অভিমান

অভিমান

— আমি তোমায় বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি!

: কেন বেসেছ?

— ভালোবাসতে কারণ লাগে বুঝি?

: অবশ্যই লাগে। প্রকৃতিতে কারণ ছাড়া কোনো কিছুই ঘটে না।

— তুমি খুব যত্নবান। আমায় সহজেই বুঝতে পারো, তাছাড়া তোমার উপস্থিতি আমায় সহজ রাখে, আনন্দ দেয়।

: তোমার চারপাশে এরকম অনেকেই আছে যারা তোমার প্রতি যত্নবান, তোমায় সবসময় আনন্দে রাখতে চায়। তাদের কেন ভালোবাসলে না?

— তাদের সবার চেয়ে তোমায় বেশি ভালো লাগে, তুমি স্পেশাল।

: তার মানে তুমি নির্বাচন করছ?

— এত সস্তা করে ভাবছ কেন? আমাদের সবকিছুর ভেতর আলাদা করে কিছু ভালো লাগতে পারে না? যেটা একান্ত করে পাওয়ার ইচ্ছেকে নির্বাচন বলে উড়িয়ে দেওয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত?

: হয়তো যুক্তিযুক্ত হচ্ছে না। কিন্তু ধরো, আমার চেয়ে আরও অধিক স্পেশাল কেউ এলো, যে অধিক যত্নবান; তখন তুমি কি তাকে ভালোবাসবে?

— উঁহু, তা কখনওই সম্ভব নয়। ভালোবাসা, প্রেম, কাম এগুলো সবার প্রতি আসে না।

: আমি স্পেশাল বলে আমার প্রতি যদি এসব আসে, তবে আমার চেয়ে অধিক স্পেশাল কারও প্রতি তোমার ভালোবাসা কেন আসবে না? এর পেছনে যুক্তি কী?

— ভালোবাসা যুক্তি দিয়ে হয় না।

: অর্থহীন কথাবার্তা!

— মোটেই অর্থহীন নয়। প্রতিটা সম্পর্কের সাথেই নিয়তি কাজ করে। তেমনি ভালোবাসাও দাঁড়িয়ে থাকে নিয়তি এবং চরিত্রের সমরেখায়। অ্যারিস্টটলও সেরকম বলেছেন, “ক্যারেক্টার ইজ ডেসটিনি।”

: বাইবেল ভিন্ন কথা বলে, ”যৌবনই স্রষ্টার প্রকৃত রূপ।” তারমানে চরিত্র বিষয়টাই এখানে মূল্যহীন। বার্নাড শ কী বলেছেন জানো তো? সাহস আর সুযোগের অভাবই হলো চরিত্র। তাই যৌবন যখন যেমন চাহিদা পোষণ করবে তখন তুমি ঠিক তেমন। এখন আমি স্পেশাল তাই আমায় চাইছ, আমার চেয়ে অধিক স্পেশাল কেউ এলে তোমার তাকেই চাইতে হবে। এটাই নিয়ম।

— তুমি সবকিছু গুলিয়ে ফেলছ! ভালোবাসা কিংবা যেকোনো সম্পর্কের সাথেই দায়বদ্ধতা জড়িয়ে থাকে। ওটা অস্বীকার করা যায় না।

: দায় কি শুধু স্বীকার করার বিষয়?

— নাহ, দায় বহনও করতে হয়।

: দায়টা কেন আসে?

— বিশ্বাস থেকে।

: আর বিশ্বাস?

— আস্থা এবং অলিখিত চুক্তিবদ্ধতা থেকে।

: এখন আমাদের মধ্যে যে অলিখিত চুক্তি আর আস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে তুমি ভাবছ, তার চেয়ে ভালো চুক্তি অন্য যে কারও সাথেই তো হতে পারে, তাই না? সেক্ষেত্রে ঘুরেফিরে বিষয় কিন্তু একই দাঁড়াচ্ছে।

— তুমি কি ইনসিকিউর ফিল করছ? ভাবছ ভবিষ্যতে ছেড়ে যাব কি না?

: উঁহু আমি সেরকমটা ভাবছি না। ভবিষ্যতে তুমি ছেড়ে যেতেও পারো, সেটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়।

— আমি তোমায় কখনওই ছেড়ে যাব না।

: হাহাহা, অলিখিত চুক্তিপত্র?

— ধরে নাও তাই।

: তুমি কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছ যে চুক্তি ভাঙবে না?

— তুমি ভবিষ্যৎ নিয়ে এত চিন্তিত কেন?

: এটা মোটেই ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা নয়, এমনকি আমি ইনসিকিউর ফিল করছি এরকমটাও নয়।

— তাহলে এত প্রশ্ন ছুঁড়ছ কেন? সব ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে গ্রহণ করো।

: ভালোবাসা বুঝি গ্রহণ করার জিনিস?

— নাহ, ভালোবাসা বহনও করতে হয়। কেন আমায় ভালোবাসতে পারবে না?

: তোমায় ভালোবেসে ফেলাটা সবচেয়ে সহজ নির্বাচন, কিন্তু ওই যে ভালোবাসা বহন করতে হয়। ওটা কি আদৌ সম্ভব?

— তারমানে তুমি বলতে চাচ্ছ, ভালোবাসা আসলে ভালোবাসো, কিন্তু কোনো দায়বদ্ধতা নেই, বিশ্বাস নেই; যখন ইচ্ছেরা ফুরিয়ে যাবে তখনই সব শেষ, এই তো?

: হাহাহা, তুমি দেখি রেগে যাচ্ছ। আমি মোটেই সেরকমটা বলিনি। বরঞ্চ তুমিই তোমার অবচেতনে এগুলো লালন করছ!

— আমি তোমার কথা এতটুকু বুঝতে পারছি না!

: আবেগটাকে একপাশে সরিয়ে রেখে স্থির হয়ে ভাবো, তাহলে বুঝতে পারবে।

— আমি তোমার মতন পাথর নই।

: হাহাহা!

— অহেতুক দাঁত ক্যালিয়ো না।

: দেখো, জীবনে যা আসছে আর যা চলে যাচ্ছে তা মেনে নেওয়ার নামই হচ্ছে জ্ঞান। তাই মেনে নিতে শেখো।

— শোনো দর্শন দিয়ে জীবন চলে না। তাই তোমার বস্তাপচা দর্শন আমায় শুনিয়ো না। তাছাড়া তুমি বোধহয় ভুলে গেছ দার্শনিক ইমাম গাজ্জালি বলেছেন, ”দর্শন হলো একটি অপ্রয়োজনীয় এবং ভুল শাস্ত্র”।

: আমি দর্শন ঝাড়ছি এরকমটা ভেবো না। এই যে তুমি চুক্তির কথা বললে, বললে আস্থা ও বিশ্বাসের কথা। তো চুক্তি থাকলে তার মেয়াদ একসময় ফুরাবেই। তেমনি আমায় যদি তোমার কমফোর্ট জোন থেকে যদি সরে যেতে হয় কিংবা আমি বাধ্য হই; তাতেও তোমার আস্থা এখন আমার ওপর যেরকমটা আছে, তা কিন্তু থাকবে না। এবং তোমার বিশ্বাসও তখন নড়বড়ে হয়ে যাবে। একই ব্যাপার তোমার বেলাতেও ঘটতে পারে…

— সারাজীবন জেনে এসেছি ভালোবাসতে কোনো কারণ লাগে না, প্রেম এমনিতেই হয়ে যায়। কিন্তু তোমার কাছে এসে হাজারটা কারণ আর খণ্ডন শুনতে হচ্ছে।

: আমি কোনো কারণ দর্শাচ্ছি না…

— শোনো আমি এত তত্ত্ব বুঝতে চাই না। তুমি আমায় গ্রহণ কিংবা প্রত্যাখ্যান দুটোই কর‍তে পারো, সেই এখতিয়ার তোমার আছে।

: প্রেম ও প্রত্যাখ্যান দুটোই মায়া, একটি পূর্ণতা অন্যটি শূন্যতা। পূর্ণতায় যদি তৃপ্তি আসে তবে শূন্যতায় তৃপ্তি আসবে না কেন?

— ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমায় প্রত্যাখ্যান করতে চাচ্ছ, এই তো? এখন আমায় প্রত্যাখ্যানের শূন্যতায় তৃপ্ত হয়ে বাকবাকম করতে বলছ?

: তুমি আমায় ভুল বুঝছ!

— কোনটা ভুল বোঝা আর কোনটা অভিমান সেটুকুর তফাৎ বুঝতে পারছ না, আবার দর্শন কপচাও? বাহ!

: শোনো, যখন দেখবে তোমার ঘামের দুর্গন্ধ কমে গেছে, শরীরের উত্তেজনা শিথিল হচ্ছে, তখন জানবে আত্মায় আত্মায় প্রেম হবে। যদি নাহয়, জানবে হলো না। আবার ঘুরে এসো, আবার জন্মাও। ফিরে ফিরে এসো। ক্ষয় করো। পাপক্ষয়, শ্রমক্ষম এবং অভিমান ক্ষয়।

— তারমানে তোমার ভালোবাসা পেতে গেলে আমায় হাজারবার জন্ম নিতে হবে? তুমি বুঝি এতই রসগোল্লা?

: হাহাহা! ভালোবাসতে হাজারবার জন্মাতে হয় না, স্পেশাল হবার দরকারও পড়ে না, লাগে না কোনো চুক্তিপত্র।

— তবে কী লাগে?

: ভালোবাসতে একমাত্র লাগে অভিমান। পাগলি তুই যতদিন আমার ওপর অভিমান পুষবি, ঠিক ততদিন হাজারটা অকারণেও আমায় ঠিকঠাক ভালোবাসতে পারবি। যখন দেখবি অভিমান ফিকে হয়েছে, তখন ভালোবাসাও উবে যাবে।

— তুমি বুঝি আমার অভিমান টের পাও না?

: খুব পাই।

— তোমার বুঝি এরকম হয় না?

: হাহাহা! আমি তোমার জন্য ব্রহ্মাণ্ডের সমান অভিমান বুকের প্রকোষ্ঠে সযত্নে পুষে রাখি। শুধু তুমি টের পাও না। তফাৎটা এখানেই…

— তোমায় পাথর ভেবেছি, তাই সত্যিই টের পাইনি।

: শোনো, আমায় কখনও ভালোবাসতে যেয়ো না, বরঞ্চ আমায় অভিমান কোরো। অভিমান ভালোবাসার চেয়েও তৃপ্তিদায়ক।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত