একটা দরকারে বাসে করে ময়মনসিংহ ত্রিশাল থেকে চরপাড়া যাচ্ছি। আমার পাশে বসে আছে এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক।আমি কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনছি আর নিজেই গুনগুন করে গান গাইছি। হঠাৎ কোথা থেকে একটা মেয়ে এসে আমার দিকে অগ্নিময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, বাজার থেকে পচা মাছ কিনে এনেছো বলে আমি না হয় একটু বকেছি তাই বলে আমাকে একা রেখে চলে যাচ্ছ?
মেয়ের কথা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। আমি অবাক হয়ে মেয়েটাকে বললাম, আপনি কাকে কি বলছেন? আমি তো আপনাকে চিনি না। মেয়েটি তখন চিৎকার করে বলতে লাগলো, ১ মাস হলো তোমার সাথে আমি সংসার করছি আর এখন তুমি আমায় চিনতে পারছো না। এই কথা বলে মেয়েটি কাঁদতে লাগলো। পুরো বাসের সবাই আমাদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। পাশে বসা ভদ্রলোক আমার হাতে ধরে বললেন, ভাইসাহেব নতুন সংসারে এমন একটু আধটু ঝগড়া হয়৷ তাই বলে রাগ করে বউকে একা রেখে চলে যাবেন এটা কিন্তু ঠিক না। আমি তখন ভদ্রলোককে বললাম, আরে ভাই আমি এই মেয়েটাকে চিনিই না তাহলে ও আমার কি করে বউ হয়?
এইবার মেয়েটাকে বললাম, দেখেন বোন আপনার নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার কথা শুনে মেয়েটি আবার কান্না করতে করতে পাশে বসা ভদ্রলোকটাকে বললো, দেখেন ভাইসাহেব তিনবার কবুল বলে বিয়ে করা বউকে এখন সে বোন বানিয়ে ফেলেছে। একটু পর আন্টি বলে ডাকা শুরু করবে। আপনারা প্লিজ কিছু একটা করেন তা না হলে আমি এখনি গাড়ির নিচে ঝাপ দিয়ে আত্নহত্যা করবো। মেয়েটির কথা শুনে পুরো বাসের সবাই আমাকে বুঝাতে লাগলো। আমি হাজার বলার পরেও ওরা কেউ বিশ্বাস করলো না আমি মেয়েটাকে যে সত্যি চিনি না। অবশেষে সবাই আমাকে বাস থেকে নামিয়ে বললো আমি যেন বউকে নিয়ে বাড়ি যায়।
আজকাল অনেক খবর শুনি মেয়েরা ছেলেদের সাথে উল্টো পাল্টা কান্ড ঘটিয়ে তারপর ছিনতাই করে। আমিও কি শেষমেষ ছিনতাইকারীর কবলে পড়লাম। মেয়েটির দিকে তাকাতেই মেয়েটি খুব মিষ্টি একটা হাসি দিলো। বাসে মেয়েটিকে ভালো করে খেয়াল করি নি৷ কিন্তু এইবার মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকালাম। খুব সুন্দর একটা মেয়ে। চোখগুলো খুব মায়াবী।এই চোখের দিকে তাকিয়ে যে কেউ দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারবে। হয়তো রমণীর এই চোখেই আমার সর্বনাশ লেখা আছে। আমি মেয়েটিকে বললাম, দেখেন আমি খুব সাধারণ ছেলে।আমার কাছে সাধারণ এই ফোনটা আর হাজার খানিক টাকা বাদে কিছুই নেই।আপনি এইগুলো নিয়ে প্লিজ আমার থেকে বিদায় হোন।
মেয়েটি তখন আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বললো, আমাকে দেখে কি তোমার ছিনতাই কারী মনে হয়? শোনো এখন আমি যা যা বলবো তাই তাই করবে। যদি পালাবার চেষ্টা করো চিৎকার করে পাবলিকের হাতে এমন মার খাওয়াবো যে সারাজীবন ভুলতে পারবে না। মনেমনে ভাবতে লাগলাম যে মেয়ে চিনে না জানে না এমন ছেলেকে স্বামী বানাতে পারে সেই মেয়ে আমাকে পাবলিকের হাতে মারও খাওয়াতে পারে।তাই ঝামেলা না বাড়িয়ে মেয়েটি যা বলে তা মেনে নেওয়া উচিত।
মেয়েটি আমাকে ফুটপাতে গড়ে উঠা কসমেটিকসের মার্কেটে নিয়ে আসলো। তারপর আমায় বললো, তোমার পছন্দ মত একটা পায়েল কিনো তো। কোন উপায় না দেখে ৬০ টাকা দিয়ে একটা পায়েল কিনলাম। এইবার মেয়েটি আমায় বললো, পায়েলটা আমায় পড়িয়ে দাও। আমি কিছু না বলে হাটু গেরে বসে মেয়েটাকে পায়েলটা পড়িয়ে দিলাম। তারপর মেয়েটি আমায় বললো, ~তুমি কি কখনো টং দোকানে বসে লাল আদার চা খেয়েছো? আমি বললাম
— না।
মেয়েটি আমায় তখন একটা চায়ের দোকানে নিয়ে গেল। আর এক কাপ চা দিতে বললো। আমি মেয়েটিকে বললাম, আমরা ২ জন মানুষ ১ কাপ চায়ে হবে? মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো, তুমি আর আমি এককাপ চায়ে ঠোঁট ভিজাবো।।
বুঝতে পারছিলাম না মেয়েটি কেন আমার সাথে এমন করছে। মেয়েটিকে দেখে পাগল ও মনে হচ্ছে না আবার ছিনতাই কারীও মনে হচ্ছে না। এইবার মেয়েটি বললো, তোমায় নিয়ে অনেকক্ষণ রিকশাতে ঘুরবো । রিকশাতে বসে যখন ঘুরছিলাম তখন মেয়েটার খোলা চুল গুলো বাতাসে মেয়েটার মুখে আছড়ে পড়ছিলো।খুব ইচ্ছে করছিলো চুল সরানোর নাম করে আমার আঙুল দিয়ে মেয়েটার কপালটা স্পর্শ করতে কিন্তু সাহস হচ্ছিলো না যদি মেয়েটা রাগ করে। মেয়েটি তখন আমায় বললো, পিয়াস তোমার কি খুব ইচ্ছে করছে আমার কাপালে তোমার আঙুলের স্পর্শ দিতে।
মেয়েটির মুখ থেকে আমার নামটা শুনার পর চমকে গেলাম। আমি মেয়েটিকে বললাম, তুমি আমাকে চিনো? মেয়েটি কিছু না বলে শুধু মিষ্টি একটা হাসি দিলো আমি আর মেয়েটি নদীর জলে পা ঢুবিয়ে বসে আছি। আমি এখনো বুঝতে পারি নি মেয়েটি আমায় চিনে কিভাবে আর আমার সাথে কেন এমন করছে। হঠাৎ মেয়েটি বললো, পিয়াস খুব অবাক হচ্ছ তাই না আমি কেন তোমার সাথে এমন করছি. আমি কিছু না বলে শুধু মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হা সূচক মাথা নাড়ালাম।
মেয়েটি তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি তনিমা বইপোকাতে তোমার অনেক লেখা পড়েছি। তোমার লেখা গুলো পড়ে আমার মন খারাপের মাত্রা দ্বিগুণ বেড়ে যেতো।যে জিনিস গুলো আমি ভুলতে চেয়েছিলাম তুমি সেই জিনিস গুলো বারবার তোমার লেখার মাঝে তুলে ধরতে। জানো ১৫ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়। যখন আমি নিজেই নিজের খেয়াল রাখতে পারি না তখন আমি মা হয়ে যায়। একটা স্ত্রীর সবচেয়ে কাছের মানুষ থাকে তার স্বামী কিন্তু বিশ্বাস করো আমি আমার স্বামীর ভোগের বস্তু ছিলাম। দিনের পর দিন স্বামীকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসার পরেও আমি শুধু আমার স্বামীর চোখে বিছানার সঙ্গী ছিলাম।
আমার খুব ইচ্ছে হতো কোন এক সন্ধ্যা বেলা বুক পকেটে করে আমার স্বামী আমার জন্য একটা পায়েল এনে নিজ হাতে আমার পায়ে পরিয়ে দিক।শত ব্যস্ততার মাঝেও বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমার কপালে একটা চুমু দিক।মাঝে মাঝে আমায় নিয়ে পড়ন্ত বিকালে আঙুলে আঙুল রেখে অনেকটা পথা হাটুক।নদীর জলে কিছুক্ষণ আমার সাথে পা ভিজিয়ে বসে থাকুক।
কিন্তু বিশ্বাস করো আমি এর কিছুই পাই নি।বিয়ের ৬ বছর পর জানতে পারি আমার স্বামী অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক করে।নিজের বাবা মাকে জানালাম কিন্তু তারা বললো, মানিয়ে নাও তোমার আরো ২ জন ছোট বোন আছে এখন যদি তুমি ডিভোর্স নাও তাহলে এই দুই মেয়ের ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারবো না।তোমার সুখের জন্য তো আমি আমার বাকি ২ মেয়ের জীবন নষ্ট করতে পারবো না।। পিয়াস তার পর থেকে আমি মানিয়ে নিয়েছি। আজ আমার ১২ বছরের সংসার। বাড়ি ভর্তি মানুষ সবার সাথেই আমি হাসিখুশি ভাবে দিন পার করছি কিন্তু ওরা কেউ জানে না আমি একটা জীবন্ত লাশ।যে কি না প্রতি রাতেই মারা যায়।
তোমার গল্প পড়ে মনে হতো বাস্তব জীবনটা কেন তোমার গল্পের মত হয় না। আজ যখন তোমায় বাসে দেখলাম তখন ভাবলাম যে এত রোমান্টিক গল্প লিখে তার সাথে না হয় একটা দিক রোমান্টিক ভাবেই কাটাই। কথাটা বলে তনিমা হাসতে লাগলো কিন্তু আমি ওর হাসির আড়ালে ভিতরের কষ্টটা বুঝতে পারছিলাম।
সন্ধ্যা হয়ে এলো তনিমা যখন চলে যাচ্ছিলো আমি তখন তনিমার হাতটা ধরে বললাম, আমি তোমার পাশে থাকতে চাই। তনিমা মুচকি হেসে হাতটা সরিয়ে বললো, জীবনের অর্ধেকটা সময় যেহেতু একা পার করেছি বাকি সময়টাও পারবো।তুমি আবার এটা ভেবো না আমি হেরে যাবো।আমি বেচে থাকবো আমার জন্য না হলেও আমার সন্তানের জন্য। ভালো থেকো পিয়াস। তনিমা চলে যাচ্ছে আর মনের অজান্তেই এক ফোটা জল আমার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো….