সংসার

সংসার

দু’কামরার এ ছোট্ট ঘরটাকে আমি বেশ নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি। দামি দামি আসবাব আর হাল ফ্যাশনের ছোঁয়া হয়ত তাতে নেই কিন্তু আছে আমার নিবিড় ভালোবাসা। বিয়ের দু’মাসের মাথায় আসাদ আমাকে নিয়ে এই বাসায় উঠেছে। তার আয়ের সাথে মানিয়ে এর চেয়ে ভালো ফ্ল্যাটে ওঠা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

সকালে তাকে অফিসের জন্য বিদায় দেবার পরেই ঘর গুছনো ছাড়া আমার আর কোনো কাজ থাকেনা। মাঝে মাঝে বারান্দায় গিয়ে বসি। মধ্যবয়স্ক দারোয়ান চাচাকে দেখি। আধ-টাক মাথায় মেহেদি দিয়ে চুলে সোনালী আভা আনার চেষ্টা। চুপচাপ এক দৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে সিগারেট ফুঁকে।

আরো দেখি বাসার সামনের ডানপাশে টিনশেডের প্রথম দিক থেকে তিন নাম্বার ঘরটাকে। এ ঘরের স্বামী স্ত্রীর বোধ করি বনিবনা হয়না।প্রায়ই এ ঘরের চিৎকারের শব্দে বারান্দায় ছুটে যাই।বুঝতে বাকি থাকে না কি নিয়ে ঝগড়া। বাড়ীর সকলে দাড়িয়ে দাড়িয়ে তাদের ঝগড়া দেখে।কর্তা যখন গালি দিয়ে বউকে মারতে যায়, বউও তখন তেড়ে আসে তাকে মারবে বলে। বাকিরা তাদের মাঝে ঢাল হয়ে দাড়ায় আর বোঝানোর চেষ্টা করে। এ কদিনে তাদের ঝগড়ার যে সারমর্ম বুঝলাম তা হলো কর্তা বোধ হয় পরনারীতে আসক্ত।

সারাদিন একা একা সময় কাটেনা বললেই চলে। বারান্দায় কটা গাছের চারা লাগিয়েছি।গাছপালা আমার বরাবরই পছন্দ। বিয়ের পরে একদিন আসাদকে বললাম, খালি বারান্দা আমার ভালো লাগে না। কটা গাছ কিনে দাওনা।

তখন শাহবাগ থেকে দুজনে কিছু গাছ কিনলাম। আমি একটা গাছের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করতে আসাদ জানতে চাইলো এটা কি গাছ? আমি জানালাম, এটা লাকি ব্যাম্বু।সে হাসতে হাসতে পারেনা সেখানেই পড়ে যায়।আমি মুগ্ধ হয়ে তার গালের টোল পড়া হাসিটা দেখি।হাসতে হাসতে বলল,এটা বাসায় থাকলে কি লাক খুলে যাবে?
পাশের ফ্ল্যাটে একটা অল্প বয়স্কা মেয়ে আছে। বয়সে বোধ করি আমার থেকে ছোটই হবে কিন্তু তার দুই বছরের একটা কন্যা সন্তান আছে। মাঝে মাঝেই সে এসে গল্প করে,বেশিরভাগই তার ভাগ্যকে দোষারোপ করে। সে ধনী পিতার কন্যা।তবুও তার বাবা কেনো এই লোয়ার ক্লাস ছেলের হাতে তুলে দিলেন সে নিয়ে তার আক্ষেপের শেষ নেই। আমি আবার তার মনোযোগী শ্রোতা। কখনো কখনো অতি মনযোগে রান্নাঘর থেকে পোড়া তরকারির গন্ধ নাকে এসে লাগে। তাকে বসিয়ে রেখেই তখন আমাকে রান্নাঘরের দিকে ছুটতে হয়।

সেই পোড়া তরকারি মুখে তুলতে তুলতে আসাদ বলে,পাশের বাসার ধনী মহিলা এসেছিলেন নাকি?
আমি ভয়ে ভয়ে থাকলেও তখন হেসে জবাব দিই, এত বোঝো কেন তুমি!
রাতের বেলা আসাদ বাসায় ফিরলেই আমার একাকিত্ব ঘুচে।বলে,বড্ড কাজের চাপ যাচ্ছে গো।আমি তার দেরিতে ফেরার কারণ বুঝতে পারি।

আর পাঁচটা বাঙালি বউয়ের মতো আমিও তার খাওয়া শেষ হলে নিজের পাতে খাবার বারি।তাকে সারা দিনের গল্পগুলো শোনাই ঘুমানোর সময়।প্রথমে সে খুব আগ্রহ নিয়ে শুনলেও পরে সে ঘুমিয়ে পড়ে। আমি বলতে বলতে তাকে ধাক্কা দিয়ে প্রশ্ন করি,তুমি কি শুনছো?……ও পক্ষ নীরব। বুঝে নেই ঘুমিয়ে গেছে।

সেদিন বললাম,আমারনা খালি বাসায় সারাক্ষণ একা থাকতে ভালো লাগে না। আসাদ বলে, তাহলে তোমার বোনকে নাহয় কদিন বাসায় এনে রাখো। প্রস্তাব মন্দ নয়।তবে আমি আর ভণিতা না করে বলেই ফেললাম, চলোনা কয়দিনের জন্য কোথাও গিয়ে ঘুরে আসি। ও বলে,কথা ভালোই বলেছো।কিন্তু ময়না অফিসে যে কাজের চাপ যাচ্ছে তাতে এখন ছুটি নিতে পারবোনা। আর কটা দিন সবুর করো।

আমি সবুর করলাম।
দিন যায়, দিন আসে।সেদিন আবার বললো,তুমি কি দুইদিন তোমাদের বাসায় গিয়ে থাকতে পারো?
-কেন?
-আমাকে দুই দিন অফিসের কাজে ঢাকার বাহিরে যেতে হবে।
মন খারাপ হয়ে গেল।বললাম, থাক সমস্যা নেই। আমি বাসায় থাকতে পারবো।
তখনই সে বলল, মাধবী রেডি হও।আজ আমরা বাহিরে ডিনার করব।

খুশি হয়ে গেলাম।বিয়েতে পাওয়া হেনা খালার দেয়া শাড়িটার ভাজ সেদিনই প্রথম খুললাম। কালো পাড়ের বেগুনি রঙের শাড়ি। চুলে খোপা করলাম। সে এসে খোপা খুলে দিলো। বলল,এবার বেশি সুন্দর লাগছে। সে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে আমার নাকের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে দিল।

দীর্ঘ দুইদিন পরে তাকে দেখে আমি উচ্ছ্বাস সংবরণ করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল যেন হারানো জিনিস খুঁজে পেয়েছি। সে আমার অবস্থা দেখে হাসছিলো আর বলল,খুব শীঘ্রই আমরা একসাথে কোথাও ঘুরতে যাবো।

দুই বার কনিংবেল বাজলো।আমি তখন রান্নাঘরে ভাতের মাড় ঝাড়াচ্ছিলাম। গায়ের ওড়নাটা নিতে নিতে ভাবলাম, এ সময়ে কে?
দরজা খুলে মেজোমামা আর মিনাকে দেখে খুশি হয়ে গেলাম।মামাকে সালাম করলাম। হাতের মিষ্টি আর ফলগুলো টেবিলে রাখতে রাখতে বললাম, একটা খবর দিলে কি এমন হতো মামা? মামা জবাব দিলেন না।
দুপুরে খাবার পর্ব সেরে আসাদকে ফোনে জানালাম ওদের কথা।

মিনাকে বড় চুপচাপ লাগছে। ও তো এমন নয়।ওর কাছে গিয়ে বসলাম। অনেকদিন পর দেখা।কত কথা জমে আছে।দুই বোনের আড্ডায় মামাও শামিল হলেন। কথায় কথায় জানতে চাইলেন,আসাদ গতকাল কোথায় ছিলো? আমি জানালাম কুমিল্লা গেছিলো অফিসের কাজে।

মামা মিনাকে তার ফোন থেকে কটা ছবি দেখাতে বললো। মিনাও মাথা নেড়ে ফোন হাতে নিলো। কি দেখাবে আমাকে ওরা?

আমি বারান্দায় আমার গাছগুলোকে দেখে নিচ্ছি।কেমন পাতা ঝরে যাচ্ছে গাছগুলোর, লাকি ব্যাম্বুর পাতা গুলোও হলুদ রুপ নিয়েছে,সদ্য আসা গোলাপের কুড়ি টাও নেতিয়ে গেছে। আমি কাঁদছি, খুব কাঁদছি।

মা আর ছোটোবোন মিলে আমার ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে। ছোটভাইটা পেছন থেকে আমাকে ধরে আছে।আমি নিজেকে সামলাতেই পারছিনা।বারবার আশেপাশে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছি আর হাউমাউ করে কাঁদছি।আমার চোখের পানির হাত থেকে জানালার পর্দা গুলোও বাদ পড়েনি।আমি শেষবারের মতো সব দেখেনিলাম।মা,বড় মামী,ছোটো মামী,বোনেরা আমাকে টেনে হিঁচড়ে এ বাসা থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। দরজার কাছেই আসাদ ছিল। সে আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আমি সবার হাত জোর করে ছাড়িয়ে আসাদের বুকের ওপর ঝাপিয়ে পড়লাম। তবুও তার মন এতোটুকুও গলে নি সেদিন। পাশের বাসার মেয়েটার চোখেও পানি দেখেছিলাম সেদিন।বোনগো বলে একবার জড়িয়েও ধরেছিল। সাজানো ঘর ছেড়ে সেদিন আসাদের সংসার ছেড়ে সেদিন বেড়িয়ে আসতে হয়েছিলো।

আসাদ আমায় নিয়ে ঘুরতে না গেলেও গোপনে অফিস কলিগ হিয়াকে বিয়ে করে ঠিকই কক্সবাজারে হানিমুনে গিয়েছিলো। আমার মামাতো বোন মিতু ভার্সিটির প্রোগ্রামে সেখানে গিয়ে সী বীচে আসাদকে চিনতে পেরে ওদের কাপল ছবি তুলেছিলো গোপনে।
আসাদ বাসায় আসার পরে তাকে ছবিগুলো দেখিয়ে বলেছিলাম,এগুলো কি সত্যি। সে বিনা দ্বিধায় উত্তর দিয়েছিলো, একদম সত্যি। পরে সব স্বীকার করে নিয়েছিলো।

দুই পরিবারে জানাজানি হলো।সবাই বাসায় আসলো মীমাংসা করতে। আমি ওর পায়ে ধরে বলেছিলাম, তুমি একবার ওই মেয়েকে ছেড়ে দাও। আমি সব ভুলে যাব। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। স্রেফ জানিয়েছিলো সে আমাকে ডিভোর্স দিতে চায়। আমার মতো মেয়ের সাথে নাকি সংসার করা যায় না। আমার পরিবার মামলা করতে চেয়েছিলো,আমি তাদেরকে অনুরোধ করেছিলাম ওকে ওর মত থাকতে দিতে।

আমাদের ডিভোর্সের এক বছর হয়ে গেছে। শেষ খবর শুনেছি, হিয়া কনসিভ করেছে। আয়নায় নিজেকে দেখি আর ভাবি কি এমন আছে হিয়ার মাঝে যা আমার মাঝে নেই।

এমন নয় যে আমি হিয়াকে চিনতাম না। মাঝে মাঝেই আসাদের ফোনে হিয়ার কল আসলে আমি নিজে ওকে দিতাম।
উচ্চ শিক্ষিতা হয়েও শুধুমাত্র আসাদের কথায় চাকরির চিন্তা বাদ দিয়ে সংসারে মনযোগী হয়েছিলাম।আর সে কিনা এইভাবে অফসাইডে গোল দিল।এভাবে ঠকালো আমাকে।

আমি এখনও গভীর রাতে ব্যালকনিতে গিয়ে আমাদের ছবিগুলো হাতে নিয়ে বাচ্চাদের মতো কাদি।কেন করল আসাদ এমনটা।হিয়াই বা কিভাবে পারলো আমার সাজানো সংসার ভাঙতে।

বাবামা এখন আমাকে আবার বিয়ে দেবার কথা ভাবছে।আত্মীয় স্বজনরাও উঠে পড়ে লেগেছে।বৃথা চেষ্টা। ওদের আমি কিভাবে বোঝাই আমি আর কখনোই অন্তত সংসারটা করতে পারব না।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত