২০-৩-১৯৯৫ : আজ সায়মা প্রথম জানতে পেরেছে ও মা হতে যাচ্ছে।খবরটা আমাকে অবশ্য ও লজ্জ্বায় বলতে পারেনি! রাতে যখন অফিস থেকে আসি তখন ওকে সুয়ে থাকতে দেখে জানতে চাই কি হয়েছে।ও মুচকি মুচকি হেসেছিলো।পরে যখন জানতে পারি,তখন কি যে আনন্দ হচ্ছিলো…
২৫-৪-১৯৯৫ : আজ এক মাস পাঁচদিন পেরিয়েছে ওর।সকাল বেলা ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম।সব কিছু ঠিকঠাক আছে।তবে মাঝে মাঝেই বমি করে ও…
২০-৫-১৯৯৫ : ইদানিং ও কিছু খেতে চায় না।কোনো কিছুতেই নাকি স্বাদ পায় না! শুধু বমি বমি পায়।সারাদিন সময় দিতে পারিনা আমি। তবু চেষ্টা করি বার বার কল দিয়ে খবর নিতে।আম্মা অবশ্য সব সময় দেখাশুনা করে।তারপরও চিন্তা হয় আমার!
২২-৬-১৯৯৫ : তিন মাস পেরিয়ে গেছে ওর।এখনই অনেকটা দূর্বল হয়ে গেছে ও।সকাল বেলা অবশ্য অফিসে যাবার আগে খাইয়ে দিয়ে যাই আমি।কিন্তু কিছুই খেতে চায় না! ওর পছন্দের অনেক খাবার ডাক্তার খেতে মানা করেছে।বাচ্চার কথা ভেবে কখনো ভুলেও মানা করা জিনিস কিছু খায় না!
২১-৭-১৯৯৫ : আজ দুপুরে আমি অফিসে থাকতে সায়মা আমাকে কল করে। আজ ও মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলো।আমি তখনই বাসায় চলে আসি।হাতে একটু ব্যথা পেয়েছে!
২৮-৮-১৯৯৫ : আজ নাকি সায়মা প্রথমবার কিছু একটা অনুভব করেছে।বাচ্চার মুভমেন্ট টের পেয়েছে! যদিও ইদানিং ও খুব সহজেই রেগে যায়।আমি শুনেছি এ সময় এমন হয়।তবু মাঝে মাঝে রিয়্যাক্ট করে ফেলি!
২০-৯-১৯৯৫ : দেখতে দেখতে ছয় মাস পেরিয়ে গেছে।ওর চেহারাটা আগের মতো নেই।সুন্দর গাল দুটো কেমন কালচে হয়ে গেছে।চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে।শরীরের কাঠামোও পরিবর্তন হয়েছে।
২১-১০-১৯৯৫ : সায়মার শরীরটা এখন অনেকটাই বেড়ে গেছে।দেখলেই বোঝা যায়। অনেক্ষন কোথাও দাড়িয়ে থাকতে পারে না।ওকে কোনো ভারী কাজ করতে দেই না।বাবুর হাত পা নাড়ানোটা বেড়েছে।মাঝে মাঝেই রাতে কাঁদে ও।খুব যন্ত্রনা হয়…
২৩-১১-১৯৯৫ : ইদানিং ও শুধু টক খেতে চায়।আগেও খেতো। তবে এখন একটু বেশি।আমি এখন মাঝে মাঝেই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ওকে সময় দেই।বুঝি এই মুহুর্তটাতে ওর আমাকেই বেশি প্রয়োজন!
২৪-১২-১৯৯৫ : নয় মাস পেরিয়ে গেছে।আজ সকালেও ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিলাম।ডাক্তার বলেছে আরো কিছু সময় লাগবে।তবে মানসিক ভাবে যেনো প্রস্তুত থাকি।এত মাসের এত কষ্ট হয়তো আর কিছুদিন পরেই মিটে যাবে।এখন থেকেই সায়মা বাচ্চার জন্য জামা-কাপড়,কাঁথা,বালিশ,তেল,সোয়েটার,নাম সব কিছু রেডি করে ফেলেছে!
১৭-১-১৯৯৬ : সেদিন সকালে প্রতিদিনের মতোই আমি অফিসে যাই।কিন্ত ঘন্টা খানেক বাদেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়তে হয়।আম্মা ফোন দিয়ে বলে সায়মা বাথরুমে পড়ে গেছে!আমি বাসায় চলে যাই,এম্বুলেন্স কল করি!
তখনই এম্বুলেন্স আসে।ওকে নিয়ে হসপিটালে যাই।ডাক্তার বলেন দ্রুত অপারেশন করতে হবে।কিন্তু তার সাথে ডাক্তার যে কথাটা বলে সেটা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।ডাক্তার জানায় বাচ্চাটাকে বাঁচানো যাবে না।আর যদি বাচ্চাটাকে বাঁচাতে যাই তবে সায়মাকে হারাতে হতে পারে। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।আমার পক্ষে সায়মাকে হারানো কোনো ভাবেই সম্ভব না।কিন্তু সায়মা যখন ব্যাপারটা জানতে পারে।ও আমাকে ডাক দেয়। ও আমাকে বলে কোনো ভাবেই যেনো বাচ্চাটার কোনো ক্ষতি না হয়।প্রয়োজনে ও মরে যাবে।তবু বাচ্চাটা যেনো পৃথিবীর আলো দেখে!
আমি ওর কথা ফেলতে পারিনি।ওর আর্তনাদ আমি সহ্য করতে পারিনি। অবশেষে অপারেশন শুরু হয়।আল্লাহর অশেষ রহমতে দুজনেই বেঁচে যায়।সুস্থ ভাবে জন্ম নেয় আমাদের সন্তান।আমাদের খোকা সেদিনের পর থেকে প্রতিটা দিন, প্রতিটা রাত,প্রতিটা মুহুর্ত খোকাকে আগলে রেখেছে সায়মা।সারাটা রাত জেগে থেকেছে। সায়মার ত্যাগ,কষ্ট সব নিজের চোখে দেখে আমি বুঝতে পেরেছি একজন মায়ের ভালোবাসা!খুব অবাক হয়ে যেতাম ওকে দেখে।কতটা ত্যাগ করতে শিখে গেছে ও! সন্তানের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিতে পর্যন্ত পিছ পা হয়নি! মা হওয়াটা আমাদের কাছে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার মনে হয়।তবে সেই ৯-১০ মাস সন্তানকে নিজের শরীরের ভিতর আগলে রাখা থেকে শুরু করে প্রতিটা সেকেন্ড যে তীব্র যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়,তা একমাত্র ওই মা ছাড়া আর কেউ জানে না!
জানিনা খোকা কখনো ডায়রীটা পড়বে কি না।তবে সায়মার সাথে দীর্ঘ সময় পার করে বুঝতে পেরেছি, মা কি জিনিস।দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যখন শরীরের রক্ত ঘাম হয়ে ঝরে পড়েছে তখন বুঝেছি বাবা কি জিনিস! ভালো থাক খোকা,আমি কখনো না থাকলেও তোর মাকে সবসময় আগলে রাখিস! যেমন ভাবে সে তোকে আগলে রেখেছিলো মা তোর স্বর্গ,মা’ ই তোর জান্নাত!!
ডায়রীটা বন্ধ করে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছি।চোখের অশ্রুকণা গুলো অঝোরে ঝরে পড়ছে।শুধু মনে পড়ছে মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করার প্রতিটা মুহুর্ত।বাবা চলে গেছেন অনেক আগেই।মা ই আমাকে বড় করেছে! রুম থেকে বেরিয়ে ছুটে রান্না ঘরে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরি।এত দিনের না বলতে পারা কথাটা বলে দেই মাকে, মা..!! মাগো… আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি!!