ভালোবাসার রসায়ন

ভালোবাসার রসায়ন

এই রাতুল জলদি ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নে, আজ সার্জারি ওয়ার্ডে অপারেশন আছে! রাতুল ঘুম ঘুম চোখে বললো; তুই ডাক্তার হবি তুই যা! আমার এসবের প্রতি কোন চাহিদানেই, রুমের লাইট বন্ধ করে দরজা চাপা দিয়ে যাস! রাসেল কাঁধের উপরে এপ্রোন রেখে টেবিলের উপর থাকা “রিয়েল ম্যান- এক্সপার্ট”বডি স্প্রে মাখতে মাখতে বললো; মামা আমি যে কি কারনে যাচ্ছি তা যদি তুই জানতি তাহলে তুই আমার আগে হাসপাতালে যাইতি! নতুন ম্যাম এসেছে সার্জারি ওয়ার্ডে। নতুন ম্যামের কথা শুনেই রাতুল ঘুম থেকে উঠে বললো; বলিস কি? নতুন ম্যাম? রাসেল বললো হ্যাঁ। মাত্র ৫ সেকেন্ডের জন্য রাতুলের মস্তিষ্কে বিক্রিয়া শুরু হয়ে গেলো, কেনো যেনো তার মনে হচ্ছে সে হাসপাতালে যেতে চায়, রাতুল জলদি করে ফ্রেশ হয়ে এপ্রোন কাঁধের উপর দিয়ে রাসেলের সাথে বের হয়ে গেলো। এই যে একটা বিক্রিয়া এটাই কি তাহলে রসায়ন?

আপন মনে হাঁটছে আর ভাবছে রাতুল! ম্যামের কথা শুনে আমার ভালো লাগলো, কিন্তু অপারেশন থিয়েটারের কথা শুনে ভালো লাগলো না, অর্থাৎ আমার সাথে অপারেশন থিয়েটারের বিক্রিয়া হয় নি, আমার সাথে বিক্রিয়া হয়েছে ম্যামের সাথে, ভাবছে আর মনে মনে হাসছে রাতুল। সার্জারি ওয়ার্ডে প্রায় দুই মাস অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে কিন্তু এখনো যন্ত্রপাতির নাম’ই জানে না রাতুল। কিন্তু তাতে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।এক ধরনের ভয় কাজ করে এই অপারেশনের সময়, তা হলো যদি কোন অপারেশন ঠিক ভাবে না হয়? যদি কোন অপারেশনের ফলে কোন রোগী মারা যায়? তাই সে চায় সার্জারির চেয়ে মেডিসিন টা ভালো, তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে মেডিসিন-ওয়ার্ডে খুব মনযোগ দিয়ে কাজ করবে।

সার্জারি ওয়ার্ডের একটা পুরাতন ঘটনা আছে রাতুলের জীবনে। পুরাতন ম্যাম ছিলো, বয়স ২৮ হবে। ম্যামের সাথে রাতুলের বন্ধন টা বেশ সুন্দর ছিলো। একদিন ঘটা করে প্রপোজ করবে তার জন্য ঠিকঠাক দিন ঠিক করে, অবশেষে একদিন নাইট ডিউটিতে ম্যামের সাথে রাতুলের ডিউটি পড়ে। রাতুল ট্রেনিংরত স্টুডেন্ট, এম -বি -বি -এস”পাস করে তার ট্রেনিং চলছে, অন্যদিকে ম্যাম সার্জারি ওয়ার্ডের মেডিকেল অফিসার। রাত তখন প্রায় দুইটা বাজে, রাতুল গিয়ে ম্যাম কে প্রপোজ করতে গিয়ে দেখে একই হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের মেডিকেল অফিসার জালাল স্যারের সাথে খুব ঘনিষ্ট হয়ে বসে আছেন!প্রচন্ড একটা শক খেয়েসেদিন থেকেই সার্জারি ওয়ার্ডে আর যায় না রাতুল। রাতুলগোয়েন্দাগিরি করে জানতে পারে জালাল স্যারের সাথে এই ম্যামের দীর্ঘদিনের রিলেশন।

রাতুল এগুলো নিয়ে এখন আর কোন মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করেনি। নতুন ম্যাম এসেই রাতুলকে খোঁজ করেছেন, কেনোনা ওয়ার্ডে সবাই তাকে বিজ্ঞানী বলে ডাকেন! প্রতিটা বিষয়ের উপর রাতুল বিজ্ঞানের ছায়া দেখতে পান, একটা মেয়ে অন্য একটা ছেলের সাথে প্রেম করে তার মধ্যেও বিজ্ঞান সার্চ করেন, এই ওয়ার্ডে যারা যারা প্রেম করে সবার নাম খাতায় লিখেরেখেছে! এবং একটা মেয়ে কেনো এই ছেলেকে পছন্দ করেছে তার কারণ খোঁজার চেষ্টা করে । এখান থেকে যে থিউরী আবিষ্কার করে তা ফেসবুকে লিখে পোষ্ট করেন। সে যে বিজ্ঞান নিয়ে কেমন ভাবে, তা হয়তো রাসেলের ডাকে ঘুম ভাঙার পর ম্যামের সাথে তার মস্তিষ্কের বিক্রিয়ার ধারনা থেকেই প্রমান হয়! হাসপাতালে গিয়েই এক পশলা ক্লাস নিলেন নতুন ম্যাম। রাতুলকে উদ্দেশ্য করে বললেন তোমার কথা অনেক শুনেছি, তুমি নাকি সব বিষয়েই বিজ্ঞান সার্চ করো?

যদি এটা সত্যি হয় তাহলে আমরা এটা নিয়েও অনেক কথা বলবো ক্লাসে! যাতে করে সবাই বিজ্ঞান বিষয়ে ধারনা লাভ করতে পারে। রাতুল ভাবছে – আমার কথা কিভাবে ম্যাম জানবেন? নিশ্চই পুরাতন ম্যাম আমার বিষয়ে সব এক্সপ্লেইন করেছে, তাহলে আমি যে ম্যাম কে লাভ করতাম এটাও কি বলেছে? যদি এটা বলে থাকেন তাহলে এই নতুন ম্যামের কাছে আমি কতটা ভালো মানুষ হিসেবে থাকবো? নাহ বেশি চিন্তা করা যাবে না। রাতুল বললো – ম্যাম সবই তো বিজ্ঞান, কৃষকেরা কৃষি-বিজ্ঞান নিয়ে থাকেন, মেডিকেলে যারা পড়ে তারা চিকিৎসা বিজ্ঞান, যারা খাদ্য তৈরী করে তারা খাদ্য বিজ্ঞানী এভাবে হিসাব করলে সবাই বিজ্ঞানী। ম্যাম বললেন ঠিক আছে আজ তোমাদের “এবসেস”( ফোড়া) নিয়ে আলোচনা করবো। রাতুল ভাবছে এখানে কিছু ছাত্র ম্যাম এর লেকচার নোট করছে, তারা স্টাডির সাথে বিক্রিয়া করছে, কিছু ছাত্র মোবাইল অন্যমনস্ক হয়ে আছে, তারাও বিক্রিয়া করছে মোবাইলের সাথে।

আর আমি!! আমি তো ম্যামের চোখের দিকে তাকিয়ে আছি, চোখ নিয়ে একটা গল্প লিখবো বলে, কতটা দিন অচেনা মানুষের চোখ দেখি না, আজ নতুন একটা জম্পেস লেখা হবে। তাহলে ম্যামের চোখের সাথে আমার বিক্রিয়া হয়েছে, এ থেকে ধারনা করা যায় সব বস্তু সবার সাথেই বিক্রিয়া করে না, যার সাথে যার বিক্রিয়া হবে সে তৈরী করবে নতুন কোন জিনিস, তাহলে রসায়ন সাবজেক্ট টা এতো কঠিন করে কেনো ভাবে সবাই? বাসার মালিকের নবম শ্রেণীতে পড়ুয়া একটা মেয়ে আছে। বাড়িওয়ালা আন্টি সেদিন রাতুলকে বলেছিলো আমার মেয়েটা রসায়ন একটু কম বোঝে তাকে যদি একটু পড়াতে বাবা খুব উপকার হয়, রাতুল মনে করে কাউকে পড়ানোর চেয়ে তার জীবনের গল্প শুনে সেই গল্পে কিছু রস মাখিয়ে লেখালেখি করাটা আনন্দের। বাড়িওয়ালা আন্টির চাপে একদিন পড়াতে হলো তানিয়াকে। রসায়ন বুঝাতে গিয়ে একটা কম্পিউটার দেখিয়ে রাতুল বললো, বলোতো এইটা কি?

-“এইটা মনিটর!
-“বলোতো এইটা কি?
-“এইটা কি-বোর্ড
-“গুড , বলোতো এইটা কি?
-“এইটা মাউস
-“বলোতো এইটা কি?
-“এইটা বক্স।
-“তাহলে বলোতো কম্পিউটার কোনটা?
-“ছাত্রী আর উত্তর দিতে পারলেন না।

রাতুল বললো, “দেখো প্রত্যেকটা জিনিসের ভিন্ন ভিন্ন নাম, কিন্তু সব মিলিয়ে নাম হয়েছে কম্পিউটার। এখানে কি হয়েছে?  এখানে আসলে সব জিনিস বিক্রিয়া করে কম্পিউটার নাম হয়েছে। এটাই হলো রসায়ন। একটা উদাহরনের মাধ্যমে চলো আমরা ব্যাখা করি- “পানির সংকেত হলো H20. এখানে হাইড্রোজেন আছে, এবং অক্সিজেন আছে। হাইড্রোজেন আছে দুইটা এবং অক্সিজেন আছে একটা। পানির একেকটি অণু একটি অক্সিজেন পরমাণু, এবং দুইটা হাইড্রোজেন পরমানু সমযোজী বন্ধন নিয়ে গঠিত। অণু ভাই কে ভেঙে টুকরা টুকরা করলে পরমাণু পাওয়া যায়, আবার পরমাণু ভাইয়েরা গঠিত হয় ইলেকট্রন -প্রটোন-এবং নিউট্রন এর সমন্বয়ে। এই পরমাণু এবং অণু মিলে কি অবস্থা তৈরী করবে সেটাই রসায়ন।

তাহলে সংকেতে ফিরে যাই, H20 – এখানে অক্সিজেন এর একটা এবং হাইড্রোজেন এর দুইটা পরমাণু নিয়ে পানি গঠিত হয়েছে। তাহলে পানি কি? পানি আসলে কিছুই না, এই অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন প্রেম করে যা তৈরী করেছে সেটাই পানি। কম্পিউটার খুঁজতে গিয়ে যেমন কি- বোর্ড পাওয়া যায়, মাউস পাওয়া যায়! ঠিক তেমনি পানিকে খুঁজতে গিয়ে এইরকম অক্সিজেন পাওয়া যায়, এবং হাইড্রোজেন পাওয়া যায়। তাহলে এইসব সংকেত দেখে কিন্তু ভয় পাওয়ার কিছু নেই, যত বড়ই সংকেত থাকুক না কেনো, ওই সব বস্তু গুলো অন্য বস্তুর সাথে প্রেম করছে, সেই প্রেমের ফলে (বিক্রিয়ার ফলে) যা তৈরী হবে সেটা একটা আলাদা বস্তু। তাই এভাবে বুঝে বুঝে পড়বে, কেমন? রাতুল লেকচার শেষ করে বললো, তুমি যদি চা তৈরী করতে পারো তাহলে যাও এক কাপ দুধ চা নিয়ে এসো, উইথ ভালো মানের বিস্কিট। তানিয়া বললো ভাইয়া সত্যিই অনেক সুন্দর করে বুঝিয়েছেন, এখন থেকে ইয়া বড় বড় সংকেত দেখে আর ভয় পাবো না। চা-নাস্তা করে রাতুল নিজের রুমে চলে আসলো।

এই কয় দিনের মধ্যে বিশাল আকারের একটা ঘটনা ঘটেছে, আর তা হলো নতুন ম্যাম রাতুলকে প্রপোজ করেছে। ম্যাম বলেছে -“জানো তোমাকে কেউ একজন পছন্দ করে!! রাতুল বলেছে -“পটাশিয়াম! নতুন ম্যাম অবাক হয়ে বলেছে, মানে কি? রাতুল মন খারাপ করে বলেছে রসায়ন না জানলে তো এমনটা হবেই। ম্যাম খোলামেলা ভাবেই আবার বলেছে, রাতুল তুমি অনেক সুন্দর, তোমাকে আমার অনেক ভালো লাগে, আমি ভালোবাসি তোমায় রাতুল রাতুল বলেছে -“সোডিয়াম। ম্যাম এবার খানিকটা অবাক হয়ে বললো, কি যা তা বলছো? একবার পটাশিয়াম, একবার সোডিয়াম এইগুলা কি?

শেষমেষ কোনভাবেই নতুন ম্যাম রাতুলকে পটাতে পারেনি, রাতুলের সাথে এই ম্যামের রসায়ন রাতুলের মস্তিষ্কে তেমনভাবে বিক্রিয়া করেনি তাই। যদি করতো তাহলে রাতুল নিজেই আগের ম্যামের মত প্রপোজ করতো। প্রায় আরো ১ মাস পর নতুন ম্যাম সার্জারি ওয়ার্ড ইনডোর থেকে বিদায় নিয়ে আউটডোরে চলে যাবে, বিদায় নেয়ার দিন রাতুলের বন্ধু রাসেলের কাছে বলেছে বিদায় নেয়ার সময় যেনো রাতুল দেখা করে! আজ শনিবার। ম্যাম বিদায় নিবে। রাতুল এসেছে। ম্যাম সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাতুলের কাছে আসলেন, জিজ্ঞাসা করলেন; এখন আমি চলে যাবো, হয়তো এতোটা কাছাকাছি আরআসবো না, এই বিদায় বেলায় কি তোমার সেই রসায়ন টা ব্যাখা করবে? আমি তোমাকে প্রপোজ করেছিলাম, কিন্তু তুমি সোডিয়াম পটাশিয়াম বলেছো, শেষবারের মত এটার জটলা খুলে দিবে কি?

রাতুল বললো -” ম্যাম আপনি বললেন ;কেউ একজন আমাকে পছন্দ করে? আমি বললাম -” potassium. ম্যাম পটাশিয়াম এর সংকেত হলো K . তার মানে আমাকে কে ভালোবাসে জানতে চেয়েছি। আপনি যখন বললেন,আপনিই আমাকে ভালোবাসেন, তখন আমি বললাম, “Sodium. যার সংকেত হলো ল্যাটিন ভাষায়(Na) যার অর্থ না! আমি আপনার প্রপোজ “না ( Na তে না) করে দিয়েছি। ম্যাম রাতুলের কথা শুনে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে পান করলো, হাসবে নাকি কান্না করবে বুঝতেছে না। ম্যাম বললেন তা রসায়নবিদ রাতুল আমি কি করলে আমার প্রপোজ একসেপ্ট করবে?

রাতুল হাসি দিয়ে বললো, -” ম্যাম আমি যখন (Na) বললাম, আপনি কিন্তু বলতে পারতেন যে, আমি ক্লোরিন (CL)বন্ধন হয়ে বিক্রিয়া করে সৃষ্টি করবো Nacl( সোডিয়াম ক্লোরাইড) Nacl হলো সোডিয়াম ক্লোরাইড যাহা একটা খাবার লবণ। মানে আমার সোডিয়াম (Na) এবং আপনার ক্লোরিন (CL) দুইটা মিলে সবচেয়ে মজবুত বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাই। যদি এই ভাবে প্রপোজ টা করতেন তাহলে অটোম্যাটিক্যালী আমার মস্তিষ্ক বিক্রিয়া করতো, তারপর রসায়নময় একটা প্রেমের বন্ধন সৃষ্টি হতো। ম্যাম বললেন ভালোই হয়েছে বাবা প্রেম না করে, প্রেমের আগেই যে জটিল সংকেত সৃষ্টি করেছো, বিয়ের পর বিক্রিয়া করে যে কি পরিমান ভয়ংকর সংকেত সৃষ্টি করতে ভাবতেই শিহরিত হয়ে যাচ্ছি।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত