নীল ও রিজিয়া

নীল ও রিজিয়া

নিল আর রিজিয়া দুজনেই ভালো বন্ধু । সেই ছোটবেলা থেকে ওদের বন্ধুত্ব। এক গ্রামেই ওদের বাসা ।নীলের বাবা মারা গেছে যখন নীল খুব ছোট ছিল। তাই মায়ের কাছেই মানুষ ।খুব কষ্টের সংসার ওদের । মা দু-চারটে বাড়িতে কাজ করে সংসার চালায় নীল পড়াশোনাতে ভালো ।কিন্তু নুন আনতে পান্তা ফুরায় যাদের তাদের কাছে পড়াশুনাটা কিছুটা বিলাসিতার মত ।ওর প্রতিভা দেখে স্কুলের শিক্ষকরা অনেক সাহায্য করে ওর পড়াশোনার জন্য।

আর ওদিকে রিজিয়া রাজার ঘরে রাজকন্যা ওর বাবার realestate business আছে ।খুব বড়লোক এলাকায় খুব নাম ডাক ।রিজিয়া না চাইতে সবকিছু পেয়ে যায়। বন্ধুত্ব সাধারণত দেখা যায় সমানে সমান’ হয় কিন্তু এদের ক্ষেত্রে ধনী দরিদ্রতা বন্ধুত্বের মাঝে দেওয়াল হতে পারেনি । রিজিয়ার বাবার কিন্তু নীলের সঙ্গে মেলামেশাটা একদমই পছন্দ নয়। অনেক বারন করেছে কিন্তু রিজিয়া কোন কথা শোনে না ।আর একমাত্র মেয়ে তাই জোর করে কিছু বলতেও পারেনা। নীলের মা ও নীলকে বোঝায়

-দেখ বাবা ওরা অনেক বড়লোক ওদের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব মানায় না …!

কিন্তু নীল এসব কথা শুনতে চায় না। ও যে একদিন রেজিয়া না দেখলে থাকতে পারে না ।ওর সাথে কথা বলতে ,সময় কাটাতে খুব ভালো লাগে। আর মনের মতো একটা বন্ধুও। স্কুলে বন্ধু তেমন কেউ নেই বন্ধু বলতে রিজিয়া ।জানিনা গরীব বলেই হয়ত কেউ বন্ধুত্ব করতে চায় না । দেখতে দেখতে বন্ধুত্বটা যে কখন ভালবাসায় পরিনত হয় সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না ।কেউ কাউকে একদিন না দেখে থাকতে পারেনা । দুজনে দুজনকে ভালোবাসে কিন্তু কেউ কখনো বলতে পারে না।

নীলের মায়ের শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে ।আর লোকের বাড়িতে কাজ করতে যেতে পারে না সেরকম। তাই ওর মা কে ছাড়িয়ে অন্য কাজের লোক রেখেছে। একটা বাড়িতে কাজ করে কোনো রকমে সংসার চলে। কষ্টের সংসারে অভাবটা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে দিনে দিনে। নীল ঠিক করেছে আর পড়াশোনা নয় এরপর একটা কাজের যোগাড় করতে হবে। মায়ের দুঃখ যে দেখতে পারেনা ।মাধ্যমিকের পরীক্ষা শেষ হলেই শহরে চলে যাবে কাজের খোঁজে ।

আজ মাধ্যমিকের শেষ পরীক্ষা। নীলের জীবনে হয়ত এটাই স্কুল জীবনের শেষ ।আর হয়তো কখনো স্কুল যাওয়া হবে না ।আজ রিজিয়ার সাথে কাটানো সময়গুলোর কথা মনে পড়ছে খুব ।আর ওর সাথে প্রতিদিন দেখা হবেনা …ভেবেই ওর চোখ ছলছল করে ওঠে ।দুফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পরে শুকনো মাটিতে। কেউ দেখতে পায়না ।শুকনো মাটি শুষে নেয় তৎক্ষণাৎ ।রিজিয়া কে মনের কথাটা অনেকবার বলতে চেয়েছে ।কিন্তু কখনোই বলতে পারেনি । ও জানে এ সম্পর্ক কখনোই মেনে নেবে না রিজিয়ার বাবা ।কারণ ওরা অনেক বড়লোক ওদের সাথে কি আর মানায়।
আর রাজ প্রসাদে থাকা মেয়েটাকে কুঁড়েঘরে এনে রাখবেই বা কোথায়? তার চাইতেও বড় কথা নীল হিন্দু আর রিজিয়া মুসলিম এ সমাজ কোনোদিনও মেনে নেবে না ওদের সম্পর্ক?? কিন্তু ভালোবাসা কি ধর্ম জাতপাত ধনী-দরিদ্র দেখে হয় ?????

আজ নীল ঠিক করেছে মনের কথাটা আজ বলে দিবে রিজিয়া কে। তাই পরীক্ষার শেষে রিজিয়া কে দেখা করতে বলে স্কুলের বকুল গাছের তলায়। পরীক্ষার শেষে নীল বেরিয়ে আসে বকুল গাছটার দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে । নীলের বুকের ধুকপুকানি টা বেড়ে গেছে । পা যেন কিছুতেই এগোতে চায় না কি বলবে রেজিয়াকে ????বলার পর যদি রিজিয়া না করে দেয় ?????তাহলে কি করবে??? বন্ধুত্বটা রাখবে তো???? যদি হ্যাঁ করে তাহলে কি পারবে ওকে বিয়ে করতে ?????মাথায় ঘুরতে থাকে হাজারটা চিন্তা…

ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় বকুল গাছটার দিকে । দেখে রিজিয়া আগের থেকেই বসে আছে বকুল গাছের তলাতে ।তারেই অপেক্ষায় । নীল গিয়ে বসে রিজিয়ার কাছে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে ।ওর মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না। রিজিয়া বুঝতে পারে নীল কেন ওকে ডেকেছে এখানে রিজিয়াও চুপ করে আছে।যার সাথে প্রতিদিন এত কথা বলে তার পাশে এসে আজ কোন কথা বের হচ্ছে না। দুজনই চুপ করে আছে আজ ।অনেক কষ্টে নীল রিজিয়ার হাতদুটো ধরে বলে

– সারাজীবন তুই আমার সাথে থাকতে পারবি রিজিয়া???? রিজিয়া চুপ করে থাকে কিচ্ছু বলে না ।ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

– আমি তোকে খুব ভালোবাসি রে রিজিয়া বলে

-আমিও তোকে খুব ভালোবাসি সারাজীবন পারবি এভাবে আমার হাত ধরে থাকতে ।কখনো ছেড়ে যাবি না তো ???
নীল শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে মরণের আগেও আছি তোর পাশে মরনের ওপারেও তোর পাশেই থাকবো।
এই বকুল গাছটাকে সাক্ষী রাখলাম আজ এখানেই আমাদের দুজনের আত্মার বিয়ে হল ।পৃথিবীর কোন শক্তি আমাদের কখনো আলাদা করতে পারবে না । দুজনে দুজনার কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ হয় কিন্তু জানেনা ওরা ওদের সামনের পথে কতটা কাঁটা বিছানো আছে।

পরীক্ষা শেষ হয় নিল ওর মাকে বলে শহরে যাওয়ার কথা কিন্তু একমাত্র ছেলেকে ছাড়তে চায়না ওই যে একমাত্র সম্বল এখন নীল কোন কথা শোনে না বেরিয়ে যায় শহরের উদ্দেশ্যে একটা কাজের খোঁজে বাড়িতে মাকে একা রেখে অচেনা অজানা জায়গায় গিয়ে কি করবে কিছুই জানেনা তবুও বেরিয়ে যায় ওকে যেতেই হবে কিছু একটা করতেই হবে

রিজিয়া অনেক বারন করেছিল কিন্তু নিল ওকে বোঝায় শেষপর্যন্ত নীলের জিদের কাছে হার মানতে হয় রেজিয়াকে আসার সময় রেজিয়ার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল কিন্তু হয়ে ওঠেনি ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছিল রিজিয়ার কথা খুব মনে পড়ছিল না দেখা করেই চলে আসে অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা ফ্যাক্টরিতে কাজ খুঁজে পায় মাইনে কম কাজ বেশি নীলের খুব কষ্ট হয় কিন্তু মায়ের কথা মনে করে সব কষ্ট সহ্য করে নেয়

সময় কাটতে থাকে নীল প্রতিমাসে একবার বাড়ি আসে দুই চার দিন থেকে আবার চলে যায় যখন বাড়িতে আসে তখন খুব আনন্দেই কাটায় এখন আর ওর মাকে লোকের বাড়িতে কাজ করতে দেয় না রিজিয়ার সাথে কাটানো সময়গুলো যেন খুব তাড়াতাড়ি চলে যায় সময়টা ওর কাছে খুব অল্প মনে হয় পরীক্ষার result বার হয় নীল ও রিজিয়া দুজনেই খুব ভালো নাম্বার পেয়ে পাস করে কিন্তু নীলের আর স্কুলে ভর্তি হওয়া হয় না রেজিয়া কে ওর বাবা শহরে স্কুলে ভর্তি করতে চায় কিন্তু রেজিয়া গ্রাম ছেড়ে যেতে চায় না বাধ্য হয়ে ওর বাবা ওই স্কুলে আবার ভর্তি করে

ওদের সম্পর্কের কথা গ্রামের সকলে জানতে পারে ভালোবাসা কি আর গোপন থাকে ধীরে ধীরে কথাটা রিজিয়ার বাবার কান পর্যন্ত যায় জিয়ার বাবা নীলকে দেখে সাবধান করে দেয় জেনারেল জিয়ার সাথে কোন সম্পর্ক সম্পর্ক না রাখে এবং হুমকি দেয় গ্রামের ছেলে বলেই ছেড়ে দিচ্ছে অন্য কেউ হলে এর ফল খুব খারাপ হতো যদি আর কখনো ওদের একসাথে দেখে তাহলে কিন্তু ভুলে যাবে যে ও গ্রামেরই ছেলে কিন্তু নীল রেজিয়াকে ছাড়তে পারেনা নীল কাজে চলে যায় রিজিয়ার বাবা রেজিয়ার বিয়ে ঠিক করে ওর কোন মতামত ছাড়াই তাও ওর দ্বিগুণ বয়সের একটা ছেলের সঙ্গে

রিজিয়া কাঁদতে থাকে ওর বাবাকে বোঝায় ও এই বিয়ে করবে না কিন্তু বাড়ির কেউ ওর কথা শোনে না male খবর পেয়ে ছুটে আসে রিজিয়ার সঙ্গে দেখা করে রিজিয়া কানতে কানতে বলে আমি এই বিয়ে করতে পারবনা এই বিয়ের চেয়ে আমার মরণ ভালো নীল চুপ করে থাকে কিচ্ছু বলে না মনে মনে ভাবতে থাকে ছোট একটা কাজ করে আর ওই ভরসাতে কি করে বিয়ে করবে রিজিয়া কে চলনা আমরা দুজন পালিয়ে যায় কোথাও যেখানে আমাদের কেউ খুজে পাবে না কোথায় বা পালিয়ে যাবে জিনিয়ার বাবা ঠিক খুঁজে বার করবে পৃথিবীর যে প্রান্তে যাক ওরা নীলের আজ কিছু বলার ভাষা নেই গভীর সমুদ্রে ঢেউ মত দোদুল্যমান

তোমাকে খুব ভালবাসি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না নীল বলে আমিও যে তোমায় খুব ভালোবাসি কিন্তু কিছু করার নেই আমার অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করো একবার তুমি তোমার বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে নাও
ঠিক আছে কিছু বলব না আর আমার বিয়েতে এসো বলেছিলে না মরণের আগে অাছি আর পরেও থাকব মরণের আগে না থাকলেও আমার মরার সময় হলো থাকিস এই বিয়েতে আমার মৃত্যুর সমান কানতে কানতে রিজিয়া চলে যায় দূর থেকে ভরাক্রান্ত আকাশের মত দেখতে থাকে নীল দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এগিয়ে এল নীল আর ঘর থেকে বের হয়না কার সাথে ঠিকমত কথাও বলেনা বলেনা

নীল ঠিক করে রিজিয়া কে নিয়ে পালিয়ে যাবে ওর ভালোবাসাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে পারবেনা রিজিয়ার বোনের হাতে একটা চিঠি লিখে পাঠায় সেই পুরনো জায়গাটিতে আসার জন্য সবার অগোচরে পালিয়ে যাবে অন্য কোথাও দুজনে মিলে একটা সুন্দর ঘর বানাবে কিন্তু দুর্ভাগ্য চিঠিটা গিয়ে পড়ে রিজিয়ার বাবার হাতে

রিজিয়া জানতেও পারেনা কোন কিছু সন্ধ্যার সময় নীল অপেক্ষা করতে থাকে রিজিয়ার জন্য কিন্তু এত দেরি করছে কেন অন্ধকার ঘনিয়ে আসে রেজিয়া আসেনা আসে রিজিয়ার বাবার ভাড়া করা কতগুলো গুন্ডা নীল কে একা পেয়ে ঘিরে ধরে মারতে থাকে গভীর অন্ধকারে মিলিয়ে যায় নীলের আর্তচিৎকারমারতে মারতে মেরে ফেলে নীলকে ফেলে যায় ওর নিথর দেহটা রিজিয়ার দুটো চোখ অধীর অপেক্ষায় খুঁজতে থাকে নীলকে কিন্তু কোথাও খুঁজে পায়না বিয়ের সময় হয়ে এসেছে রিজিয়া রুমের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় হাতে তুলে নেয় বিসের পিসিটা কি করবে এই

জীবনটা রেখে বিয়ে করে সারাটা জীবন ধীরে ধীরে মরার থেকে একবারে মরে যাওয়ায় তো ভালো পুরো শিশিটা শেষ করে দেয় ধীরে ধীরে এলিয়ে পড়ে ওর প্রাণহীন দেহ টা বিছানার ওপর ওর বাবার সমস্ত জেদ কে হার মানিয়ে না নীলের কথাটা মিথ্যে হয়নি জীবনের আগে হয়তো ওরা সাথে থাকতে পারেনি কিন্তু মরনের ওপারে তো থাকতে পারবে একসাথে যেখানে থাকবে না রেজিয়ার বাবার মত ভালবাসার শত্রুরা..

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত