ব্ল্যাক ডায়মন্ড

ব্ল্যাক ডায়মন্ড

-তুই এটা কি রঙয়ের শাড়ি পরেছিস ? তুই এমনিতেও কালো এই নীল রঙের শাড়িতে তোকে আরও কালো দেখাচ্ছে । বাসা থেকে বের হবার আগে আয়না দেখিসনি?

– তুই না কাল বলেছিলি নীল রং তোর প্রিয়?

– হুম বলেছিলাম তো ,কিন্তু আমি কি তোকে নীল রঙের শাড়ি পরতে বলেছি?

আমি অন্য দিকে ফিরে গেলাম আমার চোখের কোনে জল জমেছে এই জল আমি আবিরকে দেখাতে চাইনা ।

– যা তুই বাসায় চলে যা ,ভেবেছিলাম তোকে আজ হাতিরঝিল দেখাতে নিয়ে যাবো ,কিন্তু তুই এমন সাজ দিয়ে এসেছিস

– আমি কান্নাটা গিলে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম যাবো না তোর সাথে হাতিরঝিলে, তোর সাথে যেতে আমার বয়েই গেছে । বলেই আমি উঠে বাসায় চলে এলাম । বাসায় ঢুকেই মাকে বললাম এই শাড়িটা আমেনা খালাকে দিয়ে দিয়ো । মা আমার দিকে আশ্চায হয়ে তাকিয়ে বললেন – কালকেই না তুই শাড়িটা কিনলি? আমি তো তোকে বারবার ঐ গোলাপি শাড়িটা দেখালাম তুই বললি না এইটাই তোর পছন্দ । একদিনেই পছন্দ শেষ?

– উফ মা এতো কথা কেন বলছ? এমনেতেই আমার মাথা ধরেছে যাও তো আমাকে ঘুমাতে দেও।

– এখন ঘুমাবি কিরে! ভাত খেয়ে ঘুমা আর শুন মা তুই রাগ করিসনা আজ বিকেলে আমাদের বাসার সামনের কফিশপে তোকে একটু যেতে হবে ।

– মা তুমি আবার আমার জন্য ছেলে ঠিক করেছো? এই পর্যন্ত ৪ জন গেলো, কেউ আমাকে পছন্দ করেছে? এই জীবনে আমার বিয়ে হবেনা মা । আমার মত কালো মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে না ।

– তুই এতো কালো কই মা , একটু শ্যামলা এই যা আর তুই এবার নিষেধ করেছিস বাসায় কাউকে আনতে না তাই কফিশপে আসতে বলেছি । এইবার যা মা,ছেলেটা খুব ভাল ,এইবার না হলে তোকে আর বলবনা ।

– মা আমি তোমার মেয়ে বলে তোমার এমন মনে হয় । অন্যদের এমন মনে হয় না । আর শুন এই কিন্তু শেষ।

বিকালে মায়ের পছন্দ করা শাড়ি পরে নিচে নেমে গেট দিয়ে বের হবার সময়ই দেখি আবির আমাদের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে!

– কিরে ব্ল্যাক ডায়মন্ড কার সাথে হাতিরঝিলে যাবার জন্য এতো সেজেগুজে বের হয়েছিস?

– শুন আবির সবসময় আমাকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড বলে ডাকবি না । আর তুই আমার বাসার সামনে কি করিস?

– আমি এইখানে কি করি সেটা বড় কথা না, বড় কথা হল তুই কি আজ আবার দেখা-দেখির কাজে যাচ্ছিস নাকি?

– আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি পাঁচটা বেজে গেছে, পাঁচটায় ছেলেটির আসার কথা, মনে হয় চলে এসেছে । এই ফাজিলের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না । আমি কোন কথা না বলে হাঁটতে শুরু করলাম আবিরটা এতো ফাজিল আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল এই দাঁড়া দাঁড়া , কই যাস বলে যা

– ঐ সামনের কফিশপটাতে, মা বলেছে একটি ভাল ছেলের সাথে দেখা করতে , তোর মত ফাজিল না ছেলেটি ।

– বাব্বাহ এখন থেকেই এতো সুনাম! এই দেখ দেখ ঐযে লম্বা ফর্সা মত ছেলেটি নয়ত?

আমি সামনে তাকিয়ে দেখি কফিশপটার সামনে সবুজ গেঞ্জি পরা সুন্দর একটি ছেলে বার বার ঘড়ি দেখছে । বুঝতে পারলাম এটাই মায়ের ভাল ছেলে কারন মা বলে দিয়েছে ছেলেটি সবুজ রং পরে আসবে । আমি বললাম মনে হয় উনি । এই কথা শুনেই আবির এতো জোরে হো হো করে হেসে উঠল যে রাস্তার মানুষ ওর দিকে তাকিয়ে থাকল । ওর হাসি আর থামেইনা, আমি খুব বিব্রত হয়ে পড়লাম । বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কি হল এতো হাসির কি দেখলি যে তোর হাসি আর থামেই না?

– এই শুন এই ছেলের সাথে তোকে একদম মানাবে নারে একদম না , ছেলের গায়ের রং দেখছিস কেমন ফর্সা ! বলেই আবার হাসতে লাগলো । আমি এইবার সত্যি সত্যি কেঁদে ফেললাম, অপমানে আমার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো আবির আমাকে সব সময় এমন করে বলে কিন্তু এতটা খারাপ আমার আগে কখনো লাগেনি । আমি আমার শরীরের সব শক্তি দিয়ে আবিরকে কষে চড় লাগালাম । তারপর কাঁদতে কাঁদতে কফিশপের দিকে না গিয়ে বাসায় চলে আসলাম ।

বাসায় এসে দরজা বন্ধ করে আমি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম । হ্যাঁ আমি কালো তাই বলে কি আমি মানুষ না? আমি কি নিজে আমার শরীরের রং দিয়েছি? আমাদের ক্লাসে আমি সবচেয়ে কালো মেয়ে,আবির ফর্সা দেখতে হ্যান্ডসাম । কিন্তু কোন এক অজানা কারনে ক্লাসের প্রথম দিন থেকে আবির আর আমার মাঝে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছে । অন্য মেয়েরা আবিরের সাথে মিশতে চাইলেও ও তেমন একটা পাত্তা দিতো না । একদিন ওকে জিজ্ঞাসা করলাম আবির আমিতো কালো তুই এতো সুন্দর সুন্দর মেয়ে রেখে আমার সাথে ঘুরিস কেন? ও বলল এইটা কেমন কথা বললি বন্ধুত্ব হল মিলের ব্যাপার তোর সাথে আমার মিল হয়েছে তাই বন্ধুত্ব হয়েছে ।

সাদা আর কালো দেখে কি বন্ধু হয় ? আর তুই সব সময় শাড়ি পরে থাকিস আমার কাছে ভাললাগে । গত তিন বছর থেকে আমি আর আবির বন্ধু, আমার সব কিছুতে ও আমার পাশে আর ওর সব কিছুতে আমি ওর পাশে । ও সব সময় আমাকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড বলে ডাকে আমার কাছে এই ডাকটা খুব পছন্দ। কিন্তু যে দিন থেকে আমার বিয়ের কথা হচ্ছে সেইদিন থেকে আমি বুঝতে পারলাম আমি আবিরকে ভালবেসে ফেলেছি । এই সেই ভালবাসা না একেবারে উথাল-পাতাল ভালবাসা। সাথে সাথে এইটাও বুঝলাম আবির যদি এই কথা বুঝতে পারে তাহলে আমাদের সব সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে। আবির কি আর আমার মত কালো মেয়েকে ভালবাসবে? তাই মায়ের কথা মত বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেলাম কিন্তু আমি রাজি হলে তো হবে না অন্য পক্ষ ওত রাজি হতে হবে ।

ভালবাসি বুঝতে পারার পর থেকেই আবির আমাকে কালো বললেই আমার চোখ ফেটে কান্না আসে। আবিরকে চড় মারাটা উচিত হয়নি, ওত সত্যি কথাই বলেছিল ঐ ছেলে আমাকে কখনো পছন্দ করতনা।কিন্তু আবির হাসাতে কেন যে আমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিলো , মা কয়েক বার এসে দরজা ধাক্কা দিয়ে ডেকে গেছে আমি কোন জবাব দেইনি । আমি উঠে ফ্রেস হয়ে ফোনটা হাতে নিলাম আবির কে স্যরি বলার জন্য, ফোন হাতে নেয়ার সাথে সাথে আবিরের কল ! আমি রিসিভ করে চুপ করে রইলাম ওপাশ থেকে আবির বলল কিরে ঘুমাস নি?

-ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি এগারোটা বাজে, বললাম হুম ঘুমিয়েছি

-ঘুমালে তোর রুমের লাইট অন কেন?

– আমার রুমের লাইট অন তুই কিভাবে জানিস? কোথায় তুই?

– আমি তোর বাসার সামনে তাড়াতাড়ি নীচে আয় তোর সাথে মানাবে এমন একটা ছেলেকে ধরে নিয়ে এসেছি তুই যদি এখন বলিস আসবি না তাহলে কিন্তু আমি ছেলেটিকে নিয়ে তোর বাসায় চলে আসবো

– দাঁড়া তুই আমি আসছি বলেই আমি এক দৌড়ে বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসতেই দেখি আবির দাঁড়িয়ে আছে । আমি নামতেই ও হাঁটতে লাগলো আমি বললাম কই যাস?

– আয় আমার সাথে তোর জন্য যে ছেলেকে নিয়ে এসেছি ওকে ঐ কফিশপের সামনে রেখে এসেছি

-লাগবেনা আমার কোন ছেলে তুই শুন আবির তোর সাথে আমার কথা আছে

– সব কথা পরে হবে আগে তুই দেখ ছেলেটিকে তোর পছন্দ হয় কিনা । কপিশফের সামনে এসে দেখি বন্ধ। আমি বললাম এখানেতো কেউ নেই! আবির আমার পাশে দাঁড়িয়ে বন্ধ কাঁচের দরজার দিকে তাকিয়ে বলল কেন এই আয়নায় তোর পাশে যাকে দেখা যায় তাকে তোর সাথে মানায় না?

আমি আবিরের কথা শুনে কেঁপে উঠলাম তাহলে কি আবিরও আমাকে ভালবাসে? আমার দু চোখ দিয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো আমি অভিমানে মুখ ভার করে বলি কেন আমি তো ব্ল্যাক ডায়মন্ড, নীল শাড়িতে আমাকে আরও কালো লাগে ,ফর্সা ছেলের সাথে কি আমাকে মানায়? তুই তো ফর্সা বলেই আমি মুখ ডেকে কাঁদতে লাগলাম ।

আবির আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বলে তুই তো আমার ব্ল্যাক ডায়মন্ডই , পৃথিবীর সবচেয়ে দামি হিরা । তুই আমাকে সব সময় বলতি ছেলেরা ফর্সা হলে মেয়ে মেয়ে লাগে , একটু শ্যামলা ছেলে তোর পছন্দ । তাইত তিনটি বছর আমি আমার ভালবাসার কথা তোকে বলতে পারিনি । যতো বার বলতে গেছি মনে হয়েছে তুই যদি আমাকে ফিরিয়ে দিস? তুই জানিস তোর ঐ দুই চোখে কতো মায়া । এই জন্যই তোর বাবা-মা তোর নাম রেখেছে মায়া । তুই জানিস এই তিন বছরে আমি কতো হাজারবার তোর প্রেমে পড়েছি, আমি তোর হাসির প্রেমে পড়েছি আমি তোর মায়া ভরা দুই চোখের প্রেমে পড়েছি তুই যাই করতি আমি প্রতিবার নতুন করে তোর প্রেমে পড়েছি, এইযে তুই শাড়ি পরিস আমি তোর শাড়ির প্রেমেও পড়েছি মায়া ।

আজ সকালে তুই যখন নীল শাড়িটা পরে এসেছিলি তোকে ঠিক পরীদের মত লাগছিল , আমার ইচ্ছে করছিল তোকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরি। আমি ভয় পেয়ে গেলাম যদি আমি উল্টা পাল্টা কিছু করে ফেলি তাই তোকে অমন করে বলেছি যাতে তুই চলে আসিস। কিন্তু তুই যখন যেতে যেতে চোখের পানি মুছলি সেই সময় আমি বুঝতে পারলাম তুইও আমাকে ভালবাসিস । ঠিক করলাম আজ তোকে সব বলে দিবো এসে দেখি আমার ব্ল্যাক ডায়মণ্ড অন্য কারো সাথে দেখা করতে যাচ্ছে , আর কি মেজাজ ঠিক থাকে বল?তাই অমন করে তোকে বললাম যাতে তুই ঐ ছেলেটির সাথে দেখা করতে না যাস।

আমি চোখের পানি মুছতে মুছতে বললাম এমন করে সারা জীবন আমাকে বুকের মাঝে ধরে রাখবি তো? আবির আমাকে আরও জোরে বুকের সাথে চেপে ধরে বলল ব্ল্যাক ডায়মন্ড কি সবাই পায় ? যে পায় সেকি হারাতে চায়?

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত