শহরের সবচেয়ে বেশি পরিচিত ফারুকি পার্ক (অবকাশ) এর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় অবস্থান আমার। এই পার্কে সচারাচর বেশির ভাগ কাপলদেরই দেখা যায়। সারা দিনের ব্যস্ততা শেষ করে আপন মানুষের সাথে একটু সময় কাটানোর জন্য বিকেল বেলায় এই পার্কে অনেক লোকের অাগমন হয়। ঠিক তেমনি কোনো একজনের জন্য আমারও আগমন এই পার্কে। হ্যাঁ, আজকে খাদিজা আসার কথা। সকাল বেলা যখন উপন্যাস ‘শেষ চিঠি’ নিয়ে একটু লেখার চেষ্টা করতেছি, ঠিক তখন খাদিজার ছোট একটা বার্তা, ‘বিকেলে অবকাশে থাকবে’ তার ফলেই আজকে আমার অবকাশে আসা। সবসময় না আসলেও মাঝে মাঝে আসি। তাও আবার খাদিজার সাথে।
প্রায় বিকাল পাঁচটা বেজে গেছে। এখনো খাদিজা আসার কোনো প্রতিফলন দেখতেছি না। হাতে সময় পেলেই খাতা- কলম নিয়ে লেখালেখির চেষ্টা করি। ঠিক আজকেও পকেট থেকে কলম আর একটা পেপার নিয়ে লেখার চেষ্টা করতেছি। এমন সময় কোনো এক আগুন্তক মেয়ের কণ্ঠ শুনতে পেলাম। মেয়েটি বলল, ‘আপনি জুবায়ের ভাইয়া না?’ আমি নিচ থেকে ওপরের দিকে মাথা ওঠিয়ে দৃষ্টি দিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিলাম। মেয়েটি আবারও আমার মুখে প্রশ্ন ছুড়ে মেরল, ‘আপনার পুরো নাম আব্দুল্লাহ আল জুবায়ের জাফর’ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক উত্তর দেই।
মেয়েটি আবারও বলতে শুরু করল, ‘আপনি নিশ্চয় ভাবছেন আমি কে? আর কিভাবেই বা আপনাকে চিনি এবং আপনার নাম জানি?’ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিয়ে কাগজ কলমে লিখে দেখালাম, ‘তাহলে আপনি কে? পরিচয় দিলে খুশি হব’ মেয়েটি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এক নাগাড়ে বলতে শুরু করল, ‘ভাইয়া আমি আপনার একজন ফ্যান, আমার নাম শিমলা, ঐ যে আপনি যে একটা গল্প লিখেছেন খাদিজা আপু নাম, আপনি কথা বলতে পারেন না, ঐযে ঐটা, আপনাকে কেউভালোবাসে না, কেবল খাদিজা আপুই ভালোবাসে। আপনার সব গল্প আমার পড়া, তবে এই গল্পটা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে।আর আপনার সাথে এভাবে দেখা হবে কখনো কল্পনা করি নাই।
আমি আপনার গল্পে কমেন্ট করেছিলাম, কখনো কি খাদিজা আপুকে দেখার সুযোগ হবে? আপনি বলেছিলেন, আশা থাকলে হবে। তাহলে আজকে কি সেই খাদিজা আপুকে দেখতে পারব?’ মেয়েটি বলা শেষ করে জুরে জুরে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কাগজ কলমে লিখে দেখালাম, ‘আজকে খাদিজা এখানে আসার কথা, যদি আসে তাহলে আপনি অবশ্যই তাকে দেখতে পারবেন’ মেয়েটি মুখে এক চিতলি হাসি দিয়ে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, ‘আমি ঐ পাশের চেয়ারটাতে আছি, খাদিজা আপু আসলে আমাকে হাত দিয়ে ইশারা দিবেন’ এই বলে মেয়েটি পাশের চেয়ারটিতে বসার জন্য চলে গেল।
শেষ বিকেলে দীপ্তময় সূর্যটা যখন ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পশ্চিম দিগন্তে লুকিয়ে যাওয়ার খেলাতে ব্যস্ত। সারা দিনের ক্লান্তি দূর করে সন্ধাকে ডেকে পারি জমাচ্ছে গন্তব্যে। সন্ধা হবে হবে এমন একটা ভাবমূর্তি, চারদিকে তাকালেই বুঝা যায়। পার্কের কাপল গুলোও যেন ছুটে যাচ্ছে তাদের নীড়ে। এমন পরিবেশে আমি এক অদম অপেক্ষায়ই মান খাদিজার জন্য। কখন আসার কথা ছিল, এখনো আসে নাই। চলে যাব নাকি আর কিছুক্ষণ থাকব দ্বিধাবোধ করছি। সকল দ্বিধা দূর করে খাদিজার আগমন ঘটল আমার পাশে। পাশে বসতেই আমি এক রাগি চেহারা নিয়ে তাকালাম খাদিজার সনে। খাদিজা বুঝতে পেরে সরি বলা শুরু করল। অবশেষে কান ধরে সরি বলল। আমি তখন করুন দৃষ্টি দিয়ে খাদিজার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
যে মেয়েটি আমার মতো একটা বোবা, কথা না বলতে পারা ছেলেকে ভালোবাসে। কখনো অজান্তে কোনো কষ্ট দেয় নি আমাকে। সবসময় শুধু নিজের ছাঁয়া দিয়ে আমাকে আগলে রেখেছে। নিজ থেকে আমাকে ভালোবাসতে এসেছে। অন্যের কথাকে তুচ্ছ করে দিয়ে আমাকেই ভালোবাসে। শেষ বিকেলে আমার কাধে মাথা রেখে সূর্যাস্ত দেখার বায়না ধরে। সে মেয়ের প্রতি আমি রাগ দেখাচ্ছি। না, আর রাগ দেখানো যাবে না। ঠোঁটের কোণায় এক আকাশ হাসি এনে খাদিজার দিকে তাকাতেই ঠান্ডা। ভালোবাসা কি আমি এই মেয়ের কাছ থেকে শিখতে পেরেছি। মেয়েটিও বড্ড বেশি ভালোবাসে আমাকে। আমিও মেয়েটিকে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি।
‘এই নাও এটা তোমার জন্য’ তাকিয়ে দেখি একটা ডায়েরী। খাদিজা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। মেয়েটি বলেছিল আমার জন্য একটা ডায়েরী কিনে রেখেছে। লেখা-লেখি করি বলে খাদিজার এই উপহার। খাদিজার কাজ দেখে মাঝে মাঝে আমি অনেক অবাক হয়। এই তো কয়েকদিন আগে, গত নভেম্বর মাসের ১৭ তারিখ। আমার জন্মদিন ছিল। আমাকে খাদিজা বলেছিল সন্ধার সময় যেন আমি দি ঝুমুরে আসি। দি ঝুমুরের কোণার এক রুমে যেতেই খাদিজা আমার সামনে কয়েকটি বেলুন উড়িয়ে বলতে লাগল, ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ ‘হ্যাপি বার্থডে প্রিয় জুবায়ের’ তারপর কেক কাটা ইত্যাদি সব কিছু আমার অজান্তেই খাদিজা নিজে করে নিল।
আমি খাদিজার এমন কাজ দেখে হতবম্ব। পরম সুখে চোখ থেকে দু এক ফোটা পানি ঝড়ে গেল। আজকের এই আধুনিক যুগে এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কার্য। কখনো এমন ভাবে কেউ কোনো দিন বার্থডে উইশ করেনি। সমাজের চোখে আমি একজন নিকৃষ্ট মানুষ। কথা না বলতে পারা একটি বোবা ছেলে। সমাজের বোঝা আমি। বন্ধুদের মাঝে বিরক্তকর ছেলে আমি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় ঘুমিয়ে যায় পরম আরামের ঘুমে। যে ঘুম আর ভাঙবে না। হবে না কোনো দিন সকাল। এক ঘুমে পারি দিব না ফেরার দেশে। ফেরা হবে না কখনো এই নঃস্বর পৃথিবীতে।
দুনিয়ার সকল মায়া ত্যাগ করে চলে যাব পরপারে। তা আর কখনো হয়ে ওঠে নি। কখনো কখনো তা করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু করতে পারি নি। কারণ আমি তো আর একা বোবা না। আমার মতো আরো হাজারো ছেলে-মেয়ে আছে যারা কথা বলতে পারে না। তারা কি বলবে? কি ভাববে তারা? আমি যদি চলে যায় তারাও তো আমার মতো এমন বোকামি কাজ করবে। তারাও তো চায় সমাজের মানুষের সাথে চলতে, ঘুরতে। চায় বাঁচতে। তাছাড়া তো, ওপর ওলা আমাকে শুধু কথা বলার শক্তি দেই নাই। অন্য সব অঙ্গ-প্রতঙ্গ তো ঠিকিই দিছে। আলহামদুলিল্লাহ, তার জন্য ওপর ওলার কাছে লাখ লাখ কোটি শুকরিয়া। সমাজের মাঝে অনেকে আছে যাদের একটা হাত নেই কিংবা একটা পা নেই। অনেকের তো দুটি চোখ নেই। তারা কিভাবে বেঁচে আছে এই স্বার্থহীন ধরণীতে।
আমি তো তাদের চেয়েও অনেক ভালো অবস্থাই আছি। শুধু কথা বলতে পারি না। এসব ভেবে কখনো আর মরে যাওয়ার চিন্তা করি নি। বেঁচে থাকতে হবে আমাকে। সমাজের সবার মাঝে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে চাই আমি। দুজনে পাশাপাশি বসে আছি। একে অপরের হাতে হাত রেখে সময় গুনছি। কিছুক্ষন বাদেই বিদায় নিব। পাশের চেয়ারে বসা থাকা ঐ মেয়েটিকে হাতের ইশারায় কাছে আসার জন্য বললাম। মেয়েটি হয়তো এতক্ষন এদিকে লক্ষ করে নি। যদি লক্ষ করতো তাহলে অনেক আগেই আমাদের কাছে চলে আসত। মেয়েটি কাছে আসতেই কাগজ কলমে লিখে দেখালাম, ‘এই যে খাদিজা দেখে নেন’ আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে বসে গেল খাদিজার পাশে।
অনেক কথা বলার পর এক পর্যায়ে আমাকে বলল, ‘ভাইয়া একটা কথা রাখবেন?’ কাগজ কলমে লিখে দেখালাম, ‘রাখার মতো হলে অবশ্যই রাখব’ মেয়েটি বলল, ‘ভাইয়া আমি আপনার একজনফ্যান, আপনার সব গল্প গুলো আমি মনোযোগ দিয়ে পড়ি। আপনাকে বলেছিলাম সেই খাদিজা আপুকে দেখার কি সুযোগ হবে। ভাগ্যক্রমে আজ দেখাও হয়ে গেল। একটু কি সময় হবে কফি খাওয়ার’ মৃদু হাসি হেসে খাদিজার দিকে তাকিয়ে কাগজ কলমে লিখলাম, ‘হ্যাঁ হবে, তবে বিল কিন্তু আমি দিব’ মেয়েটি অর্থাৎ শিমলা অনেক জুড়াজুড়ি করল বিল দেওয়ার জন্য। আমার একটাই বাক্য বিলটা আমি দিব, তাহলে কফি খেতে পারি।
মেয়েটি শেষ পর্যায়ে রাজি হলো। কফি খাওয়া শেষ করে বিল দিয়ে খাদিজা কে নিয়ে যখন চলে আসব, তখন মেয়েটি বলল, জুবায়ের ভাইয়া আর কি আমাদের দেখে হবে না’ কাগজ কলমে লিখে দেখালাম, ‘প্রাণের এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে হয়তো কোনো একদিন, কোনো এক সময়, কোনো এক মুহুর্তে, কোনো এক রাস্তায় দেখা হতেও পারে’ মেয়েটি বলল, ‘যদি আবার দেখা হয় তখন বিলটা কিন্তু আমি দিব’ কাগজ কলমে লিখে দেখালাম, ‘যদি কখনো দেখা হয় তখন না হয় দিয়েন, আচ্ছা আসি ভালো থাকবেন, খোদা হাফেজ’ মেয়েটি বলল, ‘আপনিও ভালো থাকবেন সাথে খাদিজা আপুকেও ভালো রাখবেন খোদা হাফেজ’ পার্ক জনমানবহীন।
মানুষের আনাগুনা নেই বললেই চলে। শহরের সকল মানুষ ছুটে চলছে যার যার গন্তব্যে। কর্মরত মানুষ গুলোকে আবার সেই ভোর বেলা ঘুম থেকে ওঠেই বেরিয়ে পড়তে হবে কাজের সন্ধানে। তাই তো এমন বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে চলা। আমার আর খাদিজার উদ্দেশ্য ফ্লাইওভারে। কোনো একদিন খাদিজা কে বলেছিলাম রাতের নিয়ন অালোতে এই শহরের ফ্লাইওভারে হাঁটব। অনেক ইচ্ছে ছিল বন্ধুদের সাথে আসার। কিন্তু বন্ধুরা আমাকে অবজ্ঞা করে নিয়ে আসি নি। তাদের মাঝে আমাকে বড্ড বেমানান। কথা না বলতে পারা আমি ছেলেটার সাথে চলতে অনেকেই দ্বিধাবোধ করে। কিন্তু খাদিজা সবার থেকে ভিন্ন রকম। আমার সব আশা পূরণ করতে খাদিজা সবসময় প্রস্তুত। তাই তো আজ আমি আর খাদিজা ফ্লাইওভারে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের স্বপ্নের এই ফ্লাইওভার। সুন্দর এক ফ্লাইওভার। আর এটার মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরকে যেন আরো সুন্দর করে তুলেছে। সেই ফ্লাইওভারে আজ আমরা। রাতের নিয়ন আলোর মাঝে হাঁটছি। খাদিজাকে কাগজ কলমে লিখে দেখালাম, ‘নিজেকে খুঁজে পাওয়ার অপেক্ষায় বারবার তাকিয়ে দেখি আয়নায় এই আমি তো সেই আমি নই। এই আমি কে?
সময় যায়, দিন পেরিয়ে ক্লান্ত সূর্যও ঘুমুতে যায়, শুধু আমি বসে রই প্রতীক্ষার প্রহর গুনে সময় ফুরায়, ধীর অবক্ষেপে মেয়াদ শেষ হলো বলে। আর তো মাত্র ক’টা দিন বাকি তারপর আমিও একদিন দেখে রেখো, ঠিকই দেব ফাঁকি। বলোনা তখন আমি স্বার্থপর, তোমাকে নিয়েই বাধিয়াছি আমার ঘর, তোমারই আমার কারীব, তোমাতেই মিশে আমি, এ জগত সংসারে এর চেয়ে বেশি কিছু নেই দামি, ভালোবাসি তোমাকে উজাড় করে, ভালোবাসা আমার খাদিজা তোমার তরে।’ পরক্ষনেই খাদিজা আমার বাহুডোরে মাথা রাখল। মেয়েটির চোখ জোড়া ভিজা মনে হচ্ছে। এটা সুখের কান্না, পরম সুখের কান্না। যা কখনো টাকা দিয়ে ক্রয় করা যায় না। ভালোবাসা দিয়ে জয় করে নিতে হয়। যা।সবার ভাগ্যে জুটে না। আমি অনেক ভাগ্যবান যে, খাদিজার মতো একজন সঙ্গিনি পেয়েছি।
মেয়েটিকে কখনো হারাতে চাই না। কাছে পেতে চাই, সারা জীবনের জন্য। শীতের রাতে কোয়াশা পড়েছে বেশ। একটু বেশিই ঠান্ডা অনুভবকরছি। চারদিকে ঘন কোয়াশা, আলোয় আলোয় আলোকিত রাতের এই শহর। আমি আর খাদিজা হাঁটছি ফ্লাইওভারের নিয়নের আলোর নিচে। দুজন পাশাপাশি। এভাবেই যেন একে অপরের সুখ- দুঃখে, আনন্দ-বেদনায়, হাসি-কান্নায় পাশাপাশি থেকে বাকি জীবন বেঁচে থাকতে পারি সেই প্রত্যাশায় প্রত্যাশিত।