ভালোবাসা

ভালোবাসা

‘তোমার কোথাও বিয়ে হলেও তোমার সাথে পরকিয়া করবো।’ ‘কেন?’ ‘তুমি আমার কাছে অ-নে-ক ভালো, তাই।’ অর্থি’র এমন কথায় প্রায়ই ভেসে যাই আমি। শূন্যকে অসীম কিছু ভাবতে পারে যারা, তাদের বিশ্বাসের সাথে পারা যায় না কখনোই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরুনোর দিন অনেকটা সময় কাটিয়েছিলাম দু’জনে। প্রশাসনিক ভবনের সামন থেকে গগণশিরিষের ছায়া ধরে প্যারিস রোডটায় কতবার আসা-যাওয়া, তা মনে রাখিনি কেউই।

ঘুরে ফিরে একই পথ, একই কথোপকথন; তবুও নেই কোন থামবার ইচ্ছে, নেই কোন ক্লান্তি। ‘কতদিন সামনাসামনি দেখা হবে না বলো তো?’ ‘যেদিন চাইবে, সেদিনই দেখা হবে।’ এমন কথায় রাগ উঠে অর্থি’র, ধরে রাখা হাতটায় খামছি কাটিয়েই বুঝিয়ে দেয়। ‘তুমি চাইলে বাড়িতে কথা বলবো, তুমি শুধু বাবার সাথে দেখা কর প্লিজ।’

হাসি পায় বড্ড, এমন কথায়; মন খারাপ করবে ভাবনায় হাসিনা। মেয়ের বিয়ের সময় অভিভাবকরা ভালোবাসা দেখে না, দেখে ভালো একটা বাসা। দুবেলা রুটিন করে ভালোবাসি বললেও যে পেট ভরবে না, এটুকু প্রেমিককালে না বুঝলেও অভিভাবককালে প্রাকৃতিকভাবেই বুঝে উঠে সবাই। সময় মেপে কথা না হলেও প্রতিদিন কথা বলতেই হতো স্বল্প সময়ের জন্য হলেও। দেখা করবার আকুতিগুলো ১০৩ কিলোমিটার দূরত্বে আটকায় প্রায়ই, তবুও পাগলামুতে গা ভাসিয়ে আত্মলজ্জায় ভূগতে চাইনা কেউই।

প্রায় সাড়ে তিন মাস পর দেখা হলো, অনেকটা নিরুত্তাপ সাক্ষাৎ। ঢাকায় চাকরীর পরীক্ষা শেষে নিজেই কল করে দেখা করতে বললাম। কথা হয়েছিলো আগেই, পরীক্ষায় দুজনই আসছি। ‘শুকিয়ে গেছো যে?’ অর্থির এমন কথায় মোবাইলের স্ক্রিনটা আয়না বানিয়ে নিজেকে দেখবার চেষ্টা করি একবার। ‘কই? একই তো দেখছি।’

‘আমি বলছি যখন শুকিয়েছো, তখন শুকিয়েছোই; যুক্তি দাঁড় করাতে হবে না।’ ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনটায় রাস্তার উঁচু পাড়টায় বসেই কথোপকথন চললো। ‘বাবাকে বলেছি তোমার কথা। উনি তোমায় কখনোও ডাকলে যদি দেখা কর তবে ভালো লাগবে আমার।’ ‘চাকরি তো নেই, ঘরজামাই রাখবে নাকি? হাতটা বাড়িয়ে আবার গুটিয়ে নিলো নিজে থেকেই, হয়তো খামচি কাটতো একবার। সারাটা বিকেল দাঁড়িয়ে, বসে, হেটেই কাটলো দু’জনের। আসাদগেটে বাসে উঠবো দুজনই, একই বাসে। বগুড়ায় ওকে নামিয়ে ফিরবো নিজের বাড়ি। ‘ঘুমিয়ে গেলে ডাকবে না কিন্তু।’ ‘বাড়ি পাড় হয়ে গেলেও?’ ‘তোমার বাড়িতেই উঠবো, যা একজীবনের ইচ্ছে।’ মৃদুস্বরে হাসিটা আটলাতে চাইলাম না কেউই।

‘আর যদি কখনোও দেখা না হয়?’ কথা বলতে বলতে আমার ডানহাতটা নিজের দুহাতের মাঝে শক্ত করেই নিলো অর্থি। ‘বললে না? যদি মারা যাই তাহলে?’ ‘অন্ততঃ খামচি থেকে বাঁচতাম।’ হেসে উঠে অর্থি, অনেকটা শব্দ করেই। ‘আমার যদি নাম না জানা বড় কোন রোগ হয়, তাহলে?’ ‘জড়িয়ে ধরে সুস্থ করবো।’ ‘তাহলে আর বড় ডাক্তার থাকতো না পৃথিবীতে, কারো বড় রোগ হলে তোমার কাছেই যেত আর তুমি কথা শেষ না করতেই কাঁধটায় মাথা ঠেকায় সে, বাঁধা দিতে মন চায় না একটুও। বারবার ঘুমের কথা বললেও ঘুমালো না একটুও। নামবার কিছুটা আগে বললো-‘ফোনটায় সমস্যা হচ্ছে আজকাল। যদি দুই-তিন দিন বন্ধ পাও তবে দুশ্চিন্তা করো না।’

চলে যাওয়া বাস থেকে ওর দাঁড়িয়ে থাকাটা দেখলাম দৃষ্টির সীমানা জুড়ে। বারবার মনে হলো কি যেন বলা হলো না, কি যেন বলার ছিলো। হয়তো এমন না বলা কথাগুলোর আকুতির নাম ভালোবাসা। কথা হলো আবারও প্রতিদিনই। চাকরীর পরীক্ষায় লিখিততে টিকেছি দুজনই, অর্থিই জানিয়েছে। ঢাকা থেকে ফিরে ওর একটা কথাই বেড়েছে-‘বাবা কল দিলে দেখা করো কিন্তু।’

মৌখিক পরীক্ষার তারিখটাও জেনে গেলাম। জানাতে ফোন দিয়ে আচমকা মন খারাপ হলো। অর্থির ফোন বন্ধ।
দিনে অনেকবারই চেষ্টা করলাম, একই দশা। মনে ছিলো ফোন নষ্টের কথা, তবুও বোঝাতে পারছি না নিজেকেই। প্রতিনিয়ত বলে যাওয়া কথার সময় কখনোই মনে হয়নি কখনোও কথা না বলাটা এতটা যন্ত্রণার। দিন, দুইদিন, তিনদিন পেড়িয়ে নবম দিনেও বন্ধ বলছে অর্থির ফোন। উপযাজকতা অধিকাংশ সময় অভদ্রতার পরিচায়ক, এমন ভাবনা থেকে ওর বাবার নম্বরেও কল করতে মন সায় দিলো না।

মুখে সেভিং ক্রিম লাগিয়ে রেজার হাতে নিতেই ফোন বেজে উঠলো। অনেকটা দৌঁড়েই ফোনের কাছে পৌঁছলাম। অর্থির বাবার নম্বর থেকে। ‘সময় হলে আজ একটু দেখা করিও বাড়িতে, আমি অপেক্ষা করবো।’ কিছু বলার আগেই ফোন রেখে দিলেন উনি। ভালোলাগা, খারাপলাগা মিশিয়ে এক অস্থিরতা খেলা করছে নিজের মাঝেই। যতটা দ্রুত সম্ভব বাসস্ট্যান্ডে এগুলাম। সড়কে জীবনের নিরাপত্তা থাকুক আর না থাকুক, সামান্য বিরতী দিয়ে বাস যে পাবেন এটার নিশ্চয়তা আছে। সর্বসাকূল্যে তিন ঘন্টার পথটা যেন অনন্তকালের মনে হচ্ছে। বাসে উঠে প্রতিটা সময়ই অর্থিকে ফোন দিয়ে চললাম, ফোন বন্ধই পেলাম।

কলিংবেলটায় চাপ দিতেই দরজা খুললেন অর্থির মা। সালাম জানিয়ে উনার পিছু পিছু বসার ঘরটায় ঢুকলাম। অর্থির বাবার দেখিয়ে দেওয়া সোফাটায় বসলাম। কি বলবে? বেকারত্ব মেনে নিবে কি তাঁরা? এমন ভাবনায় মাথার ওপরটায় ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানেও মৃদু ঘাম ছুটে চললো আমার। ‘অর্থি তোমার কথা বলেছে অনেক। তোমরা খুব ভালো বন্ধু, এটাও।’ কথাগুলো বলতে বলতেই চায়ের কাপটা এগিয়ে ধরলেন ওর বাবা। কাঁপা হাতে ধরলাম।

‘জ্বি।’ ‘কতদিন হয় কথা হয় না তোমাদের?’ ‘আজ সোমবার, এই গত বৃহস্পতিবারের আগের বৃহস্পতিবার। দশ দিন।’ চা শেষ করে কাপটা রাখতেই অর্থির মা কাপগুলো নিয়ে গেলেন অন্যরুমে। এদিক-ওদিক আড়চোখে শুধু পরিচ্ছন্নতার ছাঁপ লক্ষ্য করছি আর অপেক্ষা করছি পরবর্তী কথা কি হবে। ‘বৃহস্পতিবার থেকে কথা হয় না?’

‘জ্বি।’
‘ওহ্।’

‘অর্থি বাসায় নেই?’ কথাটা শুনে পাশের ঘরের দরজায় লক্ষ্য করলেন একবার। বুঝলাম ওটাই অর্থির নতুন ঘর। ও বলেছিলো-‘আগের ঘরটায় জানালা বেশি, আলো সহ্য হয় না। তাই ঘর বদল করবো।’ ‘আজ নয়দিন হলো অর্থি মারা গেছে।’

চমকে উঠলাম কথাটায়, অবিশ্বাস থেকেই। কথাটা শেষ হতেই উনার ঢুকরে কেঁদে উঠায় অবিশ্বাসটা বিশ্বাসে রূপ নিলো। কতটা সময় ছিলাম, কি কথা হয়েছে, কিভাবে মারা গেছে, এগুলো কিছুই মনে নেই; মনে করবার ইচ্ছেও নেই কখনোই। মনে আছে ওর ঘরের দেয়ালে টানানো ফটোটা। ঢাবির ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনের সড়কের উঁচু অংশটায় বসে কখন যে ছবিটা তুলেছিলো সে, টের পাইনি একটুও।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত