প্রতীক্ষার প্রেম

প্রতীক্ষার প্রেম

স্কুলের পঞ্চাশ বছরের সেই পুনর্মিলনী এর কথা আমার খুব ভালোভাবে মনে আছে। Boys’ School, Girls’ School- এক সাথে অনুষ্ঠানটি হয়েছিলো। দুদিন ব্যাপি স্থায়ী ছিল। অনুষ্ঠানটির কথা আমার মনে আছে তার কারণে। তাকে দেখি আমি এই অনুষ্ঠানেই। অনেকবার তাকে দেখেছি। কথা বলার অনেক সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু বলিনি। আমার লাজুক স্বভাবের কারণেই হয়তোবা। দুদিনে আমার একবারও মনে হয়নি যে, তাঁকে আমার অন্যরকম ভালো লেগেছে। তবে তাকে অনেকবার দেখতে চেয়েছি। পুরো অনুষ্ঠানের সময়টুকুতে আমার দুচোখ তাকে খুঁজেছে। সমস্যার শুরুটা হয় অনুষ্ঠান শেষের পর; বাসায় ফেরার পর। নির্দিষ্ট করে বললে রাতে শোয়ার পর। কাব্যিক ভাষায় বলতে গেলে শয়নে স্বপনে আমি শুধু তাকেই দেখি।

দুচোখের পাতা এক করলেই যেন তার শুভ্র কোমল মুখখানি চোখের সামনে ভেসে উঠে। কোথাও মন বসাতে পারি না। এক অজানা অনুভূতি আচ্ছন্ন করে রাখে মনকে। মাঝে মাঝে মনে হয় এত অস্থিরতা কেন তার জন্য? এটার নাম-ই কি ? আরও সমস্যা! অন্য যেকোন মেয়ের দিকে তাকালে আমার চোখের সামনে শুধু সে-ই ভেসে উঠে। কী কারণ কে জানে!? অনুষ্ঠানের প্রথম দিন সে একটি কালো শাড়ি পরা ছিল। ওহ, স্বর্গের অপ্সরীরা দেখতে কেমন হয়? আর ২য় দিন তার পরনে ছিল একটা কালো স্কার্টস আর একটা টপস্। (যদিও আমার পছন্দের রঙ নীল। কিন্তু কালো কেন?)দুদিনে তাকে অনেকবারই দেখেছি। তার নামটাই জানা হয়নি। কোন কথাও বলতে পারিনি। কারণ তখনও বুঝিনি সে আমার মাঝে এভাবে জায়গা করে নেবে।

এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে মুখচোরা আর লাজুক স্বভাবের আমি যেন অনেকটাই পাল্টে গেলাম। কলেজ পর্যায়ে বিতর্ক ক্লাবের সাথে খুব ভালোভাবে জড়িত ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও অনেক সংগঠনের সাথে জড়িয়ে যাই। এসব সংগঠনের পরিচিতির কারণে অনেক মেয়েবন্ধু জুটে যায় আমার। অনেক রূপবতী গুণবতী মেয়েদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ ঘটে। তাদের অনেকের সাথেই যে প্রেম করতে চাইনি তা নয়। চেয়েছি। কিন্তু সবসময়ই আমার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই শুভ্র কোমল মুখখানা। তাই আর কারো সাথেই শুধুই বন্ধুত্বের সীমানাটা বাড়াতে পারিনি। স্কুলের সেই পুনর্মিলনী এর উপর স্মরণিকা বের হল। সেখানে সবার নাম পরিচয় ছবি ছিল। তন্ন তন্ন করে স্মরণিকাটা ঘাঁটলাম। কিন্তু সেই মাতাল করা মুখটি খুঁজে পেলাম না। রাগে স্মরণিকাটা ছিঁড়ে ফেললাম। মুখ দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কিছু গালি বের হয়ে গেল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে উঠতে উঠে আমি কিছুটা তারকা হয়ে পড়লাম। বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম কারণটা শুধু তা-ই নয়। হাত দেখাতেও মোটামুটি পারদর্শী ছিলাম। জ্যোতিষি হিসেবে মোটামুটি বিখ্যাত হয়ে গেলাম। অনেক মেয়ের হাত ধরে বসে থাকতে পারতাম দীর্ঘ সময়। কিন্তু কোন অনুভূতি বোধ করতাম না। হায় জ্যোতিষি! নিজের ভাগ্যে কি ঘটবে নিজেই জানে না!! আদৌ জানিনা সে মেয়ের দেখা পাব কিনা। এই এক বছরে আমার নামে কিছু রটনাও রটল। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হলেও কারো সাথেই প্রেম করি না। এমনকি সময় নষ্ট করা প্রেমও নয়। সহপাঠিরা বলে ‘ভাব’। আবার শুধুমাত্র বান্ধবীর আধিক্যের কারণে “নারীবাজ” উপাধিটিও আমার সাথে জুটে গেলো। কিন্তু আমি জানতাম যতই বন্ধু-বান্ধবী থাকুক, আমার হৃদয়ে কেবল একটি চেহারা!! কেবল একটি মুখ!! কেবল একটি।

১ম বর্ষের নতুন আসা ছাত্র ছাত্রীদের নবীনবরণ হবে। আমাদের ডিপার্টমেন্টের নবীনবরণের দিন এক বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। প্রদর্শনী বিতর্কে দাঁড়ালাম। বেশ বলে যাচ্ছিলাম। বক্তব্যের মাঝামাঝি এসে হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেল এক মায়াবতী মুখের উপর। সেই শুভ্র কোমল মুখ। আমার কথাও আটকে গেল। পুরোপুরি চুপ হয়ে গেলাম। তারপর কোনমতে মান বাঁচিয়ে বক্তব্য শেষ করলাম। সেই অনুষ্ঠানেই আমি তার নাম পরিচয় বের করলাম। নামটা এখন উহ্য থাকুক। দরকার হলে বলা যাবে। কিভাবে তার সঙ্গে আমি কথা বলবো সেই চিন্তা আমাকে পেয়ে বসলো। আমি আবার কেমন জানি হয়ে যেতে শুরু করলাম।

আমি আবার আগের মতো হতে শুরু করলাম। সেই লাজুক ভদ্র স্বভাব আমার মাঝে ফিরে আসতে শুরু করলো। অনেক কষ্টে তার বান্ধবী আমাদের ক্লাবের মেয়ে বিন্দুর কাছ থেকে ফোন নাম্বার যোগাড় করলাম। সেই রাতেই তাকে call দিলাম। প্রথমে কথা বলতে রাজী হলো না। কয়েকদিন টানা ফোন করার পর শুধু বন্ধুত্বের শর্তে আমার সাথে কথা বলতে সে রাজী হলো। আমি অবশ্য তখনো তাকে আমার সত্যিকারের পরিচয় দেইনি। কয়েকমাস কেটে গেলো। ফেব্রুয়ারী আসলো। ফেব্রুয়ারীর ১/২ তারিখের দিকে চিন্তা করলাম তাকে আমার কথাটা বলে ফেলতে হবে। একরাতে একটা গোলাপ কিনে সেই খেলাটা খেলতে লাগলাম। “সে ভালোবাসে। ভালোবাসে না।” কি সৌভাগ্য আমার। উত্তর আসলো, “সে ভালোবাসে।” সে রাতেই ফোনে তাকে প্রস্তাব দিলাম। কিন্তু হায়! সে আমাকে সরাসরি না করে দিলো এবং প্রচণ্ড রাগ করলো। আমার সাথে শুধুই বন্ধুত্বের সেই শর্তের কথা মনে করিয়ে দিলো। এবং প্রচণ্ড রাগ করে ফোন কেটে দিলো। আমি পরবর্তীতে তাকে কয়েকবার ফোন করার চেষ্টা করলেও ফোন ধরলো না। হায়! আমি তাকে পেয়েও হারালাম। কিছুই করতে পারলাম না।

১২ ফেব্রুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ে হঠাৎ আড্ডা সরগরম হয়ে উঠলো। বিষয় পুরোটাই প্রেম-ভালোবাসা। হঠাৎ করেই তারা আমার কথা তুললো। আমার “নারীবাজ” উপাধিটি মনে করিয়ে দিলো। আমার কি হলো কে জানে। আমি হঠাৎ প্রতিবাদ করে উঠলাম বলে উঠলাম, “আমার সাথে এত মেয়েবন্ধুর পরিচয়। কিন্তু আমি কারো সাথে সময় কাটানোর প্রেমও করিনা।

বন্ধুরা বলল, “তুমি মিয়া, চাইলেই তো প্রেম করতে পারো। প্রেম করো না কেন? খালি ভাব মারো? নাকি তোমার কাউরে পছন্দ হয় না?” তারপর আমি সবাইকে আমার রাজকন্যার গল্প বললাম। তবে অবশ্যই গল্পের প্রথম অংশটুকু। তবে এটুকু বললাম যে তার দেখা আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়েই পেয়েছি। সবাই আমার দিকে একটু অন্য দৃষ্টিতে তাকালো। আমার সেই “নারীবাজ” উপাধিটা মনে হয় চলে যাবে। পরেরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখি সবাই আমার গল্প জেনে গিয়েছে। আমাদের ক্লাবে এসে ছেলেমেয়েরা সবাই আমার সেই রাজকন্যার পরিচয় জানতে চায়। আমি কিছুই বলি না।

১৪ ফেব্রুয়ারী। ক্যাম্পাসে বসে শুধু কপোত-কপোতী দেখছি। আমরা কয়েকজন সিট খালি থাকা মানুষ বসে আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎ ফোন এলো। তার ফোন!! হঠাৎ মনে হলো যেন আমি আশান্বিত হয়ে উঠলাম। ও ফোনে বললো, “ক্যান্টিনে চলে আসো।“ আমি কিছু ভাবার অবকাশ পেলাম না। দৌড় দিয়ে ক্যান্টিনে গেলাম। হঠাৎ ও, বিন্দু সহ ওর আর আমার কিছু বন্ধু আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। বিন্দু বলে উঠলো, “ভাইয়া, ঐদিন তো কত কথা বললেন? কিন্তু আমার এই বান্ধবীটিকে তো গত কয়েকমাস নাকি বিরক্ত করেছেন? কারণ কী? এটাতো ঠিক হয় নাই।“ আমি কিছুই বললাম না। ও বলে উঠলো, “আপনার নামটা নারীবাজ হওয়াটাই আসলে ঠিক হয়েছে। বুঝেছেন??“ আমি কেন জানি কিছুই বললাম না। ওরা রাগ করে চলে গেলো। আমি মাথা হেঁট করে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। তারপর বের হয়ে হঠাৎ অনিকের সাথে দেখা হলো।

সে বলল যে, তার দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা প্রেমটা হয়ে গেছে। আজ তার মনের মানুষ তাকে সম্মতি জানিয়েছে। হুহ! “সম্মতি!” আমি আনমনেই যেন বলতে থাকি। তারপর অনিক আমাকে বলে উঠে, “তোর সেই কালো শাড়িকে পেলে ভালো হতো”। আমি কিছুই বললাম না। দুইবন্ধু মিলে এক গাছের নিচে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পর অনিক ভেগে যায়। যাওয়ার আগে বলে, “ঐ বিশাল সুনীল আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাক। কোন কষ্টই আর কষ্ট থাকবে না। মন ভালো হয়ে যাবে।“

আমি গাছের নিচে বসে আশে পাশে তাকাই। জায়গায় জায়গায় কপোত-কপোতীরা বসে খেলা করছে। আমি শুধু দেখছি! আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ চকিত ফিরে পেলাম। চোখের সামনে একগুচ্ছ গোলাপ। তাকিয়ে দেখি নীল শাড়ি পরা এক রমণী দাড়িঁয়ে আছে। বললো, “সত্যি করে বলতো, আমি-ই কি তোমার সেই স্বপ্নের রাজকন্যা??”–আমি কিছু না বলে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলাম।

সে বলতেই থাকলো, “তুমি এতদিন ধরে আমার সাথে নাটক করলে। আর আমি নাহয় অল্প কিছুক্ষণের জন্য করলাম। রাগ করেছো?? তুমি আমাকে এতদিন বললে না কেন?”–বলতে বলতে সে আমার হাত ধরে পাশে বসে। হঠাৎ বলে উঠে, “আমার দিকে তাকাও।“–আমি তাকাই। স্বর্গের অপ্সরীর মতো রমণীটির চোখে শুধুই মুগ্ধতা, বিষ্ময়। আর অবশ্যই ভালোবাসা!! আর আমাদের মাথার উপর অনন্ত সুনীল আকাশ!!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত