দৌড়ে এসে রুমে ঢুকেই সুবা ফুপিয়ে কেঁদে দিল। কিছুক্ষণ কান্না করে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবল- এখন সত্যিই আর যেতে ইচ্ছে করছে না। কোথাও না। আর ২দিন বাদে সুবার বিয়ে হবে পছন্দের মানুষটার সাথে। সবার কতো আয়োজন। বিয়ের তোড়জোড়। মামুন মিয়া সবদিকে খেয়াল রাখছেন। মেয়ের বিয়েতে কোনো অসুবিধা যেন না হয়। সুবা দেখছে, তার বাবার কষ্টার্জিত টাকাগুলো কতো কষ্ট করে ম্যানেজ করে এই বিয়ের এ্যারেজমেন্ট করা। মধ্যবিত্তদের চাইলেও সব সাধ পূর্ণ হয় না।
পাশের ঘরেই মেহমান বসে আছে। ফুফু, চাচী আরও কতজন। সুবা দেখা করতে গিয়েছিল। সুবার মা সালমাও সবার মাঝখানে বসে আছে। এই শেষ সময়টাতেও সবার মজা করা থামছে না। সুবাকে কুরবানি দেয়া হবে। আর দু’দিন পর সুবাকে জবাই করা হবে। সুবা জামাই পেয়ে সব ভুল যাবে। সুবার এখন বিয়ের ফুল ফুটেছে। দেখাই পাওয়া যায় না। আরে সুবার মা তো শাশুড়ি এখন। সুবা মুচকি হেসে দেয়। কতো প্রতিক্ষীত দিন আসতে চলেছে তার জীবনে। মনে মনে ভাবে সুবা।
বড় চাচী বলে উঠল- সুবারে এমনে পর কইরা দিবা সুবার মা? সুবার মা- দিতে তো হবেই। না দিয়ে কি থাকা যায়? মাঝখান থেকে সুবার মামি বলে উঠল- আমরাও পর করে আসছি সব। বড় চাচী- এতগুলা বছর বাপের সংসারে থাইকা বাপ মারে ছাইড়া যাইতে কষ্টই লাগে। কি কস সুবা? সুবা এবারও মুচকি হাসি দিয়ে কথা গিলে নেয়। কোনো শব্দোচ্চারণ ছাড়াই। অথচ ভেতরের পাজর যেন সবগুলো একসাথে মোচড় মেরে উঠছে। আজকাল প্রতিদিনই এসব শুনতে হয়। ফুফু বলল- বিয়ার দিন আবার কান্দিস না। মেকাপ মুছে যাবে। কানলে আগেই কাইন্দা ল।
শুনেই রুম জুড়ে হাসির বন্যা বয়ে গেল। সুবার মা সালমাও হেসে ফেলল। সুবা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সে মন থেকে হাসছে না। সবাইকে সঙ্গ দিতে একটা পানসে হাসি হাসতে হচ্ছে। এর মধ্যে সুবার খালাতো ভাই বলে উঠল- সুবার কান্না ভিডিও করমু। বিয়ার পরে দেখামু সবাইরে। এবারও সবাই হাসল। কাজের মহিলাটা সুবার মাকে বলল- মেয়েরে বিয়া দিয়া একলা ফেলে যাবেন চাচী আম্মা? সুবা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে উত্তর শোনার জন্য। সালমা মাথা নিচু করে আছে। কোনো কথা বলছে না। কেবল একটা স্মিত হাসি ছাড়া।
সুযোগ পেলেই সুবা রুমের পর্দা টেনে তার বাবাকে এক নজর করে দেখে নেয়। কি জানি, বিয়ের পর আবার কবে দেখা হবে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে সব ইচ্ছে তো আর নিজের থাকে না। দীর্ঘ ২৫ বছর বাবা মায়ের সঙ্গে কাটিয়েও এই দু’দিন মনে হচ্ছে সময় বড্ড কম হয়ে গেল। আরও সময় চাই বাবা মাকে মন ভরে দেখে নেয়ার। যত দিন যায় বুকের ভেতরটা হাহাকারে ভরে উঠতে থাকে সুবার। হবু বরটাকে কয়েকবার বলা হলো- আমার বাবা মাকে নিয়ে কখনও কথা উঠাবে না প্লিজ। সব ছেড়ে যাচ্ছি। এর থেকে বড় কষ্ট বোধয় আর হয় না। নতুন করে তুমিও কষ্ট দিবে না প্লিজ।
ছেলেটা মুচকি হেসে সায় দেয়- নিশ্চিন্তে থাকো। তবুও কোথায় যেন খচখচানি থেকে যায়। পরের ছেলে কি আর বাপ মা ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট বোঝে? যার কষ্ট তারই থাকে। সুবা চুপ করে একটা ছোট্ট ভারী নিশ্বাস নেয়। নাহ্ সব যেন ওলট পালট হচ্ছে। আর কয়েকটা দিন সময় পেলে বেশ হতো। এইতো আর দুটো মাত্র দিন বাকি।
মাঝরাতে মামুন মিয়া স্বপ্নে কাকে যেন ডাকে। পাশের রুম থেকে সুবা ভয় পেয়ে দৌড়ে আসে। সালমা বলে স্বপ্ন দেখছে। যা ঘুমা। সুবা যেতে যেতে কয়েকবার পেছন ফেরে। যেন দুজনেই চুম্বকের মতো টানছে সুবাকে। কতদিন এই দুটো মানুষকে জড়িয়ে ধরা হয়নি। কখনও বলা হয়নি ভালোবাসি।
সুবা রুমে চলে আসে। রাত পোহালেই বিয়ে। আর কয়েক ঘন্টার ব্যবধানেই দূরত্ব তৈরী হবে। ২৫ বছর পর সব ছেড়ে নতুন জায়গায় বাঁচার অভ্যাস করতে হবে। এ অভ্যাস বড্ড পীড়াদায়ক। এ অভ্যাস সুবার মতো মেয়েদের পাজড়ভাঙ্গা আওয়াজ। যে আওয়াজ একটা ছোট্ট হৃদপিন্ড ছাড়া কারো কানে যায় না।।