স্বামী

স্বামী

নীল শাড়ি,চুড়ি পরে একদম পরিপাটি হয়ে যখন শেষবারের মতো নিজেকে আয়নায় দেখছিলাম অনু তখন তার সাত বছর বয়সী ফুফাতো দেবর এসে হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে গেলো। চিরকুটটা পড়ার পর রাগে দুঃখে চোখ ভিজে এলো অনুর। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে‌ তার। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে।নিজের রুমে কিছু সময় কান্না করার পর অনু চোখ মুছে ওর শ্বাশুরি নিরুপমার রুমে গেলো। শাশুরিকে চিরকুটটা দেখানোর পর ওর শাশুরির মুখে চিন্তার রেখা ভেসে উঠল। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,”সুপ্ত তোকে কখন ছাদে বলেছে?” অনু নিরবে কাঁদছে। সে মৃদু স্বরে বললো,”প্রায় দু ঘন্টা আগে। ” নিরুপমা আশ্চর্য হয়ে বললো, “এমা! তাহলে তখন যাসনি কেনো?”

“আমি তো যেতে চেয়েছিলাম মা। কিন্তু ফুফু মা বললো উনার পায়ের মালিশটা করেই যেনো যাই। পায়ের মালিশ করিয়ে যেতে চেয়েছি আবার নাকি উনার মাথা ধরেছে তাই মাথাটা একটু টিপে দিতে। কি করে যাই বলুন তো? এখন আপনার ছেলে আমার উপর রেগে আছেন। আমাকে সোজা বাবার বাড়িতে চলে যেতে বলেছে,ছাদে যাওয়ার কথা চিন্তা করলেও নাকি উনার মরা মুখ দেখতে হবে আমাকে। এখন আমি কি করবো মা? উনি যদি রাগ করে আমাকে আর না আনেন?

নিরুপমাও দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো। তবুও সেটা প্রকাশ না করে অনুকে বললো,” তুই তোর বাবার বাড়ি চলে যা এখন। ওর রাগ কমলে আমি ওকে বুঝিয়ে তোকে নিয়ে আসবো।” সুপ্ত সহজে রাগ করে না। কিন্তু যখন রাগ করে তখন ওর হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এখন অনুকে ওর বাবার বাড়ি না পাঠালেও হচ্ছে না। নিজের ছেলেকে ভালো করে চেনে নিরুপমা।

সুপ্ত ছাদ থেকে দেখছে অনু নীল শাড়ি পড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে গাড়িতে উঠছে। অনুর ফর্সা গাল দুটো যে লাল হয়ে আছে সুপ্ত তা দূর থেকেও বুঝতে পারছে। অনুর গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথে সুপ্তর মনে এক প্রকার ব্যাথা শুরু হলো। কখনো যে এ পাগলীটাকে ছাড়া থাকে নি সে। আর এখন না জানি কতোদিন থাকতে হয়। অনুর গাড়ি যতক্ষন দেখা গেলো সুপ্ত সেদিকে চেয়ে রইলো। এরপর গাড়ি যখন আর দেখা যাচ্ছিলো না তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুপ্ত মনে মনে বললো,”আমাকে ক্ষমা করো লক্ষীটি।”

রাতে খাবার খেতে বসে সবাই মন খারাপ করে রইলো। সুপ্তর ফুফু রাহেলা সেটা দেখা বললো,” বউটা আমার তেমন সুবিধার মনে হয় নি। সুপ্ত ওকে পাঠিয়ে দিয়ে ভালোই করেছে। কোনো কাজই ভালো করে করতে পারে না। আবার স্বামীকেও সন্তষ্ট করতে পারে না।”

নিরুপমা এতোদিন যাবত রাহেলা বেগমের হালচাল দেখছিলো। রাহেলা বেগম যে অনুকে সুপ্তর একদম কাছেই যেতে দেয় না যেটা তিনি প্রথম থেকে খেয়াল করেছে। সুপ্ত অনুকে কোনো প্রয়োজনে ডাকলেই রাহেলা বেগম অনুকে কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত করে রাখে। তাই নিরুপমা রাহেলা বেগমকে থামিয়ে দিয়ে বললো,”আপনাকে সন্তুষ্ট করতে গিয়েই তো ও আজ মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি গেলো,আর আপনি বলছেন কাজ পারে না? আমার ঘরের লক্ষী ও। কই স্বামীর সাথেও তো এতোদিন ঠিক ছিলো? আপনি আসার আগ পর্যন্ত তো এমন কিছু হয় নি?”

রাহেলা বেগম উত্তেজিত হয়ে বললো,”তার মানে তুমি বলতে চাইছো আমার কারণে বউ আজ বাড়ি ছেড়েছে? সব আমার দোষ?” নিরুপমা শান্ত কন্ঠে বললো,”আমি তা বলছি না,আপা। ওকে অনেক ভালোবাসি তাই কেউ ‌ওকে মন্দ বললে ভালো লাগে না।” “মন্দ বললাম কই? যা সত্য তাই তো বললাম।”

“তুমি একদম মিথ্যে বলো নি,ফুফু। মেয়েটা একদম ই ভালো না। তার তো বোঝা উচিত ছিলো যে সবার আগে হলো স্বামী। স্বামীর কথা মানা,স্বামীর ইচ্ছে পূরণ করা সেটাই তো ওর প্রথম দায়িত্ব। সেটা বৃষ্টিতে ভেজা হোক কিংবা ফুচকা খেতে যাওয়া। কিন্তু না সে কিনা তোমার পায়ের মালিশ,হাতের মালিশ নিয়ে ব্যস্ত। কারণ দেখায় আরকি আমি কি বুঝি না”, সুপ্ত এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে ফেললো।

রাহেলা বেগম সুপ্তর কথায় খুশি হলো।এটাই তো চাইছিলেন তিনি। সুপ্ত আর অনুর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতেই তো তিনি এখানে এসেছেন। এবার ওনার ছোট মেয়েটার কোনো গতি হবে নিশ্চয়। সুপ্তর সাথে ওনার ছোট মেয়ের বিয়ে দেওয়া যে উনার অনেকদিনের ইচ্ছা। রাহেলা বেগম অনুর ব্যাপারে আর কিছু বললেন না। উনি জানালেন উনি কালই বাড়ি ফিরে যেতে চাই। অনেকদিন হলো তিনি এসেছেন। সবার কথা মনে পড়ছে খুব। সুপ্ত রাতেই ট্রেনের টিকেট কিনে নিলো।সকালের ট্রেনেই রাহেলা বেগম খুশিমনে তার নাতিকে নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। সুপ্ত অফিস থেকে বের হতেই বৃষ্টি শুরু হলো। তাড়াতাড়ি একটা রিক্সায় উঠে বসলো সে। পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে অনুকে একটা ম্যাসেজ পাঠালো।

অনু বাড়ি পৌছে নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। অনুর মা অনেক ডাকাডাকি করলেও সে দরজা খুললো না। কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। সুপ্তর তো ওকে বুঝা উচিত ছিলো। ও কি ইচ্ছে করেই এমন করেছে নাকি। যদিও ফুফু মা আসার পর থেকে সে সুপ্তকে একদম ই সময় দিতে পারে নি। কিন্তু সুপ্ত তো ওকে যেকোনো পরিস্থিতিতেই বুঝে ফেলে। ফুফু মাকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে কি সে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে ফেলেছে? তাহলে কি ওদের মাঝে সত্যি দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে?নইতো সুপ্তর তো এমন করার কথা না। এসব ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুমাতে পারলো না অনু।

অনু কোনো কিছু নিয়ে বেশিক্ষন মন খারাপ করে থাকতে পারে না। যা তার নিয়তিতে আছে তাই হবে এটা ভেবেই ও সহজেই স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে। ওর এ স্বভাবটা ওর নিজের কাছেই ভালো লাগে। অনু বিকালে ছাদে বসে শরৎচন্দ্রের স্বামী উপন্যাস পড়ছিলো। আর ভাবছিলো সুপ্তও তো সৌদামিনীর স্বামীর মতো। ওতো এমন কোনো ভুলও করে নি। তাহলে সুপ্ত কি ওকে নিতে আসবে? মুঠোফোনে ম্যাসেজ টোনের শব্দে অনুর ভাবনায় ছেদ পড়লো। অনু দেখলো সুপ্ত ম্যাসেজ পাঠিয়েছে।

“কাল ঠিক যেভাবে সাজগোজ করেছিলে ওভাবেই সাজগোজ করে তৈরি হয়ে থাকো,নইতো আর কোনোদিন বৃষ্টিতে ভিজতে দেবো না।” অনু তৈরি হয়ে বের হতেই দেখলো সুপ্ত গেইটের বাইরে এক হাত পেছনে রেখে দাড়িয়ে আছে। অনু কাছে যেতে বললো,”একদিনে কি হাল করেছেন নিজের? খুব বেশি কষ্ট দিয়েছি তাই না?” অনু গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলো,”পেছনে কি?”

“ঘুষ।”

“কি প্রয়োজনে?”

“যাতে ক্ষমা টা জলদি পেয়ে যায়।”

“সেটা সহজে পাচ্ছেন না আপনি।”

“আমাকে এক্সপ্লেইন তো করতে দাও।”

“কি বলবেন আপনি আর?”

“আমি সব খেয়াল করেছি। ফুফু যে সারাদিন তোমাকে দিয়ে কাজ করায়,আমার কাছে আসতে দেয় না সব।আমার বউটা কাজ করতে করতে দিনদিন যে শুকিয়ে যাচ্ছে সেটা কি আমি মেনে নিতে পারি?” “কিন্তু তিনি এমনটা কেনো করবেন?” “কারণ উনি উনার ছোট মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমি ওকে বিয়ে না করে তোমাকে বিয়ে করেছি। তাই তোমাকে উনার সহ্য হচ্ছিলো না আর আমাদের মাঝে দূরত্ব তৈরি করার জন্য ই এসব করেছে। আমি আর মা সব খেয়াল করে তাই তো কাল প্ল্যান করে তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েছি।”

“মাও সব জানতো?” “হ্যাঁ পাগলী। মা ই তো আমাকে বললো যাতে তোমাকে কিছু বলে বাবার এখানে পাঠিয়ে দেই।” “তাই বলে এভাবে পাঠাবে? তুমি জানো আমি কতো কষ্ট পেয়েছি?” “এমনি বললে কি তুমি আসতে?”

হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। কিন্তু দুজনের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা দিলো না। অনু একদৃষ্টিতে সুপ্তর দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির জন্য বোঝা যাচ্ছে না ও কাঁদছে কিনা। সুপ্ত অনুর কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,”এবার কি ক্ষমা করবেন,মহারাণী?” অনু সুপ্তকে জাড়িয়ে ধরে বললো,”এতো ভালোবাসেন কেনো? কেনো আমাকে এতো বুঝেন?” সুপ্ত অনুর চুলে দুটো কাঠগোলাপ গুজে দিয়ে বললো,”কারণ আমি আপনার স্বামী।”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত