বৃদ্ধতা ও ভালোবাসা

বৃদ্ধতা ও ভালোবাসা

ছেলের রুমের দরজার সামনেই এসে থমকে গেলাম। ভিতর থেকে বৌমার চেচামেচির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । বৌমা ছেলের কাছে অভিযোগ দিচ্ছে, “তোমার মায়ের বান্দিগিরি করতে করতে আমার কি হাল হয়েছে দেখো! কি ছিলাম আমি, আর এখন কি হলাম? উনার হঠাৎ শখ হল কলার মৌচার তরকারী খাবেন। উনি তো বলেই খালাস, ওসব কাটতে গিয়ে হাত আর নখের অবস্থা খারাপ হচ্ছে তো আমার। বিনা পয়সায় ঝি পেয়েছেন তো তাই ইচ্ছেমত হুকুম চালান।” বৌমা এটুকু বলে একটু থামল। ভেবেছিলাম রাশেদ হয়ত এর প্রতিউত্তর করবে। আমার ছেলের দিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে বৌমা আবার বলতে শুরু করল, “আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছেনা ঝিগিরি করা। তুমি উনাকে কোনো বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসো।” এবার আমার সুপুত্র মুখ খুলল। কিছুটা ফিসফিস করে বলল,

— মিতু, আস্তে কথা বলো। তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? না ভেবে যা মনে আসছে বলছো। একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবো, এখন যদি মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিই মায়ের নামে যে ৫০ লক্ষ টাকার জায়গা আছে সেটা পাবনা। আর বাবার পেনশনের টাকার ভাগ ও হাতে আসবেনা। বৌমা একটু নরম হয়ে বলল,

— কিন্তু এভাবে আর কত দিন? আমার এসব ঝামেলা ভালো লাগছেনা। উনাকে তুমি রাতুলের কাছে রাখলেই তো পারো। মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসতাম, খরচাপাতি পাঠিয়ে দিতাম।

— একটু বুঝো তুমি। রাতুল এমনিতেও বাবাকে নিজের কাছে রেখে সম্পত্তি হাত করছে। এখন যদি আমরা মাকে হাতে না রাখি তাহলে সবকিছু ওর ভাগেই চলে যাবে। আর কয়েকটা দিন ই তো। বাবার টাকার মেয়াদপুর্তি হলে ভাগাভাগির কাজ টা সেরে নিব। তখন মাকে বিদায় করব। এসব শুনে আমার চোখে পানি টলমল করছে।বুকের মধ্যে অনবরত হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। আর এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম।

আমার আর মিরাজের ২ ছেলে- রাশেদ আর রাতুল। অনেক কষ্টে-আদরে মানুষ করেছি ওদের। কখনো কোনো অভাব বুঝতে দেইনি। আজ দুজন ই উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত, বিয়ে করে সংসার আলাদা করে নিয়েছে। আলাদা করে নিয়েছে আমাকে আর মিরাজকেও। তাদের পক্ষে সম্ভব না আমাদের দুজনের দায়িত্ব একসাথে নেওয়া। দীর্ঘ ২৭ বছরের সংসারে আমরা কখনো একে অপরকে ছেড়ে আলাদা থাকিনা। প্রতিটা সকাল দুজন দুজনের মুখ দেখে শুরু করতাম। আর রাতে তো মিরাজের আমাকে বুকে না রাখলে ঘুম ই হতনা। অথচ আজ ৫মাস আমরা দুজন দুজনকে একটিবারের জন্যও দেখিনি। প্রতিদিন রাশেদ অফিস থেকে ফেরার পর তার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি একটাবার ওর সাথে ফোনে কথা বলিয়ে দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে।

কখনো-সখনো সর্বোচ্চ ৫মিনিট কথা বলার সুযোগ পাই। কখনো রাশেদের বা বৌমার ঝাড়ি শুনি, “প্রতিদিন কিসের কথা আপনাদের? বুড়োবয়সে এত প্রেম আসে কোথা থেকে?” এসব শুনে তাকে স্মরণ করে চোখের পানি ফেলা ছাড়া উপায় থাকেনা। ছোট ৭ বছর বয়সী নাতিটাকে স্কুলে দিয়ে আসার পথে ফেক্সিলোডের দোকানের সামনে দাড়ালাম। বৌমার অনুপস্থিতিতে পরশুদিন পাশের ফ্ল্যাটের ঘর মুছে দিয়ে ২০টাকা পেয়েছি। মিরাজের সাথে কথা বলব বলে পরম যত্নে আচলের কোণে বেধে রেখেছি। আধছেড়া কাগজে লিখে রাখা নাম্বারটা টুকে দিয়ে দোকানদার ফোনটা হাতে দিল। মনে মনে চাচ্ছিলাম ল্যান্ডফোনটা যাতে অন্য কেউ না ধরে। ওপাশ থেকে চিরপরিচিত স্বর টা ভেসে আসে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলি,

— ওগো, কেমন আছো তুমি? মিরাজ কান্না জড়ানো কন্ঠে বলে,
— সাথী তুমি কেমন আছো? তোমার শরীর ঠিক আছে তো? এতদিন পর আমার কথা মনে পড়ল? প্রতিদিন তোমার কন্ঠ শোনার অপেক্ষায় থাকি আমি জানোনা? ছলছল করতে থাকা চোখের পানি ছেড়ে দিলাম। মানুষটার একসাথে হাজারটা প্রশ্ন করার স্বভাব কখনো বদলাবেনা।

— হ্যাগো আমি ভাল আছি। তুমি কেমন আছো? শরীর ঠিক তোমার?
— ভালো নেই আমি। তোমাকে ছাড়া বড্ড অসহায় লাগছে। ছেলে-বৌ কেউ তেমন একটা কথা বলেনা আমার সাথে, খুব একা একা লাগে। ইচ্ছে করে তোমার কাছে ছুটে যাই। বলেই বাচ্চাদের মত কাঁদতে থাকে মিরাজ। ওকে শান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমারো জানা নেই। কান্না আটকে বললাম,

— খেয়েছো তো তুমি?
— দুধভাত ছাড়া কিছু খাওয়া হয়না আমার।

অনেকদিন ধরে তোমার হাতের বিরিয়ানি খেতে মনে চাচ্ছে। বৌমা কে এসব নিয়ে কিছু বলার সাহস পাইনা। সাথী, আমাকে একটু বিরিয়ানি রান্না করে খাওয়াবা? আর কিছু বলতে পারলামনা। এভাবে আকুল আবেদন কেউ তার বউকে কখনো করেছে কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু কিছু করার ও নেই আমার। আমার হাতে স্বামীকে কিছু রান্না করে খাওয়ানোর সাধ থাকলেও সাধ্য নেই।

মাঝ রাতে একটা ছোট ব্যাগ হাতে নিয়ে অতি সাবধানে বাসার গেট খুলে বাহিরে এসে দাড়ালাম। চারিদিক ভীষণ নির্জন। একদিন ঠিক এমন একটা মূহুর্তে মিরাজের হাত ধরে সবার অজান্তে পালিয়ে গিয়েছিলাম। মিরাজ সিএনজি থেকে নেমে আমার সামনে দাড়াল। আধপাকা গোঁফ-দাড়ির আড়ালে বাচ্চা বাচ্চাভাব টা লেপ্টে আছে এখনো। অনেকদিন পরে দুজন দুজনকে দেখে আর স্থির থাকতে পারলামনা। ওর হাত জড়িয়ে ধরে কেদেই ফেললাম। ও আমার চামড়া কুচকানো বৃদ্ধ হাত শক্ত করে ধরে বলল, “চল সাথী। আবার পালাই ঠিক সেই ২৭ বছর আগে যেভাবে পালিয়েছিলাম।” আমি মুচকি হেসে তার হাত চেপে ধরে সেদিনের মতই সম্মতি দিয়েছি।

ছোট একটা কুড়েঘরে আবার সংসার বেধেছি আমরা। মিরাজ সারাদিন রাস্তায় বাচ্চাদের খেলনা বিক্রি করে বাজার আনে, সেটা রান্না করে রাতে দুজন দুজনকে খাইয়ে দিয়ে কোলে মাথা রেখে সুখের গল্প করি। ছেলেদের সাথে আর যোগাযোগের চেষ্টা করিনি। যে সম্পত্তির লোভ ওরা করেছিল তা আমরা বৃদ্ধাশ্রমে দান করে দিয়েছি। সত্যিই আমরা এখন ভীষণ সুখে আছি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর কখনো আমরা আলাদা হতে চাইনা।বৃদ্ধ হয়েছি ঠিকিই কিন্তু ভালোবাসাটা এখনো জীবন্ত কৈশোর।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত