ভালোবাসি

ভালোবাসি

-আচ্ছা ইশতিয়াক, যদি কখনো আমার একটা অঙ্গ অচল হয়ে যায়, যদি পঙ্গু হয়ে যাই, তুমি আমাকে বিয়ে করবে না?

-“ধুর পাগলী কি বলো এসব? তোমার হাত ধরে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বাচতে চাই, সুযোগ দেবে?” ইশতিয়াকের উত্তরে মুচকি হাসে মনি। ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের অনেক স্বপ্ন।
-“তোমার পরিবার যদি মেনে না নেয়?”
-“কেন নেবে না শুনি?এমন লক্ষী বউমা পেলে আমার বাবা মা মাথায় করে রাখবে।”
-“তারপরও, যদি কখনো…”

মনির মুখে হাত দিয়ে থামিয়ে দিলো ইশতিয়াক, “চুপ,একদম চুপ। আচ্ছা বাবা, যদি মেনে না ই নেয় তবে তোমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো। গ্রাজুয়েশন এর পর তোমাকে অন্তত ডাল ভাত তো খাওয়াতেই পারবো। কী?খেতে পারবে তো রোজ রোজ ডাল ভাত?”

-“খুব পারবো,” বলতে বলতে ইশতিয়াকের হাত চেপে ধরলো মনি।
-“ভালোবাসো?”
-“অনেক বেশি ভালোবাসি।”

আজ তিন বছর পর একই ভাবে মনির হাত ধরে আছে ইশতিয়াক। মনি ঠিক ততটা শক্ত করে ধরতে পারছে না।শরীরটা খুব বেশি দূর্বল হয়ে গিয়েছে।

-“মনি, অনেক বুঝিয়েছি বাবা মা কে। কোনো ভাবেই তারা বুঝতে চাচ্ছেন না এই মূহুর্তে আমার তোমার পাশে থাকা টা কতটা জরুরি।”

মনির মুখে মলিন হাসি, ভিতরে চাপা কষ্ট নিয়ে বলল,” বাবা মা তো ঠিকই বলেছেন। তারা জেনে বুঝে নিজের ছেলের সাথে এ কাজ কখনোই হতে দেবেন না।আমি বলি কি, মা বাবার কথা মেনে নাও।আমি আর কয়টা দিনই বা আছি,কিন্তু তারপর তোমার জীবনটাও যে থেমে যাবে। তুমি মা বাবার পছন্দমতো মেয়ে কে বিয়ে করে ফেলো। তবে আমি যাওয়া অবদি একটু অপেক্ষা করো।তোমাকে আমি অন্য কারো সাথে দেখতে পারবো না।” বলতে বলতে চোখের পানি গড়িয়ে পরে মনির। ইশতিয়াক কিছুটা কঠোর ভাবেই বলল, “শোনো মনি, ভালোবেসেছি তোমাকে সারাজীবন পাশে থেকে আগলে রাখব বলে।বিপদ বুঝে পালিয়ে যাবার মত কাপুরুষতা দেখানোর জন্য নয়।আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি পরিবারের বাইরে এসেই বিয়ে করবো তোমাকে।সেই যোগ্যতাটুকু আমি অর্জন করেছি।”

-“কিন্তু…”
-“কোনো কিন্তু না। ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি।পরশু তোমাকে রিলিজ দিলেই আমরা বিয়ে করব।সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। এই যুদ্ধে তোমাকে হারতে দেবো না আমি।” মনি আর কিছু বলতে পারে না।শুধু চোখের পানি ফেলে।ইশতিয়াক হাত ধরে হাসপাতালের বেডের পাশে বসে থাকে।মাত্র দু মাস আগে মনির ব্রেইন টিউমার ধরা পরে।পুরোপুরি বদলে যায় তাদের জীবন।শুধু বদলায় নি মনি কে নিয়ে ইশতিয়াকের স্বপ্ন। বকুল আর কাঠগোলাপের এক হওয়ার আশার আলো যেনো এখনো দেখতে পায় সে।

কাজী অফিসে বসে আছে তারা দুজন। চিকিৎসার জন্য মনির সব চুল ফেলে দিতে হয়েছে।তবু লাল শাড়িতে কি অপরূপ লাগছে তাকে। ইশতিয়াক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শুধু। বিয়ের পর ছোট্ট একটা সংসার হয় তাদের।ইশতিয়াকের ভালোবাসা-যত্ন আর চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে ওঠে মনি।বিয়ের ৪ মাসের মাথায় মনি জানতে পারে সে মা হতে যাচ্ছে।কিন্তু এমনটার জন্য সে কোনো ভাবেই প্রস্তুত ছিলো না।মনে তার অজানা ভয় কাজ করতে থাকে।

-“ইশতিয়াক, এই সন্তান আমি জন্ম দিতে পারবো তো?যদি তার আগেই আমাকে চলে যেতে হয়?”
-“কি সব বলছো তুমি?

ডাক্তার বলেছেন তুমি এখন আগের থেকে অনেকটা সুস্থ। তবে এখন থেকে আরো বেশি যত্ন রাখতে হবে তোমাকে। তোমার আর আমাদের সন্তানের জন্য সব করতে রাজী আছি আমি,” মনির কথার জবাব দেয় ইশতিয়াক। সময় খুব দ্রুত কাটতে থাকে।অবশেষে ৯ মাস পর মনি ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। তার নাম রাখা হয় ইশ্মা।খুশির বন্যা বয়ে যায়।

কিন্তু সৃষ্টিকর্তা হয়ত সুখ আর বেশি দিন স্থায়ী করতে চাইছে না।সন্তান জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই মনির অসুস্থতা বাড়তে থাকে।কোনো ভাবেই হয়ত আর কিছু করা সম্ভব না।ইশতিয়াকের চারপাশটায় যেনো অন্ধকার নেমে আসে।মনিকে ছাড়া সে বাচবে কিভাবে?কিভাবেই বা বড় করবে ইশ্মা কে?হাসপাতালের বারান্দায় বসে ভাবতে ভাবতে কান্নায় ভেঙে পরে সে।হটাৎ কেও পিছন থেকে তার কাধে হাত রাখে।

-“মনি,আরে তুমি এ অবস্থায় উঠে এসেছো কেনো?চলো এক্ষুনি কেবিনে।”
-“আমার একটা কথা রাখবে ইশতিয়াক? ”
-“কি কথা?”
-“বলো রাখবে?”
-“অবশ্যই রাখবো,বলো কি কথা।”
-“তুমি আমার মেয়েটার জন্য আরেক টা মা এনে দেবে প্লিজ?

যে ওকে কখনও আমার অভাবটা বুঝতে দেবে না।এনে দেবে বলো?” ইশতিয়াক করুন স্বরে বলে,”না মনি, এমনটা আমি কখনই করতে পারবো না।তোমার জায়গা আমি কাওকে দিতে পারবো না মনি।”

-“তোমাকে যে পারতে হবে।তুমি আমাকে কথা দিয়েছো। আমার শেষ কথা টা রাখবে না?বলো রাখবে না তুমি?” ইশতিয়াক মনিকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকে।
-“মনি, এই মনি, শুনতে পাচ্ছো? এই…”

মনির হার্টবিটটা আর অনুভব করতে পারে না ইশতিয়াক। নিঃশ্বাসের গরম বাতাস টা আর এসে পরছে না তার কাধে।ইশতিয়াকের চোখের পানি থেমে যায়।বাকরুদ্ধ হয়ে যায় সে।তবে কি,তবে কি সত্যি মনি আর ইশ্মার বয়স এখন ছয় বছর।ইশ্মা ডাকছে,”আম্মু তাড়াতাড়ি এসো।স্কুলের লেট হয়ে যাচ্ছে।”

-“এইতো মা চলো”, ইশতিয়াক উত্তর নেয়।সে মনির কথা রেখেছে।ইশ্মাকে মা এনে দিয়েছে। ইশ্মা কখনো তাকে বাবা ডাকে আবার কখনও আম্মু ডাকে।কারন সেই তার বাবা সেই তার মা।৬ বছরে কখনো ইশ্মা মায়ের অভাব বুঝেনি।

শুধু প্রতিরাতে ইশতিয়াকের বুকের বা পাশটা খা খা করেছে।মনির হার্টবিটটা আর কখনো তার হার্টবিটের সাথে মিশে যায় নি।থেমে গিয়েছে তার চোখের পানি।আনমনে বার বার বলেছে,”ভালোবাসি, এখনও ঠিক ততটাই ভালোবাসি।”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত