বাসর রাতে আমি বউয়ের ঘোমটা তোলতে যাব, তখনি আমার বউ বলে উঠল,
– একমিনিট, আপনাকে একটা কথা বলার আছে। কথাটা শুনে আমার একটু হাসি পেল। বউ তো বেশ সুন্দর ভাবে কথাটা বলল। একটা রোমান্টিক ফিল পাচ্ছি। তাই অল্প হেসেই বললাম,
– দুইটা বলো, তবে আমার চোখে চোখ রেখে বলতে হবে।
– আমি রোমান্টিক কিছু বলতে যাচ্ছি না যে, চোখে চোখ রেখে বলব। এবার ওর কণ্ঠে কিছুটা অভিমান খুঁজে পেলাম। কিন্তু এখনও ওর চেহারাটাই তো দেখা হল না। তাই ভাবলাম ওকে ঘোমটা তোলার কথা বলে দেখি কি হয়।
– ঘোমটার আড়াল থেকে কিছু বললে তোমার কথার অর্থ তো ঠিকমতো বুঝতে পারব না। মুখের দিকে তাকালে কথায় আর এক্সপ্রেশনে মিলিয়ে মনের ভাব অনেকটাই বুঝতে পারব। ভেবেছিলাম একটু সিনেমাটিক টাইপে ঘোমটা সরিয়ে একটা রাগী লুক দেবে। কিন্তু তেমন কিছুই হল না। বেশ শান্ত ভাবেই ঘোমটা সরাল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা নিষ্পাপ শান্ত চেহারা। চোখটা নামিয়ে রেখেছে। এবার বলা শুরু করল,
– আমি আমার বাবা মা’র একমাত্র সন্তান। এজন্যে আমার জীবনে ভালোবাসার কোনও অভাব হয়নি কখনও। প্রেম ভালোবাসাও করা হয়ে ওঠেনি। এই বিয়েটা মা বাবার ইচ্ছেতেই করেছি। তবে হুট করে একজন অপরিচিত মানুষের সাথে এক বিছানায় শুতে আমি একটু আনকমফোর্টেবল ফিল করছি। তাই কয়েকটাদিন আমরা একে অপরকে জেনে নিই তারপর নাহয় একসাথে শোব। এর আগে পর্যন্ত কেউ কাউকে স্পর্শ করব না। ওর এই কথা শুনে একটু হাসলাম। যা বলেছে যুক্তিসঙ্গত কথাই বলেছে। হঠাৎ করে একজন অপরিচিত মানুষের সাথে এক বিছানায় শুতে আনকমফোর্টেবল ফিল করারই কথা। এতে আমারও কোনও সমস্যা নেই। তাই মুখের হাসি বজায় রেখেই বললাম,
– ব্যস, এইটুকুই?
এবার ও আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল। এত সহজে ব্যাপারটা নিব হয়তো আশা করেনি। আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম। গাঢ় করে কাজল দেওয়া চোখ দুটি দেখতে কি অপূর্ব লাগছে! মায়াবী একটা চাহনি, দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মত একটা ব্যাপার। কপালের ওই মাঝারি সাইজের লাল টিপ, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক ওর চাঁদমুখটাকে যেন পূর্ণ করে দিয়েছে। এসব দেখে মনে হল, আমি ওর প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। আগেও একবার প্রেমে পড়েছিলাম তাই প্রেম সম্পর্কে হালকা একটা ধারণা আমার আছে। শ্রেয়ার মুখের দিকে ভ্যাবলা কান্তের মত হা করে তাকিয়ে এগুলো ভাবছিলাম। ও বোধহয় খানিকটা লজ্জ্বা পেল। তাই চোখ নামিয়ে বলল,
– এরকম হা করে তাকিয়ে কি দেখেন।
– আমি অপূর্ব চোখে দেখিতেছি তোমার ওই জ্যোৎস্না মাখা মুখে গাঢ় কাজলে ঢাকা দুটি চোখ, ওই নির্মল চাহনীর গভীরে ক্ষণে ক্ষণে খুঁজিয়া পাইতেছি আমার প্রাণের অন্তঃসুখ।
– বাহ, আপনি তো বেশ ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে পারেন। লিখালিখিও করেন নাকি?
– এই অবসর সময়ে একটু আধটু আরকি। লিখার জন্য তেমন সময় পাই না।
– এবার থেকে রোজ অন্তত একটা কবিতা লিখতে হবে আমার জন্য।
– রোজ লিখতে হবে?
– হ্যাঁ, রোজ লিখতে হবে।
আমার ওপর ওর অধিকার খাটানো দেখে বেশ ভালো লাগল। নিজের অধিকার নিজে আদায় করে নিচ্ছে। মনের মধ্য দিয়ে একটা ভালো লাগার অনুভূতি ছূঁয়ে গেল। তাই হালকা হেসে বললাম,
– আচ্ছা লিখব। এবার তাহলে ঘুমিয়ে পড়া যাক। অনেক রাত হয়েছে। আমি বালিশ নিয়ে সোফায় চলে যাচ্ছি।
এটা বলে আমি বালিশ আনতে গেলাম। সাথে সাথে ও কিছু বলল না। আমি বালিশ নিয়ে চলে যাব এমন সময় বলে উঠল,
– আচ্ছা শুনুন, আপনাকে সোফায় যেতে হবে না। এখানেই শুয়ে পড়ুন। বিছানা অনেক বড় আছে। মাঝখানে নাহয় বালিশ দিয়ে দেব। এই কথা শুনে ভাবলাম আইডিয়া মন্দ না। এমনিতেও সোফায় ঘুমাতে আমার অসুবিধে হত। লম্বা মানুষদের জীবনের অনেকগুলো অসুবিধের মধ্যে একটা হলো সোফায় বডি এডজাস্ট করা যায় না। তাই ওকে একবার জিজ্ঞেস করে নিলাম ওর কোনও অসুবিধে হবে কিনা।
– তোমার কোনও সমস্যা হবে না তো আমি এখানে ঘুমোলে?
– না, কোন সমস্যা না। আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি বাতি নিভিয়ে দিচ্ছি।
এই বলে ও বিছানা থেকে নেমে বাতি নিভিয়ে চলে আসল। আমিও শুয়ে পড়লাম। বেশ অনেকক্ষণ কেটে গেল কিন্তু আমার ঘুম আসছিল না। ওর কথা বেশ মনে পড়ছে। ও বলতে আমার বউ না আগে যাকে ভালোবাসতাম সে। মেয়েটার নাম ছিল হিয়া। হাসিখুশি চঞ্চল স্বভাবের একটা মেয়ে। আমরা ভার্সিটিতে একই ব্যাচে ছিলাম। ক্লাসের ফাঁকে বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা দেওয়া আর হাসি ঠাট্টা করা এগুলো ছিল ওর রোজ দিনের রুটিন। অন্যদিকে আমি ছিলাম ইনট্রোভার্ট টাইপের মানুষ। কারো সাথে মিশতাম না। সবার পেছনে বসে থাকতাম একা একা। দু একজন ছাড়া আমার সাথে কেউ কথা বলতেও আসত না। আমিও কাউকে ঘাটাতাম না, নিজের মত চলতাম। হিয়া বসত মাঝামাঝি লেভেলের বেঞ্চে। আমি পেছন থেকে মাঝে মধ্যে দেখতাম ওরা কি করছে। ভালোই লাগত ওদের এইসব আচরণ দেখতে। এভাবেই বেশ চলছিল আমার দিনকাল। কিন্তু একদিন একটা ঘটনার পর থেকে হিয়া নামের মেয়েটা আমার চিন্তাভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল।
হয়েছে কি, সেদিন বোধহয় খুব বৃষ্টি ছিল। ক্লাসে বেশি কেউ আসে নি। ৪ টা ক্লাসের মধ্যে ২ টা হয়েছে। বাকী দুইটা হবে বলে মনে হচ্ছে না। স্যারও আসেননি। তাই আমি ব্যাগের ওপর মাথা রেখে ঝিমোচ্ছিলাম। কখন চোখ লেগে গেছে বুঝতে পারিনি। হঠাৎ মাথার সামনে ঠাস করে একটা শব্দ হলো। শব্দ শুনেই ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। কি হয়েছে আসলে ব্যাপারটা বুঝতে আমার একটু সময় লাগল। ঘুম ভাঙার পর প্রথমে সামনে তাকিয়ে দেখলাম হিয়া আর আরও দুইটা মেয়ে দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হাসছে। ক্লাসে আর কেউই নেই। ওরা হাসছে বা ক্লাসে কেউ নেই এগুলা আমার কাছে সাধারণ বিষয় লাগল। আমার মাথার মধ্যে একটা কথাই ঘুরছিল যে, শব্দটা হলো কিসের। তাই চারপাশে তাকাচ্ছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল ফাটা বেলুনের একটা টুকরো। ব্যাস আমার আর বুঝতে বাকী রইল না কি ঘটেছে। কিন্তু হিয়া এরকম করল কেন এটা আমার মাথায় ঢুকল না। ও তো কোনওদিন আমার দিকে তাকায় ও নি। আজ হঠাৎ এভাবে বেলুন ফাটিয়ে আমাকে জাগানোর মানে কি বুঝলাম না। তাই বোকার মত ওদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার তাকানো দেখে হিয়া বলল,
– ক্লাস আওয়ার তো শেষ। এখানেই কি রাত পার করে দেবে নাকি?
আমি কি বলব বুঝতেছিলাম না। কখনও কোনও মেয়ের সাথে তেমন কথাও বলিনি। তাই কথার মাঝে কিছুটা তোতলানো চলে এলো।
– না মা,মানে বাসায় যা,যাব তো।
– এই, তুমি তোতলা নাকি? আগে তো কখনও খেয়াল করিনি! তোতলা উপমাটা শুনে ভালো করে কথা বলার প্রিপারেশন নিলাম। একটু আত্মবিশ্বাস নিয়ে কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললাম,
– না আসলে হঠাৎ চমকে ঘুম থেকে উঠেছি তো তাই এমন হয়েছে।
– আমি যে বেলুন ফাটিয়ে তোমার ঘুম ভাঙালাম আমার ওপর রাগ হচ্ছে না? আমি একটু মুচকি হেসে বললাম,
– রাগ হবে কেন? তুমি তো মজা করার জন্য এরকম করেছ। রাগাবার জন্য করলে হয়তো রাগ হতো।
– বাহ! বেশ চমৎকার কথা বলো তো তুমি। এরকম সুন্দর করে কথা বলতে পারো তাহলে সারাক্ষণ একা একা বসে থাকো কেন? এটা আসলে বেমানান লাগে।
– একা থাকতে ভালো লাগে তাই আরকি।
– আমি তো ভেবেছিলাম তুমি নিরস টাইপের মানুষ। একা একা থাকো, নিশ্চয়ই অনেক রাগী আর রোবট রোবট টাইপ। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে তুমি অনেক প্রাণবন্ত আর ক্লাসি টাইপের কেউ। গুছিয়ে কথা বলো, সহজে রাগ ওঠেনা। ইম্প্রেসিভ ক্যারেক্টার!
– হা হা হা, ধন্যবাদ।
– আচ্ছা, কেউ তোমার সাথে যেচে কথা বলে না কেন?
– আমরা অপ্রয়োজনে কারো সাথে কথা বলি কখন? যখন ওই মানুষটার সাথে কথা বলার আগ্রহ থাকে। আমার সাথে কথা বলার হয়তো কারোর আগ্রহ নেই।
– তাও তো ঠিক। আমিও আসলে তোমার সাথে কথা বলার জন্য বেলুন ফাটাই নি। জাস্ট তোমার রিএকশান দেখতে চাইছিলাম।
– আজ অবধি আর কেউ রিএকশান দেখতে চায় নি তাই হয়তো কথা বলা হয় নি। তাই না?
– তোমার সাথে যতোই কথা বলছি ততোই ইম্প্রেস হয়ে যাচ্ছি। এটা শুনে আমার বেশ হাসি পেল। তবে হাসলাম না। স্বাভাবিক ভাবেই বললাম,
– ক্ষণিকের আগ্রহ মাত্র। এর বেশি কিছু না।
– আচ্ছা ঠিক আছে আমি গেলাম। তুমিও বাসায় চলে যাও। বাই
– বাই।
ও চলে গেল আর আমিও বাসার দিকে রওনা দিলাম। ও আর কথা বাড়ায়নি কেন বাসায় আসার পথে ওই কথাই ভাবছিলাম। তবে হিয়ার কথা বলার ধরণটা ভালোই লাগল। দেখতেও মিষ্টি আর হাসিটাও সুন্দর। বাসায় আসার পরও ওর মুখটাই ভাসছিল। মানে বিষয়টা এমন যে ও আমার মাথার মধ্যে গেঁথে গেছে। মাথা থেকে কিছুতেই বের করতে পারছিলাম না। আগে কখনও আমার সাথে কোনও মেয়ে এভাবে কথা বলেনি। তাই একটা অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছিল। বেশ ভালোই লাগছিল ওর কথা ভাবতে। এরপর থেকে ভার্সিটিতে ক্লাসের ফাঁকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ওকে এই বিষয়টা কখনও সেভাবে বুঝতে দিই নি। তবে হালকা আঁচ করতে পারত মনে হয়। মাঝেমধ্যে হালকা কথাও হত হিয়ার সাথে। তেমনি একদিন ক্লাস ব্রেক এ হঠাৎ আমার সামনে এসে বলল,
– অভ্র, কি করছ?
– এইতো একটা ম্যাথ সলভ করতেছি।
– ব্রেক এ বসে ম্যাথ করছ, পেটে ক্ষিধে লাগে না?
– পেট আছে তাই ক্ষিদে তো একটু লাগছে। তবে ইগনোর করছি, কারণ মনযোগ এখন ম্যাথ এর মধ্যে। এতে ক্ষিদেও কম লাগছে।
– আচ্ছা, এক কাজ করো। আমার সাথে এখন ক্যান্টিন এ চলো। ক্ষিদেও মিটবে আর মনযোগও বাড়বে। আরও ভালো ম্যাথ করতে পারবে। ও এসে আমাকে এরকম বলবে এটা আশা করিনি। তবে বেশ খুশি হয়েছি। কিন্তু সাথে সাথে যদি বলি চলো যাওয়া যাক তাহলে ব্যাপারটা ঠিক দেখাবে না। তাই একটা সুন্দর বাহানা বানাতে হবে। এজন্য বললাম,
– এখন যদি পেট বাবাজীকে প্রাধান্য দেই তাহলে ম্যাথ রাগ করবে না? মাঝপথে ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
– তুমি পড়াশোনায় কেমন তা জানিনা, কিন্তু রসিকতায় একশো তে একশো মার্ক ডিজার্ভ করো।
– তাই? তাহলে চলো ক্ষিদেটাই মিটাই আগে। ম্যাথ এর হাত আবার পরে এসে ধরে নেব। একথা বলার পর দুজনেই হেসে উঠলাম। সে হেসে হেসেই বলল,
– আচ্ছা চলো।
ক্যান্টিনে বসে ওর সাথে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। এগুলা আমার স্বভাব বহির্ভুত কাজ তবে কেন জানি না হিয়ার সাথে সময় কাটাতে বেশ লাগছিল। তাই সবকিছু যেরকম চলছে সেরকমই চলতে দিলাম। বিকেলে বাসায় আসার পর শুনলাম দিদার শরীর খারাপ করেছে। তাই কদিনের জন্য মামা বাড়ি যেতে হবে মা কে নিয়ে। যাওয়ার কোনও প্রকার ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও কর্তব্যের খাতিরে যেতে হলো। আমার কাছে বাস্তবে দিদার থেকেও এখন হিয়াকে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট মনে হলো। দিদার সাথে আমার তেমন সময় কাটিয়ে ওঠা হয়ে ওঠেনি। তাই উনার প্রতি ভালোবাসাটাও নিউট্রাল। কিন্তু আমার মায়ের মন অনেক খারাপ। উনার তো মা তাই টান অনেক বেশি। এজন্য মামা বাড়ি চলে আসলাম অনিশ্চিতকালের জন্য। আমার মামারা একটু বড়লোক টাইপের। তাই এসে দেখলাম, ডাক্তার নার্স সব বাড়িতেই। অবশ্য দিদাকে হাসপাতালে দেখব এটাও আশা করিনি।
মামা বাড়িতে আমার দিনগুলো যেন কাটছিল না। কবে আবার হিয়াকে দেখতে পাব এই চিন্তায় উদাস ছিলাম। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল যে আমি হিয়ার প্রেমে পড়ে গেছি। এটা অবশ্য নিশ্চিতই ছিলাম। বুকের বা পাশের অদ্ভুত অনুভুতি অনেক আগে থেকেই এই ইঙ্গিত দিচ্ছিল। আর কয়েকদিন ওকে দেখতে না পেয়ে মনটা অনেক ব্যাকুল হয়ে উঠেছে দেখেও বুঝেছি যে আমি প্রেমে পড়ে গেছি। তবে কিছু করার ছিল না। মামা বাড়িতে ৮ দিন কাটিয়ে বাসায় আসলাম। যথারীতি পরদিন ভার্সিটিতে গেলাম ওকে দেখার আশায়। কিন্তু নিরাশ হতে হল। হিয়া আসেনি আজ। কি আর করব মনমরা ভাবে ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরে আসলাম।
এভাবে প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেল হিয়ার কোনও দেখা নেই। এবার আমার মনে একটু খটকা লাগল। এতদিন গ্যাপ যাওয়ার তোহ স্বাভাবিক কারণ থাকবে না। ও কি অসুস্থ? হতেও পারে। বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত। কাউকে যে জিজ্ঞেস করব তাও মন থেকে সায় পাচ্ছি না। সেদিনের মত চিন্তামগ্ন হয়েই বাসায় ফিরে গেলাম। বাসায় এসে ভাবতে লাগলাম কাল যদি না আসে তাহলে ওর বান্ধবী কাউকে জিজ্ঞেস করে নেব। যা হওয়ার হবে।
ক্লাসে গিয়ে দেখি হিয়া এসেছে আজ। মনটা খুশিতে ভরে গেল। আবার পরক্ষণেই খুশি উবে গেল। কারণ হিয়াকে দেখে বেশ অবাক হলাম। আজকে ওকে একটু অন্যরকম লাগছে। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম ওর দুই হাত ভরা মেহেদী আর বাম হাতের অনামিকায় একটা সুন্দর আংটি। বাকীটা অনুমান করে নিলাম কি হয়েছে। ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এটা দেখার পর বুকটা কষ্টে ফেটে যাবে অবস্থা। টের পেলাম চোখের কোণে একটু জল জমেছে। আমি সচরাচর কাঁদি না। কারণ আমি দূর্বল মনের মানুষ নই। লাস্ট কবে কেঁদেছিলাম মনে নেই। আজ হয়তো নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারব না। তাই স্যারের অগোচরে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলাম। সোজা বাসার দিকে রওনা দিলাম। বাসায় এসে রুম লক করে ফুল ভলিউম এ গান ছেড়ে দিলাম। তারপর চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। এইটা কেন জানিনা মেনে নিতে পারছি না। ২য় বর্ষে পড়া একটা মেয়ের এখনি বিয়ে হয়ে যাবে? আমি তো ওকে আমার মনের কথা বলার সুযোগই পেলাম না। জীবনের প্রথম প্রেম এভাবে জীবন থেকে হারিয়ে যাবে এই বিষয়টা যেন ভাবতে পারছিলাম না।
মনের সাথে অনেক্ষন যুদ্ধ করে ঠিক করলাম কয়েকদিনের জন্য অন্য কোথাও চলে যাব। এখন ভার্সিটিতে গেলেও শুধু ওর কথা মনে পড়বে। তাই বাবা মাকে বললাম যে আমি একটু ঘুরতে যেতে চাই। মা বাবা প্রথমে মানা করলেও পরে রাজি হয়ে গেলেন। চট্টগ্রাম চলে গেলাম দিদির বাসায়। এভাবে ক্ষণিকের জন্য তো মনকে বুঝিয়ে ফেললাম। কিন্তু এইটা থেকে রিকভারি করতে আমার দীর্ঘ ৬ বছর সময় লেগে গেল। হিয়ার বিয়ে হয় বিদেশী একটা ছেলের সাথে। আর বিয়ের কয়েকদিন পরেই হিয়া ওর স্বামীর সাথে বিদেশে চলে গিয়েছিল। এতে আমার একটা সুবিধে হয়েছিল। ভার্সিটিতে গেলে ক্লাসে কিছুটা মনযোগ দিতে পারতাম। তবে ২০১৩ এর পর জীবনে অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে। অনার্স মাস্টার্স শেষ করেই একটা কলেজ এ লেকচারার হিসেবে ঢুকে গেলাম। আর আজ তো আমার বিয়েও হয়ে গেল। তবে হিয়াকে একদম মন থেকে মুছতে পারিনি। কথায় আছে মানুষ তার জীবনের প্রথম প্রেম কখনও ভূলতে পারেনা। আমার ক্ষেত্রেও কিছুটা সেরকমই বিষয়। হিয়াকে হয়তো কখনই ভূলতে পারব না। এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙল শ্রেয়ার ডাকে।
– এই যে মশাই, আর কতক্ষণ ঘুমাবেন, বেলা যে অনেক হলো। ওর ডাকে চোখ মেললাম। দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৯ টা ১৫ বাজে। তার মানে শ্রেয়াও আমার মায়ের মত টিপিক্যাল স্টাইল এ সময় বলে। এখনও ১০ টাও বাজে নি। এটা কোনও বেলা হলো? আমি আমার ভবিষ্যৎ বাচ্চাদের সকালবেলার ঘুম নিয়ে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লাম। ওরা সকাল ৭ টার সময় ৯ টা বাজে শুনে ঘুম থেকে উঠবে। যাই হোক, এগুলো অনেক পরের বিষয়। তখন দেখা যাবে যদি কিছু ব্যবস্থা করা যায়।
ভালোই করেছিলাম বিয়ে উপলক্ষে কলেজ থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে। নাহলে এখন তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে কলেজে যেতে হতো। তো বিছানা থেকে উঠে ব্রাশ নিয়ে বাথরুম এ গেলাম। বেসিনের সামনে গিয়ে আমি তো পুরাই লুল। ভালো করে চোখ কছলিয়ে দেখলাম আমি ঠিক দেখছি তো। নাহ ঠিকই আছে। বেসিনের ওপর থেকে আমার রেজার,শেভিং জেল,আফটার শেভ সব গায়েব। সেখানে সুন্দর করে কিছু ফেসওয়াশ,বডি ওয়াশ,শাওয়ার জেল, ফেয়ার এন্ড লাভলী ক্রিম এক প্যাকেট টিপ ইত্যাদি জায়গা করে নিছে। যাহ নতুন বউ সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাথরুম এর স্পেস দখল করে নিল? এটা তো ভারী অন্যায়। তাই ব্রাশ করে শ্রেয়াকে ডাক দিলাম। ও ব্যস্ত ভঙ্গিতে রুমে আসল। রান্নাঘরে মাকে হেল্প করছিল মনে হয়। এসে বলল,
– কি হল, ডাকছেন যে?
– বাহ, এমন ভাবে ব্যস্ততা দেখাচ্ছ যেন এক বছর ধরে এখানেই আছো। নতুন বউ, কোথায় একটু লজ্জ্বা পাবে সবকিছু করতে তা না।
– এটা বলার জন্য ডাকলেন?
– না, আমার রেজার শেভিং জেল ওগুলো কোথায়, শেভ করব কি দিয়ে?
– শেভ করতে হলে সেলুনে যান না। এখন থেকে ঘরের মধ্যে নো শেভ।
– আরে ঘরের মধ্যে শেভ করব কেন, বাথরুমে করব।
– বাথরুমটা কি ঘরের বাইরের প্রপার্টি?
এই কথা শুনে আমার হাসি পেয়ে গেল। ওর কমনসেন্স বেশ ভালোই আছে দেখা যায়। তাই ওকে আর ঘাটালাম না। এত দ্রুত নিজের মত সংসার গোছাতে মন দেবে ভাবিনি। ভালোই লাগল এসব দেখে। রাতে যখন ঘুমাতে যাব তখন দেখলাম ও হাত পেছনে দিয়ে রুমে ঢুকছে। তাই ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
– হাতে কি?
– আগে চোখ বন্ধ করুন। আপনার জন্য একটা উপহার এনেছি।
– আচ্ছা ঠিক আছে চোখ বন্ধ করলাম। আমি চোখ বন্ধ করার পর প্রায় ১৫-২০ সেকেন্ড কেটে গেল কিন্তু ও কোন কিছু বলছে না। তাই বললাম,
– এবার চোখ খুলব?
– উহুঁ, এখন না। আমি বলার পর। এদিকে আমার ধৈর্য বাঁধ মানছিল না। তাই কিছুক্ষণ পর আবার বললাম,
– কি গো, এখন চোখ খুলব?
– হ্যাঁ এবার চোখ খুলতে পারেন।
চোখ খুলে দেখলাম গিফট র্যাপ করা চারকোনা একটা বস্তু। ছোটখাটো বইয়ের মত লাগছে। আমাকে ও বই গিফট করবে কেন, একটু খটকা লাগছিল। তাই হাতে নিয়ে গিফট র্যাপ খুললাম। খুলে দেখি বই না, ডায়রী আর একটা কলম। বেশ খুশি হলাম এটা দেখে। তবুও জিজ্ঞেস করলাম,
– এগুলো কেন?
– কাল রাতে কিছু বলেছিলাম আপনাকে ভূলে গেলেন?
– কবিতা লিখার জন্য?
– হ্যাঁ ঠিক তাই। প্রত্যেকদিন একটা করে কবিতা লিখবেন এটাতে। আমি সকালে উঠে পড়ে নেব।
– আচ্ছা লিখব।
– লিখব বললে হবে না। আজকেরটা এখন লিখুন আমার সামনে।
– আচ্ছা ঠিক আছে বাবা লিখছি। তবে আমাকে একটা কথা বলোতো, তুমি আমার চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় কি করছিলে?
– কিছুই না, আপনার ধৈর্য পরীক্ষা করছিলাম মাত্র।
– তা পাশ করলাম কখন?
– ঐ যখন ভালোবেসে কি গো বললেন তখন। বেশ মিষ্টি লাগল আপনার মুখ থেকে কি গো শুনতে। নিজেকে পাক্কা বউ বউ মনে হচ্ছিল। তাই ভাবলাম আর আপনাকে অপেক্ষা করাব না।
– ও আচ্ছা এই ব্যাপার?
– হ্যাঁ এইটাই, এবার কবিতা তো লিখুন।
– আরে একটু সময় তো দাও একটু ভেবে নিই।
– আচ্ছা ভাবুন।
কি লিখা যায় ভাবতে লাগলাম। কি নিয়ে লিখব সেটাই খুঁজছিলাম। কিছুক্ষণ ভাবার পর লিখা শুরু করলাম। “কোনও এক শিশিরভেজা সকালে তোমার দুহাত ধরে কুয়াশা মাখব শরীরে, ভোরের আলো পড়বে তোমার মুখে আমি অপলক চেয়ে চেয়ে দেখব মনের মধ্যে তোমারই ছবি আঁকব, আমার দিকে তাকাবে মায়াভরা চোখে সীমাহীন প্রান্তর চেয়ে রইবে আমাকে একটু ভালোবাসবে।” লিখা শেষ করে দেখলাম ও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। জিজ্ঞেস করলাম,
– কি দেখো?
– এত ছন্দ কোথা থেকে আসে সেটাই দেখছিলাম।
– তোমার ভালো লেগেছে?
– হ্যাঁ ভালো লেগেছে।
– এবার তাহলে শুয়ে পড়া যাক?
– হ্যাঁ, আমি বাতি নিভিয়ে দিচ্ছি।
এরকম রোজ রাতে ওকে একটা করে কবিতা লিখে দিতাম। ও বলেছিল আমি রাতে লিখব আর ও সকালে পড়বে। কিন্তু আমার কবিতা শেষ না হওয়া অবধি সে ঘুমায়ই না। মাঝেমধ্যে কলেজ থেকে আসার সময় ওর জন্য ফুল নিয়ে আসি। শ্রেয়া লাল ফুল খুব পছন্দ করে। তাই চেষ্টা করি লাল ফুল এনে দেওয়ার জন্য। এরকম প্রায় দিন দশেক কেটে গেল। ভালোই কাটছিল আমাদের দুজনের নতুন সংসার। একদিন রাতে কবিতা লিখতে বসে টপিক খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শ্রেয়া আমাদের মাঝখানের বালিশটা সরিয়ে আমার একদম পাশে চলে আসল। তারপর আমার কাঁধে মাথা রেখে বলল,
– বেশ অনেক্ষন হয়ে গেল কিছু লিখছ না যে? বিয়ের দশদিন পর আমাকে তুমি করে বলল শ্রেয়া। বেশ ভালো লাগল এটা শুনে। এই কদিনেই আমাকে এতটা আপন করে নিতে পেরেছে দেখে। যে টপিক খুঁজছিলাম সেটা এইবার পেয়ে গেলাম। তাই একটু ভালোবাসার সুরে বললাম,
– এতক্ষণ কবিতা লিখার অনুপ্রেরণাটা পাচ্ছিলাম না। এখন পেয়ে গেছি তাই এখন লিখা শুরু করব। ও লজ্জ্বা পেয়ে বলল,
– আজকের কবিতাটা স্পেশাল হওয়া চাই।
– আজকের দিনটাই আমার জন্য স্পেশাল। কাজেই কবিতা তো স্পেশাল হতেই হবে।
এটা বলে লিখা শুরু করলাম, “মনের আঙিনার দরজা খুলে উঁকি দিয়েছি যখন পেয়েছি শুধু তোমারে, নীল আকাশে মন মিশিয়ে মেঘের ভেতর চেয়েছি যখন পেয়েছি শুধু তোমারে, নদীর স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে ডুব দিয়েছি যখন পেয়েছি শুধু তোমারে, ডায়রীর খালি পাতায় কবিতার কলি খুঁজেছি যখন পেয়েছি শুধু তোমারে। চুপটি করে বসে ছিলাম আমি দেখেছিলাম তোমায় অনেক খুশি তুমি বললে, ভালোবাসো? আমি চিৎকার করে বলেছিলাম ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি।” লিখা শেষ করে দেখলাম শ্রেয়ার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম,
– আরে কাঁদছ কেন? ও কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,
– এত ভালোবাসো আমায়? আমি মুচকি হেসে ওর কপালে একটা চুমু খেয়ে বললাম,
– হ্যাঁ, এত এত ভালোবাসি তোমায়। পাগলি একটা, এইজন্যে কাঁদতে হয়? এটা বলে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিলাম। তারপর ওর হাতে আমার হাতটা রেখে বললাম,
– এই হাত কখনও ছাড়ব না পাগলি।
ও কিছু বলল না। শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরল। কিছু কিছু কথা মুখে বলতে হয় না। শ্রেয়ারও বলতে হলো না। আমার প্রতি ওর ভালোবাসাটা অনুভব করে নিলাম। হিয়াকে হারিয়ে যে কষ্ট পেয়েছিলাম শ্রেয়াকে পেয়ে সেটা একদমই ভূলে গেলাম। সারাজীবন এভাবেই ওর হাতটা ধরতে চাই, শুধু ওকেই ভালোবেসে যেতে চাই।