বাসে দেখা সেই মেয়েটি

বাসে দেখা সেই মেয়েটি

অনাবিল বাসে উঠেই মেয়েটার দিকে সবার আগে চোখ পড়লো।। মেয়েটার পাশের সিটটা ফাঁকা।। সাতপাঁচ না ভেবেই, চট করে মেয়েটার পাশের সিটে বসে পড়লাম।। এত হুড়মুড় করে বসলাম যে আর একটু হলে মেয়েটার কোলেই গিয়ে বসতাম।। মেয়েটার মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই, সে চুপচাপ বিষণ্নতাকে সঙ্গী করে বসে আছে।।
আমি উঠলাম যাত্রাবাড়ি থেকে, যাবো মালিবাগ রেলগেট।। মেয়েটা যে আহামরি কোন সুন্দরী, রুপবতী ললনা তা নয়- তবে চেহারায় একখাবলা মায়া মাখিয়ে দেয়া।। বাসে উঠার সময় অই চেহারা দেখেই বুকের মধ্যে ধক করে উঠে।।

আস্তে আস্তে বাস ভরে গেলো, অনেক লোক দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।। আমি শুধু আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ করছি কোন মহিলা যাত্রী যেনো বাসে না উঠে, তাইলে এই সিট আমাকে ছেড়ে দিতে হবে।। এই মেয়ের পাশে বসার লোভে আমি যে ভুলে মহিলা সিটে বসে আছি- সেটা এতক্ষণে মাথায় ঢুকলো।। না, একজন মহিলা উঠলো কিন্তু উনি পিছনে চলে গেলো, আমার আর সিট ছাড়া লাগলো না।। লোকাল বাসে যা হয় আর কি, আমার ঘাড়ের কাছে এক লোক দাঁড়িয়ে চাপাচাপি করছে।। আমি এই সুযোগে মেয়েটার দিকে অল্প একটু চেপে বসলাম।। তাতে কাঁধের সাথে কাঁধ মিলে গেলো- আমার একটু ভয় লাগছে বটে, মেয়েটা কিছু না বললেই হয়।। কিন্তু মেয়েটা তখনো নির্বিকায়।।

বাস মালিবাগ রেলগেট চলে এসেছে, আমি নামলাম না।। ভাবলাম, আমি নেমে গেলাম তো এই মেয়েকে চিরতরে হারালাম আর কোনদিন হয়তো দেখা হবে না।। যা থাকে কপালে, আজ এই মেয়েকে ফলো করবো।। কাজ- কাম না থাকলে যা হয় আর কি।। এরমধ্যে মহিলা সিট ছেড়ে অন্য সিটে বসেছি, মেয়েটার পাশে বসার সুযোগ খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় নি।। মুগদা এসেই একগাদা মহিলা উঠেছিলো, অগত্যা আমি মহিলা সিট ছেড়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকি।।
বাস যখন কুড়িল বিশ্বরোড আবার মেয়েটার পাশের সিট ফাঁকা পাই- আমি ফাঁকা হতেই লাফ দিয়ে বসে পড়ি।। মেয়েটাকে এরমধ্যে কিছুই করতে দেখলাম না, সে একধ্যানে থাকে- মাঝে মাঝে এদিক সেদিক তাকায় এই তো।। এত দূর একসাথে এলাম, মেয়েটার দিকে কতবার তাকালাম- মেয়েটা একবারো মনে হয় আমাকে খেয়ালি করে নি।। দুঃখে বাস থেকে নেমে যেতে মন চাইলো, আবার ভাবলাম থাক দেখি কতদূর যায়।। কন্ট্রাকটার ভাড়া চাইতে আসছে দুইবার আমি বলেছি পরে নেও, দূরে যাবো।। মেয়েটা সম্ভবত আগেই ভাড়া দিয়ে দিছে।। তাই বুঝতে পারছি না, সে যাবে কই!!

আব্দুল্লাহপুর এসে আবার মহিলা যাত্রী উঠলো।। মেয়েটার পাশ থেকে কোনভাবেই উঠে যেতে মন চাইছে না আমার।। আমি অসুখ আর দুর্বলতার ভান করে উনাদের সিট ছেড়ে দিলাম।। উনারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।। প্রায় পড়ে যেতে নিচ্ছি আমি, দাঁড়াতেই পারছি না- আহা অভিনয় সেই নিঁখুত হইলো।। মহিলা উঠে আমাকে আবার বসতে বলবে বলবে ভাব, এর মধ্যে পাশের এক ছেলে ছোকরা সিট ছেড়ে বলে- ভাই, আপনি এখানে বসেন।। মেজাজটা এত গরম হইলো, এত জোস অভিনয় কইরা আমার লাভ হইলো কি- কফাল!!

গাজীপুর চৌরাস্তায় অনাবিলের লাস্ট স্টপেজ- মেয়েটা বাস থেকে নামলো হাতে ভারি ব্যাগ।। ব্যাগটা সম্ভবত বাসের সামনে রাখা ছিলো।। আমিও আবালের মত নেমে মেয়েটার থেকে খানিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছি।। মেয়েটার হাইট খুব বেশি না, আমার হাইটের তুলনায় কমই বলা চলে।। পায়ে তাকিয়ে দেখলাম, নরমাল স্লিপার জুতা পড়া।। মেয়েটা জামালপুরগামী রাজীব বাসে উঠে পড়লো।। ব্যাগ বক্সে দিয়ে দিলো, আমি এতদূর এসে এভাবে হেরে যাবার পাত্র নই।। আমিও উঠলাম, আল্লাহ্‌র কি কাম- সিট তো এইবার একসাথে পাইলাম।।

এক বন্ধুকে ম্যাসেজ দিলাম- দোস্ত সেই বিপদে পড়ছি, এক হাজার টাকা বিকাশ কর ভাই।। আর্জেন্ট- আমি ভাবলাম এখন কথা বলতেই হবে, নইলে- এত কস্ট সব বৃথা, সব জলে চলে যাবে।। আমি মেয়েটার দিকেতাকিয়ে বললাম- আপু কোথায় যাবেন? ময়মুনসিংগত যাইয়াম, আফনে কনু যাইতাইন? হাই ভোল্টেজের একটা ধাক্কা খাইলাম।। একি অবস্থা, আঞ্চলিক ভাষা জানা ঠিক আছে- কিন্তু অপরিচিত কারো সাথে এভাবে কথা বলার মানে কি? মেয়েটার লেভেল মাপার চেস্টারত আমি।। এরমধ্যে জবাব দিলাম- ময়মনসিংহ যাচ্ছি আমিও।। মেয়েটা বললো- আফনে যাত্রাবাড়ি থিকা আইসুন্না? আমার কথা বলার ইচ্ছাটাই উবে গেছে- অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললাম- হ্যাঁ, যাত্রাবাড়ি।। ময়মুনসিংগত কনু আফনের বাড়ি? মরজ্বালা, মেয়েটাই কথা চালাচ্ছে- আমি বললাম- শহরেই বাসা।। বলে মনে মনে ভাবলাম- অথচ আমি কিছুই চিনি না ময়মনসিংহ এর!!

পকেট থেকে মোবাইল বের করে, ব্যস্ততার ভান ধরলাম।। মনে হচ্ছিলো- বাস থেকে নেমে যেতে পারলে ভালো হতো।। মেয়েটাকে আড়াল করে, মানিব্যাগ বের করে দেখলাম ২১০ টাকা আছে।। কে জানে ময়মনসিংহ এর ভাড়া কত? এখন টেনশন হচ্ছে, বন্ধু এখনো টাকা পাঠায় নি- ম্যাসেজের রিপ্লাইয়ো দেয় নি।। আর পাঠালেই কি, বিকাশে কি আর বাস ভাড়া দেয়া সম্ভব!! বাসে মেয়েটার সাথে তেমন আর কথা হলো না।। বিকেল ৫ টা বাজে।। আমি ময়মনসিংহ বাসস্টপেজ এ দাঁড়ানো।। মেয়েটা আমার পাশেই আছে- আমাকে বললো- আপনার নামটা জানতে পারি?আমি বললাম- শোভন।।

ভদ্রতার খাতিরে আমিও জিজ্ঞেস করলাম- আপনার? বললো- শিখা, শিখা মানে জানেন?আমি বললাম- হ্যাঁ, কে না জানে!! হঠাৎ, মাথায় এলো মেয়েটা অনেক শুদ্ধ আর সুন্দর করে কথা বলছে।। তাহলে বাসে এমন করার কারণ কি? আমাকে মেয়েটা বললো- আমাদের বাড়িতে যাবেন? আমাদের গ্রামটা খুব সুন্দর জানেন? আপনি তো এখানকার কিছুই চিনেন না বোধহয়? আমি কিছুটা অপ্রস্তুত- বললাম, আপনি কি ভাবছেন আমি আপনার পিছে পিছে এখানে এসেছি? মেয়েটা সশব্দে হাসলো- অবাক করা সে হাসি, বাস টার্মিনালের প্যাঁ পু শব্দ ছাড়িয়ে সে হাসি আমার কানে মধুরতা নিয়ে বাজলো।। আমি ভাববো কেনো? আপনিই সত্যিটা বলেন? বলে মেয়েটা আমার মিথ্যে চোখে চোখ রাখলো।।

আমি লজ্জিত ভংগিতে মাথা নুয়ালাম।। ব্রহ্মপুত্র নদী পার হয়ে, চরডাংগা গ্রামের দিকে যাচ্ছি।। সূর্য্য প্রায় অস্তগামী।। শিখাদের বাড়ি যাচ্ছি।। কি আশ্চর্যকথা!! মেয়েটা তার বাবা মায়ের কাছে আমাকে কি বলে পরিচয় করিয়ে দিবে, কে জানে?? গ্রামবাসীরাই বা কি বলবে আল্লাহ্‌ মালুম।। আমি যেতে রাজী হই নি মোটেও- কিন্তু এমনভাবে অনুরোধ করলো শিখা, কেমন যেনো ঘোরের মধ্যে রাজী হয়ে গেলাম।। সাধারণত এমন হবার কথা না- সব কিছুই কেমন যেনো অদ্ভুত লাগছে।। শিখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে।। হলে সিট পায় নি, তাই রায়েরবাগ খালার বাসায় থাকে।। বাড়িতে ওর বাবা,মা,দাদী আর ছোট দুই ভাই আছে।। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে, জামালপুরে।। শিখার বাবার তার ভাইদের সাথে জমি নিয়ে ছোটখাট বিরোধ আছে।।

পুরোটা রাস্তা যেতে যেতে শিখার গল্প শুনলাম।। আমার কথা শিখা তেমন একটা জিজ্ঞেস করলো না- আমিও আর নিজের কথা বললাম না।। শিখার বাবা মা খুব আন্তরিক।। আমাকে দেখে উনারা খুশিই হলেন।। শিখা আসার আগে ফোনে তার মাকে জানিয়েছে, সে তার এক বন্ধুকে নিয়ে বাড়িতে আসতেছে।। ওর মা নাকি অনেক রাগ করে বলে, আগে কেন জানালো না- শহরের মানুষ কি খাবে না খাবে এসব।। শিখা সেটা নিয়ে কি হাসি।। ফোন রেখে আমাকে বলে- আমি নিজেই তো জানতাম না, কেউ একজন আমাদের বাড়িতে যাবে।। আমি অবাক হই, গ্রামের মানুষের কি তবে আজাইরা কানাঘুষার স্বভাব বাদ গেলো!!

রাতে ভরপুর খানা দানা হলো- শিখার দুই ভাই আমাকে বন্ধু বানিয়ে ফেলেছে।। ওরা পিঠাপিঠি।। একজন ক্লাস এইটে, একজন ক্লাস টেনে পড়ে।। রাতে ওদের ঘরেই শুইলাম, আলাদা খাটে আমি।। ওরা দুই ভাই এক খাটে।। ওদের নাম রাজু, সাজু।। বড়টা রাজু, ছোটটা সাজু- সাজু বিছানা ছেড়ে উঠে আমার শিতানের কাছে এসে বলে- আফনে শিখা আফারে হাসাই বিয়া করবাইন? আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম।। রাজুও বিছানায় বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।। প্রশ্নটা আমার কাছে খাপছাড়া।। তবুও মজা নিয়ে উত্তর দিলাম- হ্যাঁ, করবো।। তোমরা রাজি আছো??

সাজু আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো- আফনে ভালা, মেলা ভালা।। সাজু আমার বুকে বিড়ালের মত মাথা ঘষছে।।
রাজু বিছানা ছেড়ে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে বললো- ভাইজান কাইল আমরা গাঙের পানিতে গোসল করবাম, আফনে সাঁতার জানুইন?? আমি হেসে বললাম- জানি।। তবে অল্প অল্প।। সকাল বেলা আমি শিখার দাদীর সাথে আলাপ করছি।। রাজু, সাজু সারাদিন আমার পিছে আঠার মত চিপকে আছে।। আজ শিখাকে একদম গ্রাম্য মেয়ে মনে হচ্ছে।। ওকে এই সাজে দেখে আমি মুগ্ধ, মেয়েটা আমাকে দেখলেই মুখ টিপে টিপে হাসে।। প্রতিউত্তরে আমি ক্যাবলাকান্তের মত শুধু তাকিয়ে থাকি।। ঢেঁকি পাড়ের শব্দ পাচ্ছি- মনে হচ্ছে পিঠা পুলির আয়োজন হবে।। যাক, এখানে এসে অন্তত ঢেঁকি দেখতে পেলাম।। আজকাল গ্রামে গঞ্জের সব জায়গা থেকে তো ঢেঁকি গায়েব।। শিখার দাদী রাজু সাজুকে সরে যেতে বললো, কইলো ভাইসাবের সাথে আমার পেরাইভেট কথা আছে, তরা এন থিকা যা এহন।।

রাজু সাজু চলে গেলো- আমি আর শিখার দাদী বসা।। শিখার দাদী পান চিবুতে চিবুতে আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো- হুনো ভাইসাব, আল্লাহ্‌র নীলা খেলা বুঝা দায়।। এই যে তুমি আমাগো শিখাডারে বিয়া করণের লিগা রাজী হইছো এইডা বিরাট উপকার করছো আমগোরে।। আল্লাহ্‌ তুমারে অনেক সুখি করবো, এই বুইড়া মানুষ কইলাম তুমারে।। উনি একটু দম নিলেন- কথাগুলো বলে!! আমি কথার আগামাথা বুঝতে পুরাই অক্ষম!! তবু শুনে যাচ্ছি, মজা পাচ্ছি এই ভেবে যে- সবাই ভেবে নিছে, আমি শিখার প্রেমিক টাইপ কিছু।। গ্রামের মানুষ তো বোকা নারে, আরো দুই কাঠি সরস।।

আমার ভাবনায় ছেদ দিয়ে, দাদী বলে চললো- বেশি পুড়ে নাই কইলাম, আমি ছুডু বেলায় দেখছি মেলাবার।। বুকের মইধ্যে তেমুন পুরা দাগ নাই, পেটের মধ্যে পুরাডা বেশি।। এহনো আমার কয়েল দেখলে ডর লাগে ভাইসাব।। আহা রে, কিবা কইরা কয়েল থিকা লেফের মইধ্যে আগুন ধরলো, আমার শিখার বয়স তহন কত, ৪-৫ হইবো, কিবা চিক্কির যে পারছে মাইয়াডা।।

কত কস্ট পাইছে রে ভাইসাব।। তুমাগো ঢাহার হাস্পাতালেত আছিলো মেলা দিন।। পুরা দাগ এহন মেলাহানি কমছে মনে কয়।। ভাবছিলাম, এই মাইয়াডারে ক্যারায় বিয়া করবো!! আল্লাহ্‌ তুমার নাগাল এডা রাজপুত্তুর দিবো আমাগো, জীবনেও ভাবি নাই- কথাগুলো বলতে বলতে, দাদী জীর্ণ রুক্ষ হাতে চোখ থেকে মোটা ফ্রেমের চশমা খুলে, শাড়ির আঁচলে চোখের পানি মুছতেছে।। আর আমি ভাবতে বসলাম- শিখা মানে কত সহজ, কে না জানে!!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত