অভিমানের চাঁদ

অভিমানের চাঁদ

ফারহান অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরল। কাল শুক্রবার মেয়েকে নিতে যেতে হবে,
সপ্তাহের এই দুই দিন শুক্রবার ও শনিবার ফারিয়া তার বাবার সাথে থাকে, সারা দিন বাবা মেয়ে শুধু ঘুরে বেড়ানো
খুব সকালেই ফারহান তার শ্বশুরবাড়ি গেলো, নিলাও জানে ফারহান সকালে আসবে, তাই ফারিয়াকে রেডি করেই রেখেছিল,
ফারহান বাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তার শ্বশুর ফারিয়াকে নিয়ে আসলো, বলল বাবা বাসায় আসো, নাস্তা করো।
ফারহান বরাবরের মতোই বলল বাবা, আজ না! ফারিয়া ৪ বছরের পিচ্চি মেয়ে, সে এত কিছু বুঝে না,
ফারিয়া দাদুর বাসায় গিয়ে অনেক মজা আনান্দ করে… রাতে ফারহান তার মেয়েকে নিয়ে শুয়ে আছে,
ফারিয়া হটাৎ প্রশ্ন করে, বাবা, আম্মু আসবে না?
আমার একা ঘুম হয় না, ফারহানের কাছে তার কোন উত্তর নাই, সে বলল তুমি একা কেন হবা? তুমি আমার বুকে ঘুমাও,
ফারিয়া ঘুমিয়ে যায়, কিন্তু ফারহানের চোখ দুটো যেন ঘুমাতে ভুলে গেছে,
কিন্তু এক সময় এই রকম ছিল না, বছর ৬ আগে ফারহানের সাথে নিলার বিয়ে হয়, বিয়েটা পরিবার দেয় কিন্তু,
তাদের মধ্যে ভালোবাসার কোন অভাব ছিল না। নিলা একটু জেদি কিন্তু কোন সময় খারাপ ব্যাবহার করে নি সে,
ফারহান ও নিলাকে খুব ভালোবাসতো,বাবা-মা, ও নিলাকে নিয়ে তার পৃথিবী, বড় শহরে গেলে ফারহানের প্রমোশন হবে,
কিন্তু ফারহান যেতো না, কারণ সে তার ভালোবাসার সুখের সংসার ছেড়ে যেতে রাজী না,
কিন্তু এই সুখের পৃথিবীতে কার যেন নজর লেগে গেলো,
ফারিয়ার বয়স যখন ২ বছর,
একদিন অফিস থেকে বাসায় এসে শুনে নিলা তার মা(নিলার শাশুড়ি) ঝগড়া করেছে, সে আর এই বাসায় থাকবে না।
ফারহানের মাথায় যেন বাজ! পড়লো। কি করবে সে? সে প্রথমে আম্মুর কাছে কারণ জানতে চাইলো,
আম্মুর কোথায় সে জানতে পারলো, নিলা মনে করে, ফারহান তার বেতনের সব টাকা বাড়ীতে খরচ করে দেয়…
নিলার কথা তাহলে তার বা তার মেয়ের ভবিষ্যতে কি থাকলো?
ফারহানের আম্মু বলল, বাবা তুমি বউ নিয়ে আলাদা থাকতে পারো, এতে আমাদের মনে কোন দুঃখ নাই,তোমরা সুখে থাকলেই আমাদের সুখ।
ফারহান কিছু বলতে পারলো না, তার চোখ দিয়ে পানি আসতে লাগলো, মা বাবার এক ছেলে ফারহান, অনেক কষ্টে তাকে মানুষ করেছে,
আজ যা কিছু আছে, সব তার মা বাবার চেষ্টায়… ফারহানের খুব ভালো করে মনে আছে, অনেক ঈদে তার মা বাবা কিছু কিনে নি,

শুধু ফারহান কে নতুন জামা কাপড় দিয়েছে,
যখন যা চেয়েছে তাই পেয়েছে, আর আজ সে মা বাবাকে ছেড়ে থাকতে হবে? আর কিছু না বলে ফারহান তার আম্মুর ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।
কিচ্ছুক্ষণ পর ফারহান নিলার কাছে যায়, নিলা ব্যাগ গুছিয়ে বসে আছে…
ফারহান নিলার সামনে বসে তার হাত দুটো ধরে বলল, এত অভিমান কেন তোমার…
বোল কি চাও তুমি? নিলা বলল হয় তুমি আমাকে নিয়ে অন্য বাসা ভাড়া নাও না হলে আমার আব্বুর বাসায় চলো,
আমি এই বাড়ীতে আর থাকবো না,
ফারহান বলল, দেখো আমি তাদের ছেলে তাই আমার কিছু দায়িত্ব আছে, আমিতো সে গুলো অমান্য করতে পারি না,
নিলা বলল, কিন্তু আমি আর আমার মেয়ে তার জন্য কিছু নাই?
ফারহান বলল আরে পাগলী, আমি কি তোমাদের কথা চিন্তা করি না?
তোমার কিসের অভাব বলো? আর আমি তো কিছু টাকা জমা করি প্রতি মাসে…।
তোমাদের জন্য অনেক কিছু আছে…। আর আমার বাবার টাকা পয়সা, এই বাড়ী এগুলো কার?
আর যদি কখনও আমার চাকুরী বদলি হয় আমি তোমাকে প্রয়োজনে নিয়ে যাবো,
তবে এভাবে না…।।
কিন্তু নিলা কিছু বুঝার মতো না, সে আর থাকবে না… সে যাবেই,
ফারহান শুধু একটাই কথা বলল, নিলা, একটা কথা মনে রাখো, যে মা বাবার ওপর রাগ করে চলে যাচ্ছ, আমি কিন্তু তাদের পছন্দেই তোমাকে বিয়ে করিছি,
তুমি ভুলে যেও না বিয়ের আগে আমি তোমাকে দেখতেও যায় নি। শুধু তাদের খুশির জন্যই তোমাকে বিয়ে করেছি।
আজ তুমি চলে যাচ্ছো, কিন্তু তুমি যদি নিজের ভুল বুঝতে পেরে, ফিরে এইবাসায় আস্তে চাও তবে আমাকে ডেকো,
কিন্তু আমি এভাবে বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে তোমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারবো না।
নিলা ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো… ফারহান চুপচাপ শুধু তার চলে যাবার দৃশ্য দেখতে থাকলো।
অভিমান জিনিসটার কাছে পাহাড় পরিমাণ ভালোবাসাটাও কেমন জানি অসহায়!

পরদিন সকালে ফারহান তার মেয়েকে নিয়ে সারা দিন ঘুরলো, বিকেলে শ্বশুরের দোকানে গেলো,
শ্বশুরের সাথে কথা বলাও হবে সাথে ফারিয়া কেও দিয়ে দিবে…
ফারহানকে দেখে তার শ্বশুর বলল, আসো বাবা,…।
তারপর তার দোকানের কর্মচারীকে বলল এই যা তো কিছু নাস্তা আর চা নিয়ে আয়…
ফারহান দোকানে বসলো, তার শ্বশুর বলল, দেখো বাবা, আমি তোমাকে ছেলের থেকে কম ভাবি না,
তাই বাবা হিসাবে একটা কথা বলতে চাই?
দেখো বাবা! এভাবে আর কতো দিন চলবে? তুমিও রাগ করে আছো আর আমার মেয়েও,
কিন্তু এভাবে তো তোমাদের নিজেরদের ক্ষতি হচ্ছে, এই সময় তোমার যেমন বউয়ের দরকার তেমনি নীলারও স্বামীর দরকার,
তোমরা অন্তত তোমাদের মেয়ের কথাটা ভাবো, তার কি দোষ বল?
এই পিচ্চি বয়সে সে বাবার থেকেও আলাদা আবার মার থেকেও…
ফারহান বলল, বাবা, আমার কি কোন দোষ ছিল বলেন?
নিলার আব্বু বলল, বাবা, আমি জানি তোমার দোষ ছিল না, কিন্তু এটা তোমাদের একটা পুরো জীবনের ব্যাপার…
অনেক দিন তো হল, একবার বাবা আমার মেয়ের কাছে যাও…।
তুমি তাকে যে অনেক ভালোবাসো তাতে কোন সন্দেহ নাই, কিন্তু এভাবে রাগ করলে সম্পর্ক থাকবে না বাবা…।
এক বার যাও বাবা…।
ফারহান বলল, আচ্ছা বাবা, যাবো… এখন বাড়ী যায়…
নিলার আব্বু বলল, বাবা, এখন ফারিয়া কে তুমি রেখে আসো… যাও না বাবা।।
ফারহান তার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ফারিয়াকে রেখে আসলো, দেখলও, নিলা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে…
ফারহান চলে আসলো…
কিছু দিন পর ফারহান অফিসে বসে আছে, হটাৎ তার শাশুড়ি ফোন করে বলল,তার শ্বশুর নাকি অসুস্থ হয়ে গেছে,
তাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে…
ফারহান বলল, আম্মা আপনি নিয়ে আসেন আমি সব ব্যাবস্থা করছি…
ফারহান ১ ঘণ্টার মধ্যে সব ঠিক করলো… তারপর তার শ্বশুরকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে কিছু টেস্ট করে বুঝলও,
তাড়াতাড়ি অপারেশন করতে হবে, ফারহান সব ব্যাবস্তা করে দিল, সে রাতেই অপারেশন হল, রাতে ফারহানের আব্বু আম্মু আসলো…
ফারহান পরের দিন অফিস করে ৭ দিন ছুটি নিলো, এই ৭ দিন সে হাসপাতালেই বেশি থাকলো…
নিলার আব্বু এখন অনেক সুস্থ, আর ২ দিন পর তিনি বাড়ী যেতে পারবেন।
নার্স এসে ঔষধ দেবার সময় জিজ্ঞেস করলো? ওটা কি আপানার ছেলে?
নিলার আম্মু বলল কোনটা? আমাদের তো কোন ছেলে নাই?
তাহলে ঐ ছেলেটা কে? যে সব সময় থাকে…
আম্মু বলল, ও ঐ ছেলে, ওটা আমাদের একমাত্র জামাই, এই আমাদের মেয়ে আর এটা নাতনি।
নার্স বলল, আপনারা অনেক ভাগ্যবান যে এরকম একটা জামাই পেয়েছেন…
আমারাতো শুধু এটা দেখতে পাই যে, জামাই মেয়েকে মেরে, অত্যাচার করে…
কিন্তু এই রকম জামাই খুব কম দেখতে পাই। আপনি জানেন, আপনার জামাই প্রতিদিন আমাদের কিছু টাকা দিত,

যাতে আমারা আপনার ভালো দেখা শুনা করি।
নার্স যাবার পর, নিলার আম্মু বলল, শুন-লা নীলা, নার্স কি বলল?
এখন তো মা তুমি নিজের অহংকার ভুলে ফারহানের কাছে ফিরে যাও…
সত্যি বলতে ফারহান জামাই হয়েও ছেলের দায়িত্ব পালন করেছে, কিন্তু তুমি তুমি ঐ বাড়ীর মেয়েতো দুরের কথা বউয়ের দায়িত্ব পালন করতে পারো নি।
সত্যি আজ খুব খারাপ লাগছে যে তোমার মতো মেয়ে ফারহানের বউ হয়েছে… এটা আসলেই ফারহানের দুর্ভাগ্য, না হলে ওকে কেউ এত কষ্ট দেই?
নীলা শুধু চুপ চাপ শুনে কাঁদছে… সত্যি মনে হয় ফারহানে বেশি কষ্ট দিয়ে দিয়েছে?

ফারহান অফিস থেকে বাড়ী ফিরছে, আজ অনেক রাত হয়ে গেছে… ফারহান তার বাসা গেলো,
নিজের ঘরে ঢুকল, কেন জানি আজ অনেক দিন পর সব কিছু গোছানো মনে হচ্ছে, মা মনে হয় গুছিয়েছে…
ছোট বেলা থেকে ফারহান এই ঘরে ঘুমায়, বিয়ের পর অবশ্য পাশের ঘরে ঘুমাতো কিন্তু এখন আবার এই ঘরে,
অফিসের পরা জামা প্যান্ট শোফার ওপর ফেলে, ফারহান শুয়ে যায়, অনেক ক্লান্ত তাই ঘুমিয়ে পড়ে…
কিছুক্ষন পর মনে হয় কে যেন তার গায়ে কাঁথাটা দিয়ে দিচ্ছে, আম্মু তো এত রাতে আসে না, তাহলে কে সে?
হটাৎ করে চোখ খুলে চমকে যায় ফারহান, এতো নীলা!
কি ব্যাপার তুমি এই বাড়ীতে,?
নীলা বলল, কেন এটা আমার বাড়ী না? আস্তে কি তোমার অনুমতি লাগবে?আর তুমি ভালো হলা না?
কাপড় গুছিয়ে রাখতে পারো না? সারা দিন তোমার ঘর গোছালাম? কি করেছ ঘরের অবস্থা?
ফারহানের মুখ দিয়ে কথা বের হয় না… সে শুধু চুপ করে শুধু শুনছে, অনেক দিন থেকে কেউ তাকে এভাবে শাসন করেনি…
তারপর নীলা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো…।
নীলা বলল, মাফ করে দাও না গো……। আব্বু আম্মু সবাই আমাকে মাফ করে দিয়েছে, তুমি মাফ করে দাও…
ফারহান বলল রাতে ভালো ব্যাবহার করলে সকালে মাফ করে দিবো…
নীলা বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি রাজী আছে…।
ঘটনার ৬ মাস পর, ভালোই কাটছিল দিন গুলো, কিন্তু হটাৎ আমার হেডঅফিস থেকে বদলির নির্দেশ।
অফিস থেকে ফিরে আম্মুকে বলল ফারহান, আম্মু বলল বাবা তুমি একা যেও না, নিলাকেও নিয়ে যাও, ওর ও মন ভালো হবে…
ফারহান ভাবল নীলা আমার সাথে যেতে পেয়ে খুশি হবে, কিন্তু নীলা যা বলল তাতে সে পুরো চমকে গেলাম,
ফারহান নিলাকে যাবার কথা বলা মাত্রই নীলা বলল সে যাবে না,
ফারহান বলল, কেন?
নীলা বলল, দেখো ফারহান আমি এখানে অনেক সুখী আছি, আর আমারা চলে গেলে, বাবা মাকে কে দেখবে,
এমনিতেই আম্মু মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে যায় তাদের কে সেবা করবে?
তুমি একা যাও, আমি এখানে থাকলে তুমি মাসে অন্তত একবার আসবা, কিন্তু আমারা সবাই চলে গেলে, বছরে একবার আসবো কি না সন্দেহ আছে…
প্লিজ তুমি কিছু মনে করো না, তুমি একা যাও।। আর তাড়াতাড়ি ফিরে আসার চেষ্টা করবা,
ফারহান আর কিছু বলল না, কারণ সে আজ খুব খুশি, সত্যি নীলা আজ এ বাড়ীর মেয়ে হয়ে গেছে…
পরদিন ফারহান তার নতুন জায়গার উদ্দেশে রওনা হল…। একা কিন্তু পুরো পরিবারের ভালোবাসা আর মনের শান্তি নিয়ে।

…………………………………………… সমাপ্ত…………………………………..

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত