বাবাটা কেন যে এতো পাগলামো করছে কিছুই বুঝতেছি না। এতো দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে কেন! সাথে আম্মুটাও আছে। বড়রা এতো অল্পতেই কেন যে হতাশ হয়ে যায়। আমি তো সামান্য একটু কান্নাকাটি করছি। এ নিয়ে এতো দৌঁড়ঝাপের কী আছে! ড্রাইভার আঙ্কেলও দেখছি তাদের সঙ্গে সঙ্গে দৌঁড়াচ্ছে। আমি কি খুব বেশি অসুস্থ। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার বয়স তো সবে চার মাস! সবাই ভাবছেন আমি কি করে তাহলে চিন্তা করতে পারছি। বড়রা খুব বোকা হয়। তারা ভাবে ছোট বলে আমরা ভাবতে শিখিনি। আসলে ব্যাপারটা তা না। আমরা সবই দেখি, সবই বুঝি শুধু বলতে পারি না। আচ্ছা আমি কী আমার বাবাটাকে বাবা বলে ডাকব? নাকি বাপি বলব? ইংরেজি টাইপ নাম হলেও খারাপ না! একটা ভাব নেয়া যাবে! ড্যাডি বা পাপা হলে কেমন হয়? নাহ্ ঠিক আরাম পাচ্ছি না।
বাবাটাকে বাবা বলেই ডাকি, কেমন নিজের গা ঘেঁষা মনে হচ্ছে। আম্মুটাকে কী বলব? মা ডাকলে কেমন হবে কিংবা মম অথবা ম্যামি? না, আম্মু ডাকের মাঝে একটা আদুরে ভাব আছে। আম্মুটাকে আম্মুই বলি। আচ্ছা আমার হলো কী! আমি এতো কাঁদছি কেন? সেই সকালে দুধু খাবার পর থেকে আমি শুধু কাঁদছি তো কাঁদছি। থামার কোনো লক্ষণ দেখছি না। কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে আমার ভেতরে। আমি তো অনেক ছোট এজন্য ঠিকঠাক মতো বলতে পারছি না। সাত সকালে আমাকে নিয়ে সবাই চিন্তা করছে। গতকাল রাত থেকে আমার কান্না থামছে না। কাঁদছি তো কাঁদছি। আচ্ছা আমার মনে কি কোনো দুঃখবোধ আছে। ঠিক বুঝতে পারছি না। দুঃখ জিনিসটা বোঝার বয়স আমার হয়নি বোধ হয়। জন্মের পর থেকে অবশ্য আম্মুটাকে আর বাবাটাকে ঠিকমত ঘুমাতে দেইনি। কত রাত জাগিয়ে তাদের বসিয়ে রেখেছি। একটু ঘুমাতে চাইলে শুশু করে দিয়েছি।
কতবার আম্মুটার গায়ে হাগু করে দিয়েছি। আচ্ছা বাবাটা, আম্মুটা হাসি মুখে আমার এই নোংরা জিনিস কীভাবে পরিষ্কার করে! ভেবে তো আমার বমি আসছে। না, এখন বমি করা চলবে না। এমনিতেই এক কান্না নিয়ে তাদেরকে পেরেশানির মধ্যে রেখেছি। তার উপর যদি বমি করা শুরু করি তাহলে একটা বিদিকিচ্ছিরি অবস্থা হবে। দেখি মুখ গুজে কতক্ষণ চুপ করে থাকি। চারদিকে এত আলো দেখে আমার চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। বাবাটা আমাকে কোলে করে দৌঁড়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চলে গেল। হাসপাতালটা তো অনেক বড়। তাদের কথাবার্তায় বোঝা গেল এটা ইউনাইটেড হাসপাতাল। এখানে ধনীরা ভালো চিকিৎসা পায়। হাসপাতালটা অনেক পেশাদারিত্ব মেনে চলে এবং খুব বেশি বাণিজ্যিক।
বাবাটা এত জোরে চিৎকার করছে কেন, ‘আমার ছেলেকে ক্যানোলা লাগাতে দিব না, এটা দেখলেই ও আরও জোরে চিৎকার করবে। এটা আমি কিছুতেই মানতে পারব না। আপনারা ক্যানোলা লাগানো ছাড়া চিকিৎসা করবেন কিনা? না হয় আমরা অন্য জায়গায় দেখি।’ বাবাটা কেন যে এত ছেলেমানুষি করে! ডাক্তার রাজি হলো না। ড্রাইভার আঙ্কেলকে গাড়ি বের করতে বললেন। আমরা আবার ছুটে চলেছি। স্কয়ার নামে নাকি এক হাসপাতাল আছে, আমরা এখন ওখানে যাচ্ছি। আমার অবস্থা আরও শোচনীয় হচ্ছে। আমার কান্নার কোনো বিরাম নেই। কেঁদেই চলেছি তো কেঁদেই চলেছি। থামাথামির কোনো লক্ষণ নেই।
আম্মুটার চোখে এত পানি কেন? পেছনের সিটে বসে একা একা কাঁদছে কেন। আম্মুরাও ভীষণ বোকা হয়। এত অল্পতেই কেউ কখনো কাঁদে নাকি। বাবাটা কী যেন বলল, ‘আহ চৈতি এতো অস্থির হচ্ছো কেন! আমরা স্কয়ারে যাচ্ছি তো। ওখানে একটা কিছু হবে। আমার ছেলেকে আমি ক্যানোলা লাগাতে দিব না। প্রয়োজনে অন্যখানে যাব। তুমি একটু চুপ করে আল্লাহর নাম নাও’। আম্মুটার নাম বুঝি চৈতি। আগেও অনেকবার এই নাম বলতে শুনেছি। তখন অবশ্য ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। বড়রা অসুস্থ হলে নাকি মাঝেমাঝে তাদের ব্রেন পরিষ্কার হয়ে যায়। আমাদের ক্ষেত্রেও কী একই রকম হয়। ঠিক বুঝতেছি না। তবে আমি কী এক বিচিত্র ঘোরের মাঝে আছি। আমাদের গাড়ি স্কয়ারে পৌঁছে গেল। এখানেও আগের মতো অবস্থা হলো। ক্যানোলা লাগানো ছাড়া এরাও চিকিৎসা করাতে রাজি হলো না। আমরা আবারো ছুটে চলেছি।
এবার আমাদের গন্তব্য ধানমণ্ডি নামক জায়গা। আচ্ছা আমি কী আমার কান্না থামাতে পারি না। তাহলেই তো বাবাটাকে, আম্মুটাকে এত কষ্ট পেতে হয় না। তাদের কষ্ট দেখে এখন তো আমার নিজের ও অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি কী করতে পারি। আমি তো ছোট, আমি কিছু করতে পারছি না। বাবাটা, আম্মুটা আমি বড় হলে তোমাদের আর কষ্ট দেব না। বাবাটা কার সঙ্গে যেন দেন দরবার করে এক ডাক্তারের বাসা কাম ক্লিনিকে নিয়ে গেল। ডাক্তার নানু ভাইয়ের অনেক বয়স। তিনি আমাকে খুব যত্নসহকারে দেখলেন। তিনি আমার চিকিৎসা করবেন বলে আশ্বাস দিলেন। বাবাটার চোখ মুখ হাসিতে ভরে গেল। আমি কিন্তু কান্না থামাতে পারছি না।
ডাক্তার নানু আমাকে কিছু একটা ওষুধ দিলেন। বাবাটা আমাকে উপুড় করে কিছু একটা আমার হাগুর রাস্তায় দিয়ে দিলেন। আমার চোখ জড়িয়ে আসতে লাগল। আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি এখন আর কান্না করার শক্তি পাচ্ছি না। আমার সব কিছু কেমন ঘোলাটে লাগছে। কিন্তু না, একটু পর আমি সবাইকে অবাক করে দিয়ে আবার কান্না শুরু করলাম। সবাই চমকে গেছে। এমন কী ডাক্তার নানুকেও চিন্তিত মনে হলো। বাবাটা এবার বাচ্চা ছেলেদের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ‘ও আল্লাহ্ আমি কী এমন অপরাধ করেছি, আমার ছেলেটা এতো কষ্ট পাচ্ছে।
কষ্ট যা দেবার আমাকে দাও, আমার ছেলেটাকে ভালো করে দাও’। বাবাটা হাতজোড় করে এতো কাঁদছে কেন। আমি তো ভেবেছি বাচ্চারা শুধুমাত্র কাঁদে। বড়রা কাঁদে না। এখন দেখি বড়রাও বড্ড বাচ্চাই হয়! আমাদের গাড়ি আবার ছুটে চলেছে। এবার হলি ফ্যামিলি নামের কোনো এক হাসপাতালে। দৌঁড়ঝাপ আবার শুরু হলো। আমাকে ভর্তি করানো হলো। ডাক্তার আঙ্কেল বাবাটার পরিচিত। এরাও আমাকে উল্টো করে কিছু একটা আমার হাগুর জায়গায় দিয়ে দিল। আম্মুটা চামচ দিয়ে আমাকে অল্প অল্প দুধু খাওয়াচ্ছে। আমার চোখ জড়িয়ে আসতে লাগল। বাবাটা আমাকে কোলে করে হাসপাতালের বাইরে চলে আসল।
দুহাতে জড়িয়ে রেখে হালকা দোল খাওয়াতে লাগল। দোলের দুলুনিতে আমি চোখ বন্ধ করছি। আমার কান্না আস্তে আস্তে থেমে যাচ্ছে। বাবাটা ড্রাইভার আঙ্কেলকে কী যেন জিজ্ঞেস করল, ‘গাড়িতে গ্যাস কেমন আছে? কতক্ষণ চলবে? ‘রাত নেমে এসেছে। আম্মুটা কি কিছু খেয়েছে? বাবাটাও তো কিছু খায়নি। আচ্ছা তাদের কি খিদে পায়নি। বড়রা এতো বিশৃঙ্খল হয় কীভাবে!
সময়মতো খাচ্ছে না, ঘুমুচ্ছে না। বাবাটা আমাকে কোলে নিয়ে গাড়িতে বসে আছে। গাড়ি সারা শহর ঘুরে বেড়াচ্ছে। গাড়ির দুলুনিতে আমার আরামের ঘুম পাচ্ছে। আমি কাঁদছি না। আমি শুধু ঘুমাচ্ছি। আরামের ঘুম, আমার বাবাটার কোলে। <<আই লাভ ইউ বাবা>>