স্বার্থকতা

স্বার্থকতা

দিবা!
-হুহ!
-তোদের বাড়িতে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে না?
-হ্যাঁ।
-মেয়েটার নাম কী রে?
-কে?
-ওই যে কালকে, শাড়ি পরা একটা মেয়ে তোদের ছাদে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নাচানাচি করছিল..
-ওহ! জিদনি আপু,,
-কোন ক্লাসে পড়ে?

-ক্লাস! উনি তো শুনলাম মাস্টার্স কমপ্লিট করে ব্যাংকে জব করছে! বিয়ের কথা বার্তা চলছে!
-ওহ নো!
-কেন? আবার ক্রাশ খাইছো?
-ক্রাশ আবার কী? পাকনা হয়ে গেছিস বেশি! নে ম্যাথ প্রবলেম সলভ কর! বেশি ভ্যাদরভ্যাদর করিসনা!!
-বকো কেন?
-এহ! বকো কেন! আহ্লাদ একদম দুইটা থাপ্পড় দিয়ে বাহির করব! সারাদিন গল্পের বই,সিরিয়াল,অংকে যে ফেল মারলি আমার প্রেস্টিজ পাংচার করে দিয়ে…

-দেখ,সারাদিন অংকের ফেল নিয়ে খোঁটা দিবা না।

তুমি যে ইন্টারে টেস্ট পরীক্ষায় বাংলায় ফেল করেছিলে সেটা কী? আর সেমিস্টারে কয়বার ডাব্বা মেরেছ গুনে বলব? তাপ্পর সারাদিন যে মেসি মেসি করো,ফুটবল দে কথা শেষ হওয়ার আগে ঠাস ঠাস দুটো শব্দ হলো। দুই দুইটা চড়! দিবা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো!

-তোমার লজ্জা লাগে না একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলতে? আবির একটু থতমত খেয়ে গেল। দিবাকে চড়টা থাপ্পড়টা মেরে অভ্যস্ত সে। হঠাৎ এইবিচিত্র প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে গেছে।দিবা গম্ভীর মুখে বই টা বন্ধ করল। খাতাটা বন্ধ করল কলমের ক্যাপ লাগাল। তারপর ব্যাগের ভেতর বই খাতা আর কলমটা ঢুকাল।

-কীরে! কই যাচ্ছিস?
-তোমার কাছে আর পড়ব না! তুমি নারী ও শিশু নির্যাতন কারী। আবির হেসে ফেলল।
-তুই নারী? নাকি শিশু?

দিবা জবাব দিল না। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হয়ে গেল। আবির ওর রকম দেখে হেসে ফেলল। মেয়েটা দিন দিন অভিমানী হয়ে যাচ্ছে। বাসায় ফেরার পথে এক হাঁটু জল সরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দিবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল প্রশ্নটা,তুই কি নারী? নাকি শিশু? জিদনি সবে অফিস হতে ফিরেছে। মুখ হাত ধুয়ে বারান্দায় বসে মাত্র চায়ের পেয়ালা টা হাতে নিয়ে বসেছিল। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুরে তাকাল।

-কে?
-আমি।
-ওহ! তুমি! কেমন আছো? ভাবছিলাম তোমাদের বাসায় যাব। তোমার নাম দিপা না?
-দিপা না দিবা।
-দিবা? সুন্দর নাম। চা দেব? বাসা এলোমেলো হয়ে আছে। বাসায় কেউ নেইতো। একটা দাওয়াতে গেছে । চা দেই?
-নাহ! আপা আপনি শাড়ি পরাতে পারেন? জিদনি হাসল।
-হ্যা। প্রোগ্রাম আছে কোন? পরাতে হবে?
-হু। আমি কখনো শাড়ি পরিনি। দিবা একটু ইতস্তত করছিল।
-বেশতো। নিয়ে এসো!
-আমারতো শাড়ি নেই!
-ওহ! সমস্যা নেই আমার অনেক আছে।

আর খুঁজলে আমার পুরনো ব্লাউজও পাওয়া যাবে। শাড়ি আমার শখের জিনিস। সেই ইন্টার থেকে পরি। তখনতো তোমার মতই শুকনো ছিলাম। জিদনি মিষ্টি করে হাসল। দিবা গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রইল।

আবির কাপড় আনতে ছাদে গেল।আকাশে ভীষণ মেঘ। মেঘমায়া অন্ধকার। ইলশেগুড়ি বৃষ্টি নেমেছে। হঠাৎ খেয়াল করল দিবাদের ছাদে খোলা চুল, লাল শাড়ি পরিহিতা কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। ডেকে আলাপ করবে কিনা তাই ভাবছিল। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি নামল। চলে যেতে নিয়েও সে ফিরে তাকাল আর অবাক হয়ে আবিষ্কার করল,শাড়ি পরিহিতা মেয়েটা আসলে আর কেউ নয়, দিবা। কান্ড দেখ! এভাবে কেউ চুল খোলা রেখে ছাদে আসে? তাও সন্ধ্যা বেলায়! আবার শাড়িও পরেছে! দিবা! এমন পরিবেশে এমন বেশে কেমন যেন অচেনা লাগছে,বাচ্চা মেয়েটা মনে হচ্ছে না। হুট করে যেন বড় হয়ে গেছে। শাড়িতে বাচ্চা মেয়েটাকে পরিপূর্ণ নারী মনে হচছে, কপালের টিপটা স্পষ্ট চোখে পড়ছে। দেবী প্রতিমার মত স্থির ছায়ামূর্তি।

দিবা চোখ মুদে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। বৃষ্টি ভিজে চুল লেপ্টে গেছে গালে,ঠোঁটে। আবির হেঁটে হেঁটে ছাদের রেলিংয়ের কাছে এলো। দুটো বিল্ডিং পাশাপাশি। হাতের শুকনো কাপড়চোপড় ভিজে একসা ততক্ষনে। কাছে এসে আধো আলো অন্ধকারে দেখল দিবা চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে। আবির নরম সুরে ডাকল,এই দিবা,এই! দিবা টকটকে লাল চোখ মেলে তাকাল। আবির একটু ইতস্তত করে বলল,বৃষ্টিতে ভিজিস না। দিবা জবাব দিল না। আবির আবার বলল, বাসায় যা। ভিজিস না,জ্বর আসবে। দিবা মৃদুস্বরে বলল,আসুক। আবির ফের কী বলবে ভেবে পেল না আর। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। এইমুহূতে দিবাকে ওর একটা জবা ফুল মনে হচ্ছে। বৃষ্টিস্নাত লাল টকটকে জবা ফুল।

শাড়ি পরে কৃষ্ণবরণ একটা মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বৃষ্টিতে ভিজছে এই দৃশ্য শুধু হূমায়ুন আহমেদ এর উপন্যাসেই পাওয়া যায় আবিরের মনে হলো সে তেমনি একটা উপন্যাস কিংবা গল্পের ভেতর আটকা পড়ে গেছে। ওর আর কোথাও যাওয়ার উপায় নেই বাসায় এসেই টিভির সামনে বসে যায় আবির। আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের ম্যাচটা নিয়ে সোহানের সাথে ৫০০ টাকা বাজি ধরেছে।দেখতেই হবে ম্যাচ টা,,,, কিন্তু কিছুতেই খেলা দেখায় মন বসছে না,,বারবার শুধু দিবার কথাই মনে পড়ছে তার।মেয়েটার সাথে আজ এমন করা ঠিক হয় নি। দিবার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে সময় চলে গেল টেরই পেল না। টিভির স্ক্রিনে ভালো ভাবে খেয়াল করতেই দেখলো আর্জেন্টিনা দুইটা গোল হজম করে বসে আছে!! দেখেই সারা শরীরের রক্ত মাথায় এসে জমা হয়। রাগে দুঃখে ক্ষোভে টিভিটা অফ করে দেয়। বাঙালি আর্জেন্টাইন ফ্যান দের এক জ্বালা,,,ক্রিকেট ফুটবল কোথাও শান্তি নাই,,,শুধু হার আর হার। আজ দিবার কথা কেন জানি একটু বেশিই মনে পড়ছে আবিরের। সন্ধ্যায় অন্যএক দিবাকে দেখেই তার ভেতর কেমন জানি লাগছে।

-আজ আমাকে কোনো প্রকার শক্ত কথা বললেই আমি কিন্তু আর কখনো পড়তে আসবো না,,, দিবার এমন কথা শুনে হেসেই ফেলে আবির।এই নিয়ে অনেকবার শুনতে হয়েছে এই কথা। দ্বাদশে পড়া মেয়েটাকে এখনো ছোট্টখুকি ই মনে হয় তার।

-ওমা তাই নাকি??আচ্ছা আসিস না,অন্য কাউকে খুঁজে নিস দিবা কিছুক্ষণ জিম ধরে বসে থেকে বলে,,

-আচ্ছা আমাকে কি তোমার এখনো ছোট মনে হয়??আমার আকার ইঙ্গিতগুলো বুঝো না??আর কি করবো তোমার জন্য??কিভাবে বুঝাবো??

-আশ্চর্য! কি হল দিবা? এমন করছিস কেন?
-তুমি এত অবুঝ কেন? জানো না মেয়েদের বুক ফাটে কিন্তু মুখ ফাটে না? কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই ছলছল চোখে বেরিয়ে যায় দিবা আর আবির হা করে দেখে থাকে।

এছাড়া আর কিছুই করার নেই তার,,,ছোটবেলায়ই মা বাবাকে হারিয়ে এতিম হয়ে যায়,,পরে চাচার দোয়ায় আজ ঢাবিয়ান। দিবা তো বাবা মায়ের আদরর টুকরি। সেকি পারবে আবিরের সাথে একাকি থাকতে,দু মুঠো খেলে খেলো না খেলে নাই,,এভাবেই দিন পার করতে,,, দুবছর পরঃ এখন রাত এগারোটা পঞ্চাশ মিনিট। আর দশ মিনিট পরই দিবার জন্মদিন দিন। আবির নিজেকে একটু অন্য সাজে সাজিয়ে দিবার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বারটা বাজতেই হঠাৎ আতশ বাজির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় দিবার। বারান্দার দরজা খুলে নিচে তাকাতেই দেখে আবির দাঁড়িয়ে আছে। সে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এল। নিচে আসা মাত্রই আবির বললো

-চল না একটু হাঁটি আজকে,,চাঁদটাও খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। দুজনেই চুপচাপ হেঁটে যেতে লাগলো,,আবির হঠাৎই দিবার সামনে নি ডাউন হয়ে বসে গেল আর গোলাপগুচ্ছ সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো,,

-তোর সবকিছুই বুঝি আমি পাগলি। কিন্তু কি করবো বল। ভালোবাসা দিয়েই তো সব হয় না,,,বাবা মায়ের আদরের টুকরিটাকে ভালো রাখার জন্য কিছুই যে নেই আমার,,তাই আগে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করলাম আজ তাই গর্বের সহিত তোর সামনে এসে বসেছি,,,ফেরাস না আমায় প্লিজ। দিবা অশ্রুসিক্ত চোখে আবিরকে তুলে নেয় আর বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে বলে

-ভালোবাসি!! পূর্নিমা রাতে চাঁদের স্নিগ্ধতা গায়ে মেখে দুজোড়া পা হেঁটে চলছে আর পিছঢালা পথটাকে সাক্ষী হিসেবে রেখে যাচ্ছে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত