পড়ন্ত বিকেলে সূর্যাস্তটা যখন নদীর বুকে মিশে যাওয়ার নেশাতে মগ্ন,নদীর পানি গুলো তখন স্রান্তনীড়ে একাকি একক বন্ধনে
অটুট হওয়ার প্রতিজ্ঞাতে বিভর।।
ঝাঁকে ঝাঁকে নীড়হারা পাখিগুলোও তার নিজ গন্ত্যব্যে ফিরে যাওয়ার জন্য অধির আগ্রহে পাখা মেলেছে।
ধিরে ধিরে সূর্যটা হঠাৎ করেই নদীর অতল গহ্ববরে নিমিষেই হারিয়ে গেলো,,চারিদিকে নেমে আসতে লাগলো আবছাঁয়ার হাতছানি।।
এমন সময় হাসান কাঁধে এসে হাত রাখলো…
দোস্ত আর কত অপেক্ষা করবি,এবার তো একটু বোঝার চেষ্টা কর।।এতোদিন তো হলো একবারের জন্য খোঁজ নেই নি আর আসবে বলে তো মনে হয় না।।
তো কার জন্য এই অপেক্ষা করিস,অকারনে।।
চল না নতুন করে জীবন টা আবার শুরু করবি,তোর এই নিস্তব্ধতা আমাদের কে অনেক কষ্ট দেয় রে।
হাসান এর কথা শুনে আমি ওর মুখের দিকে একটাবার তাকালাম,তারপর আবার নদীর পানি দেখতে লাগলাম।
হাসান আবার বলতে শুরু করলো,
:-আশিক”আমার কথা কি তোর কানে যাই না,কেন এমন পাগলামি করছিস?
রোজ রোজ দাড়িয়ে থাকার কোনো মানেই হয় না
সে আর তোর জীবনে আসবে না,তবুও কেন এভাবে নিজের জীবন টাকে নষ্ট করছিস।।
চল না আবার নতুন করে জীবন টাকে শুরু করবি।।
:-আসবে,,ঠিকি ফিরে আসবে,বলেছিলো ফিরে আসবে ঠিকি ফিরে আসবে।আমার ভালোবাসা মিথ্যে না,,সুমি একদিন ঠিকি ফিরে আসবে।
আমার কথা শুনে হাসান চুপ করে গেলো।
আজ ৪বছর হলো সুমি চলে গেছে।।সুমির সাথে শেষ দেখাটি এ নদীর পাড়েই হয়েছিলো আমাকে “ভালো থেকো “বলে চলে গেছিলো।
কখনো ভেবেও দেখেনি তাকে ছাড়া ভালো থাকাটা আমার জন্য কতটা যন্ত্রনাদায়ক।
ফিরে দেখা…….
জীবন টা ছিলো তখন নীল আকাশে উড়ে বেড়ানো একঝাঁক নীড়হারা মুক্ত পাখির মতন।লেখাপড়া শেষ করে সারাদিন হৈ হুল্লড় আর
বন্ধুদের আড্ডাবাজি ছিলো আমার জীবনে একমাত্র উদ্দ্যেশ্য।
বেশ ভালোই আর হাসি খুশি ছিলাম আমি,বন্ধু মহল টাকে সবসময় মাতিয়ে রাখতাম,খুব আদরের ছিলাম বন্ধুমহলে আমি।
কিন্তু কোথাই থেকে যে জীবন টা থমকে দেওয়ার জন্য একটা মেয়ে আসলো নিজেও বুঝতে পারি নাই।
সে দিন ছিলো বিকেল বেলা,,আড্ডবাজিতে মগ্ন ছিলাম আমি।
হঠাৎ করে একটা বাচ্চা ছেলে এসে আমাকে ডাক দিয়ে বললো,
‘ওই যে ওই আপুটা আপনাকে ডাকছে’
বন্ধুরা সবাই আমাকে নিয়ে হাসিতে গড়াগড়ি খেলো।
একজন তো বলে উঠলো,
:-দোস্ত তোর হয়ে গেছে,তোর কি কপাল রে আমার মেয়েদের পিছনে ঘুরে কেও পাত্তা দেয় না আর তোকে নিজে থেকে ডাকছে।
আমি তাদের কে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
:-তোরা একটু বেশি ভেবে ফেলেছিস হতে পারে কোনো দরকারের জন্য ডাকছে।
অতঃপর উঠে মেয়েটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।
মেয়েটা আমাকে আমার নাম জিজ্ঞাসা করলো।
:-আপনার নাম কি আশিক?
:-হুম কেন?
নাম বলতেই গালে ঠাস করে একটা পড়ে গেলো।
আমি তো পুরাই অবাক,আর তার সাথে আমার বন্ধুরাও।
মেয়েটা তারপর বলতে লাগলো।
:-আপনার সাহস তো কম না,আমাকে লাভ লেটার পাঠান।
মেয়েটার কথা শুনে আমি অবাক,
:-আমি আপনাকে লাভ লেটার দিতে যাবো কেন?
:-মিথ্যা বলার জায়গা পান না,সুন্দরী মেয়েদের দেখলেই প্রেম করতে ইচ্ছে করে তাই না।
:-আজিব তো,আপনার মাথাতে কি কোনো প্রবলেম আছে নাকি,কি বলছেন পাগলের মতন এসব।
:-ওই একদম চুপ প্রেম পত্র দিয়ে আবার বড় বড় কথা।
:-আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে আমি আপনাকে তো চিনিও না তো লাভলেটার দিবো কি করে।
:-তাই নাহ্(হাতে থাকা একটা চিরকুট খুলে দেখালো আমাকে)
এটা কি তাহলে।
:-কি এটা?
:-এটাই সেই প্রেম পত্র,আর নিচে আপনার নাম লেখা আছে।
:-ওহ্ কাহীনি তাহলে এতক্ষনে বুঝলাম।
:-মানে?
:-মানে এটা আমি লিখি নাই,আর বিস্বাস না হলে আমার হাতের লেখার সাথে মিলায়ে দেখতে পারেন।
:-তো কি লিখেছে এটা।
:-আমি কি করে বলবো,তবে এটা আমার লেখা না আর আমি এসবের কিছু জানি না।
:-দাঁড়ান আমি প্রমান করে দিবো,এটা আপনিই লিখেছেন।
:-ওকে দেখান।
বলেই সুমি আমার কাছ থেকে চলে গেলো,
আর আমিও পাগলের মতন দাঁড়িয়ে রইলাম গালে হাত দিয়ে।
বন্ধুরা সবাই এক একজন একরকমের কথা বলতে লাগলো।
কিন্তু আমি এসবের কিছুই জানি না,আর আমার বন্ধুরাও জানে আমি কেমন তাই ঘটনাটা সেদিন ই সমাপ্তি করে দিলাম।।
সপ্তাহ দু’এক পর আবারো মেয়েটি এসে দাঁড়ালো আমার সামনে,,
:-কি আবারো মারবেন নাকি?
:-দেখুন এভাবে আমাকে লজ্জা দিবেন না।সেদিনের ব্যবহার এর জন্য দুঃখিত।
:-দুঃখিত বললে কি সব মাফ হয়ে যাই,,তবুও মেয়ে বলে ছেড়ে দিলাম।
আচ্ছা ভালো কথা প্রেমপত্রটা দিয়েছিলো কে,তাকে কি পেয়ে গেছেন।
:-হুম,,সেই জন্য তো সরি বলতে এসেছি।
:-ওহ্ তা কোই সেই মহান প্রেমিক।
:-আর বলেন নাহ্,বেয়াদপ ছেলে একটা মেয়ে দেখলেই প্রেমপত্র দেয়,এর আগেও দিছে অনেককেই পাশের মহল্লাতে থাকে সে।
:-ওহ্ তো আপনাকেও তো এ মহল্লাতে এর আগে কখনো দেখি নাই।
:-আমরা নতুন এসেছি আমার বাবা সরকারি চাকুরি করে সেই জন্য আমাদের এখানে চলে আসতে হয়েছে।
:-ওহ্ আচ্ছা,নতুন এসেই প্রেম পত্র বাহ্ ভালোই তো।
:-দিলে আমি কি করবো,আর আমি তো মহল্লার তেমন কাওকে চিনিও না,শুধু ভার্সিটিতে যাওয়া আসা বাকি সময় তো বাসার ভিতরেই থাকি।
ওহ্ হ্যা আমার নাম সুমি,,
:-আমার নাম তো জানেন ই।
:-হুম,আমি একটু বেশি কথা বলি তাই নাহ্,,অবশ্য আমার মাও বলে আমি নাকি বেশি কথা বলি।।
কি করবো বলেন বাসার ভিতরে সারাদিন একা একা থাকি কথা বলার কেও নাই,তাই কথা বলার কাওকে পেলে আর চুপ থাকতে পারি নাহ্।
সুমি কথা বলে চলেছে আর আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছি তার কথা বলা,,আসলেই মেয়েটি অনেক সুন্দর করে কথা বলতে পারে।
কন্ঠস্বর টাও খুব সুন্দর।
দেখতেই কোনো দিক থেকে কম না।
এভাবেই ভুল এর দ্ধারা সুমির সাথে আমার পরিচয় হয়,তারপর বন্ধুত্ব।
আমি আর সুমি এখন অনেক ভালো বন্ধু,ওর একাকি সময়টুকু আমার সাথে কাটিয়ে দেয় আর আমি বিনিময়ে ওর মিষ্টি মধুর কন্ঠস্বর শুনে মগ্ন হয়।
বেশ ভালোই চলছিলো আমাদের বন্ধুত্বটা,কিছুটা খুনসুটি অভিমান,কিছু অজানা সুখের মুহুর্ত।
সময়টাকে যদি কোনো একটা সুখি ফ্রেমে আবদ্ধ করে রাখতে পারতাম খুব ভালো হতো।
কিন্তু তা তো হবার নই,তাই সময়ের সাথে সাথে আমাদের বন্ধুত্বটাও একটা নতুন সম্পর্কে রুপান্তর হয়।
আর সেই সম্পর্কের নাম ভালোবাসা।
বেশ চলছিলো আমাদের রাজ্য ছাড়া রাজকুমার আর রাজকুমারীর দিন গুলো।।
সুমি আমার কাছে একটু বেশি পাগলামি করতো,আর তার সাথে বায়নাটাও।।
খুব ভালোবাসতাম তাই তার পাগলামি গুলোকে নিজের এক একটা সুখের মুহুর্ত ভেবে ধরে নিতাম।
দু জনের সারাদিন অহটল ঘুরে বেড়ানো,খোলা আকাশের নিচে হাজার রঙিন স্বপ্নের জাল বুনা,ঠিক যেন এক জোড়া কপত কপতির মতন।।
কিন্তু সময় তো থেমে থাকে না,তাই আমার ক্ষেত্রেও সেটা হল,,
সে দিন বিকেলে নদীর ধারে বসে সুমির জন্য অপেক্ষা করছিলাম,,,অনেক্ষন বসে থাকার পর সুমি আসলো।
:-কি আজকে এতো দেরি করে আসলে যে।
:-আশিক তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে না(কাঁদো কাঁদো কন্ঠে)
:-মানে, কি বলছো তুমি?
:-লেখাপড়ার জন্য আমাকে বাইরে পাঠিয়ে দিবে,আজকে সন্ধ্যার সময় চলে যাবো।
:-চলে যাবে মানে,আমি থাকবো কি করে।আর আমাকে বলো নি কেন?
:-আমিও জানতাম না,হুট করেই বাবা আমার অজান্তেই সব করে ফেলেছে।
:-তোমাকে ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হবে
:-আমারো অনেক কষ্ট হবে তবুও যেতে হবে,ভালো থেকো আর নিজের খেয়াল রেখো,আবার ফিরে আসবো আমি।।
মাত্র তো কয়েকটা বছরই দেখতে দেখতে কেটে যাবে।
বলেই সুমি চলে গেলো,আমি নির্বাক চোখে সুমির চলে যাওয়া দেখছিলাম।।
হঠাৎ চোখ দুটি ঝাপসা আলোতে হারিয়ে গেলো,
নিজেকে আবিস্কার করলাম একটা অন্ধ্যকার রুমে।।
জানি না কি হয়েছিলো,শুধু এতোটুকু পড়ে সুমি চলে যাচ্ছিলো,,আর সাথে করে নিয়ে যাচ্ছিলো আমাদের হাজারো স্বপ্নগুলোকে।।
যে গুলো এতোদিন সাঁজিয়ে এসেছি।।
আজ অনেক দিন পর আবার নদীর তীরে এসেছি,কারন আজকে সুমি ফোন দিয়েছিলো সে আবার ফিরে আসছে আমার কাছে।
আজকে আমি অনেক খুশি,,এতোদিন পর আবার সুমিকে ফিরে পাবো।।
শুন্য থাকা বুকটাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বলবো এখনো তোমাকে অনেক ভালোবাসি।।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্য নেমে এলো কিন্তু সুমি এলো না,একসময় হতাশা হয়ে ফিরে এলাম।
তার মানে কি সুমি সত্যি আমাকে ভুলে গেছে,,তার দেওয়া কথা মনে নাই তার।
হাজারো প্রশ্নবিদ্ধ করছে আমাকে।।
ক্লান্ত শ্রান্ত শরির নিয়ে বিছানাতে গিয়ে সুয়ে পড়তেই চোখে ঘুম নেমে আসলো,,,
সুমির কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি বুঝতেই পারি নাই।।
সকালে ঘুম ভাঙ্গলো,একটা অল্প বয়সি মেয়ের কন্ঠে,,কন্ঠটা আমার খুব পরিচিতো।।
:-এই যে মিষ্টার।
:-ঘুম থেকে উঠেই অবাক হয়ে গেলাম,,কিছুক্ষনের জন্য মনে হলো এখনো হয়তো স্বপ্নে ডুবে আছি আমি।
অবাক চোখে প্রশ্ন করলাম,,
তুমি?
কখন এসেছো তুমি নাকি আবার আমি স্বপ্ন দেখছি।।
:-স্বপ্ন না বাস্তব,,আমি ফিরে এসেছি আবার।
:-এতোদিনে তোমাকে কতটা এসএম এস করেছি কতটা মেইল করেছি,একটারো রিপ্লে দাও নি তুমি।
একটাবারের জন্য তো ভেবেছিলাম তুমি হয়তো হারিয়ে গেছো আমার জীবন থেকে।
:-আমি চাই নি ওখানে গিয়ে তোমার কথা মনে করতে,তাহলে আমার ওখানে যাওয়াটা সফল হতো না।
তোমার মায়াতে পড়ে আবার ফিরে আসতাম।
আর বাবাও চেয়েছিলো আমার গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর তোমার সাথে বিয়ে দেওয়ার সেই জন্য আমি চাই নি তোমাকে বেশি দিন দুরে রাখতে।
:-তুমি যাওয়ার আগে বলো নি তো।
:-আমি চেয়েছিলাম আমার না থাকার শুন্যতাটা তুমি ফিল করো,,আর আমি তো তোমারই ছিলাম।
:-তবুও তো বলতে পারতে,তুমি জানো তোমাকে ছাড়া থাকতে আমার কতটা কষ্ট হয়েছে।
:-তোমার থেকে আমার বেশি কষ্ট হয়েছে,প্রতিটা মুহুর্ত তোমার কথা মনে হতো,,তবুও অনেক কষ্টে ছিলাম,
কারন আমি গ্রাজুয়েশন শেষ না করা পর্যন্ত তোমার সাথে বিয়ে দিতো না বাবা।
:-কালকে আসলে না কেন?
:-কালকেই আসতাম কিন্তু একটা ঝামেলার জন্য দেরি হয়ে গেছে,,আমি এসেই আগে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।।
:-সত্যি আজকে আমার বন্ধুদের কে কান ধরে বলতে ইচ্ছে করছে দেখ আমার ভালোবাসার ভিতরে কোনো ভুল ছিলো না।
:-হুমম,,,আর এখন থেকে আমিও তোমার থেকে দুরে থাকবো না আর।
তাহলে এখন দুরে কেন?
বলেই সুমিকে কাছে টেনে নিলাম,,
বুকের ভিতরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম,,,
:-অনেক ভালোবাসি তোমাকে।
:-হুম আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
অনেক লুকোচুরি সময় পার করার পর আবার ও ফিরে পেলাম আমার ভালোবাসা,,
আমার ভালোবাসার উপর সম্পুর্ন বিশ্বাস ছিলো একদিন সুমি ফিরে আসবে আর আমার ভালোবাসা আজকে স্বার্থক।।
তুমি আসবে বলে,,প্রতিনিয়ত এই অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো অবেলায়।।
বড় আপন করে পেলাম তোমায়………