বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১১টা বেজে যায়। কলিংবেল নষ্ট থাকার কারণে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ১০ মিনিট ধরে টুকটাক আওয়াজ করে যাচ্ছি কিন্তু দরজা খোলার নাম নেই। রাগে যখন দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগলাম তখন শ্রাবণী সাথে সাথে এসেই দরজা খুলে দিলো। আমি শ্রাবণীকে দেখে রেগে গিয়ে বললাম,
— ভিতরে কি এমন কাজ করছিলে যে দরজা খুলতে এতটা দেরি হলো? নিশ্চয়ই তোমার এক্স বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিলে? শ্রাবণী মাথাটা নিচু করে বললো,
– সরি, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কথাটা শুনে আমি শ্রাবণীকে বললাম,
–ছোটবেলা থেকে দেখেছি বাবা রাত ২টা পর্যন্তও বাহিরে থাকলেও মা ঠিকিই বাবার জন্য জেগে বসে থাকতেন। বাবার জন্য অস্থির হয়ে যেতেন। আর তুমি আমার জন্য অস্থির হবে দূরের কথা তুমি তো আরামে ঘুমিয়ে যাও। তোমার সকল অস্থিরতা তোমার এক্স বয়ফ্রেন্ডের জন্য। আমার কথা শুনে শ্রাবণী নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,
– আমার আর এমন ভুল হবে না। আমি আর এই বিষয়ে কিছু না বলে শুধু বললাম,
— টেবিলে খাবার দাও আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি…
খাবার টেবিলে খাবার দেখে মেজাজটা আবার খারাপ হয়ে গেলো। তরকারিটা যে একটু গরম করে দিবে সেটাও ওর মনে নেই। বিয়ের পর থেকে দেখছি শ্রাবণী কোন রান্নায় ঠিক মত পারে না। হয় তরকারিতে ঝাল বেশি দিবে নয়তো লবণ বেশি দিবে। রুটি দেখলে মনে হয় বাংলাদেশের মানচিত্র। কাপড় ধুতে দিলে কাপড়ের রঙের ১২টা বাজিয়ে ফেলে আর আয়রন করতে দিলে শখের শার্টটা পুড়িয়ে ফেলে। আসলে বড়লোকের একমাত্র সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করলে জীবনের এই অবস্থায় হবেই। ওরা কোন রান্না ঠিক মত করতে পারে না। বিয়ের আগে ওদের ৪-৫ টা বয়ফ্রেন্ড থাকে। আর সারাদিন বন্ধুবান্ধব নিয়েই ব্যস্ত থাকে। আমার কপাল খারাপ এইরকম একটা মেয়ে আমার জুটেছে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি শ্রাবণী কোথাও বের হবার জন্য তৈরি হচ্ছে। আমাকে দেখে মুচকি হেসে বললো,
– আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি। আমার বান্ধবী লাবণীর বাচ্চাটা একটু অসুস্থ। আর তুমি তো জানো ওর হাজবেন্ড বাহিরে থাকে। তাই আমাকে বলেছে ওকে সাথে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নাও আমি টেবিলে নাস্তা দিয়ে দিয়েছি। আমি তখন বললাম,
— ডাক্তারের কাছে যাও না কি তোমার এক্স বয়ফ্রেন্ডের কাছে যাও কি জানি। আমার কথা শুনে শ্রাবণী কিছু বলতে চেয়েও বলে নি। শুধু বললো,
– আমি গেলাম…
নাস্তা করার পর ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি ফোনে চার্জ নেই। ফোন চার্জ দিবো কিন্তু কোথাও ফোনের চার্জারটা খুঁজে পাচ্ছি না। না জানি কোথায় রেখেছে চার্জারটা। চার্জারটা খোঁজার জন্য যখন ওয়ারড্রোবের ডয়ারটা টান দিলাম তখন দেখি একটা নীল রঙের ডায়েরি ডায়রিটা হাতে নিয়ে বুঝতে পারলাম এটা শ্রাবণীর ডায়েরি। অনুমতি বাদে কারো ডায়েরি পড়া ঠিক না কিন্তু তবুও আমি ডায়েরিতে কি লেখা আছে সেটা দেখতে লাগলাম। ডায়েরির পাতাটা উল্টাতেই দেখি তাতে লেখা,
পৃথিবীতে কিছু মানুষ জন্মগ্রহণ করে যাদের কপালে কোনদিন ভালোবাসা জুটে না। আমি বোধহয় তাদের দলে। ছোটবেলা থেকে বাবা মায়ের তেমন আদর ভালোবাসা পাই নি। বাবা মা সময় দিতে পারতো না যেহেতু ওরা দুইজনেই চাকরি করতো। বড় হয়েছি নানুর ভালোবাসা পেয়ে। কিন্তু নানু যখন মারা যায় তখন আমি একা হয়ে যায়। ঠিক সেই সময় আমার জীবনে আসে সাকিব। প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলি দুইজন দুইজনকে। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা বাবা মা মেনে নেয় নি। তাই বাধ্য হয়ে বিয়ে করলাম বাবা মার পছন্দের ছেলে পিয়াসকে। আমি চাইনি কোনদিন পিয়াস আমাকে ভুল বুঝোক।
তাই বিয়ের প্রথম রাতেই পিয়াসকে আমার আগের সম্পর্কের কথা বলি। ভেবেছিলাম পিয়াস হয়তো আমায় বুঝতে পারবে কিন্তু ও আমায় উল্টো বুঝলো। সব সময় সাকিবের কথা বলে আমায় কষ্ট দেয়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সাকিবের সাথে দেখা করে ওর কাছে মাফ চাইবো। কিন্তু তা আর হয়ে উঠে নি কারণ পিয়াস জানলে হয়তো আমায় আরো ভুল বুঝবে। পিয়াসের কাছে আদর্শ স্ত্রী হবার জন্য মনপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছি কিন্তু হতে পারছি না। আর হবোই বা কিভাবে আমি তো কখনো পিয়াসকে একবেলা ভালো কিছু রান্না করে খাওয়াতেই পারি না। জীবনে কখনো রান্না করি নি। কখনো কেউ রান্না শিখাই নি। ইউটিউবে দেখে আর বান্ধবীদের মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে রান্না শিখি। আজকাল বান্ধবীদেরও ফোন দিলে ভয় লাগে কারণ পিয়াস আমায় সন্দেহ করে।
আমার মনে হয় না পিয়াসের সাথে আমার আর বেশি দিন সংসার করা হবে। কোন একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবো পিয়াস আমায় বলছে, শ্রাবণী আমি তোমার থেকে মুক্তি চাই হয়তো আমার আর কোনদিন পিয়াসকে বলা হবে না, পিয়াস আমি তোমায় ঠকাই নি। সাকিবকে যতখানি ভালোবেসেছিলাম তোমাকে আমি তারচেয়েও বেশি ভালোবেসেছি আমি ডায়রিটা পড়া বন্ধ করে দিলাম। পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই। তবুও আমার চোখের কোণে একফোঁটা জল জমা হলো। এই মুহূর্তে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ স্বামী মনে হচ্ছে। যে মেয়েটা দিনের পর দিন নিরবে আমায় ভালোবেসে গেছে আর আমি প্রতিদান সরূপ সেই মেয়েটিকে শুধু অপমান করে গেছি। যে মেয়েটা আমায় বিশ্বাস করে নিজের সবটা বলেছে আর আমি সেই মেয়েটাকে প্রতিনিয়ত অবিশ্বাস করে গেছি শ্রাবণীকে ফোন দিতেই ও ভয়ে ভয়ে বলতে লাগলো,
– পিয়াস, প্লিজ কিছু মনে করো না। রিপোর্ট দিতে একটু দেরি হচ্ছে। রিপোর্টা পেলেই আমি সাথে সাথে চলে আসবো। আমি শুধু বললাম,
— তুমি কোন ক্লিনিকে আছো? শ্রাবণী বললো,
– পপুলারে ক্লিনিক থেকে বের হয়ে শ্রাবণী আমাদের দেখে অবাক হয়ে গেলো। কারণ আমার পাশে সাকিব দাঁড়িয়ে ছিলো। সাকিব তখন শ্রাবণীকে হাসতে হাসতে বললো,
~তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই তাই আমার কাছে মাফ চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। দেখো বিয়েটা আল্লাহর হাতে। আল্লাহতালা আমার কপালে তোমার নাম লেখে নি তাই আমাদের বিয়ে হয় নি। আমার কপালে নোহার নাম লেখাছিলো তাই নোহার সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আর আমি আমাদের বিয়ের শপিং করছিলাম কিন্তু তোমার এই পাগল হাজবেন্ড আমায় জোর করে ধরে নিয়ে এসেছে। তুমি না কি প্রতিনিয়ত নিজেকে অপরাধী ভেবে কষ্ট পাচ্ছো?
শ্রাবণী কিছু বলছে না শুধু আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আর আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি রিকশা দিয়ে যখন বাসায় ফিরছি তখন শ্রাবণী আমার হাতটা শক্ত করে ধরে কাঁধে মাথা রেখে সমানে কাঁদছে। আমি আর ওকে আটকায় নি। কারণ আমি জানি এটাই ওর শেষ কান্না। আজকের পর ওর চোখে আমি একফোঁটা জল আসতে দিবো না। কয়েকমাস পর বাসায় এসে দেখি শ্রাবণী টিভি দেখছে। আমি শ্রাবণীকে বললাম,
— টেবিলে খাবার দাও তো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। শ্রাবণী অবাক হয়ে বললো,
– মানে কি, তুমি না বলেছিলে দাওয়াত খেয়ে আসবে তাই তো আমি আর দুপুরে রান্না করি নি। আমি কিছুটা অভিমান করে বললাম,
— তুমি তো জানো, আমি তোমার হাতের রান্নাবাদে অন্য খাবার খেতে পারি না। দাওয়াতে কিছুই খেতে পারি নি। শ্রাবণী আমার কথা শুনে বললো,
– বাসায় শুটকি বাদে কিছুই নেই। আমি ওর বাম গালে আলতু চুমু দিয়ে বললাম,
— সেদিন তুমি শুটকি, বেগুন আর আলু দিয়ে যেভাবে তরকারি রান্না করেছিলে আজকেও সেভাবে তরকারি রান্না করো না প্লিজ। টিভেতে তখন শ্রাবণীর প্রিয় সিরিয়াল চলছিলো। তবুও সে টিভিটা বন্ধ করে আমার চুল টেনে বললো,
– এত বিরক্ত করো কেন তুমি? বিয়েতে গোশত পোলাও খাওয়া বাদ দিয়ে আমার হাতে শুটকির তরকারি খেতে এসেছে…
শ্রাবণী রান্নাঘরে চলে গেলো আর আমি বসে বসে ভাবতে লাগলাম, আসলে ভালোবাসায় সব সম্ভব। কয়েকমাস আগেও শ্রাবণীর রান্নাকরা খাবার খেলে বমি আসতো আর আজ ওর হাতের রান্না করা খাবার বাদে আমি কিছু খেতে পারি না আপনি আপনার স্ত্রীকে ভালোবেসে একটু ওর কাজের প্রসংশা করেন দেখবেন পরের বার আপনার স্ত্রী সেই একই কাজটা আরো ভালোভাবে করবে। রাগারাগি করে কখনোই কোনকিছু সম্ভব হয় না। ভালোবেসে সবি সম্ভব…