মায়াবতী ও তার পরিবারের গল্প

মায়াবতী ও তার পরিবারের গল্প

“ইশ মাথার চুলের কি অবস্থা হয়ে গেছে।আয় তেল দিয়ে দেই মাথায়”। বলে লাবন্যর মা জোর করে মাথায় তেল দিতে বসলো। লাবন্য হায় হায় করে উঠলো ” না আম্মু প্লিয,কাল সকালে ভার্সিটিতে যেতে হবে।তেল দিলে বড় বিচ্ছিরি লাগে দেখতে”। কিন্তু কে শোনে কার কথা।রাশিদা জোর করে মেয়ের মাথায় তেল ঘষে চুল আঁচড়ে টাইট করে একখান বেনী করে দিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন “দেখ৷ এখন কত সুন্দর দেখাচ্ছে”।

সুন্দর না ছাই।তুমি আমাকে পুরা কাজের মেয়ে ছকিনা বানিয়ে দিয়েছ”। লাবন্যর কথা শুনে ছোট বোন টুশি হিহি করে হেসে উঠে বললো “আম্মু চলো আপুর হাতে একটা ঝাড়ু ধরিয়ে দিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে আপ্লোড দেই।ক্যাপশন হবে ” কার কার বুয়া লাগবে?চব্বিশ ঘন্টা ফ্রি হোম সার্ভিস”। “এক চড় মেরে সবকয়টা দাঁত ফেলে দিবো তোর।দিন দিন বাদর হচ্ছিস”। রেগে মেগে লাবন্য বললো।

কিন্তু তার আর দরকার পড়লো না।কারন তার আগেই রাশিদা ছোট মেয়ের মাথায় ও তেল দেয়া আরম্ব করে দিয়েছে।টুশি কয়েকবার চেষ্টা করলো বাধা দেবার কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলো না। লাবন্য টুশির বেচারা মার্কা চেহারা দেখে হেসেই খুন হলো। টুশি মুখ গোমড়া করে বললো ” আমাকে তো দিয়ে দিলে,এবার তোমার ছেলেকেও মফিস বানিয়ে দাও”। কাব্য মনোযোগ দিয়ে মেসেঞ্জারে জেসিয়ার সাথে চ্যাট করছিলো।জরুরি বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো তাই ওদের কথা তার কানে যায় নি।মা হঠাৎ মাথায় তেলের ঘষা দিতেই সে আঁতকে উঠে একটা চিৎকার দিলো “আম্মু এটা কি করলে তুমি”।

” চুপ কর,মাথা ঠান্ডা থাকবে তেল দিলে”।রাশিদার সোজাসাপটা উত্তর। লাবন্য আর টুশি হাসতে হাসতে বললো “সব সময় চুলে জেল মাখতে হয় না।মাঝে মাঝে আম্মুর তেলের ঘষাও খেতে হয়”। বসার ঘরে বড় করে বাধানো মায়ের ছবিটার দিকে তাকাতেই লাবন্যর এসব কথা মনে পড়ে গেলো। চোখ দিয়ে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো তার।রাশিদা মারা গিয়েছেন আজ আট দিন।হঠাৎ করে স্ট্রোক হলো।হসপিটাল পর্যন্ত নিতেও পারেনি।এত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা ঘটেছে যে তারা কেউ বুঝে উঠতে পারেনি এটা স্বপ্ন নাকি বাস্তবে ঘটছে।

রাশিদা মারা যাবার পর তারা সবাই এক ধরনের ঘোরের মধ্যে ছিলো।তাদের কাছে মনে হচ্ছিলো এটা একটা দুঃস্বপ্ন। এক্ষুনি ঘুম ভেঙে যাবে আর দেখবে মা টেবিলে নাস্তা সাজাচ্ছে আর চিৎকার করে ডাকছে ” এক্ষুনি উঠ,নাহলে পানি ঢেলে দিবো গায়ে”। কিন্তু না, এই দুঃস্বপ্ন ভাংলো না।আস্তে আস্তে সবাই বুঝতে পারলো আসলেই মা আর নেই।আর কোনো দিন আসবে না। মা মারা যাবার পর মনে হলো জীবনটা বুঝি এখানেই থেমে গেছে।তাদের জীবনের হাসি আনন্দ সব একসাথে ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে।কোন কিছুতেই যেনো কিছু যায় আসে না আর।আনন্দ দুঃখ কোনোটাই যেনো আর তাদের স্পর্শ করবে না।

লাবন্যরা তিন ভাই বোন। লাবন্য সবার বড়।একটা প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে বিবিএ শেষ করে এমবিএ ভর্তি হয়েছে।ছোট ভাই কাব্য ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষের ছাত্র।আর ছোট বোন টুশি এবার কলেজে উঠেছে। বাবা আতোয়ার রহমান সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল। সবাই মিলে খুব সুন্দর একটা পরিবার ছিলো।কিন্তু মায়ের মৃত্যুতে সবাই একেবারে চুপ মেরে গেছে। প্রথম কয়েকদিন খালা ফুপুরা থাকলেও আস্তে আস্তে সবাই চলে গেলো। তাদের নিজেদের ও যার যার সংসার আছে।মা মারা যাবার পর তারা খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলো।খালা ফুপুরা জোর করে করে খাওয়াতো তাদের।তারা চলে যাওয়ার পর ওরা সারাদিন কেউ কিছু খেলো না।

রাতের বেলা লাবন্য এই নিষ্ঠুর ব্যাপার টা উপলব্ধি করতে পারলো যে, তাদের মা কে ছাড়াই বেঁচে থাকতে হবে।এই মুহূর্তে মা কবরে একা শুয়ে আছে।মায়ের জন্য তাদের ভয়ংকর রকমের কষ্ট হলেও তাদের খেতে হচ্ছে,ঘুমাতে হচ্ছে।মা কে ছাড়াই তাদের বেঁচে থাকতে হচ্ছে। লাবন্য তার মায়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিলো। চোখ মুছে নিয়ে রান্নাঘরে গেলো সবার জন্য খাবার বানাতে।কিন্তু কি থেকে কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। শেষে ভাত,ডিম ভাজি আর আলু ভর্তা করে টেবিলে সাজিয়ে সবাইকে ডাকতে গেলো।কিন্তু সবার একই কথা।কেউ খাবে না।

“হ্যা তোদের শুধু একারই কষ্ট হচ্ছে আম্মুর জন্য।আমার তো হচ্ছে না।আমার তো আর মা না।কত কষ্ট নিয়ে এগুলো রান্না করেছি এখন এসব কথা শোনার জন্য?এক্ষুনি টেবিলে না এলে আমি সত্যি বলছি,বাসা থেকে বের হয়ে যাবো।আব্বু তোমাকেও বলছি।তাড়াতাড়ি খেতে এসো সবাই”। লাবন্যর কন্ঠের উত্তাপটুকু টের পেয়ে সবাই টেবিলে এলো।অনিচ্ছাসত্ত্বেও কিছু খাবার নাকে মুখে গুজে দিলো। খেতে বসে লাবন্য বাবাকে জানালো বাসায় বাজার শেষ হয়ে গেছে। ” ও,তুই একটা লিস্ট করে দে।আমি এনে দিচ্ছি”।

এটুকু বলেই আতোয়ার রহমান নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।খাবার টেবিলে কেউ কোনো কথা বলছে না।মনেই হচ্ছে না এখানে চারজন মানুষ আছে।অথচ রাশিদা বেঁচে থাকতে কি হৈচৈ করেই না ডিনারটা সারতো তারা। লাবন্য লক্ষ্য করলো কেউ ঠিকমতো খাচ্ছে না।ওদেরই বা কি দোষ দিবে।তার নিজেরই গলা দিয়ে কিছু নামছে না।নিরবতা ভেঙে লাবন্য বললো, “আব্বু আমাদের মনে হয় একজন কাজের লোক রাখা দরকার সর্বক্ষনের জন্য”।

” আমি কয়েক জায়গায় বলে রেখেছি।কিন্তু মুশকিল হলো আজকাল পারমানেন্ট কাজের লোক খুব কম পাওয়া যায়।তাছাড়া বিশ্বস্ত কেউ না হলে কি থেকে কি করে বসে সেটা নিয়েও চিন্তা করছি”। লাবন্য বা অন্য কেউ আর কিছু বললো না। সবাই খাওয়া শেষ করে উঠে গেলো।লাবন্য আর টুশি মিলে টেবিল গুছিয়ে প্লেট বাটি ধুয়ে রাখলো। রাশিদা কাজের লোকের কাজ পছন্দ করতেন না।সংসারের কাজ, বাচ্চাদের কাজ সব নিজের হাতে করে আনন্দ পেতেন।লাবন্য বুঝতে পারছে আম্মু তাদের জন্য কত কষ্ট করতো। লাবন্য রাতে ঘুমাবার সময় টুশির ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলো।একবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিলো।থাক কাদুকঁ। কাঁদলে কষ্ট গুলো পানি হয়ে বেরিয়ে আসে।মন হালকা হয়।

কাব্যর রুমে এখন ও আলো জ্বলছে। তার কেমন যেনো শুন্যতা অনুভব হচ্ছে।মায়ের সাথে তার কথা খুব কমই হতো।বাইরে,মোবাইলে ই বেশী সময় কাটাতো।আম্মুর সাথে সেভাবে কখনও গল্প করা হয় নি।বোনদের সাথেই আম্মুর বেশী গল্প হতো।আজ তার ইচ্ছে হচ্ছে আম্মুর সাথে খুব গল্প করার।তার ভার্সিটির গল্প,বন্ধুদের গল্প,ভালোবাসার মানুষটার গল্প।কিন্তু আম্মুযে নেই আর।তার ভীষন রকম কষ্ট হচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।নিজের ভেতরে অনুশোচনা হচ্ছে, কেন সে আম্মুর সাথে আগে এত গল্প করেনি। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।

লাবন্য রাতে পানি খেতে উঠে দেখে কাব্য লাইট জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে গেছে।জানালাও বন্ধ করেনি।জানালা বন্ধ করে দিয়ে কাব্যর দিকে তাকাতেই দেখলো চোখ ভেজা।তার নিজের ও চোখ ভিজে উঠলো।লাইট বন্ধ করে রুমে চলে যাচ্ছিলো কিন্তু বারান্দায় আলো দেখে এগিয়ে গেলো।বাবা উদাস মুখে বারান্দার ইজি চেয়ারটায় বসে আছেন।কোলের উপর বাবা মায়ের বিয়ের ছবিটা।

লাবন্য দৌড়ে রুমে চলে এসে বালিশে মুখ রেখে হু হু করে কেঁদে উঠলো। আজ সে কাঁদবে,সারা রাত কাঁদবে। মা মারা যাবার ব্যাপারটা সবাই আস্তে আস্তে সয়ে নিলো।সারাদিন যার যার ক্লাস টিউশনি শেষ করে সন্ধ্যায় ভাই বোন বাবা মিলে চা খেতে খেতে আড্ডা দেয়।রান্না বান্নার দিকটা লাবন্য আর টুশি মিলে ভালোই সামলে নিয়েছে।আমেনার মা নামে একজন কাজের লোক রাখা হয়েছে।সে সকালে এসে ঝড়ের বেগে দু’ঘন্টা কাজ করে দিয়ে যায়।লাবন্য অবাক হয়ে দেখে একটা মানুষ এত দ্রুত এত কাজ কিভাবে করে।অবশ্য স্বীকার করতে বাধ্য যে আমিনার মা আসায় তাদের অনেক কাজ কমে গেছে।

কাব্য মাঝে মাঝে সাহায্য করতে আসে রান্নায়।লেবু শশা কাটার দায়িত্বটা আজকাল কাব্যর উপর ই পরেছে।আতোয়ার রহমানের কোন কাজ নেই।শুধু শুক্রবার হলে বাজার করে দেয়া ছাড়া। রাতের খাবার পর লাবন্য দেখলো ফাহিমের কাছ থেকে ছয়টা কল এসেছে।ফাহিম আর সে একই ভার্সিটিতে পড়েছে।ফাহিম সিনিয়র ছিলো।এমবিএ কমপ্লিট করে একটা ব্যাংকে চাকরি করছে। পাঁচ ফিট এগারো ইঞ্চি লম্বা রাজপুত্রের মত দেখতে ছেলেটার ভালোবাসা লাবন্য প্রত্যাখ্যান করতে পারে নি। দুজনের পরস্পরের প্রতি যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ তা সত্যিই বিরল।

ফাহিমের কথা পরিবারে জানাতে চেয়েছিলো লাবন্য।কিন্তু তার আগেই মা মারা গেলেন।মায়ের মৃত্যুর পর ফাহিমের সাথেও খুব একটা কথা হয়ে উঠে নি। লাবন্য কল ব্যাক করে হ্যালো বলতেই ফাহিম বলে উঠলো,

“আমি তো ভেবেছিলাম আজও তোমার সাথে কথা না বলে ঘুমাতে হবে”। লাবন্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো ” নিজেকে আর নিজের পরিবার কে সামলে নিচ্ছি ফাহিম।”

“আমি অনেক সরি।আসলে এভাবে বলতে চাই নি”।

” না তোমার সরি হবার কিছু নেই।সত্যি বলতে কি,আম্মু চলে যাবার পর আমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলাম।এখন একটু একটু করে নিজেকে ফিরে পাচ্ছি”।

“আমার জন্য কি একটু সময় হবে তোমার? আমি কি তোমার নিজেকে খুজে পাওয়ার ব্যাপারে সহায্য করতে পারি”? কিছুক্ষণ চুপ থেকে লাবন্য উত্তর দিলো ” হুম পারো।তোমার কাধটা এখন আমার প্রয়োজন। আমি সেখানে মাথা রেখে অনেকক্ষন কাঁদবো”। লাবন্যর কথা শুনে ফাহিমের এত মায়া হলো যে বলার মত না।তার ইচ্ছে হচ্ছিলো এক্ষুনি লাবন্যর কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বাচ্চাদের মত আদর করতে।

“তাহলে কাল ধানমন্ডি লেকে দেখা করি আমরা”?ফাহিম বললো। লাবন্য ও রাজি হয়ে গেলো। আরো বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলো লাবন্য।টুশি অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে।তার ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। লাবন্য পানি খেতে ডাইনিংয়ে গেলো।কাব্যর রুম থেকে কথার আওয়াজ আসছে।জেসিয়ার সাথে কথা বলছে হয়তো।

বারান্দায় আলো জ্বলতে দেখলো।আজও বাবা বারান্দায় বসে আছে।কি ভীষণ রকম অসহায় দেখাচ্ছে তাকে।লাবন্যর চোখে পানি চলে এলো। বাবার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে তার।বয়স হয়ে গেলে নাকি মানুষের কথা বলার একজন সংগী দরকার হয়।কিছুদিন পর তো বাবা রিটায়ার্ড করবে।বাবার সারাদিন কিভাবে কাটবে তখন? তারা তো রাতটুকু ছাড়া বাবার সাথে সময় ই কাটাতে পারে না।তাছাড়া মন খারাপ থাকলে সে ফাহিমের সাথে কথা বলে,কাব্য জেসিয়ার সাথে কথা বলতে পারে।বাবা কার সাথে কথা বলবে?তার নিজের ভিতরের একাকীত্বটা কি ছেলেমেয়েরা দূর করতে পারবে?ছেলেমেয়েদের কাছে কি মনের সব কথা বলা যায়?

লাবন্য আজকাল লক্ষ্য করেছে বাবা রাতে ঘুমায় না।জিজ্ঞেস করলে বলে,” বয়স হয়েছে তো,সে জন্য ঘুম হয় না ঠিক মত”। লাবন্য বুঝতে পারছে তার বাবাটা ভীষণ নিঃসংগ হয়ে পরেছেন।নিজের ভেতরের কষ্ট সে ছেলেমেয়েদের বুঝতে দিচ্ছেন না।কিন্তু নিজে ভেতরে ভেতরে ভয়ংকর রকম একাকীত্ব ভোগ করছেন। লাবন্য হঠাৎ কঠিন একটা বিষয় চিন্তা করে ফেললো। তার আগে ভাই বোনদের নিয়ে ব্যাপারটা আলোচনা করতে হবে। লাবন্য কাব্য আর টুশি মুখোমুখি বসেছে। লাবন্য কথা শুরু করলো “শোন খুব জরুরি একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের”। এ পর্যন্ত বলে দুজনের দিকে তাকালো লাবন্য।

” হ্যাঁ বলে ফেলো কি সিদ্ধান্ত “।টুশি গালে হাত দিয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছে।

” বাবা আজকাল অনেক একা হয়ে পরেছে রে।আমরা আর কই তাকে সেভাবে সময় দিচ্ছি।যে যে যার যার পড়া ক্লাস এসব নিয়েই ব্যাস্ত। দিন শেষে কিন্তু বাবা একেবারে একা।কিছুদিন পর রিটায়ার্ড করবে।তখন তার দিন কিভাবে কাটবে একটু ভেবে দেখেছিস”?

“কি করবো এখন বলো।আম্মু থাকলে হয়তো এমনটা হতো না”। কাব্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো।

” হ্যাঁ ঠিক,আম্মু থাকলে এমন হতো না।তাই আমি চাচ্ছি আব্বু আবার বিয়ে করুক”।

“হোয়াট! কি বলছ তুমি আপু”। লাবন্যর কথা শুনে কাব্য বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।

” আপু কি বলছ তুমি।আব্বুকে বিয়ে করালে এটা কেমন দেখায় এখন”।টুশিও যারপরনাই অবাক হয়েছে।

লাবন্য বালিশে হেলান দিয়ে বললো “আমি ঠিকই বলেছি।দিনশেষে আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষের সাথে কথা বলতে পারি।মনের যত কথা সব বলতে পারি।আমরা যখন কথা বলায় ব্যাস্ত থাকি,আব্বু তখন বারান্দায় একা একা বসে থাকে।তার তো কথা বলার কেউ নেই।আর দেখ,যে কথা গুলো তুই জেসিয়ার সাথে শেয়ার করতে পারিস,সেগুলো কি অন্য কাউকে বলতে পারবি?কিছু ব্যাপার শুধু একজনকে ই বলা যায়।যে একজন টা আমাদের স্পেশাল হয়”। ” কিন্তু আবার বিয়ে করলে সেই মা যদি ভালো না হয়? আমাদের যদি পছন্দ না করে?যদি অত্যাচার করে”? টুশি প্রশ্ন করলো।

“ধুর বোকা,আমরা কি বাচ্চা নাকি যে যা খুশী ব্যাবহার করবে।আর পছন্দ যদি নাই করে আমরা নিজেরা নিজেদের মত থাকবো।আমরা তিন ভাই বোন মিলে থাকলেই তো কত সুন্দর সময় কেটে যায়।তাছাড়া আমরা তো নিজেদের জন্য মা চাচ্ছি না, বাবার জন্য সংগী চাচ্ছি।মনে নেই মা কি বলতো?সব সময় সব কিছু করতে হয় অন্যের জন্য।অন্যকে ভালো রাখার জন্য।বাঁচতে হয় অন্যের জন্য।নিজের জন্য বেঁচে থাকার কোন অর্থ নেই।অন্যের জন্য কিছু করতে না পারলে জীবনের কোন মুল্য নেই”। ” কিন্তু আমি কিভাবে মায়ের জায়গা অন্য কাওকে দিবো”?কাব্য মেনে নিতে পারছে না।

“এত কিছু চিন্তা করতে হবে না।মায়ের জায়গাও কাওকে দিতে হবে না।আমাদের নতুন করে মায়ের দরকার নেই।একজীবনে মায়ের এত ভালোবাসা পেয়েছি যে সেটা নিয়েই বাকী জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো।আমি বলছি শুধু বাবার কথা ভেবে।শেষ বয়সে মানুষের একজন সংগীর বেশী দরকার হয়।বিশ্বাস কর,রাতে যখন বাবাকে একা একা বারান্দায় বসে থাকতে দেখি,আমার এত কষ্ট হয় যে বলার মত না”। বলতে বলতে লাবন্যের গলা ধরে এলো। অনেকক্ষন চুপ করে থাকার পর টুশি বললো ” ভাইয়া আমার মনে হয় আপু ঠিকই বলছে।”

কাব্য বুঝতে পারছে না কি বলবে।তিনজনের মধ্যে দুজন রাজী থাকলে একা কিছু করা যায় না। “ঠিক আছে,তোমরা যা ভালো মনে করো। শুধু বাবার কথা ভেবে কিছু বলছি না।আমিও চাই বাবা ভালো থাকুক”। লাবন্য দুই ভাইবোনকে জড়িয়ে ধরে বললো ” বাবা ভালো থাকবে।অবশ্যই থাকবে।আমরা ভালো থাকার ব্যাবস্থা করবো”। আতোয়ার রহমান কে বিয়ের কথা বলতেই সে চোখ কপালে তুলে ফেললেন, “কি বলছিস তোরা। এই বয়সে বিয়ে করবো লোকে কি বলবে”?

” যার যা ইচ্ছা বলুক।লোকের কথায় কিছু যায় আসে না।এক বেলা না খেয়ে থাকলে লোকে এসে আমাদের খাইয়ে দিয়ে যায় না।অত ভেবে কাজ নেই”।লাবন্য বললো। “কিন্তু একটা ব্যাপার আছে না?সোসাইটিতে চলতে হবে তো”। ” উফ আব্বু,তুমিই মনে হয় একমাত্র মানুষ যে দ্বিতীয় বিয়ে করছে।কথা বলো না তো আর”।

“কিন্তু তোর মায়ের জায়গা আমি অন্য কাউকে কিভাবে দিবো”। আতোয়ার রহমান আনমনা হয়ে কথাটা বললেন। লাবন্য অনেক কষ্টে দীর্ঘশ্বার গোপন করে নরম গলায় বললো,” মা কে তুমি কতটা ভালোবেসেছ দেখেছি আমরা।প্রথম ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা অব্যাহত রেখেও আবার ভালোবাসা যায় আব্বু।তুমি আর কোন কথা বলবে না এখন।আমরা পাত্রী দেখা শুরু করে দিয়েছি”। আতোয়ার রহমানের কোন কথার পাত্তা না দিয়েই তারা বাবার বিয়ে করিয়ে দিলো।যার সাথে বিয়ে হয়েছে সে একজন মাঝবয়েসী ডিভোর্সি মহিলা।কোন দিন মা হতে পারবে না তাই আগের স্বামী তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে।

বিয়ের পর তারা ভাইবোনরা শিওর ছিলো,এই মহিলা অন্য সৎ মায়েদের মত তাদের দুচোখে দেখতে পারবে না।তাই আগে থেকেই তারা মানুষিক ভাবে প্রস্তুত ছিলো।কিন্তু কিছুদিন যেতেই তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো সে তাদের মায়ের মত খেয়াল রাখছে। কাব্য ভার্সিটিতে যাওয়ার আগে কোনদিন কিছু খুঁজে পায় না।নতুন মা আসার পর থেকে সকাল বেলা তার প্রত্যেকটা জিনিস টেবিলের উপর পায়।

টুশি মাছ খেতে পছন্দ করে না।তার নাকি গন্ধ লাগে।রাশিদা বেঁচে থাকতে এটা নিয়ে খুব বকাবকি করতো।জেলের ছেলের সাথে বিয়ে দিবে বলে হুমকি দিতো।কিন্তু মাছ রান্না হলে ঠিকই টুশির জন্য অন্য কিছু করতো।রাশিদা মারা যাবার পর টুশি জোর করে মাছ খেতো।লাবন্য অন্য কিছু করতে চাইলেও করতে দিতো না। কিন্তু আজকাল নতুম মা মাছ রান্না করলে টুশির জন্য আলাদা কিছু রান্না করে রাখে।

আগে লাবন্য ভার্সিটি থেকে ফিরে ক্ষুধার্ত অবস্থায় রান্না করে তারপর খেতো।এখন বাসায় ফিরে রান্নাঘরে যেতে নিলে সে হায় হায় করে উঠে বলে “আরে গড়মে কষ্ট করে এসেছো।রান্নাঘরে যেতে হবে না।হাত মুখ ধুয়ে এসো।আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি”। এসব দেখে লাবন্য মাঝে মাঝে ভাবে,সব সৎ মায়েরাই আসলে খারাপ হয় না।কেউ কেউ আসলেও মা হয়। ড্রইংরুমে মায়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে লাবন্য থমকে দাঁড়ায়।মনে হয় মা সত্যি সত্যি তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন।

স্বপ্না একজন শিক্ষিতা মেয়ে।সন্তান জন্মদানে অক্ষম হবার কারনে ডিভোর্স হবার পর ভাইয়ের সংসারে চলে এসেছিলো।কিন্তু ভাবীর অবহেলায় বাধ্য হয়ে বিয়েটা করে সে।বিয়ের পর বুঝতে পারে আতোয়ার রহমান মানুষটা আসলে খুবই ভালো। আর ছেলে মেয়ে গুলোও অনেক লক্ষি।কিছুদিন যেতেই তার সন্তান না হবার কষ্টটা সে ভুলে যায়।লাবন্য,কাব্য আর টুশিকে সে নিজের সন্তানের মত ভালোবাসতে শুরু করে।আর বিনিময়ে তারাও তাকে ভালোবাসে। আজকাল মাঝরাতে পানি খেতে উঠলে লাবন্য বাবাকে বারান্দায় একা বসে থাকতে দেখে না।সকাল হতেই আগের মত চেঁচামেচি শুরু হয়,” এই উঠলি তোরা, নাকি পানি ঢেলে দিবো গায়ে”।

স্বপ্না রাশিদার ছবিটা প্রতিদিন মুছে আর মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানায় খোদাকে এত সুন্দর পরিবার তাকে দেয়ার জন্য।
স্বপ্না ফাহিম আর লাবন্যর বিয়ে খুবই ধুমধামের সাথে দিলো।বিয়ের সময় স্বপ্নার চোখে মুখে সে কি আনন্দ ঝলমল করছিলো।মেহেদি সন্ধ্যা, গায়ে হলুদ সব কিছুতেই ছিলো তার যত্নের ছাপ।অপরিচিত কেউ ঘূনাক্ষরেও টের পায় না স্বপ্না তাদের আসল মা না।

এর মধ্যে কাব্য একদিন জেসিয়াকে বাসায় নিয়ে এসে মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো।যদিও বন্ধু বলে পরিচয় করিয়েছে,কিন্তু টুশি বার বার করে কাব্যকে খোচাচ্ছিলো সত্যিটা বলে দেয়ার জন্য।শেষে কাব্যর ধমক খেয়ে চুপ হয়েছে। এখন স্বপ্না টুশিকে ঘুমাতে যাবার আগে একগাদা তেল মাথায় দিয়ে টাইট করে বেনী করে দেয়।তারপর বলে,যাহ ঘুমাতে যা। টুশি গোমড়া মুখে ঘুমাতে যায়।

আতোয়ার রহমান আজকাল স্বপ্নার আচরনে মুগ্ধ হচ্ছে।কি সুন্দর করেই না স্বপ্না তাকে আর তার ছেলেমেয়েদের সামলে নিয়েছে। রাশিদার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে সে প্রায়ই আপন মনে কথা বলে।বুকের গভীরে রাশিদার জন্য সীমাহীন ভালোবাসা অনুভব করে।

পৃথিবীটা হচ্ছে আয়নার মতো। আয়নায় যখন আমরা হাসি তখন ওইপাশের মানুষটাও হাসে।ভেংচি কাটলে সেও ভেংচিই কাটে।হাসে না। তাই যদি আমরা কাউকে ভালোবাসা দেই,বিনিময়ে অনেক অনেক ভালোবাসা ফেরত পাবো। ভালো থাকুক ভালোবাসা!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত