আমি ও আমরা

আমি ও আমরা

আজ অফিস থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেলো, মাথাটা ঝিমঝিম করছে এ সময় এক মগ ব্ল্যাক কফি হলে মন্দ হয়না। কিছুক্ষণ বেল বাজিয়ে অবশেষে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি আমার স্ত্রী তানিয়া ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে মুখে উপটান দিয়ে চোখে শশা লাগিয়ে হেডফোনে গান শুনছে।

আমি কেন অন্য কেউ এলেও তা টের পাওয়ার অবস্থায় আপাতত নেই সে। গায়ের কাপড় ছাড়িয়ে বিছানার শুতে শুতে এসির পাওয়ার টা বাড়িয়ে দিলাম, গায়ে ঠান্ডা অনুভূত হওয়ার পর হুশে ফিরলো তানিয়া। চোখের শসা সরিয়ে বিছানায় আমাকে দেখে আবারও শসা লাগিয়ে কিছুটা আয়েশ করে বসে স্বভাবসুলভ ভাবে জিজ্ঞেস করলো;
– কখন এলে?
– এইতো ক্ষাণিক আগে।
– ডাক দিলে না যে..
-ভাবলাম রিল্যাক্স করছো তাই আর ডাকি নি।
– ওহহ আচ্ছা
– একটা কথা বলবো?
-বলে ফেলো।
– মাথাটা ঝিমঝিম করছে, একমগ ব্ল্যাক কফি করে দিবে?
-আসিফ তুমি অফিস থেকে ফিরেছো আমিও কিন্তু ঘরে বসে ছিলাম না। সারাদিন অফিস করে বেলা শেষে ক্লান্ত কিন্তু আমিও হই? দয়া করে এই সামান্য জিনিস টুকু করে খেতে শিখো।

আমি আর কথা বাড়ালাম না কারণ জানি এখন কথা বাড়ালেই ঝগড়া বেঁধে যাবে। ঝুল বারান্দার কোণ ঘেঁষে টুল টেনে বসলাম, সিগারেটে আগুন জ্বালিয়ে দু’য়েক টান দিয়ে প্রায় আস্ত সিগারেট টা বাহিরে নিক্ষেপ করলাম। কিছুতেই মন লাগছেনা, ইসস কতো ভালোবাসা দিয়ে সাজিয়েছিলাম বারান্দা টা! প্রতিটা গাছ ছিল আমার হৃদয়সম! এখন অযত্নে অবহেলায় সবগুলোরই প্রায় অন্তিমদশা! তানিয়া ও আর খেয়াল করেনা এসবের কিন্তু একসময় করতো বড্ড বেশিই করতো। বারান্দা থেকে স্পষ্ট মিলন মামার চায়ের দোকান টা দেখা যায়৷ খুব ভালো চা, কফি বানান তিনি। এখনও আলো জ্বলছে, নাহহ একমগ কফি না হলে আর হচ্ছেনা। ইতস্তত না করেই বেরিয়ে এলাম।
-মামা এক মগ কফি দেন, একদম দুধ চিনি ছাড়া।
-আচ্ছা মামা বসেন, তয় মামা আমার একটু তাড়া আছে জলদি খাওয়া লাগবো।
-ঠিক আছে মামা।

ঋতুটা গরমের হলেও বাহিরে বেশ ঠান্ডা বাতাস, হাতে ধোঁয়া উঠা কফির মগ টা আমার সামনে অতীত কে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
গত বছর চারেক আগে এরকম একটা অবসন্ন রাত্রিতে তানিয়া হঠাৎ ফোন করে বললো ;
-“আসিফ আমি দেখা করতে চাই এখন”।
টিএসসির মোড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম তার, কিছুক্ষন পর হাতে একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে এসে হাজির হলো তানিয়া। ব্যাগ দেখে ক্ষানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললাম;
– ব্যাগ কেন??
তানিয়া সহজ ভাবে উত্তর দিলো
– আমি আর বাড়ি ফিরবো না !
আমি সেখানে দাঁড়িয়ে আর কথা বাড়ালাম না, নজরুল মামার চা’য়ের দোকানে বসে কড়া লিকারে দু’কাপ চা দিতে বললাম। চা’য়ের কাপ টায় প্রথম চুমুক দিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম ;
– সিদ্ধান্ত টা ভেবে চিন্তে নিচ্ছো তো ?
– আর ভাবাভাবির কিছু নেই! আজ বেড়িয়ে না এলে কাল কাজিনের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিতো!
আমি কিছুটা হেসে বললাম ;
– আমার সাথে থাকলে যে বড্ড কষ্ট করতে হবে? এখনো ভালো চাকুরী করি না! দু’য়েক বেলা না খেয়েও কাটাতে হতে পারে পারবে তো?
তানিয়া আমার বাহু চেপে ধরে চোখে চোখ রেখে বললো;
– খুব পারবো! আর দেখো একদিন আমাদের অনেক টাকা হবে অনেক! তখন আর অভাব থাকবেনা কিছুর!

তানিয়া মাস ছ’য়েক আগে স্কুলের ছোট চাকুরী টা ছেড়ে কর্পোরেটে ঢুকেছে, চাকুরীর ডিমান্ড অনেক বেশি! বাড়ি ফিরতে তার রাত হয়ে যায়! সে ও ক্লান্ত থাকে খুব। এখন আর কেউ ভাত বেড়ে অপেক্ষা করে না আমার জন্য, বারবার কল দিয়ে বিরক্ত করে বলে না কোথায় আছো? আর কতো দূর? অফিস থেকে ফেরার পর দু মগ ব্ল্যাক কফি নিয়ে বারান্দায় বসে গল্প করতে চায়না কেউ, অনেক দিন হলো পছন্দের খাবার গুলো রেঁধে কেউ ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের ও সারপ্রাইজ দেয়না, ভরা পূর্নিমায় ছাদে গিয়ে জোসনা বিলাস করতে চায় না, হুটহাট বৃষ্টিতে ভিজতে চায়না, আমার বাড়ি ফেরার পথে ফুলের কথাও মনে করিয়ে দেয়না কেউ।

দুজনেই কাজ আর ক্যারিয়ার নিয়ে ডুবে থাকি! আগে বাসায় ফিরে ল্যাপটপে অফিসের ফাইল গুছাতাম আর মেয়েটা আমার বুকে থাকতো, এখন দুজন দু’দিকে দুই যন্ত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকি কথা টুকু ও হয়না! ছুটির দিনে বাহিরে ঘুরতে না বের হলে আর অভিমান করে না সে, কারণ সপ্তাহে একদিন ছুটি টা সে ঘুমিয়ে কাটাতেই পছন্দ করে! জীবনের শখ, আহ্লাদ, ভালোবাসা সব বাস্তবতা আর ক্যারিয়ারের চিন্তা গ্রাস করে নিয়েছে। ভিষণ সুখি আমি টাও আজ অসম্ভব অসুখি!

হ্যাঁ তানিয়া ঠিকই বলেছিল সেদিন, আজ কোন কিছুরই অভাব নেই আমাদের! শুধু ভেতর থেকে আসা সচ্ছ ভালোবাসা টার বড্ড অভাব।

– মামা আমার একটু তাড়া ছিলো আজকে! আপনার খাওয়া হইছে?
মিলন মামার ডাকে বাস্তবে ফিরলাম, তাড়াহুড়ো করে মগ টা তার হাতে দিয়ে হেসে বললাম ;
– খুব জরুরী কাজ মামা?
গলায় বেশ দরদ মাখিয়ে সলজ্জ ভাবে তিনি উত্তর দিলেন ;
– আপনের মামি সারাদিন গার্মেন্টস করে, রাইতে বাসায় আইয়া আমার লাইগ্যা রাঁন্ধে। আমি বাসায় না গেলে বউ আমার খায় না। সেই জন্যে প্রত্যেক দিন ১০ টার পরে শত কাস্টমার থাকলেও আর দোকান খুইলা রাখিনা আমি।
– বাহ মামা মারাত্মক ভালোবাসা! নতুন বিয়ে করেছেন নাকি?
– না মামা সামনের জানুয়ারীতে ৮ বছর পুরা হইবো। আল্লাহ অনেক সুখে রাখছে মামা, যা কামাই তা দিয়াই সন্তুষ্ট দিনে আনি দিনে খাই। ডি পি এস ও করছে বউ ৫০০ টাকা কইরা। দুয়া কইরেন।
– অবশ্যই মামা, আসি তাহলে..

উনাকে আর বিরক্ত করলাম না, তার ভালোবাসার কাছে যাওয়ার পথ সুগম করে দিয়ে বাড়ির পথ ধরেছি। দু’পায়ের রাস্তা টা আজ খুব দীর্ঘ লাগছে, নিজেকে পরাজিত কাপুরুষ মনে হচ্ছে! সত্যি ভালোবাসতে টাকার প্রয়োজন হয় না! তার এই সুখ কেনার সাধ্য কারোর নেই। আমরা প্রাচুর্যের কাছে আত্মসুখ কে বলি করে দেওয়া এক অসভ্য জাতী। সত্যি বলছি ছেড়ে যাবো এ প্রাচুর্য! একটা জগৎ হবে শুধু আমার আর তানিয়ার। যেখানে কোন উচ্চাভিলাষীতা থাকবে না, থাকবে না সস্তা এ ব্যস্ততা! জীবনের কাছে জিতে যাবো আমরা, অনন্তকাল চোখে চোখ রেখে মনের প্রশান্তি দিয়ে জিতিয়ে দিবো চিরনশ্বর এ ভালোবাসা কে! এটুকু ভালোবাসাও না থাকলে যে ধসে যাবে পৃথিবী! হঠাৎ ফোনে ম্যাসেঞ্জারের আওয়াজ, হ্যাঁ তানিয়াই মেসেজ করেছে। লিখেছে;
” শুনো না আসার সময় গেটের পাশে একটা বুনো ফুল দেখলাম, নিয়ে আসবে? আমি শাড়ি পরেছি আজ! দু’জন ছাদে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করবো। তারাতারি এসো “।

ভেতরের উথাল-পাথাল টা বেড়ে গেল! খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ওকে, আজ সব না গণ্ডি পেরিয়ে মেয়েটার চিবুকে হাত রেখে চোখে চোখে বলবো “ভালোবাসি বড্ড বেশি ভালোবাসি”!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত