ভালবাসি

ভালবাসি

বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ এর চোখের বালি পড়ছিলাম।বইয়ের গভীরে প্রায় ঢুকেই গিয়েছিলাম।

–কফি খাবেন ?

অপরিচিত একটা কণ্ঠস্বর আমার মনোযোগটা নষ্ট করে দিলো।কিছুটা বিরক্ত হয়ে বইয়ের থেকে চোখ নামিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার আপাদমস্তক দেখছিলাম।

–দুঃখিত , আপনি মনে হয় বিরক্ত হচ্ছেন । না, আসলে অনেকক্ষণ যাবত লক্ষ্য করছি বসে আছেন এখানে।আমি যেহেতু কফি খাচ্ছি তাই ভাবলাম ভদ্রতার খাতিরে আপনাকে একবার জিজ্ঞেস করাই যেতে পারে। ছেলেটা তার কথাগুলো গড়গড়িয়ে বলে চলে গেলো ছাদের কর্ণারে।

গায়ে বাদামী রঙের একটা পাঞ্জাবি ছিলো।পাঞ্জাবির হাতা খানিকটা বটে রেখেছে।হাতের পশম লেপ্টে আছে কালো বেল্টের একটা হাতঘড়ি।চুলগুলো অসম্ভব সিল্কি ! ছেলেদের চুল এত সিল্কি হতে আমি আগে কখনো দেখিনি।চোখ দু’টো জুড়ে অসম্ভব মায়া ! নাকের বাম পাশে একটা ছোট্ট তিল।গালে খোঁচা খোঁচা চাপদাড়ি। গায়ের রঙ খুব একটা ফর্সা নয়।আমি এতটুকু ভেবেই আবার রবীন্দ্রনাথের আশালতার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। কিছুক্ষণ পর বইটা নামিয়ে দেখলাম ছেলেটা নেই।চলে গেছে হয়তো ! আমিও বই,চশমা,চুলের ক্লিপ আর মোবাইলটা নিয়ে ছাদ থেকে নেমে আসলাম। আমি আসলে খুবই শান্ত স্বভাবের একটা মেয়ে।গড়গড়িয়ে কথা বলতে জানিনা।সাদামাটা জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে চলছি।

প্রতিনিয়ত বই পড়া নেশায় পরিণত হয়েছে।তাই রোজ নিয়ম করে বই পড়তেই হয়।সংখ্যাগরিষ্ঠ কবিরা যেমন নিকোটিনের ধোঁয়ায় এক একটা বাক্যবাণের আবিষ্কারক আমরা রমণীরা সেই এক একটা বাক্যবাণে খুন হয়ে আবার পুনরায় জীবিত হওয়ার অনুপ্রেরণা পাই সেইসব লেখা থেকে।হাসি কান্না সব তাদের লেখায় কেমন করে জানি তারা তুলে ধরে।আমি প্রতিনিয়ত তাদের লিখায় মুগ্ধ হই।তারা নিজেদেরকে পুড়িয়ে এক একটি গল্প ফুটিয়ে তুলে আর আমরা সেই গল্পগুলো পড়ে নিজেদের বাঁচিয়ে তুলি।নতুন করে আবারও ভালবাসি।আবারও স্বপ্ন দেখি। যথারীতি আজও ছাদের বেতের চেয়ারটাতে বসে বই পড়ছি।

–বসতে পারি ?

বই থেকে চোখ উঠিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে দেখছি।আজ পরেছে সাদা পাঞ্জাবি ! কিছুই বললাম না।আবার পড়তে শুরু করলাম।ছেলেটাও দ্বিতীয়বার আর কিছু বলে নি।নিজে থেকেই ছাদের কর্ণারে চলে গেছে। আমি বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে তাকে দেখছি।সে হয়তো সামনের শহরটা দেখতে ব্যস্ত ! হঠাৎ সে এদিকে ঘুরতেই আমি আবার বইয়ে মুখ লুকালাম।

তৃতীয় দিন, আজও ছাদে গিয়েছি বই পড়ার জন্য।কিন্তু আজ এসে দেখি আমার আগেই ছেলেটা এসে বেতের চেয়ারে বসে আছে।আমি গিয়ে দাঁড়াতেই নিজ থেকে উঠে গেলো। ছেলেদের এইসব ছোট ছোট দায়িত্বগুলো ভালো না,একটা মেয়ের মনে এক টুকরো ভালো লাগার জন্ম দেয় হয়তো এই দায়িত্বগুলো। আমি চেয়ারটাতে বসে ছোট্ট করে একটা ধন্যবাদ দিয়ে দিলাম।সে স্বাগতম বলে ছাদের কর্ণারে চলে গেলো। আমি বইটা খুলে লুকিয়ে তাকে দেখছি।আজকের পাঞ্জাবিটা ছিলো আকাশী রঙের।যেন পুরো আকাশটা তার মাঝেই লেপ্টে আছে।হাতের কাপটাও আকাশী রঙের ! বাহ্ বেশ দেখাচ্ছে ।

এইভাবে রোজ বইয়ের আড়ালে তাকে এক একবার এক এক রুপে দেখতাম।ভালো লাগতে শুরু করলো তাকে।তার দায়িত্বগুলো আমায় আরও বেশি আকৃষ্ট করতো।রোজ সে দুটো কফি নিয়ে আসতো ছাদে।একটা আমার একটা তার।আমিও কেমন নির্লজ্জ ছিলাম, ভাবুন একবার! কফি রোজ খেতাম কিন্তু ধন্যবাদের উপরে একটি কথাও তার সাথে বলতাম না ।

কারণ প্রথমেই বলেছি,গড়গড়িয়ে কথা বলার অভ্যাসটা আমার নেই।স্বাভাবিক হয়ে কথা বলতেও জানি না।এতটুকু অনুভব করি যে, সে যখন কফি নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায় তখন আমার হার্টবিট দ্বিগুণ হয়ে যায়।আমি মরতে মরতে বাঁচি !এই মরতে মরতে বাঁচাটা কি এক অসম্ভব যন্ত্রণা ! এভাবে প্রায় পাঁচমাস কেটে গেলো। আজ ছয় মাসের প্রথম দিন। বই নিয়ে ছাদে গেলাম।প্রথম দিনের মতই মন দিয়ে বই পড়ছি।রবীন্দ্র সমগ্রের শেষ উপন্যাসটা পড়ার চেষ্টা করছি।শেষের কবিতার প্রায় শেষের পথেই আছি। কফি হাতেই তার উপস্থিতি টের পেলাম।কফিটা আমার সামনে অর্থাৎ টেবিলের উপর রেখে সে প্রতিদিনের মতই ছাদের কর্ণারে চলে যাচ্ছে।

–এই যে শুনুন..

আমার এই কথাটা শুনে হয়তো ছেলেটা ভীষণ অবাক হয়েছে।উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে সামনে এসে দাঁড়ালো।তার উৎসুক চোখ দুটো আমায় যেন গিলে খাবে! আমি তার চোখ থেকে ভীষণ কষ্টে চোখ সরিয়ে বললাম,

–রোজ কেন কষ্ট করে কফি আনেন,বলুন তো?

–তার আগে বলুন,আপনি কেন রোজ কষ্ট করে বই পড়েন? ছেলেটা আমায় উল্টো প্রশ্ন করলো।

–বই পড়ি বিশ্বকে জানতে।নিজেকে চিনতে।কিন্তু আমার বই পড়ার সাথে আপনার কফি আনার রহস্য কি?

–আমি কফি নিয়ে আসি আপনাকে বুঝতে,আপনাকে জানতে।আপনার সাথে কথা বলতে।যদিও সেই সুযোগটা হয় নি।

–তা, কতটুকু বুঝলেন আমায়,শুনি তো?

–একটুকুও না।আমি প্রতিদিনই আপনাকে দেখেছি বুঝতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু কখনোই আপনাকে বুঝতেই পারি না!

–বুঝার কি খুব দরকার ? আমি মৃদু হেসে উত্তর দিলাম।

–অন্তত সারাজীবন একসাথে কফি খাওয়া যায় কিনা এতটুকু বুঝতে পারাটা খুবই প্রয়োজন।ছেলেটা বিষণ্ণ হয়ে প্রশ্নটা করলো।

–যতদিন বেঁচে থাকি,রোজ একটা না হলেও সপ্তাহে একটা মাসে চারটা আর বছরে ৪৮টা বই আমার চাই চাই,দিতে পারবেন ?

–একটা লাইব্রেরি দিলে চলবে ? ছেলেটা হাসতে হাসতেই বললো।

–কেবল চলবে না,দৌঁড়াবে।আর কফিটা না হয় আমি বানিয়ে নিয়ে আসবো।মেয়েলি ভাবগুলো ছেলেদেরকে মানায় না।কি বলেন?

–জ্বি, কেন নয় ।

ছেলেটা মৃদু হেসেই উত্তর দিলো। সেদিন বেশ অদ্ভুতভাবে তার প্রপোজালটা এক্সেপ্ট করে নিলাম।সাদামাটা মেয়েটা আজ ভীষণ সংসারী। ৫-১২-১৯ উনাকে টেনে তুলছি লাইব্রেরিতে যাবো বলে।আজ উনার পছন্দের নীল রঙের শিপন শাড়িটা পরেছি।সাথে মিল করে দু’মুঠো কাঁচের চুড়ি পরে নিয়েছি।যাওয়ার পথেই তার বেলীফুলের মালা কিনে দেওয়ার কথা।কিন্তু মহারাজা দিব্যি ঘুমোচ্ছে !

আমিও ঘুমিয়ে থাকা মুখটা দেখছি।সেই প্রথম দিন যেমন বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে থেকে দেখেছি ঠিক একইভাবে আজ তার অজান্তেই তাকে দেখছি।রোজ নতুন করে এই পুরোনো মানুষটাকে ভালবাসছি।এই ভালবাসাটা এক অদ্ভুত নেশায় পরিণত হয়ে গেছে,ঠিক বইয়ের মত।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত