ভালোবাসা

ভালোবাসা

আমি খাটের উপর বসে আছি। একটা পায়ের উপর আরেকটা পা তুলে। তাকিয়ে আছি সামনের দিকে। কোন ভাবেই চোখ সরাচ্ছি না। শ্বাস নিতে আমার কষ্ট হচ্ছে। তার পরও নিচ্ছি। কষ্ট করেই নিচ্ছি। আমার মাথায় ঘুরছে কবর। কোথায় আমি শুবো। মরে গেলে কোথায় কবর দিবে, তাই ভাবছি এখন। বাড়ির পাশের ঐ যে খালি জায়গাটা; ও খানে দিলেই বোধহয় ভালো হবে। এ চিন্তাকে ছাপিয়ে কেবলই মাথায় আসছে আমার ছোট ছোট ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ। আমার পরিবার, আমার সংসারের চেহারা। কি ভাবে চলবে এরা। কোথা থেকে খাবে। খাবার দাবার খেলেও আমার মত আদর সোহাগ কি তারা পাবে? আমাকে ছাড়াও কি সুখে থাকতে পারবে?

আমি মরে যাবো কয়েক দিন পর। আর অল্প কয়েক দিন আছি। খুবই অল্প কয় দিন। ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়েছে। এবং খুবই বাজে অবস্থা। তিনদিন হলো ধরা পড়েছে। জেলা শহরে পরিক্ষা করিয়েছি এর আগে। যখন প্রচন্ড বুক ব্যথা হয়ে ছিল। কিন্তু কোনো কাজ হয় নি। ধরতে পারেনি ডাক্তার। কোন ওষুধ পত্তরে যখন ভালো হচ্ছি না, ঢাকায় এলাম। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার রিপোর্ট দিল। আমি জানতে পারি নি ডাক্তারের রিপোর্টে কি ছিল। এতোটা কঠিন কোন রোগে পড়বো কল্পনাও করতে পারি নি। আমার সাথে আমার মেয়ে, নাতনি, আমার শ্যালক ছিল। ডাক্তারের রিপোর্ট আসার পর মূলত তারাই আমাকে জানায়নি।

আমি ভেঙ্গে পড়বো তাই। হাসপাতালে আসার পর চিকিৎসা করা ছাড়া যখন কোনো রুগিকে রিলিজ দিয়ে দেয়, আর আশ পাশের আপন লোকগুলোর চোখ ফুলা, ফুলা থাকে, তখন আসলে কারোই বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয় যে, সে কোনো কঠিন রোগে আক্রান্ত। তার চিকিৎসা সম্ভব নয় বলেই যে তাকে বাড়ি পাঠাচ্ছে, ঠিকই সে বুঝে নিতে পারে। আসলে আমারও তেমন কষ্ট হয় নি। আমিও মরণ কোন ব্যাধির কব্জায় পড়েছি। বুঝে গেছি। বাড়ি আসার পর শত শত মানুষ আমাকে দেখতে আসছে। আমার সাথে কথা বলছে। ক্ষমা চাচ্ছে। আমার বাড়িতে এখন মানুষের উপচে পড়া ভীড়। এ মানুষ যখন আমাকে দেখে উঠোনে দাঁড়ায় তখন আমাকে নিয়ে আলোচনা করে। আমার ঠিক কি হয়েছে, এক জন আরেক জন কে বলে। তাদের ফিসফিসে চাপা কন্ঠের অস্পষ্ট স্বরেই আমার নিকট পষ্ট হলো আমার রোগের কথা। আমি নাকি মরে যাবো কয়েক দিন পর। আমার নাকি ক্যান্সার হয়েছে। ফুসফুসে ক্যানসার হয়েছে। এবং খুবই বাজে অবস্থা।

আমি লোকটা কেমন ছিলাম। একটা প্রশ্ন। এর উত্তর যে যাই দিক, আমি বলবো আমি ভালো ছিলাম। হ্যা, আমি ভালো ছিলাম। মানুষের বিপদে আপদে পাশে থেকেছি। হাসপাতালের খরচ দিতে না পরলেও অসুস্থকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিতে সামান্যও অলসতা করি নি। বৃষ্টি বাদল উপেক্ষা করে নিয়ে গেছি। ঝগড়া বিবাদ নিষ্পত্তি করে দু পক্ষের মাঝে সমঝোতাও কম করি নি। অনেক করেছি। লাভ লোকসানের কথা ভাবি নি। আমাদের সংসারের জন্য কলুর বলদের মত অনেক কাল ঘানি টেনেছি। এখন টানছি নিজের সংসারের জন্য।

আমার কয়েকটা মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত। তাদের উপযুক্ত পাত্রস্থ করতে হবে। একটা নাতনিকে বিয়ে দিয়েছি একটা গ্রামে।জামাই ভালো না হওয়ায় তাকে আমার কাছে নিয়ে আসি। আরেক জায়গায় বিয়ে দেবো ভেবেছি। আমার ছেলে এখনো ছোট। উপযুক্ত হয় নি। সংসারের দায়িত্ব নেবার মতো, না যোগ্যতা হয়েছে, আর না, সে মানুষিকতা আছে। জায়া তো আছেই। সব মিলিয়ে কিছু মানুষের নির্ভরতা ছিলাম আমি। কিছু মানুষের মুখে আমি হাসি ফুটাতান। আমার উপর নির্ভর করে তারা সজাচ্ছিলো তাদের স্বপ্নগুলো।

সিগারেট খেতাম আমি। প্রচুর পরিমান সিগারেট খেতাম।পকেটে টাকা থাকা মানে ঠোটের আগায় সিগারেট। একটা দু’টো না। দিনে অসংখ্য সিগারেট। কাজে স্পৃহা আনতে সিগারেট ধরাতাম। বল নেই শরীরে। দূর্বল দূর্বল লাগছে। দূর্বলতা কাটাতেও সিগারেট। আমি মাঝে মাঝে গাছের কাজ করতাম। গাছের কাজ মানে, গাছ কাটা, সে কাটা গাছকে পরিমাপমত খন্ড খন্ড করা। সেগুলোকে ‘স মেলে নিয়ে চিরানো। অনেক সময়ের প্রয়োজন। সকালে শুরু করলে প্রায় বিকেল হয়ে যায়।

এ কাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার মুখে বিড়ি শোভা পেত। দু’ প্যাকেট, তিন প্যাকেট সিগারেট শেষ করে ফেলতাম নিমিষেই। কোনো প্রকার লিলা বা কার্পণ্য করা ছাড়াই। বাড়ির জন্য সদাই করতে হিসেবি ছিলাম। ছেলে মেয়েদের খরচেও হিসেব। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা পাইও হাত থেকে খসাতাম না। আমার যা একটু উদারতা আর যে টুকু বে হিসেবি হওয়া তা কেবল ঐ সিগারেটের ক্ষেত্রেই। সিগারেট কে আমি ভালো বেসেছি জান দিয়ে, প্রাণ দিয়ে। হৃদয়ের সবটুকু আবেগ উজাড় করে।

আমার ভালোবাসা আমায় ধ্বংস করেছে। আমার স্বপ্ন, আশা আকাংখা ধূলিসাৎ করে উড়িয়ে দিয়েছে। আমার পরিবারের চোখে জল এনেছে। আমি বেঁচে থাকতেও আমার সন্তানদের করেছে এতিম। আমার জায়াকে করেছে বিধবা। আমার নাতনিকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছি তা গলা টিপে রোধ করেছে। আজকে এ অন্তিম বেলায় ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী, আদরের নাতনি বলতে বড়ই ইচ্ছে করছে, আমায় ক্ষমা করো। আমি তোমাদের জন্য কিছু করে যেতে পারি নি। কিছুই করে যেতে পারি নি। এ বিশাল পৃথিবীতে তোমাদের একা রেখেই চলে যাচ্ছি। তোমরা ভালো থেকো। সুখে থেকো।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত