ভার্সিটির লাইব্রেরী রুম।গুড়ি গুড়ি কথার আওয়াজ হচ্ছে চারপাশে।পরিমিত মাত্রায় এসি চলছে।তবু বেশ শীত শীত লাগছে রাহাতের।লাইব্রেরীগুলোতে আজকাল পড়ালেখার চেয়ে আড্ডা হয় বেশি।তবু কেউ কেউ পড়তে আসে।যেমন এসেছে মেয়েটি।রোজ পূর্ব দিকের কোনার সিটটাতে বসে ও।হাতের কাছে থাকে রাজ্যের বই।এই মেয়ের চোখে মুখে পড়ুয়া আঁতেলের কোন ছাপ নেই।
তবু মেয়েটা বেশ পড়ুয়া জানে রাহাত।গত তিন মাস ধরেই মেয়েটাকে লক্ষ্য করছে সে।ক্লাস শেষের পর ও লাইব্রেরীতে এসে বসে থাকে।মাঝে মধ্যে এক দুইটা বই নেয়।সেগুলো আর পড়া হয় না ওর।ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অগোচরে মেয়েটাকেই দেখে।ওকেই ভাবে।মেয়েটা চশমা পরে।এই মেয়ের পরার দরকার ছিল গোল চশমা।মাথার চুলগুলো থাকবে দুই বেণী করা।
তাহলে পড়ুয়া স্বভাবের সাথে মানাতো।তবু ব্যাংস করে কাটা চুল,ফুল ফ্রেমের চারকোনা চশমা সবই অদ্ভুত সুন্দর ভাবে মানিয়ে গেছে ওর সাথে।নোট তোলার সময় তিন রঙের কলম নিয়ে বসে মেয়েটা।একে দেখলেই পড়ালেখার একটা লিলুয়া ইচ্ছা জাগে রাহাতের।আপাতত মেয়েটার হাতে ডাইন্যামিক সার্কিট নেটওয়ার্কিং এর একটা বই।তার মানে আর কিছুক্ষণ বাদেই চলে যাবে মেয়েটা।
বিষয়টাতে ওর খুব আগ্রহ আছে বোধহয়।প্রতিদিনই যাওয়ার আগে মিনিট বিশেক এই বিষয়ের বই পড়ে ও।ঘড়ির কাটা এত দ্রুত চলে কেন!ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রাহাত।তবু ও জানে ওর করার কিছু নেই।এসব মেয়েদের ভালো বন্ধু হওয়া যায়,নোট শেয়ার করা যায়।কিন্তু প্রেমের প্রস্তাব দেয়া যায় না।
পড়ুয়া মেয়েদের সম্পর্কে প্রথম ধারণা হয় ক্লাস নাইন এ থাকতে।রাহাতের বন্ধু ইমন পছন্দ করত স্কুলের সেকেন্ড গার্ল কে।কিন্তু বলার সাহস করতে পারত না।শেষমেষ রাহাতের কাঁধে দেয়া হয় কথা বলার দায়িত্বটা।সেদিন ছিল ফিজিক্স পরীক্ষা।জঘন্য রকমের একটা পরীক্ষা শেষে ও আর ইমন অপেক্ষা করছিল মেয়েটার জন্য।নিতুকে আসতে দেখে এগিয়ে যায় রাহাত।
-এক্সকিউজ মি -আমাকে বলছেন? -জী।তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাচ্ছি। -কি কথা বলবেন তা তো জানিই।পরীক্ষার সময় এসব চিন্তা ভাবনার সময় পান কোত্থেকে?আজকের প্রশ্নটা কি কঠিন হয়েছে দেখেছেন?সেসব দেখবেন কেন।সেসব দেখলে তো এরকম আজাইরা কাজ করতে পারবেনা না।কি বলার আছে বলেন দেখি।
এত গুলো কথা শুনে আর বলার কিছু পায়না রাহাত।চলে যাবার সময় মেয়েটা আবার ডেকে বলে,”খুব তো খুশি মনে এসেছিলেন কথা বলতে।ফিজিক্সে কত পেলেন খাতা পাওয়ার পর জানাতে আইসেন।”
সেবারের পরীক্ষায় রাহাত পায় ৪৩।এই নাম্বার নিয়ে কোন মেয়ের সামনাসামনি হওয়া যায় না।এর পরের বছর অবশ্য ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে পুরস্কার পায় রাহাত।তবু ভালোর উপর খারাপ ধারণা যতটা সহজে স্থান পায় খারাপ ধারণা মুছে ভালোর জায়গা ততো সহজে হয়না।
লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে নিচে দাঁড়াল রাহাত।এই মুহূর্তটায় নিজেকে খুব অসহায় লাগে রাহাতের।প্রেম ব্যাপারটা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।একটা প্রক্রিয়ার মাঝে দিয়ে তা ভালোবাসায় রূপ নেয়।রাহাত জানে সে এখন সেই প্রক্রিয়ার মাঝে দিয়েই যাচ্ছে।নিজেকে খুব করে আটকানোর চেষ্টা করে রাহাত।নিজের অনুভূতিগুলোতে বাঁধ দিয়ে রাখার এক ব্যর্থ চেষ্টা।মধ্যবিত্ত সাধারণ ছেলেগুলোর জীবনে প্রেম ভালোবাসার মত অসহায়ত্বের বিষয় আর নাই।
এদের কাউকে ভালো লাগতে নেই,কারো ভালো লাগার কারণ ও হতে নেই।সব ক্ষেত্রেই বুকে বিঁধে থাকা কাঁটার মত চিন চিনে ব্যথাটা নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়।অনুভূতিগুলোকে পাশ কাটিয়ে,না দেখার ভণিতা করে।
ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে।এ বৃষ্টি কখন থামবে কে জানে।সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।ক্ষণিক বাদেই নিচে নেমে এলো মেয়েটা।রাহাতের পাশে দাঁড়াতেই একধরনের ঘোরের মধ্যে চলে গেলো ও।প্রতিবারই এ ব্যাপারটা ঘটে ওর সাথে।নামের সাথে খুব কম মানুষের মিল থাকে।এ মেয়েটার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন।মেয়েটার নাম পুষ্পিতা।
মেয়েটা আশেপাশে থাকলেই একধরনের সুবাস পাওয়া যায়।চন্দ্রগ্রস্থ রাতে হাসনাহেনার তীব্র নেশা ধরানো সুবাস।এটা সত্যি নাকি মিথ্যা জানেনা রাহাত।আজ হঠাৎই ঘোরের মাঝে ধাক্কা খেয়ে উঠে মেয়েটির কথা শুনে
-আজকের ওয়েদারটা খুব সুন্দর না? -জী?আমাকে বলছেন? -আপনি ছাড়া কেউ আছে নাকি এখানে? -রাহাত অনুভব করছে হঠাৎ করেই হৃদস্পন্দনটা বেড়ে গেছে।তবু নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল তা অবশ্য ঠিক।হ্যাঁ খুব সুন্দর লাগছে ওয়েদারটা। -আপনার বৃষ্টি ভালো লাগে? -অতটা খারাপ ও লাগে না। -বৃষ্টিতে ভিজেছেন কখনো? -না। -ওমা!সেকি!বৃষ্টিতে ভিজেননি কখনো?ফুটবল খেলেননি কখনো বৃষ্টিতে? -না।খেলিনি।
-আচ্ছা আপনি এরকম গাব গাছ কেন?আমিই বক বক করছি। -আসলে কি বলব বুঝতে পারছিনা। -লাইব্রেরীতে যেয়ে যখন বসে থাকেন?কিংবা ক্যাম্পাসে যখন আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ান?তখন বলতে ইচ্ছা করে কিছু? -না মানে… -শুনুন আমি আপনার মত গাধা না।একটা মেয়ে ঠিক বুঝতে পারে তার চারপাশে কি হচ্ছে।তবু তাকে চুপ করে থাকতে হয়।সব বিষয় নিয়ে মাতামাতি করার স্বাধীনতা একটা মেয়েকে দেয়া হয়নি। -তুমি খুব গুছিয়ে কথা বল।
-তুমি?আপনি থেকে তুমি হয়ে গেলো? -ও সরি।কিছু মনে করবেন না। -সরি বলতে হবে না।সন্ধ্যা হয়ে গেছে প্রায়।বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই কোনো।আমার বাসায় যাওয়াটা বেশ দরকার এখন।দেরী হলে সমস্যায় পড়তে হবে।একটা রিক্সা ঠিক করে দিনতো। -এখানে তো রিক্সা নেই। -রিক্সা নেই তা আমিও দেখতে পাচ্ছি।সে জন্যই আপনাকে বলছি।
-আমি ছাতা আনিনি। -আপনাকে বৃষ্টিতে ভিজেই যেতে বলছি।যাবেন নাকি গাবগাছের মত দাঁড়িয়ে থাকবেন? -আচ্ছা যাচ্ছি।
বৃষ্টিতে ভিজেই মেয়েটাকে রিক্সা ঠিক করে দিলো রাহাত।অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে ওর মাঝে।রিক্সা চলতে শুরু করেছে।রিক্সার চাকার গতিতে পিচঢালা পথে বৃষ্টির পানি ছিটকে পড়ছে।রাহাত তাকিয়ে আছে সেদিকে।একটু যেতেই রিক্সা থামিয়ে পেছন ফিরে তাকালো মেয়েটা।”আর বৃষ্টিতে ভিজে কাজ নেই
চলে আসুন।আপনাকে সামনে নামিয়ে দিব।”রাহাত সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।খুব অল্প একটু দূরত্ব।তবু সে চায়না পথটা শেষ হয়ে যাক।অনুভবের মাঝে এ ভালোলাগা নিয়ে অনন্তকাল চলতে চায় সে।মেয়েটার মুখেও এক স্মিত হাসি।এই হাসির অনুভূতি বড়ই আনন্দের।
বৃষ্টির আগে আকাশে মেঘ জমে।ভালোবাসার ক্ষেত্রে জমে অনুভূতি।সে অনুভূতি খেলা করে অনুভবের মাঝে।মুখে প্রকাশ না পেলেও অনুভবের মাঝে সে বেড়ে চলে।বেড়ে চলে অপেক্ষার কোনো পথচলা হয়ে,আনন্দের কোনো স্মিত হাসি হয়ে।