শুদ্ধতম ভালোবাসা

শুদ্ধতম ভালোবাসা

কলিং বেলের শব্দ শুনে একরাশ বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতে গেলাম । হাতে তিনটা গোলাপ নিয়ে শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে । আমি নিস্তবধে দরজা লাগিয়ে দিয়ে রুমে চলে এলাম ।

_” খাবারটা বেড়ে রেখে শুয়ে পরো আমি হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নিচ্ছি ” শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে শুভ্র বললো ।

_” আজ কিছু রান্না করি নি ” বলেই আমি ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম ।

_ও উৎকণ্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করলো ” কি হয়েছে ইমি তোমার কি শরীর খারাপ ? ” কথা বলতে বলতে আমার কপালে হাত রাখলো ।

_ ” ঢং করো না প্লিজ ঢং আমার পছন্দ না ।
_ ” ওহ তাহলে রান্না করো নি যে ? ”

_” আমি কি একদিন রেস্ট ও নিতে পারবো না ? প্রতিদিন আমাকে চাকরের মত খেটে যেতে হবে ? চাকররা তো মাস শেষে স্যালারি পায় ! আমি কি পেয়েছি তোমার সংসারে এসে….? ”

_ ও গলা স্বর নিচু করে বললো , ” সমস্যা নেই , আমিও আজ ভেবেছিলাম যে রাতে খাবো না যাক ভালোই হলো । ”

হাত মুখ ধুয়ে এসে ও ঘুমিয়ে পড়লো । আমার চোখে কিছুতেই ঘুম আসছে না খুব অশান্তি লাগছে । এই নয় মাসে ওর সংসারে এসে কি পেলাম আমি ? ঘরের কয়েকটা আসবাবপত্র ছাড়া কিচ্ছু দিতে পারেনি ও আমাকে । বিয়ের পর আমার প্রথম ঈদ এটা , মাত্র দশ হাজার টাকা চেয়েছিলাম মার্কেট করতে আর পার্লারের জন্য পাঁচ হাজার । সেটাও আমাকে দিতে পারেনি । নানা রকম অজুহাত আর বাহানা দিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিলো । সকালে নাস্তা বানিয়ে শুভ্র আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললো । আমি চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম ” অফিসে যাও নি ? ”

_ ” তোমার দেখি আজকাল আমার ব্যাপারে কিছুই মনে থাকে না । আজ অফিস বন্ধ ! ” আমি কোন কথা না বলে মোবাইল হাতে বারান্দায় চলে এলাম । শুভ্র এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরাতে আমি আতঙ্কে উঠলাম । এক ঝটকায় ওর হাত সরিয়ে দিয়ে বললাম , ” শুভ্র প্লিজ ফাজলামো করো না ”

_ ” বারে ফাজলামো হবে কেন ! আমার বউকে ধরার অধিকার আমার আছে না বলো ? ”

_ ” অধিকার দেখাতে এসো না । স্বামীর কোন অধিকারটা পূরণ করেছো বলতে পারবে আমাকে ? ”

_ মুখটা কালো করে শুভ্র বললো , ” আমিতো চেষ্টা করি ইমি তোমার সব চাওয়া পাওয়া পূরণ করতে ”

_ ” ঘোড়ার ডিম করো তুমি ! আমার কাজিনরা সবাই কত আগে ঈদের শপিং করে ফেলেছে । ওরা সবাই ওদের নিউ নিউ ড্রেসের পিক আমাকে পাঠায় । আমাকে যখন জিজ্ঞেস করে আমি কিছু বলতে পারি না চুপ হয়ে থাকি । ”

_ ” ড্রয়ারে তো পাঁচ হাজার টাকা এক্সট্রা রাখা আছে । তুমি তো আপুর সাথে গিয়ে ড্রেস কিনে আনতে পারো । ”

_ ” কি বললে ফকিরের মত পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে আমি আপুর সাথে মার্কেটে যাবো ? জানো দুলাভাই আপুকে কত টাকা দিয়েছে শপিংয়ের জন্য ? পঞ্চাশ হাজার টাকা !! তুমি কোনোদিন চোখে দেখেছো শুভ্র ? ”

_ ” চিন্তা করো না আমি বেঁচে থাকতে তোমার কোনো ইচ্ছাই আমি অপূর্ন রাখবো না । বোনাসটা পেলেই তোমার টাকা তুমি পেয়ে যাবে । ” বলেই শুভ্র দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল ।

আলমারী তন্ন তন্ন করে খুঁজেও একটা ভালো শাড়ি পেলাম না । বাধ্য হয়ে মা মারা যাওয়ার আগে যে শাড়িটা দিয়েছিল সেটাই পরে নিলাম । কানে একজোড়া ছোট্ট দুল আর হাতে দুইটা মাত্র চুড়ি ই আছে আমার । সেগুলা পরে হাল্কা সেজে নিলাম । শুভ্র নামায পড়তে গেছে ও আসলে ওকে টেক্সট করে জানিয়ে দিবো । বের হওয়ার সময় হঠাৎ টেবিলে রাখা গোলাপ ফুল গুলোর দিকে চোখ পড়লো । কত্ত যে আর ন্যাকামি করবে এই ছেলেটা । দেখলে গা জ্বলে যায় । ফুলগুলো ময়লার ঝুড়িতে ছুড়ে মেরে পার্স আর মোবাইলটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলাম ।

টেক্সী থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে ইভাদের বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম । বাড়ির গেট যেমন বিশাল ভিতরে তেমনি বড় দালান , চারদিকে প্রচুর বিলাসিতার ছোঁয়া ! একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে ভিতরে ঢুকলাম । আমাকে দেখে ইভা ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো আমি টাল সামলাতে না পেরে তিন চার পা পিছিয়ে গেলাম । অন্তরের অন্তরঙ্গ বান্ধবী আমরা ! এত দিন পর দেখে খুশিতে দুজনেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি । ভালো মন্দ অনেক আলাপ হলো দুজনে । শুধু শুভ্র সম্পর্কে কোনো আলাপ হয়নি । এরমধ্যে শুভ্র বেশ কয়েকবার ফোন করেছে রিসিভ করিনি ।

_ ” ইভা তোর হাসবেন্ড কে তো দেখছি না ? সে কই ? ”

_ ” ও একটু ব্যস্ত তাই এই রুমে আসে নি ! তোর শুভ্রর কথা বল , কি খবর তার ?

শুভ্রর কথা বলাতে আমি এড়িয়ে গেলাম । ” ইভা ব্যাগের ভিতরে এই ড্রেসটা সো বিউটিফুল এটা ভাইয়া নিশ্চই তোকে গিফট করেছে ? ” ইভা কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে আমি আবার বললাম ” ইউ আর সো লাকি ইভা ” ! ইভা এবার মাথা নিচু করে রইলো ।

হঠাৎ কর্কশ স্বরে গর্জন করতে করতে ইভার স্বামী রুমে উপস্থিত হলো । রুমে যে কেউ একজন বসে আছে সেদিকে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই । তারপর হাতে থাকা এত্তগুলা কাপড় ইভার উপর ছুড়ে মেরে অকথ্য ভাষায় ইভাকে গালাগালি শুরু করলো । ঘটনার আকস্মিতা বুঝতে না পেরে আমি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম । এরপর শপিং ব্যাগে থাকা ড্রেসটার দিকে উদ্দেশ্য করে বললো , ” ড্রেসটা এক্ষুনি রাপিং পেপারে মুড়ে দিতে ।

রাপিং পেপারে মোড়ানো প্যাকেটটা নিয়ে ইভার স্বামী চলে গেল । এতক্ষনে আমি জলের মত পরিষ্কার সব বুঝতে পারলাম । আমি ইভাকে কিছু বলার আগেই ও আমায় জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলো । ইভা খুবই স্ট্রং একটা মেয়ে । আমি কখনো ওকে এভাবে দেখিনি । আর এই পরিস্থিতিতে ওকে যে কি বলে শান্তনা দিবো ভেবে পাচ্ছি না ।

_ চোখের জল মুছতে মুছতে ইভা বললো , ” ধন_সম্পত্তি আর অর্থ বিত্ত দিয়ে ভালো থাকা হয় নারে ইমি । সবাই আমার বাইরের সুখটাই দেখছে ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছি এটা কেউ দেখতে পায় না । অর্থ সম্পত্তি টাকা পয়সা কখনো সুখ শান্তির কারণ হতে পারে না । ভালো থাকার জন্য দরকার হয় একটা ভালো মন যেটা শুভ্রর আছে । ইমি তুই কি জানিস তুই যে কত্ত লাকি ? আমার জীবনে শুভ্রর মত একটাও ভালো ছেলে আমি দেখিনি। ”

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি । অজান্তেই আমার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে । আমি যেন কোনোকিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি । দুই বছর প্রেম করে তারপর একসাথে নয় মাস থাকার পরও মানুষটাকে আমি চিন্তে পারলাম না । একটা খাঁটি সোনাকে আমি অবজ্ঞা অবহেলা করে যাচ্ছি শুধুমাত্র তুচ্ছ কিছু মোহের জন্য।

বুক ফেঁটে কান্না আসছে আমার । নিজেকে সামলাতে না পেরে ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম । কত্ত বড় ভুল আমি করতে যাচ্ছিলাম আজ বিধাতা আমায় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো । বাসায় এসে দরজার নিচে একটা ছোট্ট চিরকুট দেখতে পেলাম । ” আমার যদি মৃত্যুও আসে তাহলে তাকে দাঁড় করিয়ে তোমার সব ইচ্ছে পূরণ করে হাসি মুখে তারপর আমি বিদায় নিবো ! ” _শুভ্র শোবার রুমে একটা বাদামি রঙের খাম আর একটা চিরকুট পেলাম । ” প্রিয় , জেনে নিও তোমার খুশিই আমার খুশি ! তুমি চাইলে হিমালয়ও জয় করতে পারি । _শুভ্র

খামের ভেতর সম্ভবত টাকা রেখে গেছে শুভ্র । জানিনা ছেলেটা কিভাবে এতগুলো টাকা যোগার করেছে । অফিস থেকে বেতন বোনাস পাওয়ার সময় এখনো হয়নি । কতটা কষ্ট করে এতগুলো টাকা যোগার করেছে আমার জন্য । বদ্ধ ঘরে ইচ্ছেমত কান্না করলাম । এটা কষ্টের কান্না নয় এটা অনুতপ্তের কান্না ! কতটা বোকা আমি যে কিনা সত্যিকারে ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি । রাত বারটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে কলিং বেল বাজলো । শুভ্র মনে হয় এসে গেছে আমি দৌড়ে দরজা খুলতে গেলাম । ঘরে ঢুকে শুভ্র অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে আমি ওকে চোখ ইশারা করে জিজ্ঞেস করলাম , ” কি হয়েছে ? ”

_ ” ফুলটা তো ময়লার ঝুড়িতে ছিলো ! ”

_ ” হুম তুলে নিয়ে আবার মাথায় পড়েছি ! ” শুভ্রর চোখ মুখে একসাথে আনন্দ আর বিস্ময়ের আভা ফুটে উঠেছে !

_ ” এই একি করছো ? ” আমাকে দু’হাত দিয়ে তুলে শুভ্র বললো ।

” তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে গো তাই কদমবুসি করছি । স্বামীকে তো কদমবুসি করার নিয়ম আছে । ”
_ ” তোমাকে যে আমি বুকপাজরে রাখবো অন্য কোথাও ছুঁতে দিবো না । ”

_ ” আমি একজন ব্যর্থ স্ত্রী যে তার স্বামীর ভালোবাসা পেয়েও ইচ্ছে করে তাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে । তোমার প্রবিত্র হাত দিয়ে ছুঁয়ে আমাকে শুদ্ধতম করে দাও ”

_ ” এই কাঁদছো কেন ? তোমার চোখের জল যে আমার কাছে বড্ড অসহ্য যন্তনার ”

_ ” এটাই শেষ কান্না , আর কখনো কাঁদবো না ! তোমার মত একজন শুদ্ধমত মানুষের স্ত্রী হতে পেরে আমি ধন্য ! এই চোখে কি আমার চোখে জল মানায় গো ? ”

_ ” সারাজীবন আগলে রাখবো ! বিষণ্ণতা কখনো তোমায় ছুঁতে দিবো না ”

_ ” সারাজীবন তোমার এই ভালোবাসাটুকুই আমার চাই ! বিশ্বাস করো আজ থেকে তোমার ভালোবাসা ছাড়া দ্বিতীয় আমার আর কিচ্ছুই চাওয়ার নেই ।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত