সহ্যের শেষ সীমা অতিক্রম করে অভ্র বেশ ঝাঁঝের সাথেই চিৎকার করে উঠল।
: তনিমা, প্লিজ! টিভিটা বন্ধ কর এখন। তনিমা নির্বিকার।
–কেন?
: রাত বারোটা বেজে গেছে। এখনো যদি তুমি টিভি চালিয়ে বসে থাকো তো ঘুমাবো কখন? তনিমা এবারেও কথাটা গায়ে মাখল না। হালকা চালে বলল,
–তোমার ঘুম তুমি ঘুমাবে। আমি ধরে রেখেছি নাকি!
: বেশ। কাল থেকে টিভি ড্রয়িং রুমে থাকবে। যতখুশি দেখো।
–টিভি বেডরুমেই থাকবে। তোমার ইচ্ছে করলে তুমি ড্রয়িং রুমে গিয়ে ঘুমাতে পারো
–তনিমা just try to understand সারাদিন অফিস করে ফেরার পর আমার রেস্ট দরকার। একটু শান্তিতে ঘুমাতে চাই আমি। নিজের বেডরুমে!
–সারাদিন ঘরের কাজ করার পর আমারও এনটারটেইনমেন্ট চাই। আর সেটা হলো টিভি দেখা। নিজের বেডরুমে!
অভ্র হাল ছেড়ে দিয়ে ক্লান্ত গলায় জবাব দেয়।
: এমন খাম খেয়ালী করলে সত্যি একসাথে থাকা যায় না । তনিমাও এবার চেঁচিয়ে ওঠে।
–তো থেকো না। নিষেধ করেছে কে? সারাদিন তো বাইরে থাকো। আর এই রাতগুলো মানে এক বেডে ঘুমানো। দরকার নেই এ টুকুরও। তুমি জাস্ট পুরোপুরি চলে যাও আমার জীবন থেকে। আমার দিন এবং রাতগুলি আমায় একলা থাকতে দাও। অভ্র উঠে দাঁড়ায়। অনেক সহ্য করেছে সে। আর না।
: বেশ! তোমার যখন ইচ্ছে তো থাকো একা। না দিন আর না রাত কখনো বিরক্ত করব না তোমাকে। হনহন করে বেরিয়ে যায় বেডরুম থেকে। ড্রয়িংরুমে লম্বা সোফাটায় দু’টো কুশনকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে পড়ে অভ্র। প্রতিদিন বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে ঘুম এসে যায় চোখে। কিন্তু আজকে ঘুম আসছে না। অন্ধকারে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চোখের সামনে সবকিছু স্পষ্ট হতে থাকে। সোফার পাশেই টি টেবিলটা। তার সোজাসুজি দেয়ালের সাথে লাগানো বুকশেলফ। দৃষ্টি ঘুরে আসে পুরো ঘরটার উপর। দেয়ালে থাকা কয়েকটা পেইন্টিং। ওর মধ্যে একটা নিশ্চয়ই মোনালিসা। অন্ধকারে অবয়ব বোঝা গেলেও ছবিটা ঠিক দেখা যাচ্ছে না। এক কোনে ফুলদানিটা। তারপর? তারপর অন্ধকারটা আর একটু গাড় হয়ে এসেছে।
ওই কোনটায় কি আছে দেখা যাচ্ছে না। তবে অভ্র জানে ওখানে একটা পিয়ানো আছে। একসময় তনিমার খুব ঝোঁক ছিল পিয়ানোর প্রতি। বিয়ের পরে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে অভ্রই ওটা গিফট করেছিল তনিমাকে। এরপর দৃষ্টি ফিরে এসে স্থির হয় উপরের দেয়ালে। একটা দামি ঝাড়বাতি শোভা পাচ্ছে ওখানে। তনিমার বাবা গতবছর প্যারিস থেকে এনেছিলেন ওটা। তনিমার জন্য। একমাত্র আদরের মেয়ের সংসারের অধিকাংশ দামি আসবাবই ওই ভদ্রলোকের দেয়া। মেয়ে ভালোবেসে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেনির ছেলেকে বিয়ে করলেও তনিমার বাবা তাকে বড়লোক বানানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। ভাবটা ছিল এমন যেন মেয়ে ভুল করে বসেছে এখন তাকে সংশোধন করছেন!
নিজের কম্পানিতে বড় পোস্টে চাকরিও দিতে চেয়েছিলেন অভ্রকে। কিন্তু মিডল ক্লাস ছেলেগুলোর ক্ষেত্রে যা হয় আর কি! ওই যে আত্মসম্মান বোধ। হ্যাঁ, ওটাই অভ্রকে শ্বশুরের ছেলে হওয়া থেকে বাঁচিয়েছিল। সে নিজে বড়লোক শ্বশুড়ের কোন দয়া গ্রহন করেনি। কিন্তু ঘরের আসবাবগুলো ফেরতও দিতে পারে নি। কারন বাবা যদি তার মেয়েকে কিছু দেয় তো সেখানে অভ্র না করার কে? এই যে এখন অভ্রকে বেডরুম ফেলে ড্রয়িং রুমে ঘুমাতে হচ্ছে একদিক দিয়ে ভাবতে গেলে এর জন্যও দায়ী ওই শ্বশুর সাহেবই। যে প্রমান সাইজ এলইডি টিভিটা নিয়ে একটু আগেই তনিমার সাথে ঝগড়া হলো তাও ওই শ্বশুর ঘর থেকেই এসেছে। নইলে অভ্রর সামর্থ্য নেই অত দামি জিনিস কেনার।
অভ্রর দৃষ্টি বারবার ঘুরে ফিরে আসে। ঘরের প্রতিটি কোন সে দেখে চোখ সরু করে। অন্ধকারে ঘরটাকে কখনো এমন করে দেখা হয়নি। অনেকক্ষন ধরে একটা হালকা অস্বস্তি বোধ করছিল অভ্র। ক্রমে ক্রমে সেটা বেড়েই চলছে। কিন্তু সে কিছুতেই ধরতে পারছে না ব্যাপারটা কি। আরও কয়েক বার এদিক ওদিক তাকানোর পর এক কোনে স্থির হয় তার দৃষ্টি যেখানে ফুলদানিটা পড়ে আছে। এবারে অস্বস্তির কারনটা উপলব্ধি করে অভ্র। ওই ফুলদানিটাই তাকে ভাবিয়ে তোলে। ওটা ওর নিজের টাকায় কেনা ফুলদানি। শ্বশুরের দেয়া নয়। কিন্তু ফুলদানিটা খালি পড়ে আছে।
একটা শুকনো ফুলও নেই তাতে। অথচ এক সময় তাজা তাজা রজনীগন্ধায় ফুলদানিটা সেজে থাকতো। ফুলগুলো অভ্র নিজেই নিয়ে আসতো। বিয়ের পর প্রথমদিকে অভ্র প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে তনিমার জন্য তাজা রজনীগন্ধা নিয়ে আসত। তনিমার পছন্দের ফুল। তনিমা সেগুলি যত্ন করে ওখানে রেখে দিতো। কিন্তু সেটা কতদিন আগের কথা? এক বছর? দু’বছর? নাহ্ মনে নেই। শেষ কবে হাতে ফুল নিয়ে বাসায় ফিরেছে অভ্রর মনে নেই। সত্যিই মনে নেই। সময়টা হয়তো একটু বেশিই হয়ে গেছে। কিংবা শুধু অভ্র তনিমার জীবনেই সময়টা দীর্ঘ ছিল। আবছা আলো আঁধারি ঘেরা ওই খালি ফুলদানিটায় অভ্র নিজের জীবনের ছায়া দেখতে পায়। তার জীবনটাও এখন ওই ফুলদানির মতই পুষ্পশূন্য। তনিমার আচরনে বিন্দু মাত্র কোমলতা নেই আজকাল। অভ্র নিজেও কম কিছু নয়।
সেই সকালে বাসা থেকে বের হয়। ফিরতে ফিরতে রাত দশটা এগারোটা বেজে যায়। আগে অবশ্য তনিমা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করত। দু’জন এক সাথে খাবে বলে। কিন্তু আজকাল অভ্র রাতের খাবারটা বাইরে থেকেই খেয়ে আসে। তনিমাও তাই এখন আর অপেক্ষা করে না। সামান্য একটু কথা কাটাকাটিতে যে মেয়েটা একরাশ অভিমানে ডুবে থাকত, কেন জানি আজ তার কোন অভিযোগ নেই। কেবল এক রাশ বিরক্তি একে অপরের প্রতি। হাতে হাত রেখে যে পথচলা শুরু হয়েছিল সময়ের ব্যবধানে সেই পাশাপাশি হাঁটতে থাকা মানুষ দুটোর মধ্যে এক পৃথিবী দূরত্ব। অজান্তেই তাদের পথ বেঁকে গেছে। মনের ব্যথাটাকে বিরক্তিতে চাপা দিয়ে তারা দুজনেই নিজেদের আলাদা পৃথিবীতে আটকে গিয়েছে। ব্যস্ততা অভ্রকে এতটাই জড়িয়ে ধরেছিল যে সে বুঝতেই পারেনি কখন তনিমা এত দূরে সরে গেল।
একটা হাসিখুশি প্রানবন্ত মেয়ে এত কর্কশ আর রুক্ষ কিভাবে হতে পারে? আসলে অবহেলায় কি না হয়? যখন তনিমাকে সময় দেয়ার দরকার ছিল অভ্র পড়ে থেকেছে তার অফিস আর কাজ নিয়ে। দিনের পর দিন মেয়েটা সহ্য করেছে। কিন্তু ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অবহেলাটা বড্ড ভয়ংকর। কিভাবে যেন একেবারে মনের গভীরে গিয়ে আঘাত করে। একটু আগের এক রাশ বিরক্তি অভ্রর বুকে চিনচিনে ব্যথার মত বাজে। সে শুধু তনিমার বদলে যাওয়াটাই দেখেছে। অথচ তার পেছনে কারনটা যে স্বয়ং অভ্র সেই উপলব্ধি করতে তার এতটা সময় লেগে গেল। সে যে ইচ্ছে করে এমনটা করেছে তাও কিন্তু না। কিভাবে কিভাবে যেন হয়ে গেছে। অভ্র টেরই পায়নি এর মধ্যে এতটা সময় গড়িয়ে গেছে। আজ ফুলদানিটা তাকে মনে করিয়ে দেয়, তার ভালোবাসার আকাশটা দীর্ঘদিন ধরে ব্যস্ততার মেঘে ছেয়ে আছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অভ্র ঘোর লাগা চোখে অন্ধকার দেখে। বাকি রাত তার আর ঘুম হয়না। রাতের অন্ধকার চিরে প্রথম প্রভাতের এক চিলতে আলো ঘরে আসতেই অভ্র বেরিয়ে পড়ে। আজকে সে তাজা রজনীগন্ধা নিয়ে ঘরে ফিরবে। তনিমার ঘুম ভাঙার আগেই প্রিয় ফুলদানিটা ফুলে ফুলে সেজে উঠবে। হয়ত ভালোবাসায় আবার সেজে উঠবে তাদের জীবনটাও ফুলদানি একটা জড় বস্তু। কিন্তু সেটা যখন ফুলে সাজানো থাকে তখন তার মধ্যে প্রান সঞ্চার হয়। তেমনি ভালোবাসাও একটা জীবন্ত সত্ত্বা।
ভালোবাসারও যত্ন নিতে হয়। সাজিয়ে রাখতে হয় ফুলের মত। দীর্ঘদিনের অবহেলায় অনুভূতিরা কর্পূরের মত উবে যায়। মৃতপ্রায় ভালোবাসা পড়ে থাকে ঘরের কোনে পুষ্পশূন্য ফুলদানিটার মত। অথচ একটু চেষ্টায় ফুলদানিটাকে যেমন ফুলে ফুলে সাজিয়ে তোলা যায় তেমনি মৃতপ্রায় ভালোবাসাকে জীবন্ত করাও অসম্ভব কিছু নয়। ব্যস্ততার অজুহাতে সময়েরা পালিয়ে বেড়ায়। পলাতক সময়ের কিছুটা অন্তত বন্দি করে রাখা উচিত ভালোবাসার জন্য। তাতে লাভ কিছু হোক না হোক, ক্ষতি তো হবে না নিশ্চয়ই!