অয়ন

অয়ন

‘ক্রিং.. ক্রিং..’
‘হ্যালো’
‘সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস লক্ষীপুর শাখা থেকে বলছি, আপনি অবন্তী ইসলাম?’
‘জ্বি, বলুন..’
‘আপনার একটা হলুদ প্যাকেটে মোড়া কাটা মাথা আসছে, এসে নিয়ে যান।’
‘জ্বি আচ্ছা’

অবন্তী ফোন রাখে বালিশের পাশে। নিজের উপর বিরক্ত হয় সে। তার এখন সামান্য হলেও চমকানো উচিৎ। হলুদ পলিথিনে মোড়া একটা কাটা মাথা এসেছে তার নামে। কুরিয়ার সার্ভিসের ফোনের ওপাশের খসখসে কন্ঠস্বরটা শুনে মনে হলো, এরকম কাটা মাথা রোজ আসে তার কাছে। তিনি যত্ন করে প্যাকেট গুলো আলাদা করেন। কখনো সখনো কর্মচারীদের ধমকান, ওই বেটা, আস্তে রাখ, মিডিয়াম সাইজের মাথাগুলি কোনায় রাখ, আস্তে ফেল প্যাকেট, মগজ খুলে ছেঁড়াবেড়া হলে কিন্তু চাকরী নট!

তারপর প্যাকেটগুলির গায়ে লেখা নাম্বারগুলিতে ফোন দিয়ে আদুরে স্বরে বলেন, আপনার নামে একটা কাটা মাথা আসছে স্যার, এসে নিয়ে যান। অবন্তী হেসে ফেলে। আদতে সে ভীষণ ভীতু। স্পষ্ট মনে আছে, দেয়ালে একবার লেজহীন টিকটিকি দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো ভয়ে। ধড়াম করে পড়ে দরজায় বাড়ি খেয়ে কানের নিচে কেটে ফেলেছিলো। এখনো দাগ আছে। অবন্তী চোখ বুজে ভাবলো, কেন ভয় পাচ্ছেনা সে। একটা কাটা মাথা। যথেষ্ট ভয় পাওয়ার মতোন ব্যাপারই বটে। কুরিয়ার অফিস থেকে মজা করে কেউ ফোন দেবেনা। নাম্বারটা সেইভ করাই আছে ফোনে। কাজের প্রয়োজনে এই কুরিয়ার অফিসের সাথে ভালোই যোগাযোগ হয়৷ নানান রকম জিনিস আসে। পাঠাতে হয়। একটা অনলাইন শপ আছে ওর।

অবন্তী টের পেলো, কেন ভয় পাচ্ছেনা সে। এটা একটা স্বপ্ন দৃশ্য। সে এখন স্বপ্ন দেখছে। বাস্তব জগতে তার চোখ আধবোজা এখন, ঘনঘন কাঁপছে চোখের পাতা। রেপিড আই মুভমেন্ট। চারোপাশে তাকায় সে, দেয়ালে টাঙানো গোল ঘড়িটার ফ্রেম কালো। দেয়ালটাও সাদা। নিশ্চিন্ত হয়, এটা স্বপ্ন। স্পষ্ট মনে আছে, গোল ঘড়িটার ফ্রেম কালো নয়, সোনালিরঙা। স্বপ্ন দৃশ্য হয় সাদাকালো। স্বপ্নের মধ্যেই এপাশ ফিরে অবন্তী, আর চমকে ওঠে। পাশের বালিশে একটা মাথা পড়ে আছে। ধবধবে সাদা বিছানার চাদরে কালো চুল ছড়ানো, মাথাটা চিৎ হয়ে আছে চুলের মাঝখানে, কুচকুচে কালো জলে ফোটা পদ্ম ফুলের মতোন। গলাটা ধারালো কিছু দিয়ে খুব যত্ন করে কাটা। চোখ খোলা, কানের নিচে কাটা দাগ।

অবন্তী চুপসে গিয়ে নিজের মাথায় হাত বুলায়। ঠাণ্ডা একটা স্পর্শ সমস্ত শরীর অবশ করে ফেলে তার, শব্দহীন চিৎকার দিয়ে ওঠে সে। মাথা কই? আজিব! মাথা খুঁজে পায়না অবন্তী নিজের। মাথার জায়গাটা শূন্য, কাটা গলায় আঙুল বুলাতে গিয়ে টের পায় শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। উফফ। ঘুম থেকে উঠা দরকার খুব। বিচ্ছিরি এই স্বপ্ন!
অবন্তী হকচকিয়ে ঘুম থেকে উঠে, বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার আওয়াজ আসছে। গায়ের পাতলা টি-শার্ট ভিজে লেপ্টে আছে বুকে। চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলে সে, স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। ঠিক তখুনি ফোনটা বেজে উঠে। ‘ক্রিং.. ক্রিং..’ চমকে উঠে হাতে ফোন নেয় সে, স্ক্রীন না দেখেই রিসিভ করে কানে দেয়, কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘জি, কে বলছেন?’

একটা খসখসে কন্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস লক্ষীপুর শাখা থেকে বলছি, আপনি অবন্তী ইসলাম?’ অবন্তীর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, কোনোরকমে উত্তর দেয়, ‘জি, কে..কেন?’ ‘ম্যাম, আপনার একটা হলুদ প্যাকেট আসছে। এসে নিয়ে যান।’ ফোন রেখে চুপ করে বসে থাকতে হয় অনেকক্ষণ তাকে। ডানপাশে তাকায়। দেয়ালে টাঙানো গোল ঘড়িটার সোনালী রঙা ফ্রেম অস্বস্তিতে ফেলে দেয় আরো। হলুদ প্যাকেটে কি আছে জানে অবন্তী। একটা জামা। নতুন ডিজাইনের। অনেকটা জাম্পস্যুটের মতোন, তবে জাম্পস্যুট নয়। তিন দিন আগেই অর্ডার করেছিলো। দু’হাতে মাথা টিপে ধরে হাঁটু মুড়ে বসে থাকে অবন্তী। মাথা ভারী হয়ে আছে তার। এই যে ফোনের বিষয়টা, এটা কি সম্পূর্ণ কাকতালীয়!

আহসানের মনে হলো বিষয়টা কাউকে জানানো দরকার। একটা ভয়ংকর ব্যাপার ঘটছে তার সাথে। যথেষ্ট ভয়ংকর।
সব কথা সবাইকে বলতে নেই। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও ভাগ আছে। সব বন্ধু মনের কথা পাত্তা দেয়, তাও কিন্তু না। স্কুলজীবনে আহসান এক বন্ধুকে উদাস হয়ে বলেছিলো, ‘মাঝে মাঝে ভাবি জানিস, প্যান্ট আবিষ্কার না হইলে মানুষ কি করতো? ভাব একবার, মাথায় হ্যাট, ফুল হাতা শার্ট, কালো টাই পরে একজন লোক ন্যাংটো হেঁটে বেড়াচ্ছে! সামনের দিকে বুলুটা দুলছে।’

বন্ধু আহসানের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকায়। বন্ধুর মুগ্ধতা বড্ড ভালো লাগে আহসানের। কিন্তু পরেরদিন স্কুলে গিয়ে শুনে তার নাম হয়ে গিয়েছে, বুলু আহসান। অনেকে আবার অতি উৎসাহী হয়ে বুলু এবং আহসান যোগ করে একটা ধ্বনিগত মাধুর্য এনে ডাকছে, বুলুসান! আহসানের তেমন বন্ধু নেই এখানে। কবির আছে। কবিরকে বলা হয়নি কিছুই। কেন জানি মনে হয়, এই বিষয়টা জানার পর কবির অচেনা ভঙ্গিতে তাকাবে। আর কখনোই স্বাভাবিক হবেনা বন্ধুত্ব হয়তোবা। মাথা ধরেছে ভীষণ। সোফায় বসে দু’হাতে টিপে ধরলো মাথাটা সে। সকাল সন্ধ্যা মাথাব্যথা হয় নিয়ম করে রোজ। জঘন্য রকম ব্যথা। ভোঁতা ব্যথায় মরে যেতে ইচ্ছে করে তার। মাঝে মাঝে মাথাটা ঘ্যাচাং করে কেটে ফেলে দেয়ার চিন্তাও মাথায় আসে। সকাল, এগারোটা দশ। আহসান খানিক ইতস্তত করে বলে, ‘রোজ ডিস্টার্ব করি, আপনি কি আমার উপর বিরক্ত হোন?’

আহসানের দৃষ্টি নিচের দিকে, নাক চুলকায় সে। চেয়ারে পা তুলে জুবুথুবু হয়ে বসে থাকা লোকটির নাম অমল বড়ুয়া।
অমল বড়ুয়ার সাথে আহসানের পরিচয়ের ঘটনা বলি। চকবাজারের মোড়ে একদিন ভর দুপুরে একটা ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধলোককে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে আইসক্রিম খেতে দেখে থমকে দাঁড়ায় আহসান। এমন আগ্রহ নিয়ে আইসক্রিম খাবে বাচ্চারা, চেটে চেটে খাবে স্বাভাবিক ব্যাপার। বুড়োমতোন কেউ খেলে খাপ খায়না। আহসান খুব মজা পেলো। দাঁড়িয়ে রইলো, বৃদ্ধ আইসক্রিম চেটে শেষ করেই ধুপ করে পড়ে গেলেন। আশেপাশের লোকজন ভ্রুঁ কুচকে দাঁড়িয়ে রইলো। আহসান দৌঁড়ে গিয়ে টেনে তুললো বৃদ্ধকে। বৃদ্ধ মৃদুস্বরে বললেন, ‘আমায় একটু রিকশা করে বাসায় পৌঁছে দেবে বাবা?’ রিকশায় উঠে বিড়বিড় করলেন, ‘তোমায় কষ্ট দিচ্ছি বাবা আহসান স্মিত হেসে বললো, ‘শোধ তুলে নেব পরে।’ বৃদ্ধ শব্দ করে হেসে উঠলেন। আহসান বললো, ‘আপনি বেশ মজা করে আইসক্রিম খান’ ‘বয়স হয়ে এসেছে। হাতে সময় কম।

ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রাতুর জিনিসটির অনু পরমাণুও উপভোগ করছি আহসান পাশের রিকশায় আঙুল উঁচিয়ে দেখালো এক জোড়া কপোত কপোতিকে, ‘ওদের তো অনেক সময়। দেখে কি মনে হয়?’ বৃদ্ধ মুচকি হেসে কবিতা আবৃত্তি করলো হঠাৎ, ‘আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি, যুগল প্রেমের স্রোতে; অনাদিকালের হৃদয়-উৎস হতে।’ ‘বাহ, রবীন্দ্রনাথ?’ আহসান ঠিক তখুনি ঠিক করেছিলো তার গোপন ভয়ংকর গল্পটি এই বৃদ্ধকে বলবে। বৃদ্ধের পছন্দও রবীন্দ্রনাথ। আহসান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। হলুদ প্যাকেটটা খুলে অবন্তী এক দৌঁড়ে ওয়াশরুমে গেলো। দুই মিনিট ধরে বমি করা শেষে কোনোরকমে টলতে টলতে বেডরুমে এসে ফোন হাতে নিলো। হাসবেন্ডকে ফোনে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো, আহসান, বাসায় আসো, আমার খুব শরীর খারাপ লাগছে।’

পা টিপে টিপে ডাইনিং এ এসে দাঁড়িয়ে রইলো অবন্তী। পা কাঁপছে তার। হলুদ প্যাকেটের ভেতর ছোট্ট একটা বক্স। গায়ে পাথর বসানো। বক্সের ভেতর একটা কাটা আঙুল। মধ্যমা আঙুল। যতদুর ধারণা, ধারালো কিছু দিয়ে এক কোপেই আলাদা করে ফেলা হয়েছে আঙুলটা। মোটেও খেলনার মতোন কিছু নয়। প্রথমে চমকে উঠে সেটাই ভেবেছিলো সে। পরে হাতে নিতেই উৎকট গন্ধে পুরো ঘর আর মাথা ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। ফ্রেশ সদ্য সদ্য কাটা আঙুল। কাটা অংশের ভেজা লালচে মাংস টুক টুক করে কাঁপছে এখনো। অবন্তীর বমি পেলো প্রচণ্ড আবার।

আহসান আসার আগেই কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এমনিতে অবন্তীর অনলাইন শপ, কুরিয়ার, ফুরিয়ার নিয়ে খুব বিরক্ত সে। তার ধারণা যথেষ্ট টাকা কামাচ্ছে সে, এক্সট্রা টাকার কেন এত দরকার। আহসান বুঝেনা, এটা অবন্তীর শখ। মানুষ টাকার জন্য সবকিছু করেনা। আহসান এটা ইস্যু করে মহা হাঙ্গামা বাঁধাবে একপ্রকার সিউর সে। পরবর্তী দশ মিনিটে অবন্তী ভয়ংকর সাহসী একটা কাজ করলো। বক্সটা নিয়ে বিল্ডিং এর পেছন দিকের মাটি সামান্য খুঁড়ে পুঁতে ফেললো আপদটা। থর থর কাঁপছে তখনো শরীর তার। একটা চিরকুট ছিলো বক্সের ভেতর, ফাক ইউ। মধ্যমা আঙুল উঁচু করে এই গাল দেয়া হয়। অবন্তী অসুস্থবোধ করলো। ঘরে এসে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। জ্বর আসছে সম্ভবত!

‘শুরু থেকে বলি, অমলদা আপনি আমার কথা মন দিয়ে শুনবেন। আপনাকে হেল্প করেছিলাম বলে ভেবে বসবেন না, আমি প্রচণ্ড ভালো মানুষ। আদতে আমি খুব খারাপ একটা মানুষ। আর মানুষ কি না তা নিয়েও সন্দিহান।
ছোটবেলায় শিশুরা অনেক কিছুই মুখে দিয়ে ফেলে। সাবান, পাউডার, মাটি। আমার এক বন্ধু ছোটবেলায় এসিড খেয়ে ফেলেছিলো খানিক। সমস্ত জিহ্বা জ্বলে যায় তার। যাইহোক, আমি এসিড খাইনি। টিকটিকি খেতাম। আপনি বিষয়টা জানিনা কিভাবে নিবেন। একবার ভুল করে বাচ্চা টিকটিকি একটা খেয়েছি, মজা পেয়েছি। তারপর ইচ্ছা করেই মুখে দিয়েছি। খেয়েছি। এখনো খাই। যেখানে যেটা পাই। স্বাদটা নোনতা, খড়ের মতোন, একটা ঝাঁঝালো ভেজা গন্ধ।’ অমল বড়ুয়া চুপ করে তাকিয়ে থাকেন সামনের চেয়ারে বসা যুবকটির দিকে। এই যুবক পুরো এক সপ্তাহ ধরে একটা ভয়ংকর গল্প শুনানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। আজ শুনাচ্ছে। গল্পটা ভয়ংকর এবং যথেষ্ট উদ্ভট।

‘যখন আমি কলেজে পড়ি, সবকিছু বুঝতে শিখি। তখন এই টিকটিকি খাওয়া কন্ট্রোল করতে চেয়েছি। লোকলজ্জার ভয়ে। তাও লুকিয়ে খেতে হতো। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যেত দিনে একটা খেতে না পারলে। এরমধ্যে আমি একটা মেয়ের প্রেমে পড়ি। নাম অবন্তী। শ্যামলা রঙ, এক গালে টোল পড়ে হাসলে আর উপরের মাড়ির ডানপাশের দাঁত একটা উঁচু। দাঁতের এই অসামঞ্জস্যতার জন্য বোধহয় আরো সুন্দর লাগতো অবন্তীকে আমার। অবন্তীও আমার প্রেমে পড়ে। লুকিয়ে টিকটিকি খাওয়া বাদে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ সবল সুন্দর হ্যান্ডসাম একটি ছেলে। অবন্তীর সাথে আমার দারুণ সময় কাটতো। এমনই প্রথমবার হয়েছে যে, সারাদিন অবন্তীর সাথে ঘুরেছি আর টিকটিকি খাওয়ার তৃষ্ণা হয়নি একবারও।’

আহসান হাত দুটো কোলে এনে সরাসরি অমল বড়ুয়ার দিকে তাকালো, ‘জীবনের সাথে যে মানুষটি জড়িয়ে যায়, তার কাছে কিছু গোপন রাখতে নেই। অবন্তীর কাছে আমি লুকিয়েছি। একদিন ধরা পড়ি। সেদিন পুরো সকাল দুপুর রিকশায় চড়েছি আমরা। চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, পার্ক কোনো জায়গা বাদ নেই। এমনকি কাজি অফিসও। আপনাকে জানালে সমস্যা হবেনা, আমরা লুকিয়ে বিয়ে করেছিলাম ওইদিন। অবন্তীই জোর করেছিলো। পরে বাসায় জানাবে, আগে কাজটা সেরে ফেলি। যাইহোক, সব শেষে বাসায় পৌঁছেছি অবন্তীর। তখন সন্ধ্যে। বাসায় সাথে একটা বান্ধবী থাকে ওর, বান্ধবী তখনো আসেনি প্রাইভেট শেষ করে। আমি রুমে ঢুকেই বিছানায় গা এলিয়ে দিই। অবন্তী দরজা লক করে আমার বুকের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে জড়িয়ে ধরে পরম আবেগে। আদরে চোখ বুজার আগেই সিলিং এ চোখ পড়ে আমার। একটা টিকটিকি। কিছুদূরেই একটা পোকা বসে আছে। পোকা খাওয়ার অপেক্ষায়। হালকা লেজ নড়ছে।

আমার চোখ চকচক করে উঠে। সারাদিন একটা টিকটিকিও খাইনি। টিকটিকির মাংসল শরীর দেখে জিভে জল আসে আমার। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে এক ঝটকায় অবন্তীকে সরিয়ে বিছানা থেকে ফেলে একলাফে টিকটিকিটা চেপে ধরে পুরোটা মুখে পুরে দিই। চোখ বুজে চিবোতে থাকি। সমস্ত মুখে স্বর্গীয় তৃপ্তি। চোখ খুলেই চমকে উঠি। রুমের এক কোনায় হাঁটুগেড়ে বসে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাঁপছে অবন্তী। আমি কি করবো ভেবে পাইনা। এক পা এগোতেই অবন্তী দৌঁড়ে দরজা খুলে বান্ধবীর রুমে ঢুকে দরজা লক করে দেয়। ওর ভয়ার্ত চোখ দু’টি দেখেই আমি ভেঙে পড়ি একদম। টিকটিকি খাওয়া দোষের কি বলুন তো। বেয়ার গ্রিলস কি খায় না? দুনিয়ার যতরকম পোকা মাকড় আছে, সব খায়। আমি নাহয় টিকটিকি খাই। এটা কি অস্বাভাবিক?’ অমল বড়ুয়া নরম স্বরে বললেন, ‘এটা অস্বাভাবিক নয়, তোমার অস্বাভাবিক গল্পটি বলো।’

‘ওটাও টিকটিকি সম্পর্কিত। কিভাবে বলবো গুছিয়ে উঠতে পারছিনা। আমার ধারণা টিকটিকি খেয়ে খেয়ে এই অবস্থা। এই যে দেখুন, আমার বাঁ হাত। একটা আঙুলে ব্যান্ডেজ। গতকাল কেটেছি এটা। চাপাতি নিয়ে এক কোপেই ঘ্যাঁচাঙ!’ অমল বড়ুয়া একটু কেশে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন?’ আহসান মাথা চুলকে বললো, ‘জানিনা কেন, আমি কিছু ভাবতে পারিনা, ভাবতে গেলেই মাথা আউলায়ে যায়। যে আঙুলটা কেটেছি, এই আঙুলটা এক সপ্তাহের মধ্যেই আবার গজাবে।’ আহসান ডাক্তার নিয়েই বাসায় ফিরলো। অবন্তীর গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠলো, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। ডাক্তার যদিও বললো, ভয়ের কিছু নেই। আহসান এক বালতি পানি বিছানার কাছে এনে টানা আধাঘন্টা জলপট্টি দিলো। হাত পা মুছে দিলো ভেজা কাপড় দিয়ে।

জ্বরের ঘোরে অবন্তী বিড়বিড় করলো বেশ ক’বার, ‘ফাক ইউ… ফা..ফাক’ আহসান কপালে হাত বুলিয়ে কানের কাছে মুখ এনে বললো, ‘অবন্তী, কথা বলেনা৷ জ্বর কমে যাবে একটু পর। আমি আছি।’ কপালে চুমু খায় আহসান। কি সুন্দর মায়া মায়া একটা মুখ। রঙ শ্যামলা হলেও বা কি। আর উপরের মাড়ির ডানপাশের দাঁতটা, ইশশ অত সৌন্দর্য পৃথিবীর আর কোনো মানবীর আছে? কতটা ভাগ্য থাকলে এই মানুষটিকে পাওয়া যায় ভাবলো আহসান। ওই দিনটার কথা মনে পড়লো। সারাদিন ঘুরেছিলো দু’জনে। রিকশা করে। সন্ধ্যার আগেই মাথায় ভুত চাপলো যেন ওর। বিয়ের ভুত। এই মুহূর্তেই বিয়ে করবে। তারপর পরবর্তী কয়েক ঘন্টায় কি কি যে হলো, এখনো ভাবলে গা শিউরে উঠে। কি চমৎকার মুহূর্ত ছিলো সেটা!
আহসান মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে।

অবন্তী বিড়বিড় করে গাল দেয়। পরের সপ্তাহেই কুরিয়ার অফিস গিয়ে অবন্তী কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘গত সপ্তাহে একটা কুরিয়ার এসেছিলো, আমার। প্যাকেটে প্রেরকের নাম ঠিকানা নাম্বার কোনোটাই ছিলোনা। আমি কি আপনাদের কোনো কাগজপত্র দেখতে পারি? আর আপনাকে দেখলাম না গত সপ্তাহে। নতুন কেউ জয়েন করেছে?’ কোনো কাগজ পাওয়া গেলো না। ছেলেটা আরো অদ্ভুত তথ্য জানালো। নতুন কেউ জয়েন করেনি। গত সপ্তাহে কোনো কুরিয়ার আসেনি অবন্তীর নামে। ফোনের কল লিস্ট চেক করে সে। ওখানে কুরিয়ার অফিস থেকে করা কোনো ফোনের রেকর্ড নেই।

পরের দিন সকালেই চুপি চুপি বিল্ডিং এর পেছনে যায় সে। এই যে, এখনো মাটি খুঁড়ার দাগ রয়েছে। দুহাতে নরম মাটি আলগা করে। উত্তেজনায় শরীর কাঁপতে থাকে ওর। এই যে বক্সটা! অবন্তী কাঁপা কাঁপা হাতে বক্সটা খুলে। ভেতরে আঙুল। পঁচে গলে আছে। বমি পায় ওর। কি করে যে বক্সটা পুনরায় পুঁতে বমি চেপে এক দৌঁড়ে বাসায় আসে কল্পনাও করতে পারেনা সে। বিছানায় শুয়ে থাকে কাঠ হয়ে। এমন কেন হচ্ছে তার সাথে? কান্না পায়। ঠিক তখুনি ফোনটা বাজে, ‘ক্রিং.. ক্রিং..’ ‘হ্যালো’ ‘সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস লক্ষীপুর শাখা থেকে বলছি, আপনি অবন্তী ইসলাম?’ অবন্তীর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে খসখসে কন্ঠস্বর শুনে, বলে, ‘জ্বি, আ..আমি ‘আপনার একটা হলুদ প্যাকেট আসছে ম্যাম, এসে নিয়ে যান।’

অবন্তী আমায় ছেড়ে যায় এই ক্ষুদ্র কারণে। ওর ধারণা, আমি মানুষ না। জন্তু জানোয়ার টাইপের কিছু একটা। আমি পাগলের মতোন হয়ে যাই। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে ওর বাসার সামনে ঘুরঘুর করি। অবন্তী আমার উপর বিরক্ত হয়েই বাসা পাল্টায়, সিম পাল্টায়। আমি তার ঠিকানা খুঁজি পাগলের মতোন। পাইনা। ছয়মাসে আমি পুরোদস্তুর পাগল হয়ে যাই। দেখে কেউ চিনতে পারেনা আমায়। বাবা বাসা থেকে বের করে দেয়। পথেঘাটে ঘুরি। এক দেড় বৎসর পর একদিন পথেঘাটে ঘুরতে ঘুরতেই ওর বান্ধবীকে খুঁজে পাই। তার মুখেই শুনি, অবন্তীর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছেলের নাম আশফাক। বিজনেস আছে ছেলের। সুখে আছে ও।

প্রচণ্ড রাগ ক্ষোভ কষ্ট একসাথে অনুভব করি আমি সেদিন। বাসায় ফিরে বামহাতের অনামিকা আঙুলের দিকে তাকিয়ে বাচ্চাদের মতোন কান্না করি। একটা রিং ওখানে চেপে বসে আছে। এই দীর্ঘ সময়েও ক্ষীণ আশা ছিলো, ফিরে আসবে সে। অবন্তীর দেয়া উপহার এটা। কি জানি কি হলো, ওই রাতে প্রচণ্ড কষ্ট, ক্ষোভ এবং রাগের ফলে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে চাপাতি দিয়ে এক কোপে রিং সহ অনামিকা আঙুলটা গোড়া থেকেই কেটে ফেলি।’ আহসান থামে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ‘এক সপ্তাহ পর কাটা আঙুলে চুলকায় খুব, ব্যান্ডেজ খুলে চোখ কপালে উঠে যায় আমার। একটা ছোট্ট আঙুলের ডগা নখসমেত উঁকি দিচ্ছে কাটা আঙুলের গোড়া থেকে। এই শুরু হলো। প্রথম তিনদিন ভয়ে ঘর থেকে বের হইনি। ততদিনে আঙুলটা আরো বড় হয়েছে। আর আমি টের পাচ্ছিলাম, আর দশটা মানুষ থেকে আমি আলাদা। আপনার ঘুম পাচ্ছে?’ ‘মোটেও না, গল্পটা অবিশ্বাস্য!’

‘প্রমাণ দেখাতে পারি আপনাকে, তবে দরকার হবেনা। আমার ধারণা আপনি বিশ্বাস করছেন। তারপর শুনুন, আমি এই আঙুল গজানোর বিষয়টা কয়েক সপ্তাহের ভেতরই স্বাভাবিক বলে মেনে নেই। আমার মধ্যে এই ব্যাপারটা আছে, টিকটিকি খাওয়াটাও আমি এভাবেই নিয়েছিলাম। এরপর থেকে আমি চেক করে দেখার জন্যই আঙুল কাটি, এক সপ্তাহের ভেতরই নতুন আঙুল গজায়। বিষয়টা দারুণ লাগে। এরমধ্যে অবন্তীর সাথে একদিন দেখা হয়ে যায় শপিং মলে। স্বামীর সাথে শপিং করতে এসেছে। স্বামীর নাম আশফাক। আমি আশ্চর্য হই অবন্তীর চোখভরা খুশি দেখে, কি সুখী একটা মুখ। আমার খুশি হওয়ার কথা, আমি পেলাম দুঃখ। খারাপ মানুষ বলেই হয়তো। অবন্তীর কোলে একটা বাচ্চা। ছোট্ট। পাঁচ ছ’মাস হবে বয়স। আমি কাছে গেলাম না অবন্তীর, দূর থেকে দেখলাম। আর ঠিকানা জেনে নিলাম। তারপর সব ডিটেইলস। মনে মনে একটা প্ল্যান কষেছি। এ্যা পারফেক্ট রিভেঞ্জ!’ আহসান আর অবন্তী কুরিয়ার অফিসের ভেতর থতমত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। আহসানের হাতে হলুদ প্যাকেট। কুরিয়ারের ছেলেটির নাম হাকিম। হাকিম জানালো, সে দুই সপ্তাহ হলো এখানে কাজ করছে।

হলুদ প্যাকেটে প্রেরকের কোনো নাম ঠিকানা নেই। হাকিম আশ্চর্য হয়ে জানালো, এরকম কোনো প্যাকেট রিসিভ করার নিয়ম নেই। তবে অনেকসময় সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য অফিসের লোককে টাকা খাইয়ে এরকম করা হয়।
বাসায় পৌঁছে আহসান আর অবন্তী ডাইনিং টেবিলের উপর প্যাকেটটা রেখে পাশে চেয়ার টেনে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওই দিকে। এখনো খুলা হয়নি প্যাকেট। অবন্তী ভীত চোখে তাকিয়ে নিষেধ করলো স্বামীকে খুলতে। বললো, ‘চলো, ফেলে দিই প্যাকেট পুরোটাই।’ আহসান কিছুক্ষণ অবন্তীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো, ‘প্রথমবারই জানানো উচিৎ ছিলো তোমার অবন্তী। জ্বর টর এনে কি বিচ্ছিরি অবস্থা করেছিলে। আর কোনোদিন এমন করবানা। বক্সটা খুলবো। জানতে হবে, পেছনে কে আছে এর বক্সটা খুলার সময় আহসানের হাতও কাঁপলো সামান্য।

অবন্তীর চোখ দুটি কোটর থেকে প্রায় বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। বক্সটা আগেরটার মতোই। পাথর বসানো। ভেতরে মধ্যমা আঙুল। মাংস আর রক্তের গন্ধে পেটের নাড়িভুঁড়ি প্রায় বের হয়ে যাবার উপক্রম হলো আহসানের। মুখে হাত চেপে তাকিয়ে থাকে কাটা আঙুলটির দিকে দু’জনই। ঠিক তখুনি অবন্তী খেয়াল করে, আঙুলের গোড়ায় দুটো তিল। আঁতকে উঠে আহসানকে দেখায় তিল দুটো। আহসান বিস্মিত চোখে নিজের ডান হাতের মধ্যমা আঙুল দেখে, এই তিল দুটো তার নিজের আঙুলেও আছে। কাটা আঙুলটা আহসানের! অসম্ভব! তিল থাকতেই পারে দু’টো, যে কারোর আঙুলে। অাহসান বক্সটা টেবিলে রেখে মাথা টিপে ধরে দু’হাতে, ভোঁ ভোঁ করছে ভেতরে যেন। অবন্তীকে বলে, ‘মাথাব্যথার ঔষধ আছে অবন্তী?’ অবন্তী জবাব দেয়না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আঙুলটার দিকে।

আমার রিভেঞ্জটা আমি ঠিক করেছি নেব ওই ক্ষমতার সাহায্যে, যেটা সম্পর্কিত কারণেই দূরে ছেড়ে গিয়েছে অবন্তী। আঙুল কেটে পাঠাবো। মধ্যমা। গাল দেয়ার জন্য যে আঙুল ব্যবহার করা হয়। আমি কি করলাম, রাতে আঙুলটা কেটে একটা বক্সে ভরলাম। বক্সটাও আমার বানানো। স্পেশাল। এই বক্সের ভেতর থেকে গন্ধ বের হবেনা। একটা চিরকুটে লিখলাম, ফাক ইউ। দুঃখিত, আপনার সামনে বাজে ভাষাটা ব্যবহার করার জন্য। কিন্তু অবন্তী ওটার যোগ্যই বটে। কুরিয়ার অফিসের ছেলেটাকে টাকা খাইয়ে নাম ঠিকানা গোপন করে পাঠিয়ে দিলাম অবন্তীর ঠিকানায়।

আর তার কিছু দিন পরই অবন্তীকে দেখলাম ওই শপিং মলে। বাচ্চা কোলে ঘুরছে। পাশে আশফাক। চেহারায় সেই পুরনো সুখী সুখী ভাব। একটা কাটা আঙুল পেয়ে একটা মেয়ে হকচকিয়ে না গিয়ে বরং কিছুদিনের মধ্যে পুনরায় শপিং করতে আসবে, আমার ধারণায় ছিলোনা। রাতে ফিরে আবার একিই কাজ করলাম। এবার ডানহাতের আঙুলটা কাটলাম। মধ্যমা। বক্সে ভরে পাঠিয়ে দিলাম চিরকুট সহ। কুরিয়ার অফিস থেকে ছেলেটি জানালো, প্যাকেট রিসিভ করা হয়েছে। অবন্তীর সাথে হাসবেন্ডও ছিলো তার। দু’জনই ভীত। হাসবেন্ড নাকি জিজ্ঞেস করছিলো, প্রেরক কে, কোথায় থাকে কিছু জানা যাবে কিনা। আমি তৃপ্তির হাসি হাসলাম।

আমি ভেবেছি আমি চমকে দিয়ে তৃপ্তি পাচ্ছি অবন্তীকে। আঙুল দেখলেই সে বুঝে ফেলবে এটা তার এক সময়কার ভালোবাসার টিকটিকি মনুষ্যের আঙুল। এই আঙুলের তিল দুটি নিয়ে বড্ড গর্ব করতো সে। তিল আমার, গর্ব তার। কোথাও যেন পড়েছে, ডানহাতের মধ্যাঙ্গুলের গোড়ায় দুইটি তিল থাকলে বৈবাহিক সম্পর্ক আঠালো হয়ে যাবে, কখনোই আলাদা হবেনা। হাসি পাচ্ছে। আমার ধারণা সে আঙুলটা পেয়ে নিদ্রাহীনতায় ভুগবে। অপরাধবোধেও ভুগবে হয়তোবা। মেয়েদের মনস্তত্ব ভীষণ জটিল।

আমি ও কে চমকে দিয়ে প্রচণ্ড তৃপ্তি পাচ্ছিলাম। কয়েকদিন পর নিজেই চমকালাম। ভোরে ভোরে এই ম্যাড়ম্যাড়ে ব্যাচেলর বিল্ডিং এর তিন তলার ফ্ল্যাটের দরজায় ঠক ঠক শুনে চোখ কচলে দরজা খুলেই চমকাই। অবন্তী দাঁড়িয়ে। শাড়ি পরা। চোখে কাজল। ভ্রুঁ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। আমি থতমত খেলাম। তোতলানো স্বরে বললাম, ‘তু..তুমি?’ অবন্তী গলায় হাত চেপে এক ধাক্কায় রুমের ভেতর ঢুকিয়ে প্রায় চিৎকার করে বললো, ‘তুই আমার নাম্বারে ফোন দিয়ে অধিকার ফলিয়ে কথা বলিস কোন সাহসে?’

আমি অবন্তীর একটা কথাও বুঝতে পারিনা। অবন্তীর নাম্বার আমি জানি ঠিকিই, গোপনে বক্স পাঠানো ছাড়া কখনো ফোন দিইনি। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘অবন্তী, তুমি আমার ঠিকানা কোথায় পেলে?’ অবন্তী ক্রোধে লাল হয়ে যায়। কর্কশ স্বরে বলে, ‘তুই জানিস তোকে আমি কি করতে পারি? খুন করতে পারি লোক দিয়ে। এক সময় ভালোবেসেছিলাম। তাই এটা করিনি এখনো। আর কখনো যদি ফোন দিয়ে আবোল তাবোল বকেছিস কিংবা আমার সংসার ভাঙার এতটুকুন চেষ্টা করেছিস তো খুন করে ফেলবো তোকে আমি!’ আমার থতমত ভাব কাটতে সময় লাগলো। কাটার পরই স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি সন্দেহ করছো কাটা আঙুলটা আমার?’ অবন্তী রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে উল্টা প্রশ্ন করলো, ‘কিসের কাটা আঙুল? তোর মাথা কেটে নিবো আমি কুত্তার বাচ্চা!’

অবন্তী ফোন দিলো কাকে যেন, মুহূর্তেই কয়েকজন বিশালদেহী লোক এসে রুমে ঢুকে বুকে পেটে ইচ্ছেমতোন লাথি দিলো। অবন্তী যেভাবে এসেছিলো, ওভাবে হন হন করে চলে গেলো। আমি মুখভরে বমি করলাম, পেটের নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে গিয়েছে কি না কে জানে। বমির সাথে ছোপ ছোপ রক্ত।” অাহসানের দিকে ডাক্তার বন্ধুটা কিছুক্ষণ রোবটের মতোন তাকিয়ে থাকলো। তারপর নরম চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে থাকলো অনেকক্ষণ। আহসান টেবিলে হাত রেখে একটু ঝুঁকে অবিশ্বাস্য স্বরে বললো, ‘তুই কি বুঝতে পারছিস, কি বলছিস তুই?’ বন্ধু চোখ খুলে তাকায়। মাথা নাড়ায়। তারপর ভ্রুঁ উঁচু করে বলে, ‘এটা তোর ই আঙুল, ডিএনএ ম্যাচ করছে। তোর কোনো আইডিন্টেক্যাল টুইনস আছে?’ ‘আরে নাহ।’

‘তবে আর দ্বিতীয় কোনো কথা নেই। আমি বিজ্ঞান পড়েছি। আমায় এলোমেলো করিস না আর।’ আহসান হতাশ মুখে ডাক্তার বন্ধুর চেম্বার থেকে বের হলো। পরবর্তী কয়েক ঘন্টা কাটলো আরো ঝামেলায়। আইডেন্টিক্যাল টুইনসের ডিএনএ একই হলেও ফিঙ্গারপ্রিন্ট একই হয়না। ফিঙ্গারপ্রিন্ট ফলাফল পেয়ে আহসান চুপসে গেলো পুরোপুরি। বিভা উদ্যানে হাঁটতে হাঁটতে অকারণেই হোঁচট খেলো। রাস্তাটা ছায়ায় ভর্তি। একপাশে বেঞ্চি পাতা। আহসান বেঞ্চিতে বসে ফোন হাতে নিলো, অবন্তীকে জানানো দরকার, ফোন দিলো সে, ‘হ্যালো ‘অবন্তী, ওটা আমারই আঙুল।’ ‘কে আপনি?’ আহসান অবন্তীর অপরিচিত গলার স্বরে বিস্মিত হলো। বললো, ‘অবন্তী আমি আহসান। বলছিলাম, ওই আঙুলটা আমার ই। সব ম্যাচ করছে। কিছু বুঝতে পারছিনা রে।’ ‘আহসান?’ ‘হুম, অবন্তী কি হয়েছে তোমার? শরীর ঠিক আছে?’

অবন্তীর বিস্মিত গলার স্বর ভেসে এলো ফোনে, ‘একদম ঠিক আছি। তুমি আহসান? সেই টিকটিকিখেকো! নাম্বার কোথায় পেয়েছো আমার? আর এত আদুরে স্বরেই বা কথা বলছো কেন আশ্চর্য!’ নেটওয়ার্ক ডিস্টার্ব করছে। আহসান কয়েকবার হ্যালো বলতেই ফোন কেটে গেলো। আর বসে থাকা উচিৎ হবেনা। তাড়াতাড়ি বাসায় পৌঁছা দরকার। অবন্তীর কি হয়েছে কে জানে। কিসব টিকটিকি ফিকফিকির কথা বলছে! এভাবে তো কখনোই কথা বলেনা ওর সাথে। অমল বড়ুয়া খুক খুক করে কেশে কফ ফেলার জন্য জানালা খুলে দাঁড়ায়। রাস্তায় একটা লোক জোরে জোরে হাঁটছে। ভীষণ তাড়া তার। পা ফেলায় ব্যস্ততার চাপ। হয়তো আহসানের গল্পের প্রভাবেই কেন জানি লোকটাকে দেখতে আহসানের মতোন লাগছে। লোকটার হাতে একটা হলুদ প্যাকেট।

অমল বড়ুয়া থু করে একগাদা থুতু ফেলে পুনরায় চেয়ারে ফেরত আসে। আহসান মুখ নিচু করে আছে। মুখ নিচু রেখেই অপরাধী স্বরে বললো, ‘প্রত্যেকটা মানুষের জীবন আলাদা। তবুও একটা কমন যেটা থাকে, আশা। অবন্তী ছেড়ে যাওয়ার পর আশায় ছিলাম, ফিরে আসবে সে। আসেনি। যখন বিয়ে হলো, সুখী দেখলাম ও কে, আশায় ছিলাম কুরিয়ার পেয়ে চমকাবে, ভয় পাবে, সুখ উড়ে যাবে কিংবা অপরাধবোধে ভুগবে। অমন কিছুই হয়নি। এরপর লোক দিয়ে পিটিয়ে আধমরা করে রেখে গেলো। এখন ও কে নিয়ে কোনো আশা নেই। যেটা করবো, শুধুই করবো। ভয়ের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দেব ও কে। কোর্ট কাচারী করতে করতেই ওর জীবন পার হয়ে যাবে।’ অমল বড়ুয়া মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি করবে তুমি?’
‘মাথা কেটে ফেলবো।’ অমল বড়ুয়া নড়েচড়ে বসে জিজ্ঞেস করলো,
‘কার?’
আহসান মৃদৃ হাসলো,
‘আমার’
‘আর ইউ সিউর?’

‘একদম। আর তাছাড়া একটা পরীক্ষাও হয়ে যাবে। কিছুদিন যাবৎ ভাবছিলাম, আঙুল কাটলে আঙুল গজায়। মাথা কাটলেও গজাবে কিনা চেক করার দরকার আছে। নাকি?’ আহসান শরীর দুলিয়ে হাসতে লাগলো। ঠিক এই মুহূর্তে অমল বড়ুয়ার মনে হলো, সামনে চেয়ারে কোনো মানুষ বসে নেই। একটা কদাকার টিকটিকি বসে আছে। বিচ্ছিরি গোল গোল চোখে তাকিয়ে খসখসে লেজ নাড়াচ্ছে। অমল বড়ুয়া অসুস্থবোধ করলো। ক্লান্ত লাগছে শরীর হুট করে। আহসান যেন বুঝতে পারলো ক্লান্তিটা। বললো, ‘আমি চলে যাব একটু পর। কখনো দেখা হবেনা আর হয়তো, কিংবা হতেও পারে। আচ্ছা, আমাদের প্রথম দেখার দিন রিকশায় একজোড়া কপোত কপোতি দেখে রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতার কিছু লাইন আবৃত্তি করেছিলেন আপনি। মনে আছে?’

‘হুম’ ‘ওটার প্রথম দিক কার লাইনগুলো একটু আবৃত্তি করবেন প্লিজ?’ অমল বড়ুয়া চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ভরাট স্বরে আবৃত্তি করে, ‘তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি, শত রূপে শত বার। জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার। চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার, কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার। জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।’ আহসান চোখ মুছে, কাঁদো স্বরে বলে, ‘কেন জানিনা, এই কবিতা শুনলে কান্না আসে আমার। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই জীবনটা আমার নাও হতে পারতো। ওই দিন আমি যদি বুকের উপর শুয়ে থাকা ভালোবাসাটুকুন আঁকড়ে ধরে একটা তীব্র তৃষ্ণা চেপে রাখতে পারতাম… তবে অবন্তী আমার হতো। ছিহ, কেঁদেও ফেলেছি এই দেখুন, আপনার সামনে, ইশশ।’

আহসান বাসার দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবন্তীকে স্বাভাবিক দেখেই শব্দ করে শ্বাস ছাড়লো। অবন্তী ভীত মুখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে তোমার? ফোন করছি, রিসিভ করে কিসব মাথা কাটার কথা বলছো। ওই, কি হয়েছে তোমার?’ আহসান বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করলো। অবন্তী এইমাত্র যা বলেছে, তা বুঝার চেষ্টা করছে। ওর চোখেমুখে ভয় লেপ্টে আছে। ও বলছে, ও ফোন দিয়েছে আহসানের কাছে। অথচ আহসানের কাছে ফোন আসেনি। বরং আহসান অবন্তীকে ফোন দিয়েছিলো, আর অবন্তী অদ্ভুত সব কথা বলছিলো। আহসান কপাল দু’আঙুলে টিপে ধরে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি একটু আগে আমার ফোন রিসিভ করে কি বলছিলে?’

অবন্তী ভোঁতা মুখে কল লিস্ট দেখালো। নো ইনকামিং। আহসান স্তব্ধ চেহারায় ফোন বাড়িয়ে দিলো স্ত্রীর দিকে। অবন্তী ফোন হাতে নিয়ে কললিস্ট চেক করে রোবটের মতোন ধীরে ধীরে বিছানায় বসে কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হচ্ছে আহসান এসব? আমার খুব ভয় লাগছে!’ আহসান চোখ বুজে থাকে। ভয়ানক মাথাব্যথা করছে। কোনোকিছুই ঠিক চলছে না, সব এলোমেলো। সাজিয়ে গুছিয়ে ফেলতে হবে ঘটনাগুলি। হলুদ প্যাকেটটা টেবিলে রাখা; আপাতত আগে ওটা পুঁতে ফেলা দরকার। উঠে বসতেই অবন্তীর ফোনে রিং হলো, ‘ক্রিং.. ক্রিং..’

অবন্তী কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন নিয়ে স্ক্রীনে তাকায়। কুরিয়ার অফিস থেকেই ফোন আসছে। একবার আহসানের দিকে তাকায়, কপালে ঘাম জমে অবন্তীর। কাঁপতে থাকা বুড়ো আঙুলটা রিসিভ বাটনে প্রেস করে ফোন কানে দেয় সে, ‘হ্যালো ‘আমি অমল বড়ুয়া। আজ ইংরেজী মাসের কত তারিখ ঠিক জানা নেই, মাসটা ফেব্রুয়ারি। এখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা। অনুমান করছি। আমার অনুমানশক্তি ভালো। এখন আমি অনুমান করে কিছু অদ্ভুত তথ্য জানাচ্ছি। বেশিরভাগটুকুই আমার ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা, অনুমান! এই ডায়েরীর তিনটি পৃষ্ঠা বাকি। এরমধ্যেই সবকিছু গুছিয়ে লিখতে হবে। কিছুটা বাকি থাকলে, থাকুক। অতৃপ্ততেই তৃপ্ত!

গত বৎসরের শেষের দিকে আমার সাথে একজন যুবকের পরিচয় হয়। এই যুবকের মুখে দাঁড়ি গোঁফের জঙ্গল। দীর্ঘ সময় ধরে শরীরের যত্ন নেয়া না হলে ভ্যাপসা গন্ধ বের হয় শরীর থেকে। এই যুবকের নাম আহসান। আহসানের শরীরে এই গন্ধটা ছিলো। আহসান আমায় অনেকদিন সময় নিয়ে গুছিয়ে যথাযথ মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে একটা গল্প বলে। এই গল্পে কিছু মিথ্যে ছিলো। আচ্ছা, এই কিছু কিছুকে আমরা মিথ্যে বলবোনা। ইংরেজীতে সিক্সকে উল্টোদিক থেকে দেখে কেউ যদি নাইন বলে, তবে সে মিথ্যে বলছেনা। আহসানও তেমন বলেছে। প্রথম মিথ্যে, কুরিয়ার অফিস। আমি খোঁজ নিয়েছিলাম, কুরিয়ার অফিসের ছেলেটি আহসান নামের কাউকে চিনেনা। চেহারার বর্ণনা দিয়েও চেনানো গেলোনা তাকে।

দ্বিতীয় মিথ্যে, এটা প্রথম মিথ্যের সাথেই সম্পর্কযুক্ত, অবন্তীকে কখনোই কোনো আঙুল কেটে পাঠায়নি সে। ফোন করেছিলো শুধু। ফোনে ভুলভাল বকেছে। অবন্তী ঠিকানা বের করে গিয়ে রাগের মাথায় লোক দিয়ে পিটিয়েছে ও কে। এসব আমি জেনেছি, অবন্তীর কাছ থেকেই। বড্ড মিষ্টি মেয়ে। অজানা কারণেই আমায় প্রচুর খাতির করলো। নানা বলে ডাকছিলো। কি জানি, দেখে নানার কথা মনে পড়েছিলো হয়তো, যিনি দুনিয়ায় নেই। এমন হয়। মৃত মানুষের চেহারা, অঙ্গভঙ্গী জীবিত আমরা বয়ে বেড়াই। অবন্তী আমায় জানায় সে কখনো সুন্দরবন কুরিয়ার অফিসে যায়নি, কোনো কুরিয়ার রিসিভ করেনি কয়েক বৎসরের মধ্যে।

আমি আসার সময় দরজার কাছে এসে অবন্তীকে একটা প্রশ্ন করি, ‘তুমি রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করো?’ অবন্তী মাথা নাড়ায়। সে কখনো রবীন্দ্রনাথ পড়েই নি অত আগ্রহ নিয়ে। এখন আহসানের বলা এই দুটো মিথ্যে নাইনকে রোটেট করি। আহসান শুধু শুধু একটা মিথ্যে গল্প কেন বলবে আমাকে। ধরে নিই, ওর মিথ্যে দু’টোই সত্য। আসলেই কুরিয়ার করেছে সে। অবন্তীও পেয়েছে আঙুল দু’টো। তবে দু’টোই আলাদা জগতে ঘটা ব্যাখ্যাতীত কোনো ঘটনা। প্যারালাল ইউনিভার্স নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক থাকলেও আমি কখনোই এটার অস্তিত্ব অস্বীকার করিনা। থাকতে পারে একের অধিক ডুপ্লিকেট জগত। এত বুদ্ধিমান একটা প্রাণী মানুষ, সে কেন নির্দিষ্ট বিন্দুর পর বিন্দু অনুসরণ করে একটামাত্র সরল পথে চলবে?

আমি বরং ধরে নিই, এখানে দুটো অবন্তী এক্সিস্ট করছে। একজন অবন্তীর স্বামীর নাম আশফাক, একটা বাচ্চা আছে তার এবং আহসানকে ছেড়ে এসেছে সে। এর নাম দিই, এক নং অবন্তী। অন্য অবন্তী মানে দুই নং অবন্তীর বিষয়ে বিস্তারিত আমি কিছু জানিনা। হতে পারে সেও বিবাহিত। কেননা, আহসান যখন কুরিয়ার অফিস থেকে খবর নিয়েছিলো, জেনেছিলো অবন্তী হাসবেন্ড সহ এসেছিলো কুরিয়ার অফিসে প্যাকেট রিসিভ করতে। তো আহসান দীর্ঘদিন পর যখন এক নং অবন্তীকে শপিং মলে সুখী সুখী চেহারায় ঘুরতে দেখলো, তখন প্রচণ্ড রাগে ক্ষোভে আঙুল কেটে যে কুরিয়ারটি পাঠালো… ক্রস কানেকশন হয়ে সেটা প্যারালাল জগতের অন্য অবন্তী মানে দুই নং অবন্তীর কাছে চলে আসলো। এক্ষেত্রে রাগ ক্ষোভ কিংবা ঘৃণাটাই কি প্যারালাল ইউনিভার্সের ক্রস কানেকশনের দরজা?
এটা জানা নেই আমার।

এরপরের ঘটনা সাজাই। আহসানের কথানুযায়ী এরপর শপিং মলে কিছুদিন পরই দেখে অবন্তীকে সে। সেটা অবশ্যই এক নং অবন্তী। সে কুরিয়ার পায়নি। আহসান সম্পর্কে তার কিছুই জানার কথা না। কিন্তু পরের দিন সে আহসানের ঠিকানা খুঁজে লোক দিয়ে পিটিয়ে আসলো। কেননা ফোন করেছিলো আহসান। নির্দিষ্ট করে ‘আহসান’ নাম বলার অর্থ, আহসান ই ফোন করেছিলো ও কে। পরিচিত ভঙ্গিতে কথা বলেছিলো অবন্তীর সাথে। এই আহসানটা কে? প্রথম থেকে শুরু করি আবার। ধরে নিই, দুটো অবন্তীর পাশাপাশি দুটো আহসানও এখানে এক্সিস্ট করছে। দুই এ দুই এ চার মিলাই। আমার অনুমান বলে, দুই নং অবন্তীর স্বামীর নাম আহসান।

প্যারালাল জগত সৃষ্টি হয় সিদ্ধান্ত থেকে। একেকটা সিদ্ধান্ত একেকটা বিন্দু। সিদ্ধান্তের পরই একটা বিন্দু নির্দিষ্ট হয়, আর মানুষ ওই বিন্দুর দিকে পা বাড়ায়। আহসানের কাজি অফিসে চুরি করে বিয়ের পর ওই সন্ধ্যায় টিকটিকি খাওয়ার ঘটনাটাকে যদি বিন্দু ধরি, তবে দুটো ভিন্ন বিন্দু সৃষ্টি হয়। একটা বিন্দুতে আহসান চোখ বুজে থাকবে, টিকটিকি খাওয়ার তৃষ্ণা চেপে রাখতে সক্ষম হবে। অবন্তী কিছুই জানতে পারবেনা বিচ্ছিরি এই বিষয় সম্পর্কে। সুন্দর একটা সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে। অন্য বিন্দু ওটা, যেটায় আহসান এখন চলছে। আলাদা হবে ওরা, আহসান আঙুল কাটবে, গজাবে, কুরিয়ার পাঠাবে। এখন প্যারালাল হিসেবে দুইটা বিন্দুতে দুইটা আহসান পা বাড়িয়েছে। টিকটিকি খেয়ে ফেলা আহসানের নাম এক নং আহসান।

অবন্তীর সাথে থাকা আহসানের নাম ধরি, দুই নং আহসান। এবার ঘটনায় ফিরি, আঙুল কুরিয়ার পাওয়া ভীত দুই নং আহসান তার চিন্তিত স্ত্রী দুই নং অবন্তীকে ফোন দেয় কোনো একটা ব্যাপারে রাগ, ক্ষোভ কিংবা হতাশ হয়ে। ক্রস কানেকশন হয়। ফোনটা আসে এক নং অবন্তীর কাছে। দুই নং আহসান নিজের স্ত্রী মনে করে এক নং অবন্তীর সাথে কথা বলে। এক নং অবন্তী রেগেমেগে এক নং আহসানের ঠিকানা জোগাড় করে লোক দিয়ে পিটিয়ে আসে। তারপর এক নং আহসান মাথা কেটে কুরিয়ার করার সিদ্ধান্ত নেয়। আরো উদ্ভট ভয়ংকর কিছু করাও তার জন্য বিচিত্র নয়। আমার ধারণা ইতিমধ্যে সে করেছেও। আশাহীন মানুষ ভয়ংকর!

যে শিশুটি ভুল করে টিকটিকি খেয়েছিলো, এবং যে যুবকটি ভুল করে ‘গোপন’ গোপন করেছিলো… পরিণতি জানি না আমি তার। বরং আমার ওই দুটো পথের ভিন্ন বিন্দুর শিশু এবং যুবকটিকে দেখার ইচ্ছে ছিলো খুব। যে শিশু ভুল করে টিকটিকি খায়নি কিংবা যে যুবকের কোনো গোপন নেই! আমার চোখ ভিজে আসছে কেন জানিনা। পূর্ণার কথা মনে পড়ছে বলেই হয়তো। আমার শ্রেষ্ঠ কবিতা। এই ডায়েরীর প্রথম দিকে তাকে নিয়ে প্রচুর লেখা আছে। আজকাল ভয়ানক মন খারাপ হয়, যে বিন্দুতে পূর্ণা বেঁচে আছে, ওই বিন্দুটা আমারও হেঁটে চলার পথ হতে পারতো।

পৃষ্ঠা প্রায় শেষ হতে চললো। জরুরি কথাটা বলি, আমি একটা মিথ্যে বলেছি। আমরা ব্যক্তিগত ডায়েরীতে সবসময় সত্য লিখি। মিথ্যেটা কেন লিখেছি আমি? সম্ভবত ওটা মিথ্যে নয়। আহসান ওইদিন বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর আর কখনো তার সাথে দেখা হয়নি আমার। তবে অবন্তীর সাথে হয়েছে। অবন্তীর সাথে আমার প্রথমবার অথবা দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছে। এক দারুণ অগ্রহায়ন সন্ধ্যায়। চকবাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছি। পৃথিবীটা যেন দুলে উঠলো চট করে। মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। যখন চোখ খুলি, একটা নরম হাত আমায় আঁকড়ে ধরে। আমি তাকিয়ে দেখি অবন্তী। বলি, ‘অবন্তী না?’

অবন্তী ভ্রুঁ কুঁচকে বলে, ‘নানা, আপনি আমায় চিনেন? কিছু মনে করবেন না, নানা ডাকলাম। আপনি আমার নানাভাইয়ের মতোন দেখতে।’ আমি টলতে টলতে বলি, ‘আমায় একটু বাসায় পৌঁছে দেবে তুমি?’ রিকশায় উঠে অবন্তী একহাতে জড়িয়ে ধরে রাখে আমায়। আমি সামনে তাকাই। একজোড়া কপোত কপোতি একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে রিকশায়। রিকশা স্বাভাবিকের চেয়ে ধীরে চলছে। অবন্তী ওদিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে, ‘সুন্দর না?’ আমি মাথা নাড়াই। অবন্তী মিষ্টি স্বরে আবৃত্তি করে, ‘নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি.. একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে, সকল প্রেমের স্মৃতি, সকল কালের সকল কবির গীতি…।’

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত