান করে, নিঝুমের এই গুনটির কথা কেউ জানে না..সবার কাছে নিঝুম, শুধুই বড়লোক, স্মার্ট, আধুনিকা…

নিঝুমকে, পাবার জন্য কলেজের সব ছেলেই প্রায় উৎসুক.. নিঝুম যদি কোন ছেলেকে, কিছু বলত, তা তারা আপ্রাণ চেষ্টা করত পালন করার নিঝুম সারাদিন ভালবাসি, ভালবাসি, ভালোবাসার কথা শুনতে শুনতে ভিতরে ভিতরে সে বিরক্ত, রিক্ত, শূণ্য অনুভব করতে থাকে। সব ছেড়ে, কলেজের অডিটোরিয়ামে গিয়ে, সে একা একা গাইতে থাকে..এসব নোমান ঠিক খেয়াল করে..সে, নিঝুমের গান শুনে অভিভূত হয়ে যায় বিরক্তি নিয়ে নিঝুম চলতে থাকে.. ক্লাস করতে থাকে.. কিছুই আর তার ভালো লাগে না.. এরকম সময়ে, নিঝুম খেয়াল করে, ক্লাসের প্রথম স্থান অধিকারী নোমান, তার দিকে তাকিয়ে থাকে, প্রায় সময়ই.. যখন তা নিঝুমের, চোখাচোখি হয়, তখনই নোমান চোখ সরিয়ে নেয়.. নিঝুম এই ব্যাপারটা বেশ কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করে, একদিন ক্লাস শেষ করে, সবাই যখন বেরিয়ে যেতে থাকে,তখন নিঝুম নোমানের হাত ধরে টেনে, দাঁড়াতে বলে নোমান দাঁড়ায়, নিঝুম, তার সামনে গিয়ে বলে, কিরে!! কি ব্যাপার তোর নোমান, কিছু বলেনা, মাথা নিচু করে, দাঁড়িয়ে থাকে…

-কিরে!! মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন!! মাথা তোল নোমান, তবুও কিছু বলেনা.. মাথা নিচু করেই থাকে..
-ও ভাবে তাকাস কেন!! আমার দিকে, আমাকে ভালোবাসিস!!

নোমান, নিচু মাথা তোলে.. নিঝুমের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে, নিজের পথে অগ্রসর হতে যায় নিঝুম বলে ওঠে, কি রে!! তাহলে বাকি ছেলেদের মতোই লাট্টু!!! তা বেশ নোমান ঘুরে দাঁড়িয়ে, নিঝুমের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, ঠিক করে কথা বল নিঝুম.. আর নিজের ভ্রম থেকে বেরিয়ে, আমার সাথে কথা বলবি…

-আমি ভ্রমে আছি!! মানে কি বলতে চাইছিস!!
-যা তুই বুঝলি, সহজ ভাষাতেই তো বললাম..
-আমাকে তুই ভালবাসিস না!!!
-না, ভালোবাসি না নিজেকে কি মনে করিস!!

খুব সুন্দরী!! সব ছেলে, তোকে পাওয়ার জন্য অস্থির!! সরি রে, তোর সে ভাবনা আমার ক্ষেত্রে ফলাতে আসিস না.. নিজের ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আয় এই বলে, নোমান চলে যায়.. ওদিকে নিঝুম, নোমানের ব্যবহারে স্তম্ভিত হয়ে যায় .. পুরো কলেজে, এই একটা ছেলে, যে কিনা তার পেছনে লাট্টু নয়.. পরেরদিন নিঝুম সংকোচে, সংকোচে, একটা বই নিয়ে, নোমানের কাছে যায়..বইটা সে, নোমানকে দিয়ে বলে, বিষয়টা বুঝতে পারছি না, বুঝিয়ে দিবি প্লিজ নোমান বইয়ের দিকেই চোখ রেখে বলে, ঠিক আছে..

-কোথায় বোঝাবি!!! কখন বোঝাবি!!
-ক্লাস শেষের পর বাগানে…

ক্লাস শেষের পর, নিঝুম, নোমানের জন্য বাগানে অপেক্ষা করতে থাকে.. এভাবে নোমান, নিঝুমকে রোজ বাগানে পড়া বোঝাতে থাকে.. এভাবে রোজ পড়া বুঝতে বুঝতে নিঝুম, একদিন নোমানকে বলে, আমরা কি বন্ধু হতে পারি না!!

নোমান, নিঝুমের দিকে, তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, হুমম নোমান, নিঝুমকে শুধু পড়া বোঝায় তা নয়.. সে নিঝুমের খুব ভাল বন্ধু হয়ে যায়.. নিঝুম তাকে সব কথা বলে.. তাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে গভীর হতে থাকে.. নোমান, নিঝুমকে না দেখে থাকতে পারেনা.. তাই যত কষ্টই হোক না কেন, নোমান কলেজ কামাই করে না.. রোজ যায়.. নিঝুমেরও একই অবস্থা, কিন্তু সে কোন কথা নোমানকে জানাতে ভয় পায়.. সে যে, নোমানের বন্ধুত্ব হারাতে চায় না.. ইতিমধ্যে নিঝুমের শরীর খারাপের কারনে 7 দিন সে কলেজে আসতে পারেনি.. কলেজে এসে সে, অন্যান্য বন্ধুদের সাথে কথা বলতে থাকে, তা দেখে, নোমানের রাগ হতে থাকে, কিন্তু সে কাউকে কিছু বলে না.. শেষে নিঝুম বাগানে আসে, সেখানে নোমান অপেক্ষারত..

-এতক্ষণে সময় হল!!(নোমান)
-কি হল তোর!! এত দিন পর দেখা হল.. তবুও বকছিস কেন!!(নিঝুম)
-এত দিন আসে নি কেন!!

ধুররররর এই বলে, নোমান উঠে চলে যায়.. নিঝুম পিছন থেকে অনেকবার ডাকে, কিন্তু, নোমান সব ডাককে অগ্রাহ্য করে, বাড়ি চলে যায়। পরের দিন আসলেও, নোমান, নিঝুমের দিকে, একবারও তাকিয়ে দেখে না, তার সাথে কথা বলার চেষ্টাও করে না, ক্লাস শেষে বাগানেও অপেক্ষা না করে, কলেজ থেকে বেরিয়ে যেতে চায়, কিন্তু নিঝুম, নোমানের হাত ধরে, টেনে বলে,

-কি হয়েছে তোর!!
-কিছু না.. কিছু হয়নি..
-পড়াবি না আজকে!!
-না..
-কেন!!! নোমান, নিঝুমের দিকে ঘুরে বলে, আমি আর কখনো তোকে পড়াবো না…
-কিন্তু, কেন!!!

নোমান, আর কিছু না বলে, নিঝুমের হাত ছাড়িয়ে চলে যায়.. এরপর বেশ কিছুদিন যায়, নোমান, না নিঝুমের সাথে কথা বলে, না তার দিকে তাকিয়ে দ্যাখে, সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে.. সে কেবল কলেজে আসে, ক্লাস করে, ফিরে যায়.. এভাবে নোমানের থেকে নিঝুম, অগ্রাহ্য আর সহ্য করতে পারেনা.. ছুটে নোমানের পিছনে যায়, গিয়ে, তার হাত টেনে ধরে, বলে, কি হয়েছে তোর!!!

-কিছু না.. হাত ছাড়..
-কেন এরকম করছিস!!
-হাত ছাড়….
-ছাড়বো না.. এত অবহেলা কেন করছিস!!!
-হাত ছাড়……
-আমি আর এই হাত ছাড়তে পারবো না.. আর অবহেলা করিস না নোমান… এত কষ্ট দিস না.. আর সহ্য করতে পারছি না..(কেঁদে ফেলে নিঝুম)

নোমান, কিছু না বলে, নিঝুমের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যায়.. তার সর্বাঙ্গ শিহরিত হতে থাকে, সে যে, নিঝুমের কাছে ধরা পড়তে চায় না.. নিঝুমের থেকে দূরে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে.. সে যে নিঝুমের বিশ্বাস ভাঙতে চায় না, তার বন্ধুত্ব নষ্ট করতে চায় না নিঝুম দিশেহারা হয়ে পড়ে, নোমানের এভাবে চলে যাওয়াতে.. সে হাঁটতে হাঁটতে কলেজের অডিটোরিয়ামে দিকে যায়.. অডিটোরিয়ামে ঢুকে, দরজা বন্ধ করে দেয়.. কিছু সময় একাকী চুপচাপ বসে থাকে, তারপর সে গাইতে গাইতে, নাচতে থাকে.. তার খেয়ালও থাকে না, যে সেখানে জানলার কাঁচ ভেঙে পড়ে আছে.. কোন কিছুই না খেয়াল করে নাচতে থাকে.. নাচতে নাচতে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় নিঝুমের যখন জ্ঞান ফেরে, তখন সে হাসপাতালে শুয়ে, নোমান সামনে বসে তার সেবা করছে..সে কথা বলতে পারে না, ভীষণ ক্লান্ত সে.. আবারও ঘুমিয়ে পড়ে, ঘুম ভাঙলে সে ঠায় নোমানকে সামনে দেখতে পায়.. সে বলে, তুই এখানে!!

-তুই একটাও কথা বলবি না (নিঝুম হেসে বলে) কথা তুইই বলছিস না..

-তুই এরকম কেন করিস!!!
-কি করেছি!!
-নিজেকে আঘাত…
-তোর তাতে কি!!
-অনেক কিছু.. বুঝবি না নিঝুম হাসে, কিছু বলে না..
-ওভাবে তুই নাচ- গান করবি কেন!!
-তুই কিভাবে জানলি, আমি নাচ- গান করি…
-আমি জানি সব,, তুই কখন নাচ-গান করিস, কেন করিস, সব জানি.. কিন্তু, মন খারাপ বলে ওভাবে নাচবি!! খেয়ালও করবি না, যে সামনে কাচ… আর ক্ষত- বিক্ষত করবি নিজেকে!! কেন করিস এরকম!!!

-কেন!! কি হয়েছে তাতে!!!
-কেন বুঝিস না!! আমার কষ্ট হয়…(নোমানের চোখের কোনায় জল এসে যায়)
-কাঁদছিস কেন!!! (মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে নোমান বলে) কিছু না…
-কষ্ট না ছাই… আমার হাত যে, বারবার ছাড়িয়ে চলে যায়, তার মুখে কষ্টের কথা মানায় না, আমার জন্যে…
-বুঝবি না (কাঁদো কাঁদো গলায়)

(নিঝুম, নোমানের হাত টেনে ধরে, ঘুড়িয়ে, বলে,) আর হাতটা ছাড়িয়ে নিস না প্লিজ  পারবো না আর এবার হাতটা ধরে নে, প্লিজ.. চোখের জল লোকানোর বৃথা চেষ্টা বন্ধ কর (নোমান আর কোন কথা বলতে না দিয়ে, নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে, কাঁদতে কাঁদতে বলে,) পারব না ছাড়তে তোকে.. খুব ভালোবাসি রে তোকে.. হারাতে খুব ভয় পাই তোকে (নিঝুমও কেঁদে ফেলে, নোমানকে জড়িয়ে ধরে, বলে,) আমিও খুব ভালোবাসি তোকে.. কিন্তু তোকে বলতে ভয় পাই, তোর অবহেলা যে, খুব কষ্ট দেয়, তুই বুঝিস না… পাগল পাগল লাগে, খুব কষ্ট হয় গলার ভেতর, শ্বাস যেন বন্ধ হয়ে যেতে চায়.. মাথা কাজ করে না..তবুও তুই বারবার কষ্ট দিস.. অবহেলা করিস.. কেন বুঝিস না, বুঝতে চাস না আমাকে!!!

-সসসসসসসস চুপ সব বুঝি দুজন দুজনকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখে….

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত