মিহিনের ফোন আসে আবার। আমার মেজাজ এমনিতেই খারাপ ছিল। তারউপর ওর এমন বারবার ফোন দেওয়াতে মেজাজটা আরো বেশি খারাপ হয়। আমি এবারেও ফোন কেটে দেই। ও আবার ফোন দেয়। বিরক্তি চরম সীমানা পেরিয়ে যায়। রাগ হয়ে অনেক। ফোন ধরেই বলি,
-এতো ফোন দিচ্ছিস কেন? সমস্যা কী তোর? দেখিস না ফোন কেটে দিচ্ছি। তারপরও আবার ফোন দিচ্ছিস।
ও অনেকটা সময় কিছু বলে না। চুপচাপ থাকে। আমি রাগে ফোঁস ফোঁস করতে থাকি। গা দিয়ে যেন আগুন বের হয়। দু’কান যেন জ্বলে যাচ্ছে। মিহিন শান্ত স্বরে বলে,
-কী হয়েছে তোমার? রেগে আছো কেন? ওর শান্ত স্বরটাও বড় তিক্ত লাগে আমার কাছে। মারাত্মক রাগ আমার। একবার চড়ে গেলে মাথা ঠিক থাকে না। কী থেকে কী বলে ফেলি নিজেরই খেয়াল থাকে না। বলি,
-রাগ উঠছে। এ কারণে রেগে আছি। এতো কৈফিয়ত দেয়ার সময় নেই আমার। আমি ফোন কেটে দেই। বিছানার উপর বসে থাকি। গা গরম হয়ে যায় অনেকটা। মাথাটা ঝিমঝিম করে। এই শীতের মাঝেও আমি ঘামতে থাকি। হঠাৎ আবার ফোন বেজে উঠে। স্ক্রিনে মিহিনের নাম। আমি ধরি না। সাইলেন্ট করে রেখে দেই। মিহিন অনেকক্ষন ফোন দিতে থাকে। আমি ফোন ধরিও না। ফোনের দিকে তাকাইও না। গায়ের জামা খুলে ফেলি। গা দিয়ে ঘাম টপ টপ করে পড়তে থাকি। আম্মাকে আবার ফোন দেই। রিঙ হয়। আম্মার ফোন ধরেন। আমি গম্ভীর স্বরে বলেন,
-কী অবস্থা ওখানের? আম্মার গলার শব্দ শুনি না। বুঝতে পারি ওপাশের অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। হঠাৎই আব্বার গলার আওয়াজ পাওয়া যায়। সেই কর্কশ কণ্ঠ। বলেন,
-তোর সিদ্ধান্ত কী? আমি অনেকটা সময় চুপ থাকি। বলি,
-দেখেন আব্বা, আমি আপনাকে আবারো বলছি, আপনি আমার কথাটা একটু মনযোগ দিয়ে শুনুন। আ…
-চোপ! এতো বেশি কথা বলবি না তুই? সংক্ষেপে বলে ফেল, তুই কি বাসায় আসছিস? নাকি ওই মেয়েই তোর শেষ সিদ্ধান্ত?
-আব্বা একটু বোঝার চেষ্টা করেন প্লীজ! ওই মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি। ওকে ছাড়া…
-এসব ডায়লগবাজি বন্ধ কর। ছাব্বিশ বছর ধরে তোকে পালছি। কই কখনই তো বলিসনি আমাদের ছাড়া তুই থাকতে পারবি না। এখন দুই বছরে প্রেম করে বলছিস ওই মেয়েকে ছাড়া তুই বাঁচবি না? এই দুই বছরে সে কী এমন দিল যে তুই আমাদের ছাব্বিশ বছরের ভরণপোষণ ভুলে গেলি?
-এভাবে বলবেন না আব্বা। ওকে আমি ভালোবাসি। পছন্দ করি।
-এসব আমাকে বলে লাভ নেই। তুই কাল সকালে বাসায় আসছিস।
এলে আমাদের বাবা ছেলের সম্পর্ক থাকবে। না এলে আমি তোকে ত্যাজ্য করে দিবো। বাবা ফোন কেটে দেন। আমি মর্মান্তিক অবস্থায় বসে পড়ি বিছানায়। বাবার প্রতি রাগ হয়। বড় নিষ্ঠুর মনে হয় তাকে। এতো পাষাণ হলেন কেন তিনি? আমাকে কেন বুঝতে পারেন না? রুমের দরজার কাছে সাদিক এসে দাঁড়ায়। কানে ফোন ধরে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-এই তো নিজের বিছানায় বসে আছে। নাও কথা বলো! তারপর কাছে এসে ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
-নে, মিহিনের সাথে কথা বল। তোর ফোন ওয়েটিং পাচ্ছে নাকি! ধর? আমি ওর দিকে তাকিয়েই থাকি কিছুক্ষন। ফোন নিয়ে কানের কাছে ধরে বলি,
-তোর সমস্যাটা কী বল দেখি? তোকে না বলেছি ফোন দিতে না? কথা কী কানে যায় না নাকি?
ও খানিকটা আহত স্বরে বলে,
-তোমার কী হয়েছে তাসফি? এভাবে কথা বলছো কেন?
-তো কীভাবে কথা বলবো আপনার সাথে? আদর সোহাগ দিয়ে? সরি, এসব বের হচ্ছে না এখন। ফোন রাখ। আর যদি ফোন দিস তো খবর আছে তোর। রাখ? ও পাশ থেকে ফোঁপানোর শব্দ পাওয়া যায়। বলি,
-খবরদার কাঁদবি না। এই ন্যাকা কান্না শুনলে গা জ্বলে আমার। আমি ফোন কেটে দেই। সাদিক অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। অবাক স্বরে বলে,
-হয়েছে কী তোর? ওর সাথে এভাবে কথা বললি কেন?
-তো কীভাবে বলতাম? আদর সোহাগ আর বের হয় না ভেতর থেকে আর। আমি আর পারছি নারে ভাই। দমটম বন্ধ হয়ে আসছে। এতদিন ছিল এই মেয়ের বিয়ের প্রেশার। চাকরি ছিল না। কোনো রকম গিলে নিলাম সেটা। এখন চাকরি হলো। বাবাকে ওর কথা বলব ভাবছিলাম। কিন্তু তার আগেই বাবা যা শোনালেন তার জন্যে আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমি অনেকটা ফোঁস ফোঁস করতে করতে কথা গুলো বলে ফেলি। সাদিক বলে,
-আঙ্কেল কী করলেন আবার? আমি চুপ করে থাকি। কিছু বলি না। সাদিক বলে,
-কিরে? আমি বলি,
-আমার অবস্থানটা এখন এমন যে আমার ইচ্ছে করছে আত্মহত্যা করি এখন।
-আরে ভাই তোর হয়েছেটা কী? আমি এবারেও কিছু বলি না। অনেকটা ছন্নছাড়ার মতো বের হই রুম থেকে। সাদিকও বেরিয়ে আসে। বলে,
-কী ব্যাপার? কই যাচ্ছিস তুই? আমি চুপ থাকি। বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি। সাদিকও আমার পেছন পেছন আসে। বলি,
-পিছু নিস না। আহি সুইসাইড করবো না। মন মেজাজ ভালো না। তাই একটু ঘুরতে যাচ্ছি। সাদিক কাছে এসে বলে,
-মন মেজাজ আমারও ভালো নয়। চল দুজন মিলে যাই। এক কাজ করা যাক। আমরা ক্যাম্পাসের দিকে যাই। ঘুরে আসি। মন ভালো হয়ে যাবে। কী বলিস? আমি কিছু বলি না। চুপচাপ হাঁটতে থাকি। সাদিকও আমার সাথে চলতে থাকে। আমরা অনেকটা পথ হাঁটি। আকাশে পূর্ণিমার ঝলসানো চাঁদ। কী নিপুণ ভাবে আলো দিচ্ছে। গাছের পাতার ফাঁক গলে সেই আলো রাস্তায় পড়ছে। আমরা তা মাড়িয়ে অনেকটা পথ চলে আসি তখন। একটা বেঞ্চিতে স্থির হয়ে বসি। ধীরে পরিবেশের সাথে মনটা স্থির হয়ে আসে। শান্ত হয়। তবে বুকের কাঁপনটা যেন থেকেই যায়। অনেকটা সময় পর বলি,
-আমি কি মিহিনের সাথে খুব বাজে বিহেভ করে ফেলেছি? সাদিক তাৎক্ষণিক জবাব দেয়। যেন এর অপেক্ষায়ই ছিল। বলে,
-বাজে বলতে? আমি তোকে কখনই এভাবে কথা বলতে দেখিনি। কারো সাথেই না। সত্যি বলতে আমি নিজেও খানিকটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি আনমনা হয়ে বলি,
-মেয়েটা ফোঁপাচ্ছিল। কেঁদে দিয়েছে মনে হয়। তাই না?
-কাঁদাটা অস্বাভাবিক নয় বন্ধু। আমার অস্বস্তি হতে থাকে। বলি,
-চল, আরেকটু ঘুরে আসি।
সাদিক মুচকি হাসে। কিছুই বলে না। যেন সে আগ থেকেই জানত আমি এমন কিছুই বলব। রাত তখন একটা বাজতে চলেছে প্রায়। গাড়িঘোড়ার আনাগোনা কমে এসেছে। লোকজন তেমন নেই। এই এলাকাটা অবশ্য অনেকটা শান্ত থাকে। তেমন কোলাহল নেই। আমি মিহিনদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে। আমার পাশে আমার প্রিয় বন্ধুটি। আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ও হাঁটা ধরে। কিছুদূর গিয়ে বলে,
-ফোন তো নিয়ে আসিসনি। আমিই ফোন করে দিচ্ছি। আর ওইদিকে আছি আমি। চিন্তা করিস না।
আমি ফুটাপাতের উপর বসে পড়ি। কিছুক্ষন পরই মিহিনের বারান্দার দরজা খোলা হয়। আমি নিচ থেকে ওকে দেখি। মেয়েটা আবার ভেতরে চলে যায়। নিচে নামে। দ্রুত গেইট খোলা হয়। দৌড়ে আসে আমার কাছে। আমি ভালো করে দেখি ওকে। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই তার চেহারার কী অদ্ভুত পরিবর্তন হয়ে যায়। চোখ গুলো ভেজা ভেজা লাগে। ও আমার পাশে এসে বসে; একটু দূরত্ব রেখে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। ও নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। মুখ মলিন। কান্না করে দিবে যেন। অল্প কিছু পরেই ওর ফোঁপানোর শব্দ পাই। আমি ওর দিকে সরে আসি একটু। গা ঘেঁষে বসি। ওর হাত ধরতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আমার বাজুর কাছে কপাল ঠেকিয়ে কান্না করতে থাকে। আমি বলি,
-আ’ম সরি মিহিন। মিহিনের কান্নার গতি আরেকটু বেড়ে যায়। গা কাঁপিয়ে কান্না করে ও। ভেজা স্বরে বলে,
-তুমি আমায় বকেছো কেন? হু? কী বাচ্চা সুলভ অভিযোগ তার। বলি,
-রাগ উঠেছিল। তাই। তুমি তো জানো আমার কেমন রাগ।
-জানি তো। কুত্তা রাগ তোমার। আমি হাসি খানিকটা। ও হাসে না। বলে,
-আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি তাসফি। তুমি আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছো। আমি ওর সামনে গিয়ে কান ধরে বসি। বলি,
-সরিইই মিহিন! মিহিন কান্না মিশ্রিত হাসি দেয়। আমাকে জড়িয়ে ধরে। বলে,
-যাই করো তুমি, আমি সহ্য করে নিবো। তবুও আমাকে ছেড়ে যেও না। তুমি না থাকলে আমার যে কী হবে আমি নিজেও জানি না। আমি কিছু বলি না। কেবল পরম আত্মবিশ্বাসের সহিত তাকে জড়িয়ে ধরে রাখি। বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেকটা সময় হয়ে যায়। আমি আর সাদিক কেউই তেমন কোনো কথা বলিনি আসার সময়। রাতে ঘুমানোর আগে ব্যাগ গোছানোর সময় ও বলে,
-কই যাচ্ছিস? আমি একবার ওর দিকে ফিরে তাকাই। আমার চোখ তখন ভেজা ভেজা। তারপর হুট করেই ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেই। সব কথা খুলে বলি ওকে।
-বাবা আমার জন্যে পাত্রী ঠিক করেছেন। ভালো কথা। কিন্তু তিনি সেখান পর্যন্তই স্থীর থাকেননি। ডেট ফিক্সড করে ফেলেছেন। আত্মিয়দের দাওয়াত দেয়া শুরু করেছেন। অথচ এর কিছুই আমি জানলাম না। এখন আমাকে কালকের মধ্যে বাসায় যেতে বলেছেন। না গেলে আমি পরিবার হারাবো। আর তুই তো জানিস, আমার পরিবার আমার জন্যে কী! ও চট করেই বলে উঠে,
-মিহিন? ওর কী হবে? তুই ভেবে দেখেছিস ও যখন জানতে পারবে তোর অন্য কোথাও বিয়ে হচ্ছে তখন ওর কী হবে? বাঁচতে পারবে ও?
-আমার কিছুই করার নেইরে। আমি বন্ধি হয়ে আছি। হ্যাঁ, একটা কাজ করা যায়। সুইসাইড করতে পারি। কিন্তু তুই তো জানিস,এই ব্যাপারটা আমি কতটা ঘৃণা করি।
-বুঝলাম, মিহিনও সুইসাইড করবে না। সেটাও জানি। কিন্তু মেয়েটা এই খবরটা নিতে পারবে কি না তা শিওর বলতে পারি না। এমনও হতে…
-থাক না। খারাপ লাগে আমার। যে কয়দিন সময় পাবো আমি বাবাকে বুঝানোর চেষ্টা করবো। এরপরও যদি না বুঝেন…
-তাহলে?
-আমার দেখা পাবি না আর। মুখ দেখাতে পারবো না এই নগরীতে।
বাসায় আসলাম পরের দিনই। মনে হচ্ছিল দেহটা টেনে নিয়ে এসেছি বহু কষ্ট করে। কিন্তু মনটা ওই শহরের একটা মেয়ের কাছে ঠিকই রয়ে গেছে। বাসায় এসে কারো সাথেই কথা বলিনি। সোজা নিজের রুমে চলে আসি। ফ্রেশ হই। জামা কাপড় বদলে চুপচাপ বিছানায় বসে থাকি। মনে কেবল একটাই চিন্তা, মিহিনের কী হবে? বাবা রুমে আসেন। বলেন,
-আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো? আমি বাবার দিকে তাকাই একবার। মেকি হাসি। বলি,
-জ্বী না। হয়নি।
-বেরিয়ে আয়। কিছু খেয়ে নে? আমি মাথা নামিয়ে নেই। খাবার খেতে যাই। চুপচাপ খেয়ে উঠে যাই। বাবা ডাক দেন।
-তোর মায়ের সাথে কথা বলবি না? আমি মুখে একটা হাসি রাখি। অথচ আমার ভেতরটা কী ভীষণ জ্বলছে। বলি,
-মা কোথায়?
-কই আর? রান্না ঘরে দেখ! তার তো আজীবন সেখানেই কাটল। বাবা রসিকতা করতে চাইলেন। আমি সেই রসিকতায় বিন্দুমাত্র রস পাইনি। বাবাকে বড় খুশি খুশি লাগে। কী উচ্ছ্বাসিত তিনি। আমি রান্না ঘরে যাই। মুখে সেই হাসিটা। বলি,
-মা কেমন আছো? মা আমায় দেখেন না। তাকান না আমার দিকে। বলেন,
-ভালো আছি। তুই ভালো আছিস? এই বলে মা আমার দিকে তাকায়। আমি কী সুন্দর করে হাসি দেই। মা কেবল আমার দিকেই চেয়ে থাকেন। আমি রান্নাঘর থেকে বের হই। বাবা বলেন,
-সেভ হয়ে আয়। মেহমান আসছেন। এই সময় বরকে এমন দাঁড়ি গোঁপে মানায় না। জলদি যা।
আমি জলদি যাই। সেভ হয়ে আসি। বিকেলের দিকে মেহমান সব চলে আসেন। ঘরময় আনন্দের বন্যা বইতে থাকে। আমি দূরে দূরে থাকি। কী ভীষন কষ্ট আমায় তিল তিল করে খাচ্ছিল সেটা কেবল আমিই বুঝতে পারি। অবাক হই। কতো ম্যাচিউরিটি আমার। কি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলি। কেউ বুঝতেই পারছে না যে আমি আসলে ভালো নেই। একদমই ভালো নেই। পরেরদিন যে আমার হলুদ,আমাকে তাও জানানো হয়নি। সকাল সকাল বাবা এসে পাঞ্জাবি দিয়ে যান। পরতে বলেন। অনেক বছর পর এই পাথর বাবাটার মুখে এতো হাসি দেখি আমি। এই হাসি দেখে বড় আনন্দ হয় আমার। তবে তা একদমই খনিকের। সবাই কতো আনন্দ করে। ছোট থেকে বড় সবাইই! অথচ এরা কী বুঝতে পারে না এদের একটু হাসি আমার জন্যে বিষের মতো লাগে? সন্ধ্যার দিকে সাদিকের ফোন পাই। হস্তদন্ত হয়ে বলে,
-দোস্ত সর্বনাশ হয়ে গেছে? আমি পাগলের মতো হয়ে যাই। বলি,
-কী হয়েছে? মিহিনের কিছু হয়েছে? বল? কিছু হয়েছে?
-হ্যাঁ রে। বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমি বিছানায় বসে পড়ি। কিছু বলি না আর। গাল বেয়ে পানি পড়তে থাকে। সাদিক বলে,
-ও সব জেনে গিয়েছে। আমাকে ফোন দিয়ে ঝাড়লো কিছুক্ষন। এতো কান্না করছিল যে মনে হচ্ছিল কাঁদতে কাঁদতেই মারা যাবে ও। কিছুক্ষন আগে নীরা ফোন দিয়ে জানালো যে মিহিন নাকি বাসায় অনেক ভাঙচুর করছে। সব ছুড়ে মারছে। সেই কতক্ষণ থেকে দরজা আঁটকিয়ে বসে আছে। বলছে তুই না এলে দরজাই খুলবে না ও। দোস্ত, কী হবে এখন? আমি ভেজা স্বরে বলি,
-আমি নিজেও জানি না রে। তুই একটু আসবি এদিকে? একটা পিস্তল নিয়ে আসিস। আমি একটা নোট লিখি। আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়। তারপর তুই আমায় গুলি করে দিস। মুক্তি পাবো অন্তত। আমি পারছি না আর।
ঠিক তখনই বাবা আসেন রুমে। আমি ফোন রেখে দেই। চোখ মুছে নেই দ্রুত। বাবা আমার কাছে এসে দাঁড়ান। আমার পাশে বসেন। বলেন,
-বাবা,ভালো আছিস তুই? বাবার কণ্ঠস্বর বড় অপরিচিত লাগে। আমি মেকি হাসি। আমার চোখ ঘোল হয়। বলি,
-ভালো আছি বাবা। বাবা কিছুক্ষন আমার দিকে চেয়ে থাকেন কেবল। আমার গাল বেয়ে এক ফোটা পানি টুপ পড়ে যায়। বাবা সেটা মুছে দিয়ে বলেন,
-কতো বড় হয়ে গিয়েছিস তুই! আমি কিছু বলি না। চুপচাপ থাকি কেবল। বাবা আমায় হুট করেই জড়িয়ে ধরেন। বলেন,
-প্রথম দিন তোর মুখে এই হাসিটা দেখে একদম ভেতরে লেগে যায় আমার। তবুও এড়িয়ে যাই। নিজের জেদকে জয় করার জন্যে উঠে পড়ে লাগি। অথচ আমার জেদটা যে তোকে এমন বানিয়ে দিবে আমি ভাবিতেও পারিনি। এভাবে হাসিস না আর। এই হাসি বড় কষ্টের। তোর মুখে মানায় না। তুই যে ভেতরে ভেতরে মরছিস আমি তা বেশ বুঝতে পারছি। ভাগ্য ভালো যে সাদিকটা আমায় সব কিছু খুলে বলেছে। বুঝিয়ে বলেছে। আমার জেদ তখনও মানছিল না। কিন্তু তোর এভাবে মিথ্যা হাসি দেয়াটা ঠিক মেনে নিতে পারিনি আমি। অল্পের জন্যে আমি দুটো মানুষের খুনি হয়ে যেতাম। এর ভার আমি সইতে পারতাম না রে। আমি কেবল বাবার বিশাল বুকে ঠাঁই পেয়ে পাগলের মতো কেঁদে যাই। এই প্রথম আমার নিষ্ঠুর বাবাটাকে বড় দয়ালু মনে হয়। গম্ভীর, রাগি রাগি, সবার উপরে হুকুম চালানো বাবাটাকে বড় কাছের মনে হয় আমার। বাবা আমাকে ছাড়িয়ে নিলেন এক সময়। টেনে নিয়ে এলেন রুম থেকে। বাইরে এসে দেখি সবাই জড়ো হয়ে আছেন। বাবা তাদের উদ্দেশ্যে বলেন,
-এই বিয়েটা আমি নিজেই ভেঙ্গেছি। তবে আমার ছেলের বিয়ে হবেই। হলুদও হবে। তোমরা হলুদ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নাও। আমরা মেয়ে দেখে আসি। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-চল। আমাকে মিহিনদের বাসায় নিয়ে যা। মেয়েটা এখনও না খেয়ে আছে শুনেছি। চল চল। আমি বাবার সাথে গাড়িতে গিয়ে বসি। পাথর বাবাটার চিন্তিত মুখ আমায় ভীষণ আবেগি করে তোলে। যে মানুষটি আজীবন নিজের সম্মানের বিন্দু্ পরিমাণ খসে পড়তে দেননি, নিজেকে শক্ত রেখে নিজের সম্মান ধরে রেখেছেন, নিজের সিদ্ধান্তে পাহাড়ের মতো অটল থাকা মানুষটি আজ নিজের ইজ্জত সম্মানের কথা বিন্দুমাত্র না ভেবে, কেবল আমার কথা ভেবে এই বিয়েটা ভেঙ্গে দিলেন। সেই মানুষটি আজ আমার শক্ত করে জড়িয়ে ধর থাকতে ইচ্ছে করে। অথচ আমি তা পারি না। বাবাদের সাথে খুব সহজে মেশা যায় না। মিশতে হলে সময় লাগে। আমি বাবার দিকে তাকিয়ে থাকি কেবল। তিনি আজ কী ভীষন চিন্তিত। বড় ভালো লাগে আমার। সাদিক দাঁড়িয়ে আছে মিহিনদের বাসার সামনে। আমি ওকে ফোন দিয়ে আসতে বলি এখানে। গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যাই ওর দিকে। আমার গায়ে তখন হলুদ অনুষ্ঠানের পাঞ্জাবিটা। সবে পরেছিলাম তখন। আমি দ্রুত ওর কাছে যাই। জড়িয়ে ধরি ওকে। বলি,
-স্রষ্টা আমাকে সেরা অনেক কিছুই দেননি। কিন্তু আমাকে সেরা একটা বন্ধু দিয়েছেন। ও বলে,
-আমরা পরে কথা বলবো। আগে মিহিনকে দেখ। ওটা জরুরি। আঙ্কেল আপনি আমার সাথে আসুন। তুইও আয়।
মিহিনদের দরজার কাছে যেতেই দেখলাম ওর বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। মলিন চেহারা তার। উনারা বসার ঘরে বসলেন। আমি আর সাদিক এলাম মিহিনের রুমের সামনে। টোকা দেই। বলি,
-মিহিন?
কারো দ্রুত পথ চলার আওয়াজ হয়। দরজা খোলা যায়। কেউ একজন হেচকা টান দিয়ে আমায় রুমের ভেতর নিয়ে যায়। তারপর আবার দরজা বন্ধ। দরজা বন্ধের আগে আমি সাদিকের মুখে বিজয়ের হাসি দেখি। মিহিনের দিকে তাকাই। কী অবস্থা তার। চুল গুলোর কী অবস্থা করে রেখেছে সে। কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। তারপর দৌড়ে আসে আমার কাছে। একটা চড় দেয়। আমি মাথা নিচু করে রাখি। আরেকটা চড় দেয়। আমি কিছুই বলি না। ও কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-খোল এই পাঞ্জাবী! আমি অবাক হয়ে দেখি ওকে। বলে,
-জলদি খোল বলছি। এটা দেখে রাগ বাড়ছে আমার। আমি আজ এই পাঞ্জাবীকে শেষ করে ফেলবো। কতো বড় সাহস। আমাকে ছেড়ে সে অন্য কাউকে বিয়ে করবে। কী স্পর্ধা। আজ তো আমি তোকে খুনই করে ফেলব।
ও আমার পাঞ্জাবীটা টানতে থাকে। আমি নিজে থেকে সেটা খুলে ওকে দিয়ে দেই। ভাগ্য ভালো ভেতরে গেঞ্জি ছিল আমার। ও পাঞ্জাবিটা নিয়ে টানতে থাকে। কিলঘুষিও দেয়। লাত্থি মারে। অস্ফুট স্বরে কী কী বলে পাঞ্জাবীটাকে। কী পাগলামো যে শুরু করে ও। আমি কেবল অবাক হয়ে দেখি। আসলেই! এই মেয়েটা এমনতেই মারা যেত। আমি নিশ্চিত। এই অল্প কিছুক্ষনে কী হাল করল রুমটার। মিহিন পাঞ্জাবীটা বারান্দা দিয়ে ফেলে দেয়। রুমে আসে। আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায়। আমি অসহায়ের মতো দেখি ওকে। ও দ্রুত আমার দিকে আসে। চেহারা পরিবর্তন হয় দ্রুত। আমিও তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। মিহিন কাছে এসে হুট করেই জড়িয়ে ধরে আমায়। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সে। ভেজা গলায় বলে,
-তুমি খুব খারাপ। খুব। আমায় খালি কষ্ট দাও। ও গা কাঁপিয়ে কান্না করে এবার। শব্দ হয়। আমি ওর চুল ভর্তি মাথায় চুমু খাই। বলি,
-আর এমন হবে না বাবু! আজ থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ও কিছু বলল না আর। কেবল কেঁদেই গেল। মন্দ মনে ভাবলাম, একটা সুন্দর শুরু খুব প্রয়োজন। দোয়া করবেন। শুরুটা যেন সুন্দর হয়। গল্পের সাথে বাস্তবতাকে না মেলানোর বিশেষ অনুরোধ রইলো। আমাদের বাবারা জানেন না তারা আসলে তাদের জেদকে পরিপূর্ণ করার জন্যে কতো বড় একটা ভুল করছেন। সেটা ছেলে কিংবা মেয়ে যার ক্ষেত্রেই হোক। তাদের পছন্দ অপছন্দকে অবশ্যই রাগী,কঠোর বাবাদের প্রাধান্য দেয়া উচিৎ।