তৃপ্তিকর ভালবাসা

তৃপ্তিকর ভালবাসা

–নীল জামদানি শাড়িটা দেখান তো । এর সাথে ম্যাচিং করে ব্লাউজের কাপড় আছে তো ? তিথী শাড়িটা দেখুন, কেমন লাগছে শাড়িটা ? বেশ কৌতুহল হয়ে আরিফ শাড়িটা দেখছে আর আমাকে বলছে ।আমি উনার পাশেই বসে আছি । একই অফিসে চাকরী করি সেই সুবাদে দু’জনের বন্ধুত্ব । উনার অনুরোধে অফিস শেষে মার্কেটে আসলাম।

–শাড়িটা খুব সুন্দর। আমি অনেকটা বিচলিত হয়ে উনাকে বললাম।বুঝতে পারছিনা আসলে শাড়িটা কার জন্য বা আমাকে নিয়েই কেন শপিং করতে আসলেন ?

–আচ্ছা তিথী, শাড়ির সাথে আর কি কি ধরনের প্রসাধনী লাগে ? আসলে আমার তো কোনো ধারনা নেই তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করা। কিছু মনে করবেন না, প্লিজ।

–আরে না না , ইটস ওকে। মনে করার কি আছে ? শাড়ির সাথে মিল রেখে আপনি প্রসাধনী কিনবেন, সেটা ঠিক আছে । কিন্তু যার জন্য কিনবেন তিনি দেখতে কেমন বা উনাকে কেমন জিনিস মানাবে সেটাতো আমি জানিনা।

–দেখতে খুব সুন্দর।যার সৌন্দর্যের কাছে দুনিয়ার সব সৌন্দর্য হার মানাবে। তার চোখে রয়েছে অসীম ভালবাসা আর মায়া । যেটা মুখ ফুটে বলার আগেই আমি বুঝে ফেলি।কারণ তার চোখ যে কথা বলে ।জানেন , তার চোখে সর্বদা কাজলের রঙ লেপ্টে থাকে ! তার মাথার চুলগুলো খুব সুন্দর । জানেন, আমি যখনি সময় পাই তার চুলগুলোর যত্ন নিতে শুরু করি। আরিফ চোখ বন্ধ করে তখন থেকে একজন রমণীর প্রশংসা করছে।আর আমি মুগ্ধ নয়নে সেটা দেখছি এবং অনুভব করছি।পরবর্তীতে আরিফকে বললাম,

–আপনি নীল জামদানিটা নিন।একজোড়া ঝুমকো নিবেন সাথে । এলোচুলে রক্তজবা না না বেলীফুলের মালাটা ই নিয়েন । দু’ডজন সিলভর কালার কাঁচের চুড়ি নিয়েন । চাইলে একটা কাজল নিতে পারেন । কারন যার চোখ এত সুন্দর তাকে হালকা কাজলে না জানি কত সুন্দর লাগবে !

–চলুন তাহলে । আরিফ আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো। প্রসাধনীগুলো নিয়ে আমরা মার্কেট থেকে বেরিয়ে আসলাম।আরিফের চোখে মুখে খুশির আভা ! বেশ ইতস্ত:ত করে উনাকে প্রশ্ন করলাম,

–এইসব কেনাকাটা আপনার স্ত্রীর জন্য ?

–না , আমার গার্লফ্রেন্ডের জন্য । অনেকটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আরিফ উত্তর দিলো।

–ও আচ্ছা । আরিফ সাহেব, তাহলে এবার আমি যাই।বাসায় ফিরতে হবে । আমিও আর কথা বাড়ানোর ইচ্ছে পোষণ করলাম না।

–চলুন না, তিথী । আপনি নিজ হাতে আমার গার্লফ্রেন্ডকে সাজিয়ে দিবেন আজ।

–মানে ? ঈষত কপালের চামড়া কুঁচকে উনাকে প্রশ্ন করলাম।

–আজ প্রায় সাতবছর যাবৎ আমরা একই অফিসে চাকরী করছি।আশা করি, আপনার কাছ থেকে ভরসা রাখার মত যোগ্যতা আমি অর্জন করেছি । সেই সৎ সাহস থেকে আমার বাড়িতে যাওয়ার জন্য আপনাকে অনুরোধ করতেই পারি।তাই নয় কি?

–আচ্ছা ।

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মৃদু হেসে উত্তর দিলাম। ঘন্টাখানেক পর আরিফের সাথে উনার বাড়িতে আসলাম।কলিংবেল চাপতেই ৩০/৩৫ বছর বয়সী একজন মহিলা দরজা খুলে দিয়েছেন । দেখে মনে হলো উনি আরিফদের বাড়িতে কাজ করেন। ফ্ল্যাটের ভেতরে গিয়ে আমি হতবাক হয়ে গেলাম ! বিছানায় একজন মহিলা শুয়ে আছেন । এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমাকে দেখছেন ! চোখের নিচে অসম্ভব কালি পড়ে গেছে ! মাথায় পাকা কাঁচা মিলিয়ে অগুনতি চুল ! খাটের পাশে একটা হুইল চেয়ার রাখা। দেখে মনে হচ্ছে কয়েকবছর যাবৎ উনি এভাবেই শুয়ে/বসে দিনগুলো অতিবাহিত করছেন!

–উনি আমার মা , আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া আমার শ্রেষ্ঠ উপহার, আমার জান্নাত, আমার গার্লফ্রেন্ড । কথাগুলো বলে আরিফ বাচ্চাদের মত চোখের পানি ফেলতে শুরু করলো । কত আকুতি লুকিয়ে আছে এই কাঁন্নায় !

–উনার কি হয়েছে ?

আরিফকে কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করলাম। আরিফের কাঁন্না দেখে আমারও খুব কাঁন্না পাচ্ছিলো।মা তো মা’ ই। সেটা আমার মা হোক বা অন্যের ।

— প্যারালাইজড ।

বছর চারেক আগে ব্রেইনস্ট্রোক করে এমনটা হয়েছে । আজ মায়ের জন্মদিন। আমরা তিন ভাই বোন।আমি সবার বড় । বোন আর ভাই, ওরা নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। সংসার হলে বুঝি মা বাবাকে ছেড়ে দিতে হয় ? তখন আর মা বাবাকে লাগেনা ? আসলে এসব মনে করেই বিয়ে করিনি।কারণ আমার চিন্তা ছিল মা’কে নিয়ে। যদি সংসার করার পর বাকি ভাই বোনদের মত আমিও মাকে হারিয়ে ফেলি সেই ভয়ে ।

–সবাই কি আর এক ? হাতের পাঁচ আঙ্গুল সমান নয় আরিফ সাহেব । আপনার বাকি ভাই বোনেরা আসবেনা ? আর আপনার বাবা ?

–বাকি ভাই বোনদেরকেও আসতে বলেছি । জানিনা ওদের সময় হবে কিনা ? কারণ ওরা খুব ব্যস্ত।কাজের মাঝে মায়ের জন্য সময় বের করাটা হয়ে ওঠেনা ওদের । বাবা বেঁচে নেই । মা এখন আমার সব ।

–আন্টির জন্য নিয়ে আসা জিনিসপত্রগুলো দিন । উনাকে সাজিয়ে দেই।

আরিফ জিনিসপত্রগুলো দিয়ে চলে গেলো।আমি আর আমেনার মা (আমি আসার পর যিনি দরজা খুলে দিয়েছিলেন) আন্টিকে নীল জামদানি শাড়িটা পরিয়ে দিতে শুরু করলাম। হাতে চুড়ি পরিয়ে দিলাম আন্টিকে ।
উনার মাথার চুলগুলো আসলেই খুব সুন্দর । চুলগুলো স্পর্শ করতেই আরিফ দরজার ওপাশ থেকে বললো,

–তিথী , অনুমতি পেলে মায়ের চুলগুলো আমি বাঁধিয়ে দিতে চাই। উনি হয়তো অপেক্ষা করছিলো মায়ের চুল বাঁধিয়ে দেওয়ার জন্য।

–আচ্ছা, ভিতরে আসুন ।

অত:পর আরিফ দুহাতে আলতো করে মায়ের চুল আঁচড়িয়ে দিচ্ছে । এটাই যেন জীবন্ত ভালবাসা ! পাশে বেলীফুলের মালাটা রেখে দিলাম।আরিফকে দেখে মনে হচ্ছে কৌতুহল হয়ে বাচ্চা ছেলের মত মায়ের চুল নিয়ে খেলছে । যেমন একটা নিষ্পাপ বাচ্চা মায়ের কোলে শুয়ে হাত পা ছুড়ে মায়ের চুল নিয়ে খেলে ঠিক তেমন ! আমি পাশে দাঁড়িয়ে অনুভব করলাম এক তৃপ্তিকর ভালবাসা !

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত