কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে রবিন খেকিয়ে উঠল। সাধের ঘুম ভাংগাতে কে এই সাতসকালে জ্বালাতে এলো? রেমিকে ধাক্কা দিতেই মেয়েটা উহ করে একটা শব্দ করল।তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ল। এত ঘুম কাতুরে কেউ হয়? রেমি ওঠ কেউ এসেছে। ঘুম ঘুম চোখে রেমি মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল ১১:২০ বাজে।না সকাল পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষন।কিন্তু বুয়ার তো আজ দুপুরের পরে আসার কথা।ছুটির দিনটা রবিন কোন বিরক্ত পছন্দ করেনা।তাই সেভাবেই ওকে আসতে বলা। আমি ওয়াশরুমে গেলাম।তুমি দরজা খুলে দেখো কে এসেছে।
কথাটা বলেই রেমি ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। রবিন অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠল।দরজায় দাঁড়ানো আগুন্তকের ধৈয্য আছে বলতে হয়। এই ফ্লাটটা গত বছর রবিন কিনেছে।২২০০ স্কয়ার ফিটের ফ্লাটটা দুজনের জন্যে একটু বড়ই হয়ে যায়।তবে ফ্লাটটা রেমির পছন্দে কেনা।বিশাল ড্রয়িংরুম পেরিয়ে দরজা খুলে দেখল পুলিশের পোশাকে একজন দাঁড়িয়ে।কি চাই? রবিনের কর্কশ কন্ঠ জানান দিচ্ছে সে যথেস্ট বিরক্ত।
আমি এস.আই রায়হান সাদমান। নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে সাদমান বুঝল সামান্য ভদ্রতার ছিটেফোঁটাও এই লোকের মাঝে নেই।অপমান টা হজম করে হাতটা সরিয়ে নিল। আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। সাদমানের কথা যেন রবিনের কান পর্যন্ত ঢুকলনা। ছুটির দিনে আমি কোন কাজ পছন্দ করিনা। কেন এসেছেন যদি বলতেন? সাদমান বুঝতে পারল লোকটা সম্পর্কে যা শুনেছে তার একবিন্দুও মিথ্যে না।মিনিট দুয়েক হল সে দরজায় দাঁড়িয়ে। অথচ একবার ও বসতে বলার প্রয়োজন টুকুও বোধ করেনি।
আপনাদের এপার্টমেন্টের ডি ব্লকের মিঃ হাসানকে ত চেনেন নিশ্চয়? গতরাতে উনার মিসেস আত্মহত্যা করেছেন।আমি যতটুকু জানি আপনার স্ত্রীর সাথে উনার সখ্যতা ছিল।আমি এ ব্যাপারে উনার সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি। এলকোহলের নেশাটা এতক্ষনে কাটতে শুরু করেছে রবিনের। আপনি বসুন।আসলে ছুটির দিনে বাড়িতে কাজের লোক থাকেনা।তাই চা,কফি কিছুই খাওয়াতে পারবনা। রবিনের আচমকা পরিবর্তন টা হজম করতে কষ্ট হল সাদমানের।যদিও পুলিশদের সব রকম পরিস্থিতিতেই মানিয়ে নিতে হয়। না না ঠিক আছে।আপনি বরং আপনার মিসেসকে ডাকেন।আমি বেশি সময় নেবনা।
রেমিকে ডাকতে যেতে হলনা।সে তখনি এসে হাজির হল।এত অল্প সময়ে মেয়েটা রাতের পোশাক ছেড়ে শাড়ি পরে ফেলেছে।এমনকি সাজগোজের ও কমতি নেই।মেয়েটার অনেক গুনের মধ্যে এটা রবিনকে মুগ্ধ করে।চটজলদি নিজেকে পরিবর্তন করতে পারে। রেমি এখানে এসে বস।এস.আই তোমার সাথে কথা বলবে। রেমি রবিনের পাশে যেয়ে বসল। কোন খারাপ খবর রবিন? আমি দুঃখিত ম্যাম এই সকালে আপনাকে একটা খারাপ খবর দিতে হচ্ছে।মিসেস হাসান গতরাতে সুইসাইড করেছেন। সাদমানের কথা শেষ হতেই রেমি মাথা ঘুরে রবিনের গায়ের উপর পরল।রবিন স্ত্রীকে জরিয়ে সমবেদনা জানাচ্ছে।
সাদমান রবিনকে দেখে আবারো অবাক হল।এই লোকটা তো ক্ষনে ক্ষনে নিজের চরিত্র বদলায়। দেখুন , আমার মিসেস অসুস্থ বোধ করছে।আসলে মিসেস হাসানের সাথে ওর ভাল বন্ধুত্ব ছিল।ওরা একসাথে অনেক ভাল সময় কাটিয়েছে।তাই হয়ত এই শক টা ও নিতে পারছেনা।আপনি বরং অন্য কোনদিন আসুন।আর আসার আগে অবশ্যই কন্টাক্ট করে আসবেন। সাদমান যেতে যেতে পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে রবিনের হাতে দিল। ম্যাম সুস্থ হলে আমাকে একটু নক করবেন। নিতান্ত তাচ্ছিল্যের সাথে রবিন কার্ডটা নিল।
মিসেস হাসানের মৃত্যুটা রহস্যে ঘেরা।ভদ্রমহিলার আত্মহত্যা করার কোন কারন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।যথেষ্ট হাসিখুশি একজন মানুষ।হাসবেন্ডের সাথেও খারাপ সম্পর্ক ছিলনা।তার কেস স্ট্যাডি করে তাকে একজন সুখি মানুষ বলেই মনে হয়েছে।তবে তার বাবার অভিযোগ তাকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়েছে।তিনি একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ।এই কেসের দায়িত্ব এখন স্পেশাল ব্রাঞ্চ নিয়েছে।তবুও সাদমানের মাথা থেকে কিছুতেই এটা যাচ্ছেনা।অবশ্য সেটা শুধুমাত্র মিসেস হাসানের জন্যেও না।ভাবনার মধ্যে ছেদ পরল মোবাইলের কর্কশ রিংটোনে। হ্যালে এস. আই আয়মান সাদমান বলছি।
আমি রেমি।তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।আমি শুক্রবার বিকেল ৫ টায় রোদেলা কফি সপে অপেক্ষা করব।
উত্তরের অপেক্ষা না করেই রেমি কলটা কেটে দিল। সেদিন রবিন সাহেবের বাসায় যেয়ে রেমিকে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল সাদমান।এত বছরে রেমির কোন খবর না পেয়ে ভেবেই নিয়েছিল ওর সাথে হয়ত আর কখনো দেখা হবেনা।রেমিকে সেদিন একদম অন্যরকম লাগছিল।কড়া মেকাপ আর দামি শাড়িতে ওকে ভীষণ অচেনা লাগছিল।অবশ্য যেদিন রেমি ওর বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল সেদিন ও ওকে ভীষণ অচেনা মনে হয়েছিল।রেমির কথা ভাবতে গিয়ে অতীতে চলে গেল সাদমান।
রাশেদের অনুরোধে তার ছাত্রীকে পড়াতে এসে সাদমান খুবই বিব্রত বোধ করছিল।বরাবরই সে মেয়েদের এড়িয়ে চলে।আর তাকেই কিনা বন্ধু এভাবে ফাঁসিয়ে দিল? বড়লোকের মেয়েদের এমনিতেই সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। এদের ন্যাকামির ও শেষ থাকেনা।আর সবচেয়ে বড় কথা এরা পড়াশুনায় প্রচুর ফাঁকিবাজ হয়।কিন্তু রেমিকে পড়াতে এসে ঠিক তার বিপরীতটাই ঘটল।মেয়েটা পড়ালেখা ছাড়া কিছুই বোঝেনা।দুইমাস পড়ানোর পর ওর বন্ধু ফিরে এলো।এই দুই মাসে সাদমান একবার ও ভালো করে রেমিকে দেখেনি।শেষ দিন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ও নিজেকে হারিয়ে ফেলল।মেয়েটার চোখে কি জানি আছে।কেমন আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল ওকে।যদিও এসবের কিছুই রেমি জানতনা।
এর মাস খানেক পরে হঠাৎ একদিন একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে। কলটা রিসিভ করে সাদমান খুব অবাক হয়। রেমি রাশেদের কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে ওকে কল করেছে।২ দিন পর ওর জন্মদিন।আর সাদমানকে নাকি যেতেই হবে। রেমির কল পেয়ে সাদমান ভীষণ এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছিল।সেই সাথে চিন্তায় পরল রেমিকে কি উপহার দেবে সেটা ভেবে।অনেক ভেবে ওর পছন্দের লেখকের দুটো বই নিয়ে গেল।সমরেশ মজুমদারের গর্ভধারিণী আর হুমায়ুন আহমেদের মেঘ বলেছে যাব যাব।জন্মদিনে রেমিকে পরীর মত সুন্দর লাগছিল।সাদমান যেন নিজের চোখ সরাতেই পারছিলনা।
এরপর থেকে মাঝে মাঝেই রেমির সাথে সাদমানের কথা হত।কখনো কখনো রেমি আচমকা কল করে দেখা করার কথা বলত।সাদমান ও কিছু না ভেবেই ছুটে যেত।যদিও রেমির মনে কি চলছিল তা বুঝতনা।এমনি একদিন রেমি কল করে ২০ মিনিটের মধ্যে ওকে দেখা করতে বলল।সাদমান ও দৌড়াতে দৌড়াতে গেল।সাদমান পৌঁছাতেই রেমি আচমকা ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পরল।সাদমান কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই ও সাদমানের বুকে এলোপাথাড়ি কিল ঘুসি মারতে থাকল। আপনি কেমন পুরুষ?এতদিনেও একটা মেয়ের মনের কথা বোঝেননা।আর নিজের মনের কথাও বলতে পারেননা।আমি আপনাকে ছাড়া বাঁচবনা।বলেন আমাকে ছেড়ে কখনো যাবেননা? রেমির আচমকা এসব কথায় সাদমান বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।অথচ এরকম একটা স্বপ্ন সে কতদিন দেখেছে।আজ সেটা বাস্তবে ঘটছে।কিন্তু ওর কি করা উচিত তা যেন বুঝতেই পারছেনা।
৫ বছর চুটিয়ে প্রেম করেছে দুইজন।এর মধ্যে সাদমানের লেখাপড়া শেষ।ও একটা প্রায়ভেট কোম্পানিতে জব করছে।সেই সাথে বি. সি. এস এর জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে।রেমি এবার অনার্স ফাইনাল দিল।অফিস থেকে বেড়িয়েই দেখে রেমি দাঁড়িয়ে। মেয়েটার মুখটা আজ কেমন মলিন।রেমির মুখে হাসি না দেখলে সাদমান যেন পাগল হয়ে যায়।
কি হয়েছে তোমার? সাদমান আজ আমাকে বিয়ে করবে? তুমি ত জানো আমি বি. সি. এসের জন্যে কত চেস্টা করছি।ওটা হয়ে গেলেই তোমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব। ততদিনে আমি ২ ছেলেমেয়ের মা হয়ে যাব।বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।ছেলে অস্ট্রেলিয়া থাকে।আগামি শুক্রবার বিয়ে।আজ যদি আমাকে বিয়ে না কর তাহলে আর কোনদিন আমার মুখ দেখবেনা।রেমির চোখদুটো ছলছল করছে। সাদমান যেন কিছুই বুঝতে পারছিলনা।কিন্তু কোনকিছুর বিনিময়ে ও রেমিকে হারাতে পারবেনা।
কাজী অফিসে যেয়ে ওদের বিয়েটা হয়ে গেল।সাদমান খুব ভয়ে ভয়ে রেমিকে ওদের বাড়িতে নিয়ে গেল।না জানি মা কি বলে?বাবা মারা যাওয়ার পর ওর মা ওদের ২ ভাইকে মানুষ করেছে।বড় ভাইয়াকে নিজের পছন্দে বিয়ে করিয়েছে।কিন্তু ভাবির সাথে মায়ের বনিবনা হয়না।রেমিকে দেখে সাহানা বেগম কোন কথায় বললেননা।তবে কিছুক্ষন পর আলমারি খুলে একাটা সোনার চেইন এনে রেমিকে পরিয়ে দিলেন।সাদমানকে খুব রাগারাগিও করলেন এভাবে ঘরে বউ আনার জন্যে। রেমিকে যতই ভালবাসুক সাদমানের মনে একটা ভয় ছিল।ধনীর দুলালী রেমি হয়ত এই মধ্যবিত্ত পরিবারে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেনা।কিন্তু সাদমানের সব ধারনাকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে রেমি খুব গুছিয়ে সংসার করছিল।সাদমান বুঝতে পারত গরমে মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে।এত ছোট ঘরে থাকতে ওর অস্বস্তি হচ্ছে।তবুও কখনো মুখ ফুটে একটা কথাও বলেনি।এই পরিবারে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার সেকি প্রানান্তকর চেস্টা।
হঠাৎ কি যে হল মেয়েটার?হুট করে কেমন অস্বাভাবিক আচরণ। যেন জোর করে ওকে কেউ আটকে রেখেছে।মায়ের সাথে ঠিকমত কথা বলেনা।সাদমানের সাথেও খারাপ ব্যবহার করে।একদিন রাগের বশে মেয়েটার গায়ে হাত দিয়েছিল ও।সারারাত মেয়েটা কেঁদেছিল। পরদিন অফিস থেকে ফেরার সময় সাদমান রেমির জন্যে একটা শাড়ি আর একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে বাড়ি ফেরে।বসার ঘরে রেমির বাবাকে দেখে খুব অবাক হয়।নিজেদের ঘরে গিয়ে দেখে রেমি কাপর চোপর গুছিয়ে তৈরি হয়ে আছে।সাদমান অনেক অনুনয় বিনয় করেও সেদিন রেমিকে ফেরাতে পারেনি।এরপর কতভাবে রেমির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে।কিন্তু প্রতিবারই নিষ্ফল হয়েছে। আজ বাড়িতে ফিরে সাদমানের খুব ক্লান্ত লাগছে।প্রতিদিন সাদমানের আগমন বার্তা পেয়ে ছেলে মেয়ে দুটো দৌড়ে আসে।আজ কারো কোন সাড়া শব্দ নেই।ঘরে ঢুকতেই ও বড়সড় ধাক্কা খেল।ওদের ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো।যদিও এসব কিছুতে ওর আগ্রহ নেই।মনটা খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় বসতেই নীরা কোথা থেকে উড়ে এলো।এসেই সাদমানকে জরিয়ে ধরল।
আমি জানতাম তুমি আজকের দিনটার কথা ভুলে যাবে। সাদমানের মাথায় এসব কিছু ঢুকছিলনা।গাড়িয়ে উঠে একটা ঘুমের ওষুধ খেয়েছে।এতক্ষনে ওষুধ ক্রিয়া করতে শুরু করেছে।নীরা নিজের মত বকবক করেই যাচ্ছে। বিয়ের পর ত আমরা একটা বিবাহ বার্ষিকী ও নিজেদের মত করে কাটাতে পারিনি।দুই ছেলে মেয়ে এত তাড়াতাড়ি এলো যে ওদের নিয়েই সারাক্ষন ব্যস্ত থেকেছি।তুমি ত কখনো আমাকে নিজের মত করে পাওনি।আজ মা এসে রুপ আর রিতাকে নিয়ে গেছে।আজকের রাতটা শুধু আমরা দুজনই কাটাব।
সাদমান তাকিয়ে দেখল নীরা আজ খুব সুন্দর করে সেজেছে।আচ্ছা রেমি বেশি সুন্দর নাকি নীরা? নীরা ভীষণ ভাল একটা মেয়ে।বিয়ের পর থেকে কখনো কোন বিষয়ে সাদমানকে অভিযোগ করেনি।সাদমানের এত ব্যস্ততা, ছেলেমেয়েদের সময় না দেয়ে সত্ত্বেও নীরা কত সুন্দর করে সংসারটা সামলাচ্ছে।বরং উল্টো নিজেই সতর্ক থাকে সাদমান যেন কোন কারনে বিরক্ত না হয়। সাদমান নীরার দিকে তাকাল।মেয়েটাকে দেখে আজ মাতাল মাতাল লাগছে।ওর হরিণী চোখে হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে।নীরা ওর অনেক কাছে এসে বসল।ওর শরীর থেকে অদ্ভুত একটা গন্ধ আসছে।সেই গন্ধে কেমন জানি নেশা ধরে যাচ্ছে।সাদমান হাতটা বাড়াল নীরার দিকে।কিন্তু হাতটা ওর কাছে পৌঁছলনা।তার আগেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ও।
রেমির চোখে আজ ঘুম নেই।বারবার ওর মন শুধু অতীতে ফিরে যাচ্ছে।সাদমানের জন্যে কত পাগলামিই না করেছিল তখন।বাবার প্রাচুর্যকে ফেলে মধ্যবিত্ত সাদমানের হাত ধরে চলে গিয়েছিল।মা আর সাদমানকে নিয়ে ছোট্ট একটা সুখের নীড় গড়েছিল ও।খুব বেশি ভালবেসেছিল ওই সংসারটাকে।বিয়ের পর ও সাদমানের সাথে দুষ্টুমি করত সব সময়।সাদমান ওর সব আবদার হাসি মুখে মেনে নিত।হঠাৎ এলো সেই খুশির খবর।রেমি মা হতে চলেছে।সাদমান যেন এই খবরে দিশেহারা হয়ে গেল।কেউ যে তার অনাগত সন্তানকে নিয়ে এতটা স্বপ্ন দেখতে পারে সেটা সাদমানকে না দেখলে কখনো জানা হতনা।রেমির বাবাও সব অভিমান ভুলে মেয়ের কাছে ছুটে এলো।সবকিছু যখন ঠিকঠাক ঠিক তখনি একদিন ওয়াশরুমে পা পিছলে পরে গেল রেমি।ব্যস সব সাজানো স্বপ্ন ভেংগে খানজান হয়ে গেল। সেই সময় ও কিছুদিন বাবার বাড়িতে ছিল।
সাদমান নিয়মিত আসত।ওর সাথে সময় কাটাত,ওকে স্বান্তনা দিত।রেমিও ভেবেছিল সব ঠিক হয়ে যাবে।দ্বিতীয়বার কন্সিভ করলে এই কষ্ট আর থাকবেনা। কিন্তু হঠাৎ এক নির্মম সত্য এসে ওর জীবন টাকে এলোমেলো করে দিল।সাদমানকে ছেড়ে আসতে ভীষণ কষ্ট হয়েছিল।ভালবাসার মানুষকে ছাড়া বেঁচে থাকা হয়ত কষ্টের।কিন্তু ভালবাসার মানুষের করুনা নিয়ে বেঁচে থাকা যে মৃত্যুর সমান। এসব ভাবতে ভাবতে কখন চোখের কোনবেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরল।রবিন তখনি রেমিকে জরিয়ে ধরল। আবোল তাবোল বলতে বলতে রেমিকে জরিয়ে ধরেই ঘুমিয়ে পরল। সাধারনত ছুটির দিনটা সাদমান বাড়িতে থাকে।বাচ্চা দুটো সারা সপ্তাহ ওকে পায় না।এই একটা দিন তাই ওরা বাবার পিছনে আঠার মত লেগে থাকে।আজকে বেড়তে দেখলে নির্ঘাত একটা অঘটন ঘটাত।ভাগ্য ভাল কিছুক্ষন আগে ওরা ঘুমিয়েছে। সাদমানকে তৈরি হতে দেখে নীরা ওর পাশে এসে দাঁড়ায়।
তুমি কি বাইরে যাচ্ছ? হ্যাঁ একটু কাজ আছে। অন্য সময় হলে নীরা ছেলেমানুষি করত।কিছুতেই সাদমানকে যেতে দিতনা।কিন্তু সেই রাতের পর মেয়েটা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে।আগের মত কারনে অকারনে ওকে কল করেনা।এমনকি বাড়িতে ফিরলেও বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে।কি হয়েছিল সে রাতে? সামান্য মদ্যপান করেছিল ও।সেই সাথে ঘুমের ওষুধ। ঘুমের মধ্যে কি উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলেছিল?
একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে? নীরার কথায় ওর দিকে তাকায় সাদমান। মা আজ রাতে ও বাড়িতে খেতে বলেছিল।তুমি কি যেতে পারবে? নিশ্চয় যাব।তোমরা তৈরি হয়ে থেক।আমি এলে সবাই একসাথে যাব।নীরার গালে আলতো ছোঁয়া দিয়ে সাদমান চলে যাচ্ছিল। বাচ্চারা উঠলেই আমরা চলে যাব।তুমি বরং সরাসরি ও বাড়িতে চলে যেও। নীরার মুখটা কেমন থমথমে। সাদমান ওর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে হাটা শুরু করল।
রেস্টুরেন্টের দরজায় পৌঁছে সাদমান ঘড়িতে দেখল ৪:৫০ বাজে।কি করবে ভেবে না পেয়ে ভিতরে গিয়ে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল।রেস্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকে ও বেশ অবাক হল।রেস্টুরেন্টে কোন মানুষ নেই।একেবারে শেষ মাথায় রেমি বসে আছে।এখন সাদমানের ভীষণ নার্ভাস লাগছে।এত বছর পর রেমিকে এতো কাছ থেকে দেখে কেমন জানি লাগছে। সাদমানকে দেখে রেমির মুখে হাসি ফুটে উঠল।দুজনে মুখোমুখি বসে আছে কারো মুখে কথা নেই।যেন কি বলবে সেটাই কেউ বুঝতে পারছেনা।কেন করলে আমার সাথে এমন?কি দোষ ছিল আমার? হঠাৎ সাদমানের কথায় চমকে ওঠে রেমি।
তোমার কোন দোষ ছিলনা।আমিই তোমার অযোগ্য ছিলাম। ভনিতা করোনা রেমি।সত্যটা জানার জন্যে এতগুলো বছর ধরে আমি অপেক্ষা করছি। রেমির চোখ ছলছল করছে।কিন্তু আজ যে সবকিছু বলার সময় এসে গেছে। আমি একটা অসম্পূর্ণ মানুষ সাদমান।মা হওয়ার কোন ক্ষমতাই আমার নেই। রেমির কথা যেন সাদমানের কান পর্যন্ত পৌছলনা।রেমি যে এররকম কোন কথা বলতে পারে তা সাদমান কল্পনাও করতে পারেনি।ও ভেবেছিল হয়ত বাবার চাপে রেমি এটা করতে বাধ্য হয়েছিল। সন্তান ছাড়া কি মানুষ বাঁচেনা?
তা হয়ত বাঁচে। কিন্তু সে জীবনটা যে অসম্পূর্ণ থাকে। এখন কি আমাদের জীবন সম্পূর্ণ?প্রতিটা জীবনই অসম্পূর্ণ রেমি।আমরা কেউই পুরোপুরি সুখি না। আমি খুব ভাল আছি সাদমান।আমি জানি তুমিও ভাল আছ। সাদমান আর কথা বাড়ালনা।রেমি হয়ত ওর বর্তমান জীবন নিয়ে সুখেই আছে।ওর এই জীবনে সাদমান হয়ত শুধুই স্মৃতি। দুজনে বেশ কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকল।তারপর রেমি উঠল। আমাকে যেতে হবে।রবিনের ফিরে আসার সময় হয়ে গেছে সাদমানের মনে পড়ল নীরাকে নিয়ে ওর বাবার বাড়ি যেতে হবে। চল যাওয়া যাক।
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই রেমি সাদমানের হাতটা ধরল। সাদমান খুব অবাক হল। জানো সাদমান প্রকৃতি আমাদের থেকে যতটা কেড়ে নেয়।তারচেয়েও বেশি দেয়।যা হারিয়েছ তাকে না ভেবে যা পেয়েছ তাকে আগলে রাখ।ভালবাসা অমূল্য সম্পদ।সবার ভাগ্যে তা জোটেনা।আবার অনেকে যেচে আসা ভালবাসাকে যত্নের অভাবে হারিয়ে ফেলে।তোমার ভালবাসাকে হারিয়ে যেতে দিওনা।প্রতিদিন তার যত্ন নিও।তাকে ভালবেস হৃদয়ের গভীর থেকে।মস্তিষ্ক থেকে যে উন্মাদনা আসে সেটা সাময়িক।তাই সেটা ভালবাসা না।হৃদয়ের উন্মাদনা তো এক জীবনেও শেষ হয়না।হৃদয়ের সেই উন্মাদনাকে কখনো মরতে দিওনা।
রেমি চলে যাচ্ছে।বাতাসে ওর শাড়ির আচল উড়ছে।সাদমানের হঠাত মনে পরল রেমি যেদিন ওর বাড়ি থেকে চলে আসে সেদিন এই শাড়িটাই ও কিনে এনেছিল।মেয়েটা এতদিন শাড়িটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল।সাদমানের চোখ দুটো ছলছল করে উঠল।ঠিক তখনি রেমির গাড়িটা শা শা শব্দে ওকে পাশ কাটিয়ে সামনে চলে গেল। নীরার জন্যে একটা শাড়ি নিয়ে সাদমান বাড়ি ফিরল।মেয়েটা হয়ত এতক্ষনে অভিমানে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। কলিংবেল দিতে নীরা দৌড়ে দরজা খুলল। ওমা তুমি তো দেখি এখনো তৈরি হওনি। ভাবছিলাম তুমি যদি না আস।তাই বাচ্চাদের পাঠিয়ে দিয়েছি। এটা নাও আর তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে এস। নীরা শাড়ির প্যাকেটটা নিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেল।
কি এত ভাবছ? নীরার কথায় সাদমানের সম্বিত ফেরে। নীরা খুব সুন্দর করে সেজেছে।তুমি সব সময় এভাবে সেজেগুজে থাকবে।তোমাকে এভাবে দেখলে কেমন পাগল পাগল লাগে। নীরা যেন লজ্জা পেল। ধুর কিযে বলনা।চল দেরি হয়ে যাচ্ছে। আজ আমরা কোথাও যাচ্ছিনা নীরা।বিবাহ বার্ষিকীর রাতটা তোমাকে ফেরত দেব।আজকের রাতটা শুধু আমাদের দুজনের। তোমার কি হয়েছে বল তো?নেশা টেশা করনি তো? ভালবাসার চাইতে ভয়ংকর নেশা আর হয় নাকি? আমি সেই নেশাতেই বুদ হয়ে আছি।
নীরার চোখে স্পষ্ট সংশয়। এ কোন সাদমানকে দেখছে ও? আমি তোমার কোন কথায় বুঝতে পারছিনা।কিন্তু রাতের জন্যে কিছুই রান্না করিনি।শুধু ভালবেসে যদি পেট ভরে তাহলে আমার থাকতে আপত্তি নেই। শুধু ভালবেসেই হাজার বছর বেঁচে থাকা যায়।তুমি কিছুই বোঝনা মেয়ে। সাদমান নীরাকে ওর বুকের কাছে টেনে আনল।নীরা সাদমানের বুকের মাঝে লেপ্টে থাকল।ভালবাসা প্রকাশের জন্যে কোন ভাষার প্রয়োজন হয়না।ভালবাসার নিজস্ব একটা ভাষা আছে।নীরা ঠিকই সেটা বুঝতে পেরেছে।