আমার ভাই

আমার ভাই

আব্বু আস্তে করে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। চোখ খুলেই দেখি আব্বু শার্ট গায়ে দিচ্ছে। “কই যাও আব্বু? আমিও যাবো।”, এই বলে আব্বুর দিকে হাত বাড়াতেই বড় খালাতো বোন আমাকে ধরে ফেললো। আব্বু আস্তে করে আমাকে বললো, “আপুর সাথে নানু বাসায় যাও। আমি আসতেছি।” আমি বিকট শব্দে চিৎকার করে কান্না শুরু করলাম। “না! আমি তোমার সাথে যাবো আব্বু।” আপু আমাকে কোলে তুলে নিলো। তারপর আব্বুকে একটা জামা দিতে বললো। আমি বেশি জেদ শুরু করাতে জামা না পড়িয়েই আমাকে নিয়ে বের হয়ে গেলো। আমার গায়ে শুধু একটা গোলাপি রঙের মেঁও প্যান্ট।

আমি কাঁদতে কাঁদতে হাত পা ছোড়াছুঁড়ি করতে লাগলাম। আমাদের ভাড়া বাসা থেকে নানুর বাসা ছয় সাত মিনিটের রাস্তা। এতো ভোরে আমাকে কেন ওইখানে নিয়ে যাচ্ছে আমি বুঝলাম না। আব্বুই বা আমাকে রেখে কোথায় যাচ্ছে! আব্বু তো কখনো আমাকে রেখে কোথাও যায় না। এই ভেবেই আবার কান্না করে উঠলাম। কিছুটা যাওয়ার পর জেদ করে রাস্তায় বসে পড়লাম। আপু টানতে শুরু করলো, আমি কাঁদতে কাঁদতে হাত ছুটানোর চেষ্টা করলাম। পাশে দুই টা মহিলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। আপুকে জিজ্ঞেস করলো, “কি হইছে? জোর করতেছো কেন বাচ্চাটাকে?”

আপু উনাদের কে বললেন, “ওর ভাই আজকে মারা গেছে। ওর বাসায় কেও নাই। ওর আব্বু সিএমএইচে যাবে এখন বাকি কথা আর শুনলাম না। কোনরকমে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উলটা দিকে দৌড় দিলাম। মেইন রোড পার হলাম দৌড়ে। একটা সাইকেল আমার গায়ের উপর প্রায় উঠেই গেলো। আমি তাও থামলাম না। সাইকেলের লোকটা বললো, “এইটা কার বাচ্চা? রাস্তায় এইভাবে দৌড়াচ্ছে!” আমি চোখ মুছতে মুছতে বাসায় গিয়ে দেখি আব্বু তালা দিয়ে বের হচ্ছে। আমি আব্বুকে ধরে কেঁদে বললাম, “আমি তোমার সাথে যাবো।”

আব্বু আমাকে একটা জামা পড়িয়ে নিয়ে বের হলো। একটা হলুদ ট্যাক্সি তে আম্মু আমার ভাইকে কোলে নিয়ে উঠলো। তোয়ালে দিয়ে মোড়ানো ছোট্ট তালহা! আম্মুর দুই পাশে দুইটা মহিলা উঠতেই ট্যাক্সি ছেড়ে দিলো। আমি আব্বুর হাত ধরে দূরে দাঁড়িয়ে দেখছি। আম্মু আমাদের দিকে তাকালোও না। আশেপাশে অনেক মানুষ, আমার খুব অদ্ভুত লাগলো সবকিছু।

সরাসরি নানু বাসায় আসলাম আব্বুর সাথে। নানুর রুমে ঢুকেই দেখি ফ্লোরে একটা পাটি বিছিয়ে তালহাকে শুইয়ে রাখা। আশেপাশে অনেক মহিলা। আর পাশে খাটে আম্মু উলটো হয়ে শুয়ে আছে। সবাই বলছিলো আম্মু বার বার জ্ঞান হারাচ্ছে। আমিও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম আসলেই তাই। আম্মু একটু পর পর উঠে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে “আমার মানিক, বাবুটা” বলেই চোখ বন্ধ করে পড়ে যাচ্ছে। আমার আর ভালো লাগলো না। আব্বুর কাছে গিয়ে বললাম, “চিপস খাবো।”

আব্বু সিঁড়িতে বসে ছিলো। কাকে যেন বললো চিপস এনে দিতে। পটেটো চিপস। তখন মশলা ওয়ালা গুলো খেতে পারতাম না। যেই চিপস গুলোতে বেশি মশলা থাকতো ওইগুলো বড়দের দিয়ে দিতাম। আব্বুকে অনেকবার সাধলাম খাওয়ার জন্য, খেলো না। পরে খালামনির কাছে গেলাম। খালামনির মুখে জোর করে ঢুকিয়ে দিতে চাইলাম, খালামনি খেতে চাইলো না। পাশ থেকে কেও একজন বললো, “খেয়ে নেন। ছোট মানুষ, ও কি কিছু বুঝতেছে!” একটু পরেই আমার খুব মজা লাগতে শুরু করলো। বাসায় অনেক লোক আসছে। পুরো বাসা ভর্তি মানুষ। আমার অনেক বন্ধু বান্ধবও এসেছে। আমি ওদের নিয়ে খেলতে শুরু করলাম। লুকোচুরি। অনেকক্ষণ খেললাম, কিন্তু কেউ কিচ্ছু বললো না।

দুপুরে দেখলাম একটা গাড়িতে করে বরফ আনা হয়েছে। নানুর বাসার টি-টেবিলটা বাইরে আনা হলো। তার উপর বরফ গুলো স্তুপ করে রাখা হচ্ছে। আমি তখন হুজুরের সাথে বসে ছিলাম। হুজুর শলার কাঠি ভেঙে ছোট ছোট টুকরা করছিলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি ১ ২ গুনতে পারো?”

আমি মাথা ঝাঁকালাম। আমাকে কাঠিগুলো গুনতে দিলো। আঠারো টা কাঠি ছিলো, হুজুরকে বলতেই আরো দুটো কাঠি যোগ করলো। আমার পিছে মামা দাঁড়িয়ে ছিলো, তাকিয়ে দেখলাম খুব কাঁদছে। একটু আগেই মামাকে দেখেছি কবরস্থানে বিশাল গর্ত খুঁড়ছে। আমি অনেকক্ষণ পাশে বসে ছিলাম। তালহা কে হুজুর গোসল করালেন। আমার গণা কাঠিগুলো দিয়ে ওর একটা একটা নখ পরিষ্কার করলেন। তারপর টি-টেবিলের বরফের মাঝখানে ওকে শুইয়ে দেওয়া হলো। আমি ভীষণ অবাক হলাম। আব্বুকে জিজ্ঞেস করলাম, “ওর ঠান্ডা লাগবে না? এইভাবে বরফ দিচ্ছে কেন?” আব্বু কিছুই বললো না।

আসরের আজানের আগে মাইকে মুয়াজ্জিন ঘোষণা দিলেন সবাই যাতে জানাজায় আসে। অনেক লোক তখন নানু বাসায়। ঠিক মত দাঁড়ানো যাচ্ছে না। শেষ বারের মত সবাইকে একবার করে ভাইয়ের কাছে আনা হলো। আমি ওর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেই সময় একটা ছেলে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “এইটা কি তোমার আপন ভাই?”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “নাহ! এইটা তো আমার তালহা ভাই।” তালহা কে যখন কবর দেওয়া হচ্ছিলো তখন আমি সেখানে ছিলাম। যখন ওকে কবরে রেখে বাঁশ বিছানো হচ্ছিলো আমি চমকে উঠলাম। আব্বুর হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বারবার বললাম, “তালহা তো ব্যাথা পাবে আব্বু! ওর উপর এইগুলা কেন দিচ্ছে?” আমি ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললাম। যখন মাটি দেওয়া শুরু হলো আমার অসহ্য লাগতে শুরু করলো। কেমন যেন একটা যন্ত্রণা। আমার কান্না শুনে একজন এসে আমাকে কবরস্থান থেকে নিয়ে গেলো। ব্যাস শেষ। ওইটুকুই। আর কিছু মনে নেই। শুধু কবরের ভিতর ছোট্ট তালহার উপর মাটি ফেলা হচ্ছে এইটুকুই আমার শেষ স্মৃতি।

বি.দ্র: ঘটনা টা ২০০৫ সালের। তখন আমার বয়স ৫ বছর। তালহা আমার চার বছরের ছোট ছিলো। মাত্র সাড়ে সাত মাস বয়সে হার্টে ফুটো থাকার কারণে ও মারা যায়। ওকে নিয়ে আমার তেমন কোনো স্মৃতি মনে নেই। শুধু ওর মারা যাওয়ার দিনের সব ঘটনা মনে আছে। ওর কোন ছবিও কখনো তোলা হয়নি, তাই ওর চেহারাটাও আমার মনে নেই।

তালহাকে যেখানে কবর দেওয়া হয়েছে তার পাশেই আমরা বাসা বানিয়েছি। আমাদের খাট থেকে ওর কবরের দূরত্ব দশহাত। ও যখন মারা যায় তখন এতটাই ছোট ছিলাম যে মারা যাওয়া কি, আপন মানে কি তাই বুঝতাম না। এখন বুঝি, তাই অনেক বেশি কষ্ট পাই।

আমার ভাইটাকে আমি প্রতিদিন ভালবেসেছি। কেও জিজ্ঞেস করলে কখনো বলিনি আমরা দুইবোন। সবসময় দুইবোন একভাই বলেছি। আমি কক্ষনো চাই না ও আমাদের থেকে হারিয়ে যাক। আজকে ৯ জুন। তালহার ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম ওর কবরটার উপর বৃষ্টি পড়ছে। ভাইটা কি কোনোদিনও জানবে আমি ওকে কতটা ভালোবাসি?

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত