নিলুকে বিয়ের কথা বলতেই তার চেহারাটা লাল হয়ে উঠে। মুচকি হেসে, লজ্জায় মুখ ডেকে সে রুমে চলে যায়। বোনের এই লাজুক হাসি মেহরাবের মনে অনিন্দ্য সুখ যোগায়। ভালো ঘর দেখে একটা বিয়ে ঠিক করেছে সে বোনের জন্য। ছোট বেলাতেই তাদের বাবা-মা মারা যাবার পর নিলুকে সে-ই মানুষ করেছে। আদর, স্নেহ, ভালোবাসায় লালিত বোনটি তার আজ অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। এবার সে দায়িত্ব থেকে মুক্তি নিতে চায়। ভাইয়ের মুখে বিয়ের কথাটা শুনেই নিলুর কেমন যেন অনুভব হচ্ছে। অদ্ভুত এক অনুভূতি। কিশোরী কাল থেকে মনের মাঝে লালিত সেই স্বপ্নগুলোর অবসান হতে যাচ্ছে। সে জানে না তার সেই স্বপ্নগুলোর অবসানটা কীভাবে হবে। তার স্বপ্নগুলো কি বাস্তবতার স্বাদ পাবে নাকি স্বপ্নগুলো স্বপ্ন হয়েই চিরতরে হারিয়ে যাবে?
গভীর রাত। পাড়ার ক্লাব ঘরে এলাকার কিছু যুবক আড্ডা দিচ্ছিল। সবার হাতেই জ্বলন্ত এক শলা সিগারেট। রাজুর চেহারাটা বিষণ্ন। পরপর তিন-চারটা সিগারেট শেষ করে ফেলেছে সে। নিকোটিনের ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত পুরো রুম। আলোর সামনে পিণ্ড আকারে উড়ছে সেসব। রাজু বিমর্ষ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে লম্বা করে নাকে-মুখে ধোঁয়া ছাড়ে। রাজুর সব থেকে কাছের বন্ধু আকাশ রাজুর পিঠ চাপরে বলে, “কিরে শালা, এমন নিস্তেজ হয়ে গেলি কেন? আবার কারো প্রেমে পড়ছস নাকি?” বলেই আকাশ সহ অন্যরা হাসে। “চুপ শালা, মজা নিবি না।” রাজুর কণ্ঠে কিঞ্চিৎ রাগ। রাজুর রাগ দেখে অন্যরা আরো হাসে। ওরা এমনি। সারাক্ষণ হাসি-তামাশা, আড্ডাবজি, মাঝেমাঝে কিছু নেশা, সিগারেট এসবেই তাদের দিন কাটে।
রাজু মলিন চেহারায় বলে, “দোস্ত, ঘর থেকে আমার বিয়ে ঠিক করে দিয়েছে!” রাজুর কথায় সবায় একসাথে হেসে বলে, কী বলছিস? তো এতে সমস্যা কী? বিয়ে কর, মাস্তি কর। কথাগুলো বলেই পুনর্বার সবাই হাসে। আকাশ বলে, “যখন তোর মুড থাকবে না, আমাদের খবর দিস, আমরাও শেয়ার করবো।” আকাশের কথায় আবারো হাসির ধুম পড়ে সকলের মাঝে। রাজু এবার খানিকটা রেগে বলে, “ঐ শালা, তোরা বুঝতে পারছিস বিয়ে মানে কী? বিয়ে মানে একটা শিকল। একটা বন্দীখানা। কারো নিকট কয়েদ হয়ে থাকা। আমার এসব ভালো লাগে না। আমি কারো কাছে কয়েদ হয়ে থাকতে পারবো না। আর কোনো মেয়েকেই আমি বিশ্বাস করি না।”
“তাইলে বিয়ের কথা না করে দে।” আকাশ সহজ ভঙ্গিতেই কথাগুলো বলে। “পাগল হইছস? বাবা-মা এমনিতেই আমার উপর খুব রেগে আছে। বলেছে এখন যে মেয়েটাকে তারা বিয়ের জন্য ঠিক করছে, ওকে যদি বিয়ে না করি, সোজা বাড়ি থেকে বের করে দিবে।” হতাশ কণ্ঠে কথাগুলো বলছিল রাজু, “কিন্তু তোরা তো জানিস, এসব বিয়ে টিয়েতে আমার পোষাবে না। আমি এসবে জড়াতে চাই না। মেয়েরা হল একটা কালসাপ, বুঝলি? এদের থেকে যত দূরে থাকা যায়, ততেই ভালো।”
রাজুর কথায় সবাই নীরবতা অবলম্বন করে। কিছুটা সময় নীরবতার মধ্য দিয়েই অতিক্রান্ত হবার পর আকাশ শান্ত কণ্ঠে বলে, “শুন দোস্ত, একদম চিন্তা করিস না। বিয়ে করে ফেল, কিছু দিন মোজ-মাস্তি কর, তারপর ভালো না লাগলে দু’চার দিন একটু আউলা-ঝাউলা করবি, দেখবি বউই তোরে ফালাইয়া ভাগবো।” আকাশের কথাটা মনে ধরেছে রাজুর। তার চেহারাটা উজ্জ্বল হহয়ে উঠে। মনে হয় যেন একটা মহা বিপদ থেকে রাজুকে উদ্ধার করেছে সে। অন্য সকলেই আকাশের এই তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রাজু যখন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, তখন রাজুর অন্য বন্ধু সায়মন হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বলে, “এবার তবে মালটা বের কর।”
সকলে উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ পেন্টের ভিতরে আণ্ডারওয়ার থেকে একটা পেকেট বের করে। কয়েকটা ইয়াবা ট্যাবলেট তাতে। সবার দৃষ্টিতে সেগুলোতে। মনে হয় যেন ওরা ওদের কামনার বস্তুটি পেয়ে গেছে। সকলেই একটা করে ট্যাবলেট চা চামচে রেখে মুখের কাছে নিয়ে নিচে লাইটারটা জ্বালিয়ে ধরে। খানিক বাদেই উত্তাপে ছড়ানো গ্যাসটা প্রাণ ভরে টেনে নিতে থাকে তারা। ধীরে ধীরে সকলের চেহারাতেই এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। চোখ জোড়া লাল, উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শক্ত হয়ে আসে চেহারা। ধীরে ধীরে সকলে গভীর সুখ কামনায় মত্ত হয়ে উঠে।
আকাশে দশমির চাঁদ। রাতের তাঁরারা মিটমিট আলো বিলিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণের ঝিরঝির বাতাসে বাড়ির পিছনের লতানো গাছগুলো দুলছে। জনালাটা খুলা থাকায় দক্ষিণা বাতাসের খানিকটা রুমে প্রবেশ করছে। তাতেই নড়ছিল খাটে সাজানো ফুল সজ্জার ফুলগুলো। খাটের চারদিকে মৃদু কম্পমান ফুলগুলোর মাঝে বধূ বেশে বসে আছে নিলু। লজ্জার আবেশে চেহারা তার রক্তাক্ত। শাড়ির পাড় ছাপিয়ে তার আলতায় রাঙ্গানো ডান পা খানিকটা বেরিয়ে আছে। মাথার অনেকটা অবদি টেনে রাখা গোমটায় মুখটা প্রায় ঢেকে আছে।
গভীর রাত হয়ে এসেছে। নিলু পূর্বের মতোই বসে। হঠাৎ দরজাটা কেৎ করে একটা শব্দ করে খুলে যায়। বরের বেশে ঘরে প্রবেশ করে রাজু। চেহারায় তার প্রবল বিরক্তি। রাজুকে দেখতেই নিলু বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তার বুকটা ধুরু ধুরু করে কাঁপছে। প্রচণ্ড লজ্জা, ভয় আঁকড়ে ধরে তাকে। তবে নিলু খুব বিস্মিত হয়, যখন তার সদ্য বিবাহিত বর তার সাথে কোনো কথা না বলে বিছানায় শুয়ে পড়ে। নিলু যেন বুকের মাঝে হঠাৎ প্রচণ্ড যন্ত্রণা অনুভব করে। তার মনে হতে থাকে তার বহু দিনের স্বপ্নগুলো যেন এক নিমিষেই ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেল। কোনো কথা বলতে পারে না সে। অনেকটা সময় অনড় হয়ে পূর্বের স্থানেই দাঁড়িয়ে থাকে। তার চেহারার সেই লাজুক ভাবটা আর নেই। সেখানে স্থান করে নিয়েছে রাজ্যের বিস্ময় আর হতাশা।
মনেতে ভর করেছে এক পাহাড় যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণার পাহাড় বইবার সামর্থ তার নেই। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে খাটের একটা কোণে গুপটি মেরে বসে থাকে সে। অনেক বেলা করে ঘুম ভাঙ্গে রাজুর। রুমে কাউকে দেখতে পায় না সে। আরও খানিকটা সময় বিছানায় গড়াগড়ি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ক্লাবে যায় রাজু। ক্লাব ঘরে অনেকেই আছে। রাজুকে দেখতেই সবাই চ্যাঁচিয়ে উঠে। আকাশ বলল, “কিরে, বউ তবে ছাড়লো ?” কথাটা বলেই পরিচিত সেই হাসি হাসে সকলে। সায়মন দুষ্টমির ছন্দে বলে, “চুপ কর তোরা। এখন রাজু কথা বলবে। তা বলতো রাজু, বাসর রাতে কেমন বিড়াল মারলি?”
রাজু বিরক্তি নিয়ে বলে, “চুপ শালা, কিচ্ছু হয়নি। তোদের কাছ থেকে গিয়েই তো ঘুমিয়ে পড়েছি।” সবাই হা করে রাজুর দিকে তাকিয়ে বলে, কী বলিস? এসব কেউ মিস করে? না পারলে আমাদের বলতি। এসব বলতে বলতে আবারো সবই খুব হাসে। এভাবেই শ্লীল-অশ্লীল ভাষায় অনেক কথা চলতে থাকে রাজু আর তার বন্ধুদের মাঝে। সব কিছুই তাদের জন্য স্রেফ আনন্দের খোরাক। তাদের মাঝে ভালোবাসা, মনুষত্ব, মমত্ববোধ এসব খুঁজা নিতান্তই বোকামি।
সারাদিন এখানে সেখানে কাটিয়ে অনেক রাত করে বাড়ি ফিরে রাজু। দরজা খুলে রুমে একটা পা রাখতেই এক রাজ্যের বিস্ময় ঘিরে ধরে তাকে। অপলক দৃষ্টিতে সে খানিকটা সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে খাটের কোণায় বসে থাকা এক তরুণীর দিকে। অপরূপ মায়াময় চেহারায় মাথায় গোমটা টানা এক পবিত্র তরুণী। যার দিকে অনন্ত কাল ধরে শুধু চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। তার অপূর্ব চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে দূর অজানায়। রাজুও যেন হারিয়ে গিয়েছিল।
“আপনার খাবারটা দিয়ে দিব?” সম্বিৎ ফিরে পায় সে নিলুর ডাকেই। নিলুর দিক থেকে চোখ জোড়া সরিয়ে সে এগিয়ে যায় খাটের দিকে। বিছানায় বসে, কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠেই বলে, “দাও।” খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে রাজু। নিলু একটা পাশে গুপটি মেরে শুয়ে আছে। রাজু সেদিকে তাকাতে গিয়েও তাকাতে পারছে না। প্রচণ্ড দ্বিধায় ভোগছে, মনের সাথে তীব্র এক যুদ্ধে পতিত হয়েছে সে । এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি রাজু। নিলুর চোখ জোড়া তখনো এক হয়নি। তার চোখের কোণে প্রশান্তির ঘুম নয়, ডিম লাইটের আলোতে চিকচিক করছে ফোঁটা ফোঁটা জল।
পূব আকাশে সবে মাত্র দিনমনির আগমন ঘটেছে। ভোরের এই সময়টাতেই ঘুম ভাঙ্গে রাজুর। এই সময় তার কখনোই ঘুম ভাঙ্গে না। রাজু কিছুটা বিরক্তি নিয়েই ঘড়ির দিকে তাকায়। আর সেই মহুর্তেই তার কানে মিষ্টি একটা সুর ভেসে আসে। রুমের কোণে, দক্ষিণের জানালার পাশে বসে নিলু মৃদু কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত করছে। নিলুর মিষ্টি কণ্ঠের সুরেলা তেলাওয়াত রাজুর অন্তর আত্মায় প্রবল আঘাত হানে। ঘুমের ভান করে শুয়ে থেকে সে নিলুর তেলাওয়াত শুনতে থাকে। তার অন্তরে যেন ঝড় বয়ে চলছে।
কোরআন তেলাওয়াত শুনতে শুনতেই রাজু আবারো ঘুমিয়ে পড়ে। অতঃপর অনেক বেলায় ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে বাহিরে চলে যায় সে। কেন যেন আজ আর তার ক্লাবে যেতে ইচ্ছে করছে না। হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় থানা শহরের দিকে। মনটা আজ তার বড্ড উতলা। উদাসীন পথিকের মতো দিক-বিদিক ছুটতে থাকে সে। কী যেন ডাকছে তাকে। উদ্দেশ্যহীন পথে হাঁটতে হাঁটতে একটা ফুল দোকানের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় রাজু। লাল টকটকে সতেজ একটা গোলাপ দেখে তার চোখ জোড়া জুড়িয়ে যায়। দীর্ঘ দিন হয়েছে ফুলের এই মুগ্ধ করা সৌন্দর্য তার উপভোগ করা হয় না। মন ভরে নেওয়া হয় না ফুলের সৌরভ। আজ যেন সেসব ডাকছে তাকে। প্রবল শক্তি সেই ডাকের। যা উপেক্ষা করার মতো নয়।
প্রতিদিনকার মতোই গভীর রাতে বাড়ি ফিরে রাজু। তার পিছনের দিকে লোকানো একটা লাল টকটকে গোলাপ। নিলু খাবার নিয়ে বসে আছে। রাজু ফিরতেই চঞ্চল হয়ে উঠে সে। রাজু ধীরে ধীরে খাটে গিয়ে বসে। তার খুব ইচ্ছে করছে নিলুর হাতে গোলাপটা গুজে দিতে। তবে সাহস হচ্ছে না। নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হচ্ছে তার। খাবার শেষ করে অনেকটা সাহস সঞ্চার করেই প্রশ্ন করে রাজু, “তুমি খেয়েছো?” খানিকটা সময়ের জন্য বিস্মিত হয়ে যায় নিলু। নিজেকেই যেন তার নিজের বিশ্বাস হচ্ছে না। বিমর্ষ কণ্ঠেই জবাব দেয় সে, “হ্যাঁ।” রাজু দ্বিতীয় বার আর কোনো প্রশ্ন করতে পারলো না। গোলাপটা বালিশের কাছে রেখেই শুয়ে পড়লো সে। বুকে জমাট বেধে থাকলো এক ঝাক কষ্ট।
রাতের শেষ ভাগে অকস্মাৎ রাজুর ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। পাশে হাত রাখতেই সে অনুভব করে নিলু নেই। বুকটা ধুপ করে উঠে তার। মাথাটা উঁচু করে পুরো রুম জুড়ে চোখ বুলাতেই একটা জায়গায় এসে চোখ জোড়া আটকে যায় তার। একটা জমাট বাধা অন্ধকার যেন নড়ছে। খুব মনযোগ দিয়ে দৃশ্যটা দেখছে রাজু। রাজু বুঝতে পারে, নিলু নামাজ পড়ছে। নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকে সে। তার অনুতাপ হয়, এমন পবিত্র একটা মেয়েকে সে কীভাবেই না এতদিন কষ্ট দিয়েছে। যে মেয়েটা তার ভরসায়, সবাইকে ছেড়ে তাকে আপন করে নিয়েছে, সে কিনা তাকেই অবজ্ঞা করেছে। রাজু অনুভব করে, বড্ড ভুল করে ফেলেছে সে।
অনেকটা সময় পর নিলুর নামাজ শেষ হয়। অতঃপর দুই হাত সৃষ্টিকর্তার দরবারে মেলে ধরে সে। রাজু বুঝতে পারে নিলু কাঁদছে। মেয়েটা যেন তার সব দুঃখ সৃষ্টিকর্তার সাথে ভাগ করে নিচ্ছে। অনেক কাল পর রাজুর চোখেও যেন কয়েক ফোঁটা অশ্রুর আগমন ঘটে। মাথাটা বালিশে রাখতেই চোখের কোণ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।
নিলু বিছানায় এসে শুতেই রাজুর অন্তর্জালা শুরু হয়। তার ইচ্ছে করছিল নিলুকে কিছু বলতে, তার কাছে ক্ষমা চাইতে। তবে কিছুতেই যেন সে পেরে উঠছিল না।
অদৃশ্য কোনো অশুভ শক্তি যেন তাকে বাধা দিচ্ছিল। নিজের সাথে অনেকটা সময় যুদ্ধ করে, বুকের মাঝে পাহাড় সমান সাহস সঞ্চার করে সে ডাকে নিলুকে, “নিলু, ঘুমিয়ে পড়েছ?” রাজুর কণ্ঠে হঠাৎ কথাটা শুনে নিলু কিঞ্চিৎ ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। বুকটা মুচড়ে উঠে। তার মনে হয় রাজু বোধহয় ঘুমের ঘোরে প্রলাপ বকছে। তবে একই ভঙ্গিতে দ্বিতীয় বারের ডাকে নিলুর ঘোর কাটে। নিলু কোমল কণ্ঠে বলে, “কিছু বলবেন?” রাজু উঠে বসে, সাথে সাথে নিলুও। রাজু অকস্মাৎ নিলুর একটা হাত টেনে ধরে আকুতি ভরা কণ্ঠে বলে, “আমাকে ক্ষমা করতে পারবে?” নিলুর যেন বিস্ময়ের বাধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। আবছা অন্ধকারে সে হা করে চেয়ে থাকে রাজুর দিকে। “কী বলছেন এসব?” নরম কণ্ঠে কথাটা বলল নিলু।
“সত্যি বলছি নিলু, খুব অন্যায় করে ফেলেছি আমি। সত্য কথাগুলো কী জান, আমি না খুব খারাপ ছিলাম। তবে তোমাকে আর তোমার মাঝেকার পবিত্রতা দেখার পর থেকে আমি কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি। এমন কোনো বদঅভ্যাস নেই, যা আমার নেই। ইয়াবা, গাজা, সিগেরেট, রাস্তায় মেয়েদের ইভটিজিং করা, বন্ধুদের সাথে সারাদিন আড্ডাবাজি, এটাই ছিল আমার জীবন। আমার বাবা-মা নিশ্চয়ই এটা তোমাকে কিংবা তোমার ভাইকে বলেনি। আসলে তারা চেয়েছিল আমাকে ভালো পথে আনতে। আর তাই তোমার মতো একটা মেয়েকে বেছে নিয়েছে। তবে আমি কখনো এসব বিয়ে টিয়েতে জড়াতে চাইনি।
মেয়েদের প্রতি আমার ছিল প্রচণ্ড রাগ। আরও প্রায় পাঁচ বছর পূর্বে তানিয়া নামের একটা মেয়েকে ভালোবেসেছিলাম আমি। তবে সে ধোঁকা দেয় আমাকে। আর তারপর থেকেই আমার এই ঘৃণ্য জীবন আর মেয়েদের প্রতি রাগ।” সহজ আর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে যাচ্ছিল রাজু। নিলুর চেহারায় বিস্ময়। তার হাতটা তখনো রাজুর হাতের মুঠোয়। আবারো কথা বলতে থাকে রাজু, “যদিও বাবার কথা মতো তোমাকে বিয়ে করি, তবে কখনোই তোমার সাথে সংসার করার ইচ্ছে ছিল না আমার। সেটা হয়তো ইতোমধ্যে তুমিও বুঝেছ। তবে তোমার কণ্ঠের পবিত্র কোরআনের সুর আমার অবচেতন মনের চেতনা জাগায়। আমি আমার নিজেকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে শিখি।”
মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথাগুলো শুনছিল নিলু। শুনছিল সে এক অন্ধকার পথিকের আলোর ফিরে আসার গল্প। শুনছিল এক ভুল পথে চলা মানুষের আত্মস্বীকারোক্তি। অন্ধকারে রাজুর চেহারাটা স্পষ্ট দেখা যায় না। তবে নিলুর অনুভব করতে কষ্ট হয় না, মানুষটা কাঁদছে। রাজু, নিলুর হাতটা ছেড়ে দিচ্ছিল। হয়তো তার মনে হচ্ছিল, এই হাত ধরে রাখার অধিকার তার নেই। তবে নিলু তা হতে দেয়নি। সে রাজুর হাতটা শক্ত করে ধরে বলে, “আলোর পথের সঙ্গি হয়ে আমার হাতটা ধরে চলতে পারবে না?”
রাজু কষ্ট মাখানো একটা চাপা ঢুক গিলে বলে, “না, তবে তুমি এভাবে শক্ত করে ধরে আমাকে টেনে নিলে পারবো।”
নিলু কান্না মাখা একটা হাসি দিয়ে, রাজুর হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বলে, “বিনিময়ে আমি কী পাব?” অনেকগুলো দিন পর রাজু মুচকি হাসে, সেই হাসিতে পবিত্রতার রেশ খুজে পাওয়া যায়। রাজু বালিশের পাশ থেকে গোলাপটা এনে নিলুর সামনে দিয়ে বলে, “এটা পাবে, চলবে?” ফুলটা নিয়ে নিলু আর একটাও কথা বলে না। মাথাটা রাজুর ঘাড়ে রেখে জড়িয়ে ধরে তাকে। তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে সুখের অশ্রু। তার মুষড়ে পড়া স্বপ্নগুলো অবশেষে বাস্তবতার স্বাদ পেল। রাজু পেল পবিত্র আর অনিন্দ্য সুখের সন্ধান।