আমার দুলালি ননদীনি তুলতুলি বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছে। ওর নাকি লেখাপড়ার প্যারা ভাল্লাগে না তাই সে বিয়ে করে বিয়ের প্যারা নিতে চায়। কিন্তু প্রবলেম হলো বাড়ির সবাই তাকে ফোর ফাইভে পড়া বাচ্চা মনে করে। এদিকে তো বাচ্চা বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছে। জড়িয়ে কড়িয়ে সব বিপদ এলো আমার ঘাড়েই। রাতে আমি লিখতে বসেছি, বেশ মনোযোগ দিয়েই লিখছি। সে হুড়মুড় করে আমার রুমে ঢুকে বললো-
__”বৌরানী শোনো, তোমার সাথে একটা ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে।” আমি ওর দিকে না তাকিয়েই বললাম-
__”এখন লিখছি পরে শুনবো আমার তুলতুলি পাখিতা।”
__”না এখনি শুনবা।”
বলেই সে আমাকে সোফা থেকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো। বুঝলাম না সোফায় বসে কথা বলতে কি প্রবলেম! ভাবলাম হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ গোপন কথা হবে। কিন্তু সে আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো-
__”আমি বিয়ে করবো বৌরানী।” আমি সাত আসমান থেকে মাটিতে পড়লাম না। কারণ ওর বয়স তো প্রায় ১৮ হয়েই গেছে। সামনে সপ্তাহে ওর ১৮তম জন্মদিন। বিয়ের ইচ্ছে প্রতিটা মানুষেরই থাকে। কিন্তু প্রবলেম হলো এই বাড়ির সবাই তাকে বাচ্চা মনে করে।
বললাম-
__”তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? হঠাৎ বিয়ে কেনো করতে চাইছিস?”
__”আমার লেখাপড়া করতে ভাল্লাগে না। আমাকে এই প্যারা থেকে উদ্ধার করো প্লিজ বৌরানী!” লেখাপড়া করার ভয়ে বিয়ে করতে চাওয়া মেয়ের সংখ্যা বাংলাদেশে কম নয়। তাই আমি অবাক হলাম না।
__”তুই লেখাপড়া করার ভয়ে বিয়ে করবি?”
__”আরো কারণ আছে।”
__”কি কারণ?”
__”বিয়েতে প্রচুর শপিং করবো আর খুব সাজবো।
খাওয়া দাওয়া হবে। দারুণ মজা হবে। আর নতুন একটা মানুষও তো পাবো।” এই মেয়ের কথা শুনে আমি অবাক হই না। বিয়ের পরে এবাড়িতে আসার পর থেকেই তো ওর উদ্ভট কথাবার্তা শুনে আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। বললাম-
__”তুই এমন ভাবে বলছিস যেনো, তুই কখনো শপিং করিস না, আর এ বাড়িতে ভালো খাওয়া দাওয়াও হয় না। আর নতুন মানুষ, একটা প্রেম করলেই তো নতুন মানুষ পাওয়া যায়। এসবের জন্য আবার বিয়ে করতে হয় নাকি?”
__”এসব লজিক বাদ দিয়ে আমাকে বিয়ে দাও ব্যাস। আমি আর পড়বো না।”
__”শোন, এখন প্রেম করার সময়, বিয়ের প্যারা এই বয়সে নিতে পারবি না।”
__”লেখাপড়ার প্যারার চেয়ে বিয়ের প্যারা অনেক সহজ। আর আমি প্রেম টেম করতে পারবো না। আমার একটা বর-ই চাই।”
__”বিয়ের পর বলবি লেখাপড়ার প্যারাই সহজ ছিল।” সে বেশ সিরিয়াস ভাবে বললো-
__”তুমি ভাইয়াকে বলো পাত্র দেখতে। ভাইয়া বিয়ে দেবে। আর হ্যাঁ, আমি বিয়ে করতে চাই এটা প্লিজ বলো না।”
__”তাহলে কি বলবো?”
__”বলবে তুলির তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে তাই তাকে বিয়ে দিয়ে দাও।”
__” এ বাড়িতে সবাই কি জানে যে তোর বিয়ের বয়স হয়েছে? সবাই তো মনে করে তুই একটা বাচ্চা।”
সে মুখটা করুণ করে বললো-
__”এটাই তো আমার দুঃখ। আমার বয়স ১৮ হতে চলেছে অথচ সবাই আমাকে ফোর ফাইভে পড়া বাচ্চা মনে করে। এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি!”
__”বিয়ে করবি ভালো কথা। বাবা আর তোর দুলাল ভাইয়াকে ডেকে বলে দে।”
__”তুমি বলবে।”
__”আমি একটা শিশুকে বিয়ে দিতে বলে মরবো নাকি? শেষে পুলিশ এসে আমাকে ধরে হাজতে ভরবে। তোর ভাইয়া আমাকে হাজতে দেখতে গিয়ে বলবে, ‘বাল্য বিবাহ দিতে চাওয়ার ফলাফল পেয়েছো তো নির্বোধ মাথামোটা?’ এত বিপদ আমি ঘাড়ে নিতে পারবো না বাবাহ!”
__”তাহলে আমার ১৮তম জন্মদিনের পার্টিতে তুমি সবাইকে বুঝিয়ে দেবে যে, আমার বিয়ের বয়স হয়েছে। আর মেয়েদের বিয়ে তাড়াতাড়ি দিতে হয়। সাথে হাবিজাবি আরো কিছু বানিয়ে বলবে।”
__”আমি কি করে বোঝাবো?”
__”যেমন ধরো, ভাইয়া আর বাবাকে বলবে, ‘তুলির তো ১৮ হলো তার মানে এখন তুলিকে বিয়ে দেয়া যাবে।’ এটা শুনে ভাইয়া আর বাবা বুঝতে পারবে যে, আমার বিয়ের বয়স হয়েছে।”
__”আমি এসব পারবো না। কি বলতে আমি কি বলবো আর তোর ভাইয়া আমাকে উরাধুরা ঝাড়ি দেবে।”
__”প্লিজ বৌরানী প্লিজ প্লিজ! আমার জন্য না হয় একটু ঝাড়িই খেলে। আর তুমি তো শুধুই আমার বৌরানী নও।”
__”তাহলে আমি কি?”
__”আমার বান্ধবীও। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তো তুমিই।”
__”আমি তোর বয়সে অনেক বড়। বান্ধবী হলাম কি করে?”
__”আরেহ বান্ধবী হতে বয়সের মিল থাকতে হয় নাকি? মনের মিল থাকলেই হয়।” কথাটা বলেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বললাম-
__”থাক আমাকে আর পটাতে হবে না।”
আমাদের কথোপকথনের মধ্যেই স্যামস্ রুমে ঢুকলো। তুলি উঠে দাড়িয়ে হঠাৎ দুলালি বাচ্চা হয়ে গেলো। দুলালের বোন তো দুলালিই হবে। সে বেশ আল্লাদ করে বললো-
__”ভাইয়া চকলেট কোথায়?”
স্যামস্ ভুলে যাবার ভান করলো। আমি জানি সে তার বোনের জন্য চকলেট নিয়ে আসতে ভুলে যায় না। সে ভান করেই বললো-
__”ওহ নো! ভুলে গেছি চকলেট আনতে।” তুলি ঠোঁট ফুলিয়ে বললো-
__”আমি এসব কিচ্ছু শুনবো না। আমার এখন চকলেট চাই।”
__”কাল এনে দেবো আমার রাজকুমারীকে।”
__”না আমার এখনি চাই। নইলে আমি কিচ্ছু খাবো না।”
স্যামস্ চকলেটের বক্সটা সামনে ধরতেই তুলির মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে গেলো। সে বক্স নিয়ে দৌড়ে চলে গেলো। ওদের ভাই বোনের ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করে। হঠাৎ আমার ভাইটার কথা মনে পড়লো। কত দিন হয়ে গেলো কেউ আমার চুল ধরে টানে না। কেউ আমার খাবার খেয়ে ফেলে না। কেউ জোর করে আমার পার্স থেকে টাকা বের করে নেয় না। কেউ বলে না,”আপা দারুণ একটা শার্ট দেখে এসেছি, তুই ওটা কিনে দে।” আমার চোখ দুটো ভিজে এলো। খুব সাবধানে চোখ দুটো সামলে নিয়ে চেঞ্জ করার জন্য স্যামস্ কে কাপড় এগিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বললাম-
__”আমার জিনিস কোথায়?”
__”তুমি তো চকলেট খাও না।”
__”আমি কি বলেছি যে আমার জিনিসটা চকলেটই?”
__”তো কি?” আমি অভিমানের স্বরে বললাম-
__”ভুলেই যখন গেছো তখন আর শুনতে হবে না।”
সে কিছু মনে করার চেষ্টা করলো না। কি-ই বা মনে করবে! আমি তো আমার জন্য তাকে কিছু আনতেই বলিনি। সে উদাস ভঙ্গিতে বললো-
__”আচ্ছা।”
তার মুখে “আচ্ছা” শব্দটা শুনে হুট করেই আমার ভীষণ অভিমান হলো। আমি তাকে কিছু আনতে বলিনি, সেও আনেনি তাহলে অভিমান কেনো হলো আমার সেটাই আমি বুঝলাম না। হয়তো মেয়েদের কারণে অকারণে অভিমান করার স্থান এই একটাই, “স্বামী”। আর পৃথিবীতে এই একটা মানুষই হয়তো দ্বিধাহীন ভাবে সব অভিমান আপন করে নেয়। অজান্তেই বলে ফেললাম-
__”কাঠঠোকরা একটা।”
__”কিছু বললে?”
__”না তো।”
__”মনে হলো বিড়বিড় করে কি যেনো বললে।”
__”বলেছি তুমি আস্ত একটা কাঠঠোকরা।”
__”কোন্ এ্যাঙ্গেলে আমাকে কাঠঠোকরা মনে হচ্ছে? আমি কাঠকে ঠোকরাই?”
__”তুমি তো নিজেই একটা কাঠ।”
__”এ আর নতুন কি!”
রাতে ঘুমাতে যাবার আগে আমি ফ্রেশ হয়ে চুল বেনি করে দাড়াতেই, স্যামস্ পেছন থেকে আমার বেনী ধরে টান দিলো। আমি চমকে উঠে দাড়িয়ে গেলাম। সে আমার বেনীতে বেলীফুলের মালা পেঁচিয়ে দিয়ে বললো-
__”তোমার জিনিস আনতেও আমার ভুল হয় না গো আমার অভিমানী বউ।”
আমি স্তব্ধ দাড়িয়ে রইলাম। কিচ্ছু বললাম না। কেনো জানি না আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। মাঝে মাঝে চুপ থেকে মনের সাথে কথা বলতে ভালো লাগে। যেটা একান্তই নিজের, যা কাউকে জানাতে নেই। তুলির প্ল্যান মোতাবেক ওর বার্থডে তে আমি হাসিমুখে স্যামস্ এর সামনে বাবাকে বললাম-
__”আমার তুলতুলি পাখিটা দেখতে দেখতে কত্তো বড় হয়ে গেলো। বিয়ের বয়সও হয়ে গেলো।” বাবা হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
__”ওর মাত্র ১৮ হলো। সে তো শিশু। ওর বিয়ের বয়স মানে?” আমি ঢোক গিলে বললাম-
__”সেটাই তো, বিয়ের বয়স এখনি কি করে হবে? ওর অনার্স শেষ হবে তারপর বিয়ের বয়স হবে।”
__”শুধু অনার্স নয়, আমার মামনির লেখাপড়া শেষ হবার পরে তারপর ওর বিয়ে দেবো।”
__”হ্যাঁ একদম ঠিক ডিসিশন বাবা।” তুলি একটু দূরে থেকে সব শুনছে আর খিটমিট করে আমার দিকে চেয়ে আছে। রাতে এটা নিয়ে স্যামস্ আমাকে উরাধুরা ঝাড়ি দিলো।
__”তুমি এসব বলে বলে দেখছি একটা বাচ্চা মেয়ের মাথায় বিয়ের ভুত ঢুকিয়ে দিচ্ছো।”
__”আমি কবে কখন এসব করলাম?”
__”ওর বিয়ের কথা তোমার মুখে আসে কি করে?”
__”আচ্ছা ভুল হয়েছে, আর কখনো এসব মুখে আসবে না।”
__”শোনো, ওর মাথাতে যদি কখনো নিজে থেকে বিয়ের ভুত চাপেও তাহলে তা দমন করার দায়িত্ব তোমার।”
তুলির সব কথার দায় নিজের মাথায় নিলাম। হলাম না হয় দোষী ভালোবাসার মানুষ গুলোর জন্য। মেয়েটা তো সত্যিই আমাকে ভালোবাসে। তুলি রোজ জিজ্ঞেস করে আমি বিয়ের কথা তার ভাইয়াকে বলেছি কি না। তুলির বিয়ের কথা স্যামস্ এর সামনে বলার সাহস পাই না। বলতে গেলেই সেদিনের উরাধুরা ঝাড়ি গুলো কানে বাজে। তাই তুলির কথাতে পটে গিয়ে আমি আর স্যামস্’কে কিছু বলি না। স্যামস্ বলেছে তুলির মাথা থেকে বিয়ের ভুত যেনো আমি সরিয়ে দিই। হে আল্লাহ তুমি আমাকে এ কোন্ পরীক্ষায় ফেললে? আমি তো ওঝা নই যে ভুত তাড়াবো! এদিকে তুলি বিয়ে বিয়ে করে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে। আমি না পারছি এদিক যেতে, না পারছি ওদিক যেতে। এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে ওর রুমে গেলাম। দেখি লেখাপড়া বাদ দিয়ে দুলালি ফোন টিপছে। এর আগে একদিন বলেছি রাত জেগে যেনো সে ফোন না টিপে। সে জবাব দিলো, “বিয়ে দাও তাহলে।” ভয়ে আর বারণ করিনি। আজকেও বারণ করার উপায় নেই। বারণ করলেই তো বলবে তাহলে বিয়ে দাও। বললাম-
__”ঢকঢক করে দুধ টুকু খেয়ে নে তো তুলতুলি পাখিটা। আমার হাতে অনেক কাজ আছে।” সে আমার দিকে না তাকিয়ে ফোন টিপতে টিপতে বললো-
__”দুধ খাবো কেনো?”
__”এত রাত জেগে ফোন টিপিস, শরীরটা তো ঠিক রাখতে হবে।”
__”ওরে আল্লাহ! এর জন্য দুধ খেতে হবে?”
__”হ্যাঁ হবে। রোজ তুই দুই গ্লাস দুধ খাবি। এটা শেষ কর আমি আরেক গ্লাস আনছি।”
__”কেনো?”
__”এক গ্লাস লেখাপড়া করিস তাই আর আরেক গ্লাস ফোন টিপিস তাই।”
__”ফোন টিপি বলে শাস্তি দিতে পারো মানলাম কিন্তু কষ্ট করে লেখাপড়া করি তাহলে শাস্তি দিবা কেনো?”
__”শাস্তি কখন দিলাম?”
__”এই দুধ খাওয়টা কত বড় শাস্তি তা তুমি নিজেও জানো কারণ তুমি নিজেও দুধ খাও না।”
__”এসব প্যাচাল রেখে তাড়াতাড়ি খেয়ে নে।”
__”তুমি বরং শাস্তি স্বরূপ আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও।”
__”থাক তোর দুধ খেতে হবে না।”
__”গুড বৌরানী আমার, উম্মাহ।”
__”তোর উম্মাহ তোর কাছেই রাখ।”
প্রায় বছরখানেক ধরে তুলি বিয়ে দাও, বিয়ে দাও বলে আমার মাথা খেলো। আমার বাপের বাড়ি যাবার কথা শুনলে স্যামস্ এর মন যতোটা খারাপ হয় তার চেয়ে দ্বিগুণ বেশি খারাপ হয় তুলির। সে কিছুতেই আমাকে যেতে দিতে চায় না তাই বিয়ের প্রসঙ্গ টেনে আনে। বলে, “আমাকে বিয়ে দিয়ে তারপর বাপের বাড়ি যাও।” তাকে বিয়ে দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই কিন্তু তাকে আমার সাথে বাপের বাড়িতে নিয়ে যেতেই পারি। কারণ ওর মূল সমস্যা হলো সে আমাকে ছেড়ে থাকবে না। তাই স্বামী সাথে থাকুক বা না থাকুক, ননদীনিকে ঠিক সাথে রাখি। এমন করেই হেসে খেলে কেটে গেলো কয়েক বছর।
তুলির অনার্স শেষ হলো। ওর বিয়ে নিয়ে বাড়িতে প্রায়ই কথা হয়। আমি চুপচাপ শুনি। ইদানিং সে বিয়ে ভাঙা কার্যক্রমে যোগ দিয়েছে। সেদিন পাত্র দেখাতে ক্যাফেটেরিয়াতে গেলাম, দু’জন দুজনকে দেখবে। সে উদ্ভট প্রশ্ন করে করে ছেলেটাকে নার্ভাস করে বিতাড়িত করলো। আরেক দিন গেলাম শপিংমলে, সেদিন সে ছেলেটাকে টেনে শপিংএ নিয়ে গেলো। তারপর তাকে জোর করে শাড়ি পরালো। ছেলেটা যে তুলিকে মেন্টাল পেসেন্ট ভেবে চলে গেছে তা আমি নিশ্চিত। এমন সব উদ্ভট ঘটনা ঘটিয়ে সে সব সমন্ধ রিজেক্ট করছে। স্যামস্’কে বিষয়টা জানানোর পর বাইরে পাত্র দেখা বন্ধ হলো।
পাত্র বাড়িতে এলেও তুলির অদ্ভুত আচরণের বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাদের। মেয়েটা কিছুতেই বিয়েতে রাজী নয়। কে বলবে যে কয়েক বছর আগে এই মেয়েটাই বিয়ে পাগলি ছিল! আসলে নির্দিষ্ট বয়সের পরে মেয়েরা বিয়ে করতে ভয় পায়। একটা বয়সে মেয়েরা ভীষণ আবেগী থাকে। তখন মনে হয় বিয়েটাই যেনো জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু। সেই বয়সটা পেরিয়ে গেলে বিয়ে হয়ে উঠে ভীতিকর। স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের সাথে মানিয়ে নিতে পারবে কি না, সুখী হতে পারবে কি না এই সব ভাবনা তখন ভীতিগ্রস্ত করে ফেলে। যেটা এখন তুলির মধ্যে আছে। স্যামস্ আমাকে বলেছে তুলিকে বিয়েতে রাজী করাতে। চেষ্টা তো করতেই হবে। সন্ধ্যায় ওর রুমে গেলাম। ওর পাশে বসে ওর মাথায় হাত রেখে বললাম-
__”বিয়ের জন্য তো পাগলি ছিলি, এখন কেনো চাইছিস না?” সে উদাস ভঙ্গিতে বললো-
__”ভাল্লাগে না বিয়ে শাদী।”
__”কারণটা তো বল? কত ভালো ভালো ছেলেকে রিজেক্ট করছিস।”
__”কে জানে তারা আদৌ ভালো কি না। আর এত শত দায়িত্ব যদি ঠিকঠাক পালন করতে না পারি তাহলে সবাই ভাববে আমার ফ্যামিলি আমাকে কিচ্ছু শেখায়নি। বাবা মা ভাইয়া আর তোমার দিকে আঙ্গুল উঠাবে। এসব আমি মানতে পারবো না। এর চেয়ে ভালো বিয়ে না করা।”
__”শুধুই এই কারণে বিয়ে করতে চাইছিস না? আমি তো আছি নাকি? বলেছি তো সব শিখিয়ে দেবো। কখন তুই চন্ডী হবি আর কখন দূর্গা হবি সবটাই তো শিখাতে চেয়েছি।”
__”আরেকটা কারণ আছে।”
__”কি কারণ?” হঠাৎ ওর চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো। সে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে বললো-
__”আমি তোমাদের না দেখে থাকতে পারবো না বৌরানী।”
আমি অবাক হলাম না। কারণ মায়ার কাঁটাতারে সব মেয়েই আটকে থাকে। তুলিও আটকে আছে। আর স্যামস্ এর প্রতি তার টানটা সব চেয়ে বেশি। মূলত সে তার ভাইয়াকে না দেখে থাকতে পারবে এই আত্মবিশ্বাসটা তার নেই। আমি সান্ত্বনার ভাষায় বললাম-
__”পাগলি একটা। বাবা মাকে ছেড়ে আমি তো থাকছি ২২৭ কিলোমিটার দূরে।”
__”জানি এটা মেয়েদের খুব গভীর একটা কষ্টের জায়গা। ভাইয়া পৃথিবীর সব সুখ তোমাকে এনে দিলেও এই কষ্টটা তোমাকে ঠিকই যাতনা দেয়। আমি ভাইয়াকে ছেড়ে থাকতে পারবো না।”
__”তাহলে বরং আমার তুলতুলি পাখিটার জন্য একটা ঘরজামাই ধরে আনি?”
__”ওহ নো। কি সব বলছো?”
__”ছেলেটা খুব ভালো, দেখতেও সুন্দর। রাজী হয়ে যা।”
অনেক বুঝিয়ে তুলিকে রাজী করালাম। যদিও ওর মন সায় দিচ্ছে না। আসলে সে আমাদের ছেড়ে দূরে থাকতে চাইছে না। যদিও তার এই শহরেই বিয়ে হচ্ছে। কিন্তু সে সারাক্ষণ আমাদের চোখের সামনে দেখতে চায়। এমন প্রত্যাশা তো কোনো নারীরই পূরণ হয় না। একদিন না একদিন নারীদেরকে পরিবার ছাড়তেই হয়। রহস্যঘন ব্যাপার হলো, স্বামীর বুকে মাথা রেখে একদিন তারা কাছের মানুষ গুলোকে দূরে রাখার কষ্ট গুলোও ভুলে যায়। মায়ার কাঁটাতার স্থান পরিবর্তন করে। তখন পৃথিবীর সব মায়া ভর করে স্বামীর উপর।
স্যামস্ ঘুমানোর আগে একবার তুলির রুমে যায় তাকে দেখতে। সারা দিনের ব্যস্ততায় বোনকে সময় দিতে না পারলেও রাতে দুই ভাই বোন বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়। বোনের সব আবদার শোনবার সময় ওটাই। স্যামস্ এর ফিরতে বেশি রাত হয়ে গেলে তুলি ঘুমিয়ে যায়। সে নিয়ম মাফিক তুলির ঘরে গিয়ে তার ঘুমন্ত মুখটা দেখে আসে।
তুলি বিয়েতে রাজী হবার পর স্যামস্ বাহিরে খুশি কিন্তু ভেতরটা তার দগ্ধে যাচ্ছে। রাতে তার ঘুম হয় না। সেদিন ঘুম ভেঙে দেখি সে সোফায় বসে আছে। ওর পেছনে গিয়ে দাড়িয়ে দেখি সে এ্যালবাম দেখছে। সব গুলো তুলির ছোট বেলার সব ছবি। কত শত সুন্দর মুহূর্ত ফ্রেমে আটকে রাখা হয়েছে।
সে ভেজা চোখে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখছে সেই ফ্রেমে আটকানো সময় গুলো।। তাকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা আমার নেই। মনে পড়ে গেলো আমার বিয়ের দিনের কথা। আমার ভাইটা চোখের জল লুকানোর জন্য অস্থির হয়ে ছিল সেদিন, আর আমি বার বার তাকে আমার কাছে ডাকছিলাম। আমার বুকটাও যে ফেটে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আর বুঝি দেখা হবে না। তারও হয়তো এমন হৃদয়বিদারক কিছুই মনে হচ্ছিল। ভাইদের এই অপ্রকাশ্য কষ্টটা হয়তো শুধু ভাইয়েরাই উপলব্ধি করতে পারে। আমরা মেয়েরা তাদের এই অপ্রকাশ্য আত্মচিৎকার শুনতে পাই না। আমি চেতনায় ফিরলাম। স্যামস্ এর কাঁধে হাত রাখতেই সে আমার হাত টেনে ওর ঠোঁটে চেপে ধরে বললো-
__”সোনাবউ কোথায় লুকাই বলো তো এই কষ্টটা?” কথাটা বলতে বলতে ওর গলা ভারী হয়ে এলো। আমার হাতে ওর চোখের জল টপটপ করে পড়লো। গরম এই লোনা জলে অদৃশ্য হয়ে লুকিয়ে আছে কত শত ভালোবাসার উপাখ্যান। বললাম-
__”তোমার রাজকুমারী সুখেই থাকবে। তার কোলে আরেকটা ছোট্ট রাজকুমারী আসবে। তোমার ভালো লাগবে না?”
__”হু”
আমি আর কিছু বললাম না। আর কি-ই বা বলার আছে আমার! সব কষ্টের সান্ত্বনা হয় না। কিছু কিছু কষ্টে কেঁদে হালকা হতে হয়। তাই তাকে কাঁদতে দিলাম। আজ তুলির জন্মদিন। সামনে সপ্তাহে ওর বিয়ের তারিখ। বারোটার পরে সবাই তাকে উইশ করে এক এক করে নিজের রুমে চলে গেছে। স্যামস্ও চলে গেলো রুমে। আমি তুলির পাশে বসে বললাম-
__”সামনে বছর এই দিনটাতে আমরা সবাই তোর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তোকে উইশ করে আসবো। আর বারোটা এক মিনিটেই উইশ করবো।”
__”সত্যি?”
__”হ্যাঁ গো আমার তুলতুলি পাখিটা।” হঠাৎ সে মন খারাপ করে বললো-
__”জানি না বিয়ে করে আমি সুখী হতে পারবো কি না। সে আমাকে ভালোবাসবে কি না।”
__” জানিস তুলতুলি পাখি, পৃথিবীতে সব চাইতে কঠিন কাজ হলো সুখী হওয়া আর সুখী করা।
এর চেয়ে কঠিন আর কিছু হয় না। আমি অনেক ভুল করি, তোর ভাইয়া অনেক সময় আমাকে ভুল বোঝে। রাগ করে, আবার ক্ষমা করেও দেয়। সেও ভুল করে, আমি মানিয়ে নিই। রাগ দেখাই না। দু’ জনই যদি রাগ করে বসে থাকি তাহলে সংসার ভেঙে যাবে। এত সাধের ভালোবাসার ঘরটা ভাঙি কি করে বল তো? তাই তো ভালোবাসার এই বাবুই পাখির বাসাটা অতি যত্নে আগলে রেখেছি।”তুলি নিশ্চুপ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি মুচকি হেসে পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করলাম। বললাম-
__” ভালোবাসায় লাভ ছাড়া কোনো লস নেই। তুই তোর বরটাকে প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসবি। আর তার চেয়েও বেশি ভালোবাসবি তার চারপাশটাকে। তারপর দেখবি ওর আর কোনো উপায় নেই তোকে ভালো না বেসে।”
__”চারপাশ মানে?”
__”যেমন তোর ভাইয়ার চারপাশটা হলো বাবা মামনি তুই আর সব আত্মীয় স্বজন।” তুলি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো-
__”তোমার মতো করে সবাইকে ভালোবাসার আপ্রাণ চেষ্টা করবো। তুমি তোমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার ভাইয়াটাকে খুব করে ভালোবেসো বৌরানী। তার খেয়াল রেখো। মানুষটা তোমায় ছাড়া শ্বাস নিতে পারে না।”
আমি কিছু না বলে ওর মাথায় হাত রাখলাম। ঐ মানুষটাকে ছাড়া যে আমিও শ্বাস নিতে পারি না। তার প্রতি তীব্র মায়ার কাঁটাতারে আমি যে আটকে আছি তা কখনো বুঝিয়ে বলতে পারবো না। পৃথিবীতে স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসাই হলো শ্রেষ্ঠ ও পবিত্র ভালোবাসা। মেয়েটা আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদছে। মেয়েরা সৃষ্টিগত ভাবেই অনেক কিছুই পারে। বাবা মা ভাই বোন সবাইকে না দেখেও স্বামীর বুকে মুখ গুজে এরা সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। নারীর এই অসীম ধৈর্যের রহস্য ভেদ করা সম্ভব নয়।