একদল নরপশু জোরপূর্বক নিলুকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পাশের জঙ্গলে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। পরে তার রক্তাক্ত নিথর দেহটাকে আবার রাস্তার পাশের ঝোপে ফেলে রেখে চলে যায়। এলাকাটি বেশ নির্জন হওয়ায় এই রাস্তা দিয়ে মানুষের তেমন যাতায়াত নেই। ততক্ষণে পশ্চিমাকাশে সুয্যিটা হেলে পরেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকারে পুরো এলাকা ঢেকে যাবে। যেখান থেকে নিলুকে তুলে নেয়া হয়েছিল তার অদূরেই একটা ফ্যাক্টরি। তাতেই কাজ করতো নিলু। ওভারটাইম কাজ করার জন্য বাসা থেকে ফ্যাক্টরিতে যাচ্ছিল সে। এদিকে আব্দুর রব মৌলানা তাড়াহুড়ো করে সাইকেলে করে মসজিদে যাচ্ছে মাগরিবের জামাত পড়াবে বলে। ফুটপাত দিয়েই সাইকেল নিয়ে যাচ্ছিল মৌলানা। হঠাৎ একটি কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে তার কানে।
হ্যাঁ, আওয়াজটা ঝোপের দ্বার থেকেই আসছে। সাইকেলটা দাড় করিয়ে এবার ঝোপের দিকে এগিয়ে যান তিনি। কিন্তু একি! অর্ধ বিবস্ত্র একটি মেয়ে রক্তাক্ত হয়ে পরে আছে! সাথে সাথে সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে নেন তিনি। ঠিক সেই মুহুর্তে দূরের কোন মিনার থেকে ভেসে আসলো ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার। আশহাদু আল্লাহ্ ইলাহা ইল্লাল্লাহ.. ‘ -মৌলানা মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলেন। ভরসার স্বরে বললেন; মা, তুমি কে আমি জানিনা। ধরে নাও মহান আল্লাহই তোমার সাহায্যার্থে আমাকে পাঠিয়েছেন। তোমার আর কোন ভয় নেই।’ -এই বলে মাথা থেকে তাঁর পাগরী মোবারক খুলে মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ‘এই নাও, আপাতত এটি দিয়ে তোমার শরীরটা ঢেকে নাও! আমি সালাত আদায় করে তোমাকে এখান থেকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাব’।
রাস্তার পার্শ্বে ঘাসের চাদরে ছোট সূরা দিয়ে ফরজ তিন রাকাত নামাজ আদায় করে দিলেন মৌলানা। কিছুক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটি রিক্সার ব্যবস্থা করলেন। এবার মেয়েটিকে রিক্সায় তুলে দিয়ে নিজেও সাইকেল নিয়ে পিছু পিছু চলতে লাগলেন। পার্শ্ববর্তী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাবার পর একজন নার্সকে ডেকে আনেন তিনি। বারান্দার বেঞ্চে একান্তে কথা বলার জন্য নিলু আর নার্সকে একা ছেড়ে দিলেন। নিলুর বিষয়ে তার নাম বা অন্যকোনো তথ্যই ছিলনা মৌলানার কাছে। নার্সের কাছে ঘটনাটি বলার পর হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে নিলু। মৌলানা এবার তাঁর বড় ছেলে আব্দুর রউফকে ফোন দিয়ে বলেন হাসপাতালে আসার জন্য। আব্দুর রউফ সবেমাত্র অনার্স পাশ করেছে। বাবার ফোন পেয়ে ছুটে আসে সে। সব জানার পর মর্মাহত হয় আব্দুর রউফ এবং সেখানকার সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। ততক্ষণে নিলুর পরিবারের মানুষজন চলে আসে এবং পুলিশও। পুলিশ নিলুর জবানবন্দি নেয় এবং দোষীদের ধরতে তাদের তল্লাশি শুরু করে দেয়।
একটি বিশেষ রুমে নিলুর ট্রিটমেন্ট চালাচ্ছে ডাক্তাররা। বারান্দায় বারবার মুচড়া যাচ্ছেন নিলুর বাবা-মা। নিলুর বাবা তার মায়ের তুলনায় বয়স্ক বেশি। হয়ত রোগব্যাধির কারণেই তেমন দেখাচ্ছে। সংসারের খরচ চালানোর জন্যেই নিলুকে ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে হতো। রাত ন’টা বাজে তখন। দু’জন সাংবাদিক চলে এসেছে নিলুর ছবি নিতে। আব্দুর রউফ তাদেরকে ছবি তুলতে বাঁধা দেয়। সাংবাদিকরা কারণ জানতে চাইলে আব্দুর রউফ বলে; ‘আপনারা পারলে দোষীদের ধরার জন্য পুলিশের সহায়তা করুন গিয়ে। নিউজ করুন ঠিক আছে। কিন্তু এই মেয়ের ছবি বা নাম-পরিচয় কিছু যেন পাবলিশড না হয়। এতে করে সমাজে মেয়েটার লাঞ্ছনা আরো বেড়ে যাবে। পারলে দোষী তথা যারা ধর্ষক তাদের নাড়িনক্ষত্র খুজে বের করে সেগুলো পত্রিকায় প্রকাশ করুন’। তার কথা শুনে সাংবাদিকরা ছবি না তুলে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে নিলুর নাম-পরিচয় গোপন রেখে দোষীদের খুজে বের করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করত পুলিশের কাজে সহায়তার আশ্বাস দিয়ে চলে যায়।
নিলুর বাবা-মা মৌলানার পাশে বসে কান্নাকাটি করা শুরু করেন। নিজেদের মেয়ের এমন সর্বনাশে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন তারা। বলতে থাকেন; ‘আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই অক্ষম বলে মেয়েটাকে সংসার চালাতে কাজ করতে হতো। এখন আমাদের কি হবে। আমাদের মেয়েটার জীবনটা যে নষ্ট হয়ে গেল। সমাজে মেয়েটা কি করে মুখ দেখাবে? লোকে ওরে দেখলেই তো আঙ্গুল তুলে বলবে, ঐ যে দেখ সবাই- নষ্টা আর ধর্ষিতা নিলু যাচ্ছে! আমাদের মেয়েটার যে এখন বিষ খেয়ে মরা ছাড়া আর কোন উপায় রইলনা’ -শান্তনার স্বরে মৌলানা এবার নিলুর বাবা-মাকে বললেন, ‘আপনারা এভাবে ভেঙ্গে পরবেননা। দেখবেন আল্লাহ কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন’।
মৌলানা এবার পুত্র আব্দুর রউফকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘বাবা, আমাকে তো তুমি জানোই। নিজের সামর্থের সবটুকু দিয়ে তোমাকে পড়াশোনা করিয়েছি। ভালোমন্দ বিচার করার ক্ষমতা এখন তোমার হয়েছে। তুমি তো জানোই আমাদের সমাজ কেমন। মেয়েটির ভবিষ্যৎ আর জীবন দুটোই এখন অনিশ্চিত। তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে তাহলে আমি চাই তুমি মেয়েটাকে বিয়ে করো’। নিজের মৌলানা বাবার মুখে কথাগুলো শোনার পর মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে দাড়িয়ে থাকে আব্দুর রউফ।
‘কি হলো বাবা, আমি কি তোমার উপর জুলুম করতেছি। তোমার যদি এতে আপত্তি থাকে তাহলে না করে দিতে পারো’ -পুত্রের কাছে মৌলানার জিজ্ঞাসা। ‘নাহ বাবা, আমার কোন আপত্তি নেই। আমি এটাকে আমার তকদির হিসেবে মেনে নিচ্ছি। আর এমন একজন নির্যাতিতার সারাজীবনের অবলম্বন হতে পারলে আল্লাহ অবশ্যই আমার সহায় হবেন। আর তাছাড়া, যারা তার সাথে এমন অন্যায় করেছে তারাও তো পুরুষই ছিল। সকল পুরুষ খারাপ নয় বা সকল পুরুষ শুধুমাত্র নারীর দেহ ভোগের কথা ভাবেনা এটাও আমি প্রমাণ করে দিব। আমি বিয়ে করব এই মেয়েকে’ -বাবার প্রতি পুত্র আব্দুর রউফ।
পরেরদিন মৌলানা তার স্ত্রীর সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন এবং তিনিও রাজি হন। এরপর নিলুর বাবা-মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন। এমন প্রস্তাবে নিলুর বাবা-মা আবেগআপ্লুত হয়ে পরেন এবং মৌলানার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন। হাসপাতালের বেডে কাতরাতে থাকা নিলুকে বিষয়টি জানানো হলে তার চোঁখ বেয়ে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার অশ্রু বেয়ে পরে। এবং একসপ্তাহ পর মাত্র বিশ হাজার টাকা দেনমোহরে আব্দুর রউফের সাথে নিলুর বিয়ে হয়।
নিলু খাটের উপর বসে আছে। অপেক্ষায় আছে সেই মহা পুরুষের যে কিনা তাকে তার নারীত্বের সম্মান দিয়ে বউ করে ঘরে নিয়ে এসেছে। অবশেষে তার অপেক্ষার অবসান ঘটলো। দরজা খুলে ভেতরে আসলো আব্দুর রউফ। বিছানার পাশে এসে স্ত্রীকে সালাম জানালো। স্ত্রীও সালামের জবাব দিলো। এবার পকেট থেকে বিশ হাজার টাকার বান্ডেলটা নিলুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘দেখো, আমি একজন বেকার ছেলে। আমার বাবা আমাকে কষ্ট করে পড়াশোনা করিয়েছেন। আমি এখনো চাকরী পাইনি। বিয়েতে যত খরচ হয়েছে সবই বাবা করেছেন। আর এই বিশ হাজার টাকা যেটা আমি তোমায় দেনমোহর হিসেবে দিচ্ছি এটা আমার টিউশনি করিয়ে বাবার কাছে রাখা জমানো টাকা। আমি ভার্সিটিতে পড়ার সময় টিউশনি পড়িয়ে যে টাকা পেতাম তা থেকে পকেট খরচ বাদে এগুলো জমা করেছিলাম।
তোমাকে আমার বিয়ে করাটাকে তোমার প্রতি আমার দয়া হিসেবে দেখোনা। আসলে, দয়া তো মহান আল্লাহ আমার প্রতি করেছেন যে তোমার মতো একনজনের প্রতি স্বামীর দায়িত্ব তিনি আমাকে দিয়েছেন। আমি সারাজীবন তোমায় ভালোবাসবো এবং সুখে রাখবো। আর আমার বিশ্বাস, আমি তোমায় আমার সাধ্যের যাই দিব অল্প হলেও তুমি তা সাদরে গ্রহণ করবে এবং সারাজীবন আমার মনের মানুষ হয়ে থাকবে’। নিলু এবার হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। আব্দুর রউফকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো, ‘জানিনা জীবনে কি এমন পূণ্য করেছিলাম যার বিনিময়ে এতকিছুর পরও মহান আল্লাহ্ আমাকে আপনার মতো হীরার টুকরো স্বামী উপহার দিলেন।