ভালোবাসার অপূর্ণতা

ভালোবাসার অপূর্ণতা

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই মন টা খুব ফ্রেশ লাগছে, লাগবেনা? আজ তো আমার লেডি গুন্ডির জন্মদিন!! ওহ্ লেডি গুন্ডি নাম টা তো আমি আদর করে রেখেছি, ওর আসল নাম রিমি। ভারি মিষ্টি মেয়ে। ওকে দেখে আমার যেন বেহেশতের হূর দেখা হয়ে গেছে!! ওর চোখের দিকে যতবারই তাকিয়েছি আমি যেন নীল সীমানার অতলে হারিয়ে গিয়েছি। বালিশের পাশ থেকে মোবাইল টা বের করে পাগলীটার ছবিতে দুইটা কিস করলাম! মজার ব্যপার কি জানেন?আজকের দিনেই আমাদের প্রথম দেখা হয়!

৩বছর আগে এই শহরে আমার আগমন। ভার্সিটি তে ভর্তি হইছিলাম জন্য আসতে হয়েছিল। কলেজে যাচ্ছি এমন সময় দেখি রাস্তায় একটা মেয়ে পথশিশু দের সাথে দৌড়াদৌড়ি করছে! মেয়েটা নিন্তান্তই অনেক সুন্দর। কাপড় চোপড় ও বেশ দামি। কিন্তু নিজেই নিজের মন কে জিজ্ঞেস করছি, ওকি তাড় ছিড়া নাকি?? যাই হোক আমার এগুলা দেখে লাভ নাই, এই শহরে আরো অনেক জিনিস দেখা বাকি আমার। এই ভেবে চলে যাবো, হঠাৎ কে যেন আমার শার্টের কলার ধরে টান দিল। পেছনে ঘুরতেই দেখি ওই মেয়েটাই! আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। বয়সে আমি বড় কিন্তু খুব ভয় পেয়ে গেলাম।

– নাম কি?
– জ্বি (ভয়ে ভয়ে)
– ওমা, তোমার নাম জ্বি? এই বলে বাচ্চাগুলো সহ দাঁত খেচিয়ে হাসতে লাগল। খুব অপমানিত বোধ করলাম।
– বাসা কৈ?
– জ্বি আমি এসেছি আজ ২ দিন হয়। ভার্সিটি যাবো দেরি হচ্ছে
– যাবে তো। কিন্তু নতুন এসেছো আর চাদা দিবেনা তা কি হয় নাকি? তাড়াতাড়ি হাজার টাকা ফেলো
– আমার কাছে হাজার টাকাই আছে, এটা দিয়ে সারা মাস চলতে হবে যে
– (সাথে সাথে চিৎকার করে উঠল) ওই রতন আমার কুড়ালটা নিয়ে আয় তো

এই কথা শুনে আমার কলিজা নড়ে উঠল! পকেট থেকে নোট টা বের করে দিলাম দৌড়। ওরা হাসতেছিল খুব জোড়ে জোড়ে, শুনতে পাচ্ছিলাম। কোন জায়গায় এলাম বাপু? দিন শুরুতেই ছিনতাই! তাও আবার মেয়ে ছিনতাইকারী! কিন্তু ভাবছি মাস টা পার করবো কিভাবে? আর তো টাকা নেই আমার কাছে। শহরে নতুন, কেউ তো ধার ও দিবে না। না খেয়েই থাকতে হবে! অবশ্য ভার্সিটির বন্ধু গুলা অনেক ভাল ছিল। খুব বন্ধুসুলভ। মেস এ আসলাম। কোন রকম এ কিছু খেয়ে বের হলাম টিউশনি খুঁজতে। রাস্তায় আবার ওই মেয়ের সাথে দেখা! ওর সাথে ভিলেন টাইপের ৫/৬ জন। বুঝতে বাকি নেই যে ও কোন মাস্তান টাইপের কেউ। কিন্তু এই বয়সেই!!

– ওই ‘জ্বি’!
– আমি?
– হ্যাঁ, এদিকে আসেন
– আমার নাম মেহেদি হাসান মাসুদ। জ্বি নয়
– ওমা, আজ কথা ফুটেছে তাহলে? বেশি কথা বললে ওই যে ওদের দাড়ায় পটেটো ফ্রাই বানাবো আপনাক
– দেখেন আমার কাছে সর্ব সাকুল্যে আর ৫০ টাকা আছে, এই নেন আর আমাকে যেতে দেন। কাজ আছে আমার!
– কি কাজ
– টিউশনি খুঁজতে যাবো
– কি নিয়া পড়তেছেন?
– গণিত। এই নেন টাকা। বাই

বলে চলে আসলাম। খুব বীর মনে হচ্ছে নিজেকে। আজ আমি বড় হয়ে গেছি তাইনা? লেডি গুন্ডির ভাব কমায় দিছি। কিন্তু আমি যে ফাঁকা হয়ে গেলাম! যাই হোক ২টা প্রাইভেট পেয়েও গেলাম! কাল থেকে পড়াবো। সকালে ঘুম থেকে উঠতেই দেখি বাইরে অনেক লোক। রুম থেকে বের হতেই একজন এসে বলছে, আমাদের মেয়র ইনি, সালাম দেও, তোমার সাথে কথা বলতে এসেছে আমি সালাম দিলাম, উনি জবাব দিলেন

– কি করো বাবা তুমি?
– আমি গণিত বিভাগে পড়ছি, প্রথম বর্ষ
– আমার মেয়ে টা গণিতে একদম কাচা, ওকে পড়াবা?
– জ্বি স্যার অবশ্যই!

তারপর অনেক কথা হলো! প্রতিদিন ওদের গাড়ি এসে আমায় নিয়ে যাবে আবার রেখে যাবে! এত্ত সম্মান আমি কখনোই পাইনি! যাই হোক পরদিন গেলাম পড়াতে, গিয়ে তো আমি অবাক, এ তো সেই মেয়ে, যে ২দিন আমায় ছিনতাই করে!! পরে বুঝলাম যে আমি এখন ওই মেয়ে টার এ স্যার! মনে মনে ভাবছি এ কোন জায়গায় এসে ফেসে গেলাম! পরে মেয়েটি আমায় সব বুঝিয়ে বলল।। ওর পথ শিশু দের সাথে খেলতে খুব ভালো লাগে । মাঝে মাঝে হঠাৎ ইচ্ছা করলে ও রাস্তায় ছিনতাই করতে যায়! এটা নাকি ওর শখ!! পরে ওর আব্বু লোক পাঠায়ে সব টাকা দিয়ে দেয়। মনে মনে ভাবছিলাম এ ক্যামন শখ!! অত কিছু জেনে লাভ নেই, পড়াতে আসছি পড়াতে হবে ।।

কথা গুলো মনে পড়ছে আর খুব হাসি পাচ্ছে আমার। যাই হোক তারাতারি বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করলাম। তারপর জান পাখির জন্য কয়েকটা গিফট কিনলাম! ওর আজ জন্মদিন জন্য মসজিদে দোআ’র ব্যাবস্থাও করেছি। তাই তাড়াতাড়ি গিফট কিনে বাসায় এসে গোসল করে মসজিদে গেলাম। নামাজ শেষে হুজুর মিলাদ পড়ায় দিয়ে দোআ করলেন। সবাইকে তবারক দিয়ে বাসায় আসতেছি। আশ্চর্য পাগলিটার কথা আজ যেন মাথা থেকে নামছেই না! খুব খিদে লেগেছে, খাবারের কথা ভাবতেই একটা কথা মনে পড়ে গেল, একদিন আমি না খেয়ে পড়াতে গিয়েছিলাম। খুব খিদে লেগেছিল। রিমি বুঝতে পরেছিল।। আর এক টিৎকার দিতেই দেখলাম আমার সামনে ৭/৮ রকমের খাবার হাজির! কিছু কিছু খাবার আমি কখনোই দেখিনি। ও হাত এ একটা লাঠি নিয়ে বলতেছে,

– ৫ মিনিটে সব শেষ না হলে ওই মোটু গুলোরে ডাকবো কিন্তু

সেদিন কিন্তু আমি ভয় করে খাইনি।খুব খিদে লেগেছিল তাই গাপুস গুপুস খেয়ে নেই হাহাহাহা এভাবে বেশ কয়েকদিন যেতে থাকে। কেন জানি ওর প্রতি আমার চাহিদা অনেক বেড়ে যেতে লাগল। ওর সাথে দেখা বা কথা না হলে থাকতে পারতাম না। এক সময় মনে হয় যে আমার আর ওর অবস্থার কথা। তাই আর কিছু ভাবিনি এই ব্যপারে। এভাবে বেশ কিছুদিন পর যেদিন আমি পড়াতে গেলাম, ও এসে আমাকে বলতেছে……

– একটা কথা বলবো?
– বলো,
– ভালবাসি
– কাকে?
– তোমাকে
– কি!! না এটা সম্ভব নয়
– কেন সম্ভব নয়?
– কোথায় তোমার অবস্থা আর কোথায় আমি, আর এটা ভালে লাগা, ভালবাসা না
– আমি কোন অবস্থার কথা জানতে চাইনা। তোমাকে না দেখলে আমার ঘুম হয় না,

খেতে পারিনা এটা কি ভালবাসা নয়? বই, খাতা দেয়ার ছল করে আলতো করে তোমার হাত ছুঁয়ে দেই এটা কি ভালবাসা নয়? তোমার সাথে সারাজীবন ঐ ছোট্ট ঘরে থাকতেও রাজি, এটা কি ভালবাসা নয়? তোমার জন্য এই প্রাসাদে থেকেও আমি রান্না শিখছি এটা কি ভালবাসা নয়? আমি আমার কথা বলে দিয়েছি। সত্য করে বলো তো তুমি আমাকে ভালবাসো না?

– আসলে এটা একটা অবাস্তব সম্পর্ক রিমি। আমরা কখনো এক হতে পারবো না
– যা আমি চাই তা কিভাবে আদায় করে নিতে হয় আমি জানি। বলো ভালবাসো কি না? যদি না বাসো তাহলে ওই মোটু দের ডাকবো কিন্তু

– আমি তোমাকে যদি হ্যাঁ ও বলি তোমার আব্বু তখন ওই মোটু গুলারে ডেকে আমাকে চিকেন তন্দুরি বানাবে
– সেটা পরের ব্যাপার। তখন তোমাকে বাঁচানোর জন্য আমি আছি। কিন্তু এখন?
– জোর করে ভালবাসা আদায়?
– হুমমমম, জানো না, আমি তোমার লেডি গুন্ডি?

কথা টা শুনেই হেসে ফেলি, আর ও এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আর বলে আমার বুকে একটু জায়গা দিতে! যাক গুন্ডি টার কথা ভাবতে ভাবতে খাওয়া শেষ করলাম। রেডি হয়ে গিফট গুলো নিয়ে সোজা ওদের বাসায় যাওয়ার জন্য বের হলাম। হঠাৎ রিকশায় চরতেই মনে পড়ে গেল গতবছর ওর জন্মদিনের কথা! আমার প্রাণপ্রিয় মানুষটার জন্মদিন বলে কথা! ওর জন্মদিনে স্পেশাল কিছু গিফট করতে চেয়েছিলাম। তাইতো গত ৪মাস ধরে টাকা জমিয়ে পরে বন্ধুর কাছে আরো কিছু টাকা ধার নিয়ে পাগলিটার জন্য একটা আংটি কিনে নেই!! আর ঠিক করেছিলাম সবার আগে ওকে উইশ করবো। আর তাই ওই গার্ড ভর্তি বাসায় চুপিচুপি চলে যাই। অনেক কষ্টে বিল্ডিংয়ের ছাদে উঠে যাই। অবশ্য পাশে বিশাল এক গাছ থাকার কারনে তা সম্ভব হয়। ১২ টা বাজার ঠিক ৫ মিনিট আগে ওকে মেসেজ দিয়ে ছাদে আসতে বলি। ও সাথে সাথে চলে আসে । এসে তো পুরাই অবাক!

– তু,,,,,,তুমি?
– হুম আমি!
– এত রাতে এখানে কেন?
– তোমাকে দেখতে এসেছি
– পাগল হইছো?
– হুম। আর ভালবাসায় পাগলামি না করলে কি হয় বলো?
– ঠং……

রিং টা বের করে হাঁটু গেড়ে রোমান্টিক ভাবে ওকে বলি “তুমি কি আমার লাইফের লেডি গুন্ডি হয়ে সারাজীবনের জন্য আমাকে ছিনতাই করে নিবে?” ও জবাব দিয়েছিল “হুম ” আর কিছুই বলেনি। ও অবাক হয়ে গিয়েছিল। এরকম কিছু হয়তো আশাই করে নাই। তবে ওর চোখের কোনায় পানি দেখেছিলাম। আমি জানি সেদিন ও কষ্ট পেয়ে কাঁদেনি। আংটি পরিয়ে দিয়ে যখন ওকে একটা গোলাপ দিয়ে উইস করলাম, পাগলি টা যেন কেঁদেই দিল। আর এমন জোড়ে জড়ায় ধরল যেন আমার বুকের হাড্ডি ভেঙে দিবে! কাঁদতে কাঁদতে বলতেছে

– প্লিজ, আমাকে ছেড়ে যাইও না কখনো। মরে যাবো আমি
– ছি, এসব বলতে হয়না!

এমন সময় কে যেন আসতেছিল। তাই তারাতারি গাছ দিয়ে নেমে চলে আসি!! খুব মনে পরছে সেই দিনগুলো ভাবতে ভাবতে চলেই আসলাম। মেয়র সাহেবের একমাত্র মেয়ের জন্মদিন, গিয়ে তো আমি অবাক,, কম করে হলেও ৩০০ জন দাওয়াতে এসেছে। সবাইকে আপ্যায়নের সময় আমিও একটু সাহায্য করলাম। সবাই চলে গেলে বিকালে আন্টি আংকেল আর আমি আমার গিফট গুলো নিয়ে রওনা দিলাম রিমির কাছে যাওয়ার জন্য।আমি আগে আগে আসলাম এসে দেখি রিমি শুয়ে ঘুমাচ্ছে। গিফট গুলো ওর পাশে রেখে দিয়ে বললাম “শুভ জন্মদিন” ওর পাশে একটু বসলাম।

ইচ্ছে করছিলো ওর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেই। কিন্তু তা সম্ভব নয়। এমন সময় রিমির আব্বু আম্মু এসে আমার পাশে বসে কাঁদতে শুরু করে কারন রিমি যে বাঁশের বেড়ায় ঘেরা এক বিছানায় চির নিদ্রায় আচ্ছাদিত হয়ে আছে। আর কখনো ওর ঘুম ভাঙবে না। আর কখনো আমার গুন্ডি আমাকে ছিনতাই করতে আসবে না।বা কেউ কখনো আর ভয় দেখাবে না মোটু গুলাকে দেখিয়ে। কেন এমন হলো? আমার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়ে কেন ও সারাজীবনের জন্য ঘুমাতে গেল? কি দোষ করেছিলাম আমি? আমার বুকে ও একটু জায়গা চেয়েছিল, আর সেই বুক খালি করে কেন গেল ও?কেন আমার সাথে এত বড় অন্যায় করা হলো? সেদিন আংটি পরে যখন ও নিচে নামতে ধরছিল ওর আম্মু আব্বু ওকে ডাকল।

– মা, এত রাতে ছাদে কেন গেছিলা?
– এমনি আব্বু
– ও, এই তোমার জন্মদিনের গিফট। শুভ জন্মদিন।

গিফট নিতে যাওয়ার সময় ওর হাতের আংটি টা ওর আব্বু আম্মু দেখে ফেলে! পরে ওকে নাকি জিজ্ঞেস করতেই ও সব সত্যিটা বলে দেয়! আর এ ও বলে আমাকে ছাড়া নাকি কাউকে বিয়ে করবে না। মরে গেলেও না! ওর আব্বু শুনেই তার চেলা গুলোকে বলে গাড়ি বের কর, আজ ২ টাকার ওই ছেলের মাথা দিয়ে ফুটবল খেলবো । এই কথা শুনে ও নাকি ওর আব্বুর পায়ে ধরছিলো যাতে কিছু না করে আমাকে, অনেক চেষ্টা করেছিল বোঝানোর কিন্তু ওর আব্বু চেলা গুলা সহ কিছু দেশি অস্ত্র নিয়ে আমাকে খুন করার জন্য বের হয়। কিন্তু উনি আমার কাছে আসে ঠিকই কিন্তু আমাকে মারতে নয়।

আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসে তার মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য। আর জন্মদিনের গিফট হিসেবে আমাকে নিয়ে যায় তার মেয়ের সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য। আর এই কথা বলে বের হয় রিমি কে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য!! কাজি সহ বাসায় গিয়ে দেখি,, আমার গুন্ডি গলায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে ঘরের এক কোনায়! হাতে তার বিষের বোতল। আর একটা কাগজে লিখা ” মাসুদ কে আমি অনেক ভালবাসি আব্বু। আমি যে ওকে ছাড়া একদম বাঁচতে পারবো না। ওকে যেখানে পাঠিয়ে দিলে আমিও চলে গেলাম। এখন সা হয় ওই পারে ওর বউ হয়ে থাকবো! আমায় ক্ষমা করে দিও”

ছোট্ট একটা ভুলের জন্য বা ওর একটু পাগলামীর জন্য আজ প্রতি তা সেকেন্ড পুড়তে হচ্ছে। ও তো মরে গিয়ে বেঁচেই গেল। কিন্তু আমি যেন বেঁচে থেকেও মরে আছি!!! পৃথিবীতে সবার ভালবাসা পূর্ণতা পায় না, তাদের মধ্যে হয়তো আমিও একজন। আঙ্কেল আন্টি খুব কান্নাকাটি করা শুরু করে দিল ওর কবরের পাশে। তাই ওদের নিয়ে বাসায় চলে আসলাম।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত