— শাড়ি পরে হাঁটা খুব কষ্টের তাই না রাহাত ভাই? এমন অদ্ভুত কথা শুনে হঠাৎ রাহাত চমকে উঠলো। ফিরে দেখলো নিধি দু’হাতে শাড়ি টাকে হালকা উপরে তুলে ধরে দাড়িয়ে অাছে। রাহাত অারো ভালো ভাবে খেয়াল করে দেখলো নিধি অাজ হালকা করে খয়েরী লিপইস্টিকও পরেছে।অাজ একমাসের মাঝে রাহাত নিধিকে কখনো সাজতে দেখেনি । অাজ নিধির এই শাড়ি পরা, সাজা সব দেখে কিছু টা অবাক হলো।
ছোট থেকে প্রবাসে বড় হওয়া রাহাত নানার হাজার অাবদারে অনেক বছর পর দেশে অাসলো। সম্পর্কে নিধি তার মামাতো বোন। রাহাতের ১০ বছরের ছোট। কিন্তু এমন ভাবে রাহাতের সাথে কথা বলে, যেন সে রাহাতের কাছাকাছি বয়সের হবে। এই জিনিসটা রাহাতের অসহ্য লাগে। তার মনে হয় নিধি সারাদিন তার পিছু পিছু ঘুরে। যার কারণে নিধি কে সে সহ্যই করতে পারেনা। সে সব সময় একা থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু নিধি তাকে একা থাকতেই দিচ্ছেনা। রাহাত কে চুপ থাকতে দেখে নিধি অাবার বলে উঠলো,
— বান্ধবীর বিয়েতে যাচ্ছি। অামার একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড। অনেক কাছের। ওর কাছ থেকে অামি কখনো কোনো কথা লুকিয়ে রাখিনা। সব বলি ওকে। এই যে অাপনার কথাও বলেছি।
— অামার কথা? অামার কথা কি বলেছো?
— বলেছি অামার ১ টা কাজিন অাছে, বিদেশ থেকে এসেছে। দেখতে স্মার্ট হলেও, চালচলন সুবিধের না। ঠিক ভাবে কথা বলতে পারেনা। হাসতেও পারেনা। হাহাহাহা।
কথা টা বলেই নিধি জোরে হাসতে লাগলো। নিধির এমন কথা অার হাসি শুনে রাহাতের তখন মন চেয়েছিলো জোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতে নিধির গালে। কিন্তু ভদ্রতার খাতীরে তা না করে চুপচাপ সেখান থেকে নিজের রুমে চলে গেলো। রাহাত কে এভাবে চলে যেতে দেখে নিধি মনে মনে খুব মজা পেলো। অাজকাল রাত-দুপুরেও নিধির একাকিত্ব লাগে সব। নিজেকে খুব একা লাগে। আর যখন ই এমন হয় তখনই তার সাজতে ইচ্ছে হয়। নিধির নিজের ই এটা অবাক লাগে। অাগে তো সে কখনো সাজ গোজে এত সৌখিন ছিলোনা। কিন্তু এখন এমন কেন হয়, সে নিজেই জানেনা। এটা নিয়ে বেশি ভাবলে তার মাথা যেন কেমন কেমন করে। তাই বেশি না ভেবে যখন যা মন চায় তা করে বসে।
নিধি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত ১২ টা বাজে। চারদিকে সব কিছু নিশ্চুপ। শুধু ঝিঁঝিঁদের ডাক শুনা যাচ্ছে। নিধি চুপচাপ অালমারি খুলে একটা সাদা কাতান বের করলো। শাড়িটা নিধির দাদুর। নিধি দেখলো শাড়িটায় হালকা অাকাশি রঙের অাভাও দেখা যাচ্ছে। নিধি অাকাশি রঙের ব্লাউজ দিয়ে শাড়িটা পরে ফেললো। চোখে কাজল পরলো। তারপর চুপচাপ ছাদে চলে গেলো।চাঁদটা অদ্ভুত রকমের অালো ছড়িয়েছে। চাঁদের অালো দেখে নিধির একাকিত্ব যেন অারো বেড়ে গেলো। সে বুঝতে চেষ্টা করলো, সে কাকে মিস করছে। মা কে, নাকি দাদু কে!ছোট থেকে মা হারা নিধি যখন দাদুর স্নেহে বড় হচ্ছিলো তখন ই একদিন নিধির সে সুখও কেড়ে নেয় বিধাতা। নিধি যখন এসব ভাবছিলো হঠাৎ তখন রাহাত অাসে সেখানে। এত রাতে নিধিকে একা ছাদে দেখে রাহাত বললো,
— রাতে একা ছাদে ভয় লাগেনা?
নিধি চমকে গিয়ে পিছনে ফিরে দেখলো রাহাত দাড়িয়ে অাছে। তাকে দেখে নিধির বুকের মাঝে কেমন যেন অনুভব হলো। তার প্রচুর কান্না পাচ্ছিলো। ইচ্ছে করছিলো রাহাতকে ধরে অনেক কান্না করতে। কিন্তু তা সে করলো না। কারন, নিধি জানে রাহাত তাকে পছন্দই করেনা।অার যারা অপছন্দ করে তাদের কখনো কষ্ট দেখাতে নেই। নিধি কে চুপ থাকতে দেখে রাহাত অাবার বললো,
— এত রাতে শাড়ি পরে অাছো কেন? তাও সাদা শাড়ি! নিধি তাও চুপচাপ রাহাতের দিকে চেয়ে দাড়িয়ে রইলো। রাহাত খেয়াল করলো চাঁদের ধূসর অালো অার নিধির সাদা শাড়ি নিধির চেহারায় এক ধরণের মায়া ভাবের সৃষ্টি করেছে। চাঁদের অালোয় নিধিকে অসম্ভব মায়াবতী লাগছে। রাহাত খেয়াল করলো, নিধির চোখের নিচে কি যেন চকচক করছে। নিজের অজান্তেই সে নিধির গালে হাত লাগিয়ে দেখলো। রাহাত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— তুমি কাঁদছো কেন?
নিধি এক ঝটকায় রাহাতের হাত সরিয়ে সেখান থেকে দৌড়ে চলে গেলো। অার রাহাত অবাক চাহনি নিয়ে তার চলে যাওয়া পথে চেয়ে চেয়ে ভাবছিলো, মেয়েটা কি অদ্ভুত! কখনো হাজার কথার ফুলঝুরি অার তখনো বিরহের রং তুলি। সে রাতে রাহাতের ভালো ভাবে ঘুম হলোনা। বারবার তার মনে চাঁদের অালোয় দেখা অপরুপ মায়াবি নিধির সে চেহারা ভেসে উঠলো। অার বারবার প্রশ্ন জাগলো, নিধির কান্নার কি কারন ছিলো!
পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে নিধি কে দেখা গেলোনা। সারাদিন ২/১ বার ছাড়া নিধিকে অার একবারের জন্যও রাহাত চোখে দেখেনি। রাহাতের রাগ হতে লাগলো। যে নিধি সারাক্ষণ তার পিছু পিছু ঘুরতো, সে নিধির এমন পরিবর্তন তার মন মানতে রাজি হচ্ছিলো না। তার অজান্তেই তার মন চাচ্ছিলো নিধি তার অাশে পাশে ঘুরঘুর করে তার সে অদ্ভুত সব গল্প গুলো শুনাক।
কিন্তু নিধি তা করলোনা। নিধি সিদ্ধান্ত নিলো রাহাত যতদিন এই বাড়িতে থাকবে ততদিন অার রাহাতের সামনে দরকার ছাড়া যাবেনা।। গত রাতে সে শেষ রাত পর্যন্ত জেগে ছিলো। তার বারবার মনে হয়েছিলো সে রাহাতকে পছন্দ করে ফেলেছে। এই পছন্দ অন্য রকমের এক পছন্দ। ভালোবাসাও বলা যায়। এখন রাহাতকে দেখলেই তার কেমন যেন কষ্ট হয়। হয়তো না পাওয়ার কষ্ট। সে জানে সে কখনো রাহাতকে পাবেনা। তার কাছে ভালোবাসা জিনিস টা অদ্ভুত ঠেকলো। তার মনে হলো ভালোবাসা এক ধরণের ক্রয় – বিক্রয় হিসাব। যেখানে হৃদয় দিয়ে কষ্ট কিনা হয়।
মসজিদ থেকে এশার অাযান শুনা যাচ্ছে। যত রাত নামছিলো রাহাতের বুকের মাঝে যেন তত বেশি শূন্যতা বেড়ে যাচ্ছিলো। তার ইচ্ছে হচ্ছিলো নিধিকে কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারতে অার জিজ্ঞেস করতে, এত নাটকের কারন কি। কিন্তু মনে মনে অনেক রাগ হলেও সে রাগ সে কাউকে দেখাতে পারলো না। যত রাত নামছিলো রাহাতের কষ্ট ততই বেড়ে যাচ্ছিলো। সারারাত তার কাটলো কষ্টের পিছনের কারন খুঁজতে খুঁজতে। পরদিন সকাল সকাল সে চলে গেলো শাড়ির দোকানে। জীবনে প্রথম কোনো মেয়ের জন্য শাড়ি কিনবে সে। সে ভাবলো, বাঙালী মেয়েরা দেখতে যতটা সাধারন হয় অাসলে ততটা সাধারন তারা নয়। তাদের সাধারন সাজগোজ, চালচলনের পিছনে রয়েছে অসাধারণ সব সৌন্দর্য। যা সে নিধি কে না দেখলে কখনোই বুঝতোনা। সে মনে মনে হেসে ভাবলো, মেয়েটা কি অদ্ভুত! নিজে তো প্রেমে পড়লো, সাথে অামাকেও পড়ালো।
সন্ধ্যে রাতে নিধি রুমে ঢুকে দেখলো, খাঁটের উপর ১ টি মেরুন রঙের প্যাকেট। কৌতুহল নিয়ে সে প্যাকেট টা খুলে অবাক হলো। ভিতরে একটি নীল রঙের শাড়ি। শাড়ি টা বের করার সময় একটি চিরকুট পেলো সে। নিজের অজান্তেই কেন জানি তার হৃদয় কেঁপে উঠলো। কাঁপা হাতে সে চিরকুট টি পড়তে লাগলো, নিধি, অাজকাল অামার খুব করে ইচ্ছে করে তুমি-অামি হাত ধরে হেঁটে যাবো জোনাকির মাঝে। অামার ইচ্ছে করে ঘোর অামাবস্যায় তুমি অামার চাঁদনী হয়ে পাশে থাকো। ধূসর অন্ধকারে অামি তোমার চেহারা অাঁকবো চোখের তারায়। ভালোবাসা কি অদ্ভুত তাই না নিধি? মজার ছলে সে নামলো অামাদের মাঝে।
সেদিন চাঁদনী রাতে প্রথম তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। অার সারাজীবন অারো বারবার প্রেমে পড়তে চাই। শর্ত একটাই! শাড়ি পরা কষ্টের হলেও তোমাকে শাড়ি পরতে হবে। চিরকুট টা পড়া শেষ করেই নিধি নিজে নিজে বলে উঠলো, পরবো। সারাজীবন পরবো। নিজের অজান্তেই তার গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। সে তাড়াহুড়া করে সে জল মুছে শাড়ি টা নিয়ে অায়নার সামনে চলে গেলো। যত তাড়াতাড়ি হোক তাকে শাড়ি টা পরে ছাদে যেতে হবে। রাহাত যে তার অপেক্ষায় অাছে।