রান্না ঘরে ঢুকেই পিছন থেকে দুই হাত দিয়ে স্ত্রীর চোখ চেপে ধরলাম। হাতে থাকা চামিচ হাঁড়ির ওপর রেখে দিয়ে আমার হাত ধরে বলে, “ছাড়ো জাকির, কেউ দেখে ফেলবে?” অস্বস্তিকর ভাবে বললাম, “কেউ দেখলে দেখুক। অন্য কারো চোখ তো ধরিনি?” মাজেদা আপা (বুয়া) দুজনের গুনগুন আওয়াজ শোনে ছোট করে তিন বার কাশি দিয়ে সতর্ক করলো। মাজেদা আপা লজ্জা পেয়ে চলে যাচ্ছে, আমি লজ্জা স্বরে বললাম, “মাজেদা আপা, তুমি থাকো। দুজনে মিলে রান্না করো খুব ক্ষুধা লাগছে।” মাজেদা আপা তিন বছর ধরে আমাদের পরিবারের ই একজন সদস্য। প্রথম প্রথম বুয়া বলেই ডাকতাম। কিন্তু আমার স্ত্রী ওকে এতোটাই আপন করে নিয়েছে ধরা চলে মাজেদাও আমাদের ফ্যামিলির একজন।
ভাড়া বাসায় থাকা অবস্তায় আমার স্ত্রী যতবারই অসুস্থ হয়ে পরে পাশে মাজেদা আপাই দাঁড়ায়। সেদিন স্ত্রীর ভীষণ জ্বর। আমার ডিউটি ছিল রাত্রি বেলায়। আমাকে বাসায় যেতে বার বার ফোন দিলেও ব্যস্ততার জন্য যেতে পারিনি। রাত্রি প্রায় একটার দিকে বাসায় ফিরতেই দেখি মাজেদা আপা স্ত্রীর মাথায় জ্বলপট্টি বেঁধে ফ্লোরে বসে আছে। দৃশ্য দেখে হকচকিয়ে গেলাম। “আরে মাজেদা আপা, তুমি এখনো বাসায় যাও নাই?” “কিভাবে যাই ভাইজান, থালা বাসন গুছিয়ে বাসায় যাব ঠিক এমন সময় আপার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠে। আর আপনাকেও বার বার ফোন দিল। আপনি আসলেন না বিধায় থেকে গেলাম”। আমি বুকের সাথে থুতনি লাগিয়ে মাথা নিচু করে করুণ স্বরে মাজেদা আপাকে যেতে বললাম। আমার স্ত্রী কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে, “ওর তো বাসায় কেউ নেয়। ও আমাদের সাথেই থাকুক না! আমারও কোনো ছোট বোন নেই। বোন হয়েই এ বাড়িতে থাকুক ও।” আমিও অনেক হিসেব মিলিয়ে দেখলাম ওর আজ অব্ধি কোনো ফল্ট পাইনি।
ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে বসে জহির রায়হানের ‘বরফ গলা নদী’ বই পড়তেছি। হঠাৎ মাজেদা আপা হাতে ব্যাগ নিয়ে বাহির থেকে এলো মনে হচ্ছে। ব্যাগ ভর্তি কাচা সবজি। পরক্ষণেই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি মুচকি হেসে দিলাম। সাথে মাজেদা আপাও মুচকি হেসে বললো, “ভাইজান হাসতেছেন কেনো? হেসে হেসে আমার স্ত্রীকে ডাক দিলাম। ও ড্রয়িংরুমে আসে। “হঠাৎ চিল্লাচ্ছো কেনো?” স্ত্রীর কথা শোনে শব্দ করে হেসে বললাম, “তোমার ছোট বোনের কাণ্ড দেখো! মুখে মেকাপ মাখতে মাখতে ওকে চেনায় যাচ্ছে না। তোমার মেকাপ সব শেষ করে ফেলেছে।”
মাজেদা আপাকে সোফায় বসিয়ে ও আবার রুম থেকে মেকাপ বক্স নিয়ে এলো। মাজেদা আপা বলে, “আপা এগুলো দিয়ে এখন কি করবেন?” আমার স্ত্রী মেকাপ বক্স খুলছে আর বলতেছে, ” সত্যি করে বলতো, আজ মেকাপ করে কোথায় গিয়েছিলে? কেউ আছে নাকি?” ও লজ্জার ভঙ্গিমা করে বলে, “না আপা, কি যে বলেন না কেউ নাই।”
পাশ থেকে আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “কেউ নাই বললেই হলো! একদিন বাড়িতে নিয়ে আসো না! দেখি ছেলেটি কেমন।” স্ত্রীও আমার সাথে সায় দিয়ে বললো, “হ্যা, তোমার ভাই তো ঠিকই বলেছে। বাসায় নিয়ে আইসো, আমরা দেখে শোনে বিয়ে দিয়ে দিবো।” মাজেদা আপা লজ্জা পেয়ে চলে গেল। স্ত্রী সারাক্ষণ ওর প্রশংসা নিয়ে পরে থাকে। “আজকাল কার যুগে ভালো বুয়া পাওয়াটাই মুশকিল। ভাগ্যগুণে ওরে আমরা পেয়েছি।”
আমি আর স্ত্রী দু’জনে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে আছি। হঠাৎ মাজেদা আপা গলা খাকার দিয়ে রুমে ঢুকলো। খুব বেশি জরুরী না হলে আমাদের রুমে আসে না। বুকের সাথে থুতনি লাগিয়ে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। আমি বললাম, “কিছু বলবে?” ও আগের অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে রইলো। ও আমার কথার উত্তর না দিয়ে স্ত্রীকে চোখ ইশারায় বাহিরে যেতে বললো। স্ত্রীও বাহিরে গেল। কিছুক্ষণ পর আবার রুমে এসে সাথে করে মোবাইল নিয়ে গেল।
৫/৭ মিনিট পর স্ত্রী মোবাইল হাতে নিয়ে রুমে আসে। ওরে বললাম, “মোবাইল দিয়ে মাজেদা আপা কি করলো?” স্ত্রী মুচকি হাসি দিয়ে বললো, ” কি করে বুঝো না? তার স্বপ্নের পুরুষ খেয়েছে কিনা, বাসায় গিয়েছে কিনা এগুলো জিজ্ঞাসা করলো।” আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “যাক মেয়েটার একটা গতি হবে মনে হচ্ছে।”
সকাল বেলা মাজেদা আপার হাতের চা না খেলে দিনটাই বৃথা। সোফাতে বসে বসে মুজা পড়তেছি। এমন সময় চা হাতে নিয়ে আস্তে করে মাজেদা আপা বললো, “ভাইজান, আজ অফিসে না গেলে হয়না?” আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “কেনো?” মুচকি হেসে বললো, “ভাইজান, আজ ও আসবে”। দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হয়নি। মেয়েটাকে আর লজ্জা দিতে চাইনি। এমনিতেই ও লজ্জায় লাল হয়েছে।
স্ত্রী গরুর মাংসো রান্না শেষ করে খাটের ওপর বসে বসে টিভি দেখতেছে। আমি বই পড়তেছি। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ আসে। বুঝতে বাকি রইলো না কে আসছে। দুজনেই তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে ড্রয়িংরুমে আসলাম। মাজেদা আপা দৌড়ে ড্রয়িংরুমের লক খোলে দিলেন। দুজনেই দরজার সামনে দাঁড়াতেই নিস্তব্ধ হয়ে রইলাম। তার স্বপ্নের পুরুষের হাতে মিষ্টির প্যাকেট। সদ্য দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির পিছনে রিকশা দাঁড় করানো। সম্ভবত সে রিকশা চালায়। মনে মনে বেশ আনন্দ লাগছে এটা ভেবে যে, দিন মজুর’রা কখনো খারাপ হতে পারে না। এদের ভালোবাসাটা সব মানুষের উর্ধে।
মাজেদা আপা ছেলেটিকে বাহিরেই দাঁড়াতে বললো। আর সে বাহিরেই কথা বলবে। স্ত্রী রাগ নিয়ে বললো, “সে কি কথা! বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকবে মানে? তুমিও যেমন আপন, তেমনি উনিও আপন। আপনি ভিতরে আসেন তো, ভিতরে এসে বসেন।” ওদের দু’জনকে এক সোফায় বসিয়ে রেখে স্ত্রী খাবার আনতে যায়। আমি চুপচাপ পাশের সোফায় বসে আছি। কিছুক্ষণ পর স্ত্রী সবার জন্যই মাংসের তরকারি আর পোলাও নিয়ে আসে। পরক্ষণেই ছেলেটি আমাদের সামনে মাজেদা আপাকে রাগান্বিত হয়ে বলে, “তুমি থাকতে ভাবী এসব করছে আর তুমি বসে বসে দেখতেছো?”
আমি ছেলেটির কথা শোনে মুখে হাসতে না পারলেও মনে মনে ঠিকই হাসছি। স্ত্রী হেসে হেসে বলে, “ওইতো বাড়ির সমস্থ কাজ করে, আজ না-হয় আমিই করলাম। ক্ষতি নেই তো।” টেবিল ছেড়ে সোফাতে বসে খাচ্ছি। ছেলেটি পরক্ষণেই বললো, “বাহ্, তুমি তো খুব ভালো রান্না করতে পারো।” ওর কথা শোনে স্ত্রীর গলায় খাবার আটকে গেল। মাজেদা আপা হাতের কুনই দিয়ে ছেলেটিকে আস্তে করে ধাক্কা বলে, “এতো কথা বলতেছো কেনো? খাও তো!” স্ত্রীর রান্নার কথা গোপন রেখে বললাম, “হ্যাঁ, ওর রান্না বরাবরের মতই ভালো হয়। এমন রান্না কখনো আর খাওয়া হবে কিনা জানি না।” খাওয়া দাওয়া শেষ করে ছেলেটিকে বিদায় দিয়ে তিন জনেই সোফাতে বসে বসে কথা বলতেছি। স্ত্রী মাজেদা আপাকে বিয়ের কথা বললো। মাজেদা আপা লজ্জা স্বরে বলে, ” ও আগে কিছু টাকা জমা করে নেক তারপর না-হয় বিয়ে করবো!” কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ওড়না দিয়ে মুখ লুকিয়ে রুমে চলে যায়।
(সমাপ্ত)