ছয় বছর পর সুফিয়ার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি । এমন ভাবে তার সাথে আমার দেখা হবে যা আমি কখনোই চাইনি । সুফিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে তার মেয়ে । সুফিয়ার পড়নে সাদা শাড়ী ।এই ছয় বছরে অনেক শুকিয়ে গেছে সে । চোখের নিচে কালো দাগ পরেছে । চেহারাটা কেমন জানি মলিন হয়ে গেছে । দুই জনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ,কেউ কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না । প্রথমে সুফিয়া কথা বলে নিরবতা ভাঙ্গে । সে বলে ,
– বিদেশ থেকে কবে ফিরলে ।
= দুইদিন হয়েছে দেশে ফিরলাম ।
– ও আচ্ছা ,তা কেমন আছো ।
= হ্যাঁ ভালো আছি , তুমি কেমন আছো ?
– অনেক ভালো , এতোটা ভালো যে সুখ সহ্য হচ্ছে না এখন আর । “এই কথা বলে সে মুখ ফিরিয়ে নেয় অন্য দিকে ।
= তুমি কি আমার ওপর এখনো রেগে । আমাকে কি ক্ষমা করতে পারো না ।
– এই বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না । তবে একটা কথা জেনো রাখো , আমার যে সুখের জন্য তোমার জীবন থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলে । সেই সুখের দেখা আমি এখনো পাইনি । ” তার এমন কথা শুনে আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দই বের হচ্ছিল না ।
তার মেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে – উনি কে মা? সুফিয়া বলে – উনি সেই লোক মা যে আমার বুকের বাঁ পাশে , তোমার সাথে বাস করে। এই বলে মেয়ে কে নিয়ে সেখান থেকে বিদায় নেয় । সাত বছর আগে তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় । একদিন আমি আর আমার কিছু বন্ধু একটা চায়ের দোকানে বসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম । রাস্তা দিয়ে কোন মেয়েকে যেতে দেখলেই তাকে উদ্দেশ্য করে গান গাইতাম । পালাক্রমে একবার একজনে গান গাইত । এরপর ছিল আমার পালা আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে মেয়ে আসার অপেক্ষা করছিলাম । কিছুক্ষণ পরে একটা মেয়ে কে আসতে দেখলাম ।আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমি সিগারেট টানতে টানতে গান গেয়ে উঠলাম – বলোনা আমায় তুমি , হবে আমার চিরদিনই । আমার গান শুনে হঠাৎ মেয়েটা থমকে দাঁড়ায় , তারপর সে আমার দিকে আসতে থাকে ।
আমি তখন খুব ভয় পেয়ে যাই , যদি সবার সামনে আমাকে থাপ্পড় মেরে বসে , তাহলে তো আমার ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যাবে । মেয়েটা আমার সামনে এসে দাড়িয়ে বলে – গলা ভালো বা খারাপ হোক গান সবাই গাইতে পারে । এটা কোন দোষের কিছু না । কিন্তু গান গাওয়ার সময় হাতে সিগারেট কেন । এটা অনেক বড় অন্যায় , এটা গান কে অপমান করা । আর আপনি কি জানেন না সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ।এই বলে মেয়েটা আমার হাত থেকে সিগারেট টা নিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে হন হন করে হেঁটে চলে যায় ।
এর পরের দিন থেকে আমি প্রতিদিন সে দোকানের সামনে বসে বসে মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করতাম ।আমার বন্ধুরা ভাবছিলো মেয়েটা সেদিন আমাকে অপমান করছিলো । এখন আমি সেই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছি । চার দিন পর সে দোকানের সামনে বসে বসে আবারো সিগারেট টানছিলাম । হঠাৎ আমার বন্ধুরা বলে দোস্ত ওই মেয়েটা আসতেছে । আমি তাড়াতাড়ি সিগারেটটা ফেলে দিলাম । তারপর তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম । সে আমাকে জিজ্ঞেস করে,
– কিছু বলবেন ।
= তোমার নামটা কি জানতে পারি ।
– আমার নাম সুফিয়া । এখন সামনে থেকে সরে আমাকে যেতে দেন ।
– দেখো সুফিয়া তোমাকে আমার কিছু কথা বলার আছে ।
সেদিন সেই ঘটনা থেকেই আমি শুধু তোমাকেই নিয়ে ভাবছি । জীবনে যদি এমন একটা মেয়ে আসে যে মানুষ টা ভালবাসবে আবার শাসন করে আমার জীবনটা গুছিয়ে দিবে । তাহলে আমার জীবনটা সার্থক হয়ে যাবে । তাই তোমাকে একটা কথা বলতে চাই , তুমি কি হবে আমার চিরদিনই ।
এরপর থেকেই তার সাথে আমার একটা রিলেশন হয়ে যায় । খুব ভালো যাচ্ছিল সেই দিনগুলো । কিন্তু হঠাৎ করেই আমার বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন । আমি পরিবারের বড় ছেলে ছিলাম ,তাই পরিবারের সব দায়িত্ব আমার উপর পড়ে । আমাদের সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটন । আমি কোন রকমে সংসার সামলাতে পারছিলাম না । তাই মা বাবা সিদ্ধান্ত নেন আমাকে বিদেশ পাঠাবেন । দেশে থেকে আমি কিছুই করতে পারবো না ওনারা সেটা বুঝে গেছেন । তারপর কিছু জমি ছিল সেগুলো বিক্রি করে আমাকে বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করেন ।
একদিন সুফিয়ার সাথে দেখা করে ,সবকিছু জানালাম । তাকে বললাম আমাকে ভুলে যেতে । তার বাবা মায়ের পছন্দ করা কোন ছেলেকে বিয়ে করতে । সেদিন সুফিয়া অনেক কেঁদেছিলো । আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছিল কেন আমি এমন করছি তার সাথে । আমি কি কখনো তাকে ভালবাসনি , এতদিন কি তাহলে শুধু অভিনয় করছি। কিন্তু আমি তার ভালোর জন্যই তাকে আমি দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম । আমি জানতাম আমার সাথে থাকলে সে কখনো সুখী হতে পারবে না । এই অভাব অনটনে তাকে আমি রাজকুমারীর মত রাখতে পারব না । ভালোবাসা আর আবেগ দিয়ে জীবন চলে না বাস্তবতা বুঝতে হয় । আমি চেয়েছিলাম সে যেন অন্য কোন ছেলেকে বিয়ে করে সুখে সংসার করতে পারে যেন রাজকুমারীর মত থাকতে পারে ।
সেই দিন ছিল তার সাথে আমার শেষ দেখা । সেদিন সুফিয়া অনেক কান্না করছিলো । তার অনেক কষ্ট হচ্ছিলো । কিন্তু আমার যে কষ্ট হয়নি তা কিন্তু নয়। তার দ্বিগুন কষ্ট আমার হচ্ছিল যখন আমি কথাগুলো বলছিলাম । আমারও বুক ফেটে কাঁন্না আসছিল ।কিন্তু আমি অনেক কষ্টে কান্না চেপে রাখলাম । তার সামনে নিজেকে দুর্বল হতে দিলাম না । এরপরে আমি বিদেশ পাড়ি জমালাম । বিদেশ যাওয়ার পর থেকে এখন আর আমাদের সংসারে অভাব-অনটন নেই । আমার উপর যে দায়িত্ব ছিল আমি সবকিছু সুন্দরভাবে পালন করতে পেরেছি । একটা ঘর করলাম বাবার চিকিৎসা করালাম ।দুটো বোন ছিল তাদের বিয়ে দিলাম । তারপর ছয় বছর পর এখন আমি দেশে আসলাম । আজকে আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে আসলাম । কিন্তু পথে সুফিয়ার সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে তা আমি কখনো কল্পনা করিনি ।
আমি আমার বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পারলাম । আমি বিদেশে যাওয়ার এক বছর পর সুফিয়ার বিয়ে হয়ে যায় একটা ছেলের সাথে । কিন্তু বিয়ের দুই বছর পর তার স্বামী মারা যায় । এরপর সে তার বাপের বাড়ি চলে আসে এবং তার বাপ মায়ের সাথেই থাকে এখন । আমি সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না , আমার কানে শুধু সুফিয়ার একটা কথাই বারবার ভেসে আসছে , উনি সেই লোক মা, যে লোকটা আমার বুকের বাঁ পাশে তোমার সাথে বাস করে। আমি বাসায় এসে মাকে সবকিছু জানালাম । মা শুধু আমাকে বলল – যদি তাকে সত্যি ভালবাসো , তাহলে তাকে কখনো কষ্ট দিও না । ভালোবাসার মানুষকে কখনো কষ্ট দিতে নেই ।
মা বাবাকে নিয়ে যখন সুফিয়া দের বাসায় গেলাম। তখন তার মা বাবার রাজি না হয়ে নিষেধ করার কোন অবকাশ ছিলোনা । কারণ সুফিয়া এখন তাদের কাছে বোঝা । সেই বোঝা যেভাবেই পারুক বিদায় করা চাই । কিন্তু বাধা দিয়েছিল সুফিয়া নিজে , সে আমাকে তার রুমে ডেকে অদ্ভুত শীতল কণ্ঠে বলল – কারো করুনা জিনিষটা আমার একদম পছন্দ না , আমি আশা করব তুমি বুঝতে পারছ। আমি তখন কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না । শুধু বলছিলাম – আমি কারো উপর কখনো করুণা দেখাই না । আমি একবার ভুল করে আমার ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলেছি । দ্বিতীয় বার আর হারাতে চাই না ।তুমি সেদিন বলছিলে না তোমার বুকের বাঁ পাশে আমি বাস করি । ঠিক তেমনি আমার বুকের বাঁ পাশে তুমি বাস কর । আমি আজও তোমাকে ভালোবাসি ।
এখন আমার ঘুম ভাঙ্গে , আমার প্রথম ভালোবাসার মানুষ সুফিয়ার রিনিঝিনি চুড়ির শব্দে । ছয় বছর আগে যেমন করে আমাকে শাসন করতো ,এখন ঠিক সেভাবেই শাসন করছে আমাকে । যখন মেয়েটা আব্বু বলে চিৎকার করে আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে । আমার মনে হয় , আমি পৃথিবীর অন্যতম সৌভাগ্যবান পুরুষ ।