বাসের হেল্পার ভাড়া বললো পঁচিশ টাকা। বললাম, ‘পঁচিশ টাকা মানে? বিশ টাকা দিয়ে প্রতিদিন যাওয়া-আসা করি। পঁচিশ টাকা দেবো কেনো?’ আমার কথায় হেল্পারের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। থাকার কথাও না। আমাকে না নিলে তার বিশেষ কোন ক্ষতি নেই। আমার জায়গায় বসার জন্য বাসের বাইরে একঝাঁক যাত্রী অজগরের মতোন হাঁ করে আছে। আমি নেমে গেলেই মুহূর্তে পূরণ হয়ে যাবে আমার শূন্যস্থান। না গেলে বরং আমারই ক্ষতি। অতো দূরের পথ। কখন না কখন আবার বাস আসে।
হেল্পার চিল্লিয়ে বললো, ‘পঁচিশ টাকাই ভাড়া। টাকা না থাকলে নাইমা যান’। পঁচিশ টাকা ভাড়া শুনে মনে হয় আমার গত্রেই লেগেছে খালি। আর কেউ টু শব্দটাও করলোনা। দূর্মূল্যের বাজারে অন্যায় আর অনিয়ম মানুষের গা সয়ে গেছে, না তাদের বোধ শক্তি লোপ পেয়েছে তা বুঝে উঠা মুশকিল। অগত্যা পঁচিশ টাকা ভাড়া গুণেই আমাকে ফিরতে হলো।
বাসায় ফিরেছি। প্রতিদিনই ফিরি। কাঁধে ব্যাগ। চোখে চশমা আর একরাশ ক্লান্তি নিয়ে। আমাকে দরোজা খুলে দেয় আমার স্ত্রী, রেবেকা। দরোজা খুলেই সে সালাম দেয়। আমি ক্লান্ত ভীষণ। হনহন করে হেঁটে চলে আসি নিজেদের রুমে। রেবেকা এসে আমার কাছে দাঁড়ায়। বলে, ‘লেবুর শরবত করে দেই?’ ক্লান্তিতে আমার গা নুইয়ে আসে। ঘরে আসলেই আমি যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলি। কথা বলতে পারিনা। রেবেকা আবার প্রশ্ন করে, ‘মাথাব্যথা করছে? রঙ চা করে দেই? লেবু আর আদা দিয়ে?’
আমি রঙ চা’র ব্যাপারেই সম্মতি জ্ঞাপন করি। অনেকটা রাজার হালতে। ইশারায়। রেবেকা ছুটে যায় রান্নাঘরে। তড়িঘড়ি করে চুলোয় পানি বসিয়ে দেয়। একফাঁকে কেটে নেয় এক ফালি লেবু আর খানিকটা আদা। মুহূর্তকাল পরেই সে ধোঁয়া উঠা কাপ হাতে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। চায়ের কাপ যে-ই না মুখে নিতে যাবো, ওমনি বিকট শব্দে কেঁদে উঠে আমার ছেলে, আবদুল্লাহ। কান্নার সে কি আওয়াজ! কানের পর্দা যেন ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো।
রেবেকা এক দৌঁড়ে এসে আবদুল্লাহকে কোলে তুলে নেয়। বাচ্চার কান্না থামানোর তার সে কি প্রাণান্তকর চেষ্টা! কিন্তু আবদুল্লাহ, ও যেন কান্না না থামানোর পণ করেছে আজ। আবদুল্লাহর কান্নাতে আমার অসুবিধে হচ্ছে ভেবে রেবেকা তাকে নিয়ে অন্য রুমে চলে গেলো। আবদুল্লাহর কান্না তখনও থামেনি। রেবেকা একসুরে বলে যাচ্ছে, ‘ও বাবা আমার! আমার সোনা আব্বুটা! আর কান্না করেনা। এই দেখো, আম্মু তোমাকে কোলে নিয়েছি বাবাই। আর কান্না করেনা আমার বাবুটা। ওলে ওলে বাবা আমার!’
আবদুল্লাহর কান্না আর রেবেকার কান্না থামানোর সঙ্গীত- দুটোর যৌথ প্রযোজনা আমার মাথাব্যথাটা যেন আরো দ্বিগুণ বাড়িয়েই দিলো। শরীর একটু হালকা লাগলে আমি ফোন হাতে নিয়ে বসি। দেয়ালের সাথে পিট ঠেঁকিয়ে প্রবেশ করি নীল সাদার ভার্চুয়াল জগতে। জগতটা অদ্ভুত মায়াময়! উত্তর আধুনিক সময়ে, আমাদের সকল সুখ-দুঃখের গল্প এই জগতের বাসিন্দারা জেনে যায়। আমরাই জানাই। আমাদের সুখে অন্যরা সুখী হয়। দুঃখে অন্যেরা বলে উঠে, ‘আহারে’।
আমি ফেইসবুক স্ক্রল করতেই থাকি…করতেই থাকি। ইতোমধ্যেই আবদুল্লাহ আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। খেয়াল করলাম, রেবেকা খুব সযত্নে আবদুল্লাহকে শুইয়ে দিয়ে গেলো আমার পাশে। তার ছোট্ট মশারিটাও পেতে দেওয়া হলো। আবদুল্লাহকে শুইয়ে দেওয়ার পর রেবেকা খুব নিঁচু স্বরে, পাছে আবদুল্লাহ জেগে যায় এই ভয়ে, জিজ্ঞেস করলো, ‘খাবার কি এখনোই দেবো?’ একেবারে শুরুর ক্লান্তিটা যখন আর নেই, তখন কথা একটু বলাই যায়। রেবেকার প্রশ্নের জবাবে তাই বললাম, ‘একটু পরেই দাও’।
একটু পরে দেওয়ার কথা শুনে রেবেকা পুনঃরায় রান্নাঘরে ছুটে গেলো। সেই কবেই সে রান্না চড়িয়েছিলো কে জানে। ঠান্ডায় সবকিছু জমে বরফ হয়ে আছে নিশ্চয়। খাবারগুলো এবার গরম করার পালা। সে খুব সযত্নে তার কাজে গেলো। তার কাজ, যা সে প্রত্যহ করে। রুটিন মেনে। যাতে কোনোদিন ব্যত্যয় ঘটেনা। একটু পরে সে আবার ছুটে এলো আমার কাছে। শাড়ির আছলে হাত মুছতে মুছতে বললো, ‘চিংড়ির ঝোল আর গরুর গোশত দুটোই করা আছে। দুটোই গরম করবো?’
আমি তন্ময় হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছি। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা লেখা চোখের সামনে। অন্তত আমার কাছে। আমার এক বন্ধু, যার সাথে ফেইসবুকেই আমার পরিচয়, তার লেখা। তাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে আজ। ডিভোর্স পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সে খুব আবেগময় করে তুলে ধরেছে। প্রচন্ড ভালোবাসতো একজন অন্যজনকে। এরপর, কি থেকে যে কি হলো। ডিভোর্স! খুব কষ্টই লাগলো। তাদের দু’জনের জন্যই। রেবেকা আবার বললো, ‘শুনছো? তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছি’। আমি মাথা তুলে রেবেকার দিকে তাকালাম। বললাম, ‘কি?’
-‘চিংড়ি আর গোশত দুটোই করা আছে। দুটোই গরম করবো কিনা জানতে চেয়েছি। নাকি দুটোর যেকোন একটা?’
বেশ রাগ উঠলো। এটা কোন প্রশ্ন হলো করার মতো! গলা উঁচু করে, একটু জোর শব্দেই বললাম, ‘যেকোন একটা করলেই তো পারো। এটা জিজ্ঞেস করার জন্য তো কাকতাড়ুয়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হয়না’।
রেবেকা চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ। এরই ফাঁকে আমি আবার সেই লেখায় মনোনিবেশ করেছি। সেই লেখায় যেখানে আমার বন্ধু তুলে ধরেছে একটা সংসার ভাঙার কাহিনী। এতোদিনের একটা সংসার কিভাবে ভেঙে গেলো সেই দৃশ্যপট খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে আমার বন্ধুটা। খানিক বাদে রেবেকা আবার বললো, ‘সেদিন তুমি চিংড়ির ঝোল খেতে চেয়েছিলে। আমার জ্বর থাকায় রান্না করা হয়নি। তাহলে চিংড়িটাই গরম করি?’
রেবেকার কথাগুলো আমার মনোযোগে বেশ বিঘ্ন ঘটালো। সারাদিন কাজের মধ্যে থাকি। কাজ সেরে বাসায় ফিরেও শান্তি নেই। জেরার পর জেরা। বাবা আমি তো মানুষ, তাইনা? রোবট তো নই। আমারও তো একটু একান্ত সময় দরকার। কিছু একান্ত মুহূর্ত!
মুখে বিরক্তির সর্বশেষ রেখাটি ফুটিয়ে তুলে বললাম, ‘জানোই যখন আমি চিংড়ির ঝোল খেতে চেয়েছি, সেটা তাহলে বারেবারে জিজ্ঞাসা করছো কেনো? চিংড়িটাই গরম করে নিলে পারো’।
আমার বিরক্তিভরা উত্তরে রেবেকা এবার দমে গেলো। সত্যি সত্যিই দমে গেলো। ধীর পায়ে সে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। দরোজার যে জায়গায় রেবেকা এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো, সেখানে এখন একটা পর্দা দুলছে। রেবেকার প্রস্থানে শূণ্যে তৈরি হওয়া হাওয়ায়। আর আমি? আমি আবারও ডুব দিয়েছি নীল সাদার জগতে।
খাওয়া-দাওয়া পর্বের একেবারে মাঝামাঝি পর্যায়, আবারও আবদুল্লাহর সেই গগনবিদারী চিৎকার। সেই কান ফাঁটানো কান্নার আওয়াজ। আমার তাতে কোন অসুবিধা হয়না অবশ্য। বেশ খেতে হয়েছে চিংড়ির ঝোলটা। আমি আরাম করে খাচ্ছি। আর রেবেকা? আবদুল্লাহর কান্নার শব্দ শুনে সে কোন ফাঁকে যে হাওয়ায় উড়ে আবদুল্লাহর কাছে চলে গেলো, আমি টেরই পেলাম না। আবারও সেই একই সুর। একই সঙ্গীত। ‘ও বাবা আমার! আমার সোনা আব্বুটা! আর কান্না করেনা। এই দেখো, আম্মু তোমাকে কোলে নিয়েছি বাবাই। আর কান্না করেনা আমার বাবুটা। ওলে ওলে বাবা আমার!’
সকাল হয়। আমি অফিসের জন্য বের হই। আমার যা যা দরকার, সবকিছুই হাতের কাছে পাওয়া যায়। রেবেকাই এনে রাখে। প্রতিদিন। নিয়ম করে। আজও ব্যত্যয় হয়নি। সে দরোজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ততোক্ষণ, যতোক্ষণ আমি তার দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য না হই। এটাই হলো রোজকার জীবন। আমার…আমাদের।
আজ রেবেকা বাপের বাড়ি যাচ্ছে। আমার শ্বশুর এসেছেন তাকে নিয়ে যেতে। আমার কাজের চাপ। রেবেকাকে রেখে আসার ফুসরত আমার নেই। কদাচিৎ থাকে, সবসময় না। ঠিক এগারোটা ত্রিশ মিনিটে তারা চলে গেলো। আমি অবশ্য এর আগেই অফিসে চলে এসেছি। সকালবেলা রেবেকা বলছিলো, ‘কবে যাবে আমাদের ওখানে?’ আমি শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে বললাম, ‘বলতে পারছিনা। কাজের চাপ আছে’। রেবেকার মুখে খানিকটা অন্ধকার নেমে এলো। সে বললো, ‘ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করো। বাইরের খাবার খেয়ো না যেন! ক্যান্টিনে খেতে পারো। অন্তত বাইরের চেয়ে ভালো’।
-‘তা বটে’।
-‘বেশি রাত জেগো না। রাত জাগলে তোমার চোখের নিচে কালচে দাগ পড়ে’।
-‘হুম’।
-‘বাবা বলছেন মা’র অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। বেশ অনেকদিন থাকা লাগতে পারে’।
-‘সমস্যা নেই’।
-‘তোমাকে আরেকটা ডিম অমলেট করে দিই?’
-‘দরকার নেই’।
উপরের কথাগুলোই রেবেকার সাথে আমার আজকের শেষ সংলাপ। এরপর আমি অফিসের জন্য বেরোই। ঠিক এগারোটা ত্রিশ মিনিটে, রেবেকা ম্যাসেজ করেছে আমার ফোনে। লিখেছে- ‘আমরা এইমাত্র বেরোলাম। তোমার অপেক্ষায় থাকবো’।
বাসায় ফিরেছি রোজকার মতো। কলিংবেল চেপে দাঁড়িয়ে আছি বাইরে। রেবেকার কোন সাড়াশব্দ নেই। ও, মনে পড়েছে। ও তো বাসায় নেই। আজিব! দরোজার সাথে এতোবড় একটা তালা ঝুলছে সেটাও আমার চোখে পড়লো না। রেবেকার ওপর কি এক অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে গেলো আমার! ব্যাগ হাতড়িয়ে বাসার চাবি বের করলাম। দরোজা খুলে ভিতরে আসতেই মনে হলো ঘর জুড়ে এক নিশ্চুপ নীরবতা। সুনসান। লাইটগুলো জ্বালাতেই চোখ গিয়ে পড়লো রেবেকার পড়ার টেবিলে। একটা খাতা। খোলা অবস্থায়। কৌতূহল জাগার কথা নয়। কিন্তু রেবেকা এমন মেয়ে নয় যে সে আনমনে এই খাতাটা খুলে রেখে যাবে। সে খুব গোছালো ধরণের। একটা পিনকেও সে অনেক যত্নে তুলে রাখে।
খাতাটার কাছে আসলাম। কিছু যেন লেখা তাতে। রেবেকার লেখা বলেই মনে হলো। কিন্তু, কি লেখা তাতে? ‘আমি জানি জীবিকার তাগিদে তোমাকে ছুটতে হয়। ভীষণ ব্যস্ততায় পার হয় তোমার সারাটা দিন। এক মাথা যন্ত্রণা নিয়ে বাসায় ফিরো রোজ। তোমার মুখাবয়ব দেখলেই আমি আঁচ করতে পারি তোমার সারাটা দিন। আমি শশব্যস্ত হয়ে পড়ি তোমাকে সামলাতে। তুমি কি কফি খাবে না শরবত, সেই চিন্তায় আমি অস্থির হয়ে যাই। তোমার রাতের খাবার, শোবার বিছানা, সকালের নাস্তা এবং অফিসের পোশাক- সবকিছু ঘিরেই আমার পৃথিবী। আমি ব্যস্ত থাকতে চাই তোমাকে নিয়ে।
আচ্ছা, অফিস থেকে ফিরে কখনো কি তুমি জানতে চেয়েছো আমি দুপুরে খেয়েছি কি না? আমার তো সাজতে ভালো লাগে। কতোদিন হয় আমি সেজেগুজে তোমার সামনে দাঁড়াইনি। কখনো একটিবারের জন্য কি তুমি জানতে চেয়েছো কেনো এখন আর আমার সাজগোঁজ করার ফুসরত মেলেনা? অফিস থেকে যে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে তুমি আসো, সেই চেহারা আমাকে অনেক কষ্ট দেয়। তোমার বিধ্বস্ততা আমি দেখতে পাই। বুঝতে পারি। আচ্ছা, তুমি কি কখনো আমার বিধ্বস্ততা বোঝার চেষ্টা করেছিলে? অন্তত একবার? সংসারের ঘানি টেনে আমারও যে মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে, সেটা তুমি অনুভব করেছো কখনো?
সারাটা দিন একা একা থাকি। একটা অবুঝ বাচ্চাকে সামলাই। তার সাথে আর কতোই বা কথা বলা যায়, বলো? মন চায় খুব করে কথা বলতে, কিংবা খুব মন দিয়ে কথা শুনতে। অপেক্ষায় থাকি কখন তুমি ফিরবে আর আমি মেলে বসবো আমার গল্পের ডালপালা। তুমি তন্ময় হয়ে শুনবে আমার কথা। আর যখন তুমি বলা শুরু করবে, আমি কেবল মন্ত্রমুগ্ধের মতোন শুনে যাবো। কিন্তু দেখো, তুমি ঠিকই তন্ময় হয়ে থাকো। কিন্তু তোমার সেই বিস্ময়, সেই আবেগ, সেই বিহ্বলতা জুড়ে কেবল আমিই নেই। আছে অন্য অনেকে। বাসায় এসে তুমি সেই ভার্চুয়ালে ডুব দাও, আমার কথা তোমার খেয়ালই থাকেনা। তুমি যেখানে আমগ্ন ডুবে থাকো, সেখানে কেউ কি তোমার জন্য দরোজা ধরে অপেক্ষা করে? তোমার পছন্দের খাবার প্রস্তুত করে অধীর অপেক্ষার প্রহর গুণে তোমার জন্য? কিন্তু দেখো, যে মানুষটা তোমার পথ চেয়ে বসে থাকে সারাদিন, তার জন্য তোমার এতোটুকুও সময় হয় না।
তুমি সারাদিন ব্যস্ত থাকো, তাই তোমাকে অকারণ প্রশ্ন করলে রেগে উঠো। কিন্তু, তোমার ছেলে, যাকে আমার অস্তিত্বে ধারণ করে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছি, সে যে আমাকে প্রতিদিন কতো হাজার, সহস্র প্রশ্ন করে তুমি জানো? আমি কিন্তু তার প্রতি একটুও রাগ দেখাই না। একটু বিরক্তিও না। বরং মুখে একরাশ হাসি আর ভালোবাসা মিশিয়ে তার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিই। ভালোবাসার বাঁধনটা তো এমনই, বলো? আবদুল্লাহকে ঘিরে সারাদিন আমার যে ব্যস্ততা, সেই ব্যস্ততা কখনোই কি তোমার চোখে পড়ে? কখনো কি তুমি আমার সেই ব্যস্ততার মূল্যায়ণ করেছিলে? তুমি কেবল দেখছো তোমার ছেলেটা দিন দিন বড় হয়ে উঠছে। এটা শিখছে, ওটা শিখছে। কিন্তু, তার পেছনে আমার যে বিনিয়োগ, সেই বিনিয়োগ কখনোই কি তোমার চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়েছে?
বিশ্বাস করো, আমারও একটা আলাদা পৃথিবী আছে। আমার সেই আলাদা পৃথিবী জুড়ে কেবল তুমি আর তুমি। তুমিই আমার সেই জীবনের রঙ। তোমার অবসরের সমস্তটা জুড়ে আমি থাকতে চাই। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে, তুমি এসে আমার সাথে খোশগল্পে মেতে উঠবে, এমন স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমি রোজ ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু স্বপ্নটা আমার চোখের পাতায় রয়ে যায়। তুমি তোমার মতোই। তুমি আসো। ডুবে যাও একটা নীল সাদার জগতে। খাও। এরপর ঘুম। আমার জন্য তোমার কি একটু সময় থাকতে নেই? অন্তত একটু ফুসরত?
পকেট হাতড়ে মোবাইল বের করলাম। ডায়াল লিস্টের কোথাও রেবেকার নাম্বার নেই। কতোদিন তাকে আমি ফোন করিনা! কতোদিন তার জন্য কিনে আনিনা বেলি ফুলের মালা। সত্যিই তো, কতোদিন হয় তাকে আমি সাজতে দেখিনা। আবদুল্লাহর জন্মের পর তার শরীরটাও ভেঙে গেছে। ছেলেটাকে সামলাতে গিয়ে বেচারি নিজের যত্নের কথাটুকুও ভুলে বসে আছে। তবে সে ভুলেনা আমাকে। আমাকে ঘিরেই তার অঢেল ব্যস্ততা। আর আমার ব্যস্ততা? অফিস…ফেইসবুক…অফিস এপাশ ও’পাশ দোলুনি খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে আমাদের ট্রেন। আমি ছুটে যাচ্ছি রেবেকার কাছে। আমার হাতে ফুলের তোড়া। বেলি আর কাঠগোলাপ ফুলের সমন্বয়ে বানানো। বেলি ফুল রেবেকার পছন্দ, আর কাঠগোলাপ আমার। তার মাঝাখানে একটা চিরকুট। তাতে লেখা- ‘I Love You’…