মৌমিতা রহমান আজ দশম শ্রেণীর গণিত ক্লাস নিতে এসেছে । বয়েজ স্কুলের এই নবম / দশম শ্রেণীর ছেলেগুলো ভীষণ ইঁচড়ে পাকা হয় ; ম্যাডাম বলে ও নিস্তার নেই । নানান ধরনের টোন করে ছেলেরা । মৌমিতা কিছুটা অসস্থি বোধ করে । যদিও ক্লাসটা তার নয় ; দশম শ্রেণীর ক্লাস টিচার বাকের স্যারের প্রক্সি দিতে এসেছে ।
বছরের শুরুতেই টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষকরা তাদের প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে বিভিন্ন স্কুলে পাঠদান করে থাকেন তিন মাস । মৌমিতা তাদেরই একজন । আর এ সময় ছাত্ররাও ওদের সংগ ভালোবাসে কারণ শীতের পাখির মতো এই ট্রেনিংরত টিচাররা কখনো ওদের শাস্তি দেন না , যা কিনা স্কুলের চিরাচরিত নিয়মের বাইরে পড়ে ।। এই সময়ে স্কুলের রেগুলার শিক্ষকরা নানান বাহানায় ওদের উপর ক্লাসগুলো চাপিয়ে দিয়ে অলস সময় কাটাতে পছন্দ করেন । মৌমিতার অবশ্য খারাপ লাগে না , আজন্ম লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য অত্যন্ত ভালো রেজাল্ট থাকা সত্বেও শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে ও নিজেই বেছে নিয়েছে । যেখানে লোভনীয় সব চাকরির হাতছানি ছিল ।।
ছেলে গুলো মৌমিতার দিকে এক দৃষ্টিতে হা করে তাকিয়ে থাকে ,আর মাঝে মাঝে নানাবিধ প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছিল । সে ও কম যায় না ; প্রতিটা প্রশ্নের সঠিক জবাব দিয়ে পাশ মার্ক পেয়ে উতরে গেল । ক্লাস শেষে মৌমিতা ছাত্রদের কাছে জানতে চাইল : কে , কি করতে চাও বড় হয়ে ? সবাই মোটামুটি ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশের সেবা করার কথা জানালো । দ্বিতীয় বেঞ্চের বাম পাশে বসা নিলয় এতক্ষণ অন্য সবার চেয়ে একটু আলাদা রকম বেশীই , বিস্ময় ভরা চোখে ম্যাডামকে দেখছিল ।
এত্ত সুন্দর হয় নাকি মানুষ !! ও শুনেছে , সুন্দরী মেয়েরা নাকি বোকা সোকা বেকুব টাইপের হয় !! তারা রুপচর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে পারে না ; এতো পুরাই উল্টা !! যেমন রূপবতী , তেমনি গুণবতী !! দুটোর সমন্বয় খুব একটা দেখা যায় না । তাও আবার অংকের মতো একটা নিরস , বাজে বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছে । নিলয় দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে বলে : আমি ম্যাথ নিয়ে পড়তে চাই । শুনে পুরো ক্লাস হো হো করে হাসতে লাগলো । একজন উঠে বললো : ম্যাডাম , ও তো অংক ক্লাস করতেই চায় না , ৩৬ , ৪২ এর বেশি নম্বর কখনোই পায় না । আঙ্কেল প্রিন্সিপাল স্যারকে বলে কয়ে সায়েন্স পাইয়ে দিয়েছে ; ও নাকি পড়বে ম্যাথথথ!!
লজ্জায় মাথাটা নুইয়ে পড়ে নিলয়ের । মৌমিতা সবার উদ্দেশ্যে বলে : কে কি হবে কেউ বলতে পারে না ; Practice makes a man perfect. মেধা একটা চর্চার বিষয় ; চর্চা না থাকলে তাতে মরিচা ধরে । ১০০ নম্বর পাওয়া ছাত্রও ১০ নম্বর পেতে পারে । তারপর হাত দিয়ে নিলয়ের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলে : একদিন আমাদের নিলয় আইনস্টাইন হবে ।। এই প্রথম কোনও নারী স্পর্শে ওর শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল ; অন্য রকম এক ভালো লাগার শিহরণ অনুভব করলো নিলয় যা আগে কখনো ওর হৃদয়ে দোলা দেয়নি। নিজের হাতটা চুলে ( মৌমিতার হাত রাখা মাথায় ) বুলিয়ে অস্ফুট স্বরে নিলয় বলে : আপনি খুব সুন্দর ম্যাডাম।। সবাইকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৌমিতা ক্লাসের চঞ্চলতা ফিরিয়ে আনার জন্য গম্ভীর স্বরে বলে : হুম , আমি জানি ।
মৌমিতা আসলেই ভয়ন্কর সুন্দর । এসব কথা ওকে হরহামেশাই শুনতে হয় ; তাই বলে কিশোর ছেলেগুলোকে তো আর প্রশ্রয় দেয়া যায় না । তবে নাকের ওপর চশমাটা তার চেহারায় একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব এনে দিয়েছে , যা ওকে অন্যদের দৃষ্টিতে একটু রাশভারী করে তুলতে সাহায্য করে ।
সদ্য কৈশর অতিক্রম কালে এই ছেলেগুলো অদ্ভুত সব আচরণ করে । এদের বোঝা বড়ই দুষ্কর ; ভীষণ আবেগ প্রবণ হয় । হয় জেদি ; হুটহাট করে সিদ্ধান্ত নিতে যেয়ে অনেক সময়ে মারাত্মক ভুল করে ফেলে । আবেগ আর স্বপ্নের মিশেলে মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় । বয়সের এ দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে খুব কম সংখ্যক ছেলেই আছে যে , পাড়ার আপু বা স্কুলের শিক্ষিকার প্রেমে পড়েনি ; নিলয়ের বেলায় ও অনেকটা তাই হলো ।।
সারাদিন মাঠে ছুটে বেড়ানো , স্কুল পালানো দুরন্ত ছেলেটা কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিল । ম্যাথ ছাড়া এখন সে কিছুই বোঝে না । আন্তঃস্কুল ফুটবল প্রতিযোগীতায় হ্যাটট্রিক করা ছেলেটা , কারণে অকারণে এখন টিচার্স রুমে যায় । কখনো ডাস্টার আনতে বা কখনো চক আনতে । মাঝে মাঝেই মৌমিতা মিসের কাছে যেয়ে বলে : ম্যাডাম , কেন যেন অংকটা মিলছে না । মৌমিতা বুঝিয়ে দিয়ে বলতো : সূত্র গুলো ঠিক মতো ইউটিলাইজ করলে হিসেব না মিলে উপায় আছে ? প্রায়ই টিফিন পিরিয়ডে ঝালমুড়ি , বুট বা ঝাল লবণ মাখানো শশা দিয়ে আসার ছলে এক ঝলক মৌমিতাকে দেখে আসতো নিলয় কি এক অমোঘ আকর্ষণে ।
স্কুলের বাউন্ডারির পাশেই টি . টি.কলেজের হোস্টেল। ছুটির পর কখনো জুতার ফিতা লাগানোর অজুহাতে কিংবা ক্লাসে বই ফেলে আসার বাহানায় , ইচ্ছে করে বন্ধুহীন হয়ে একাই বের হতো নিলয় । মৌমিতার সাথে হোস্টেল পর্যন্ত আরো কিছুটা সময় সন্গ পাবার উদ্দেশ্যে !! বন্ধুরা ওকে ” রহিম রূপবাণ ” বলে ক্ষেপাতো । মৌমিতাকে দেখলেও দূর থেকে ” নিলয় ” বলে টোন করতো । অপ্রস্তুত মৌমিতা সেটা আংশিক আঁচ করতে পেরে , সব সময়ই অন্য শিক্ষকদের সাথে আসা যাওয়া করতো বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে ।
ষষ্ঠ শ্রেণীর নবীন বরণ অনুষ্ঠানে মৌমিতা ওর খুব প্রিয় একটা রবীন্দ্রসংগীত গাইল আমি কান পেতে রই ও আমার আপন হৃদয়গহন দ্বারেবারে বারেকোন গোপনবাসীর কান্না হাসির গোপন কথা শুনিবারে বারে বারে সে সুর নিলয়কে প্রেমের জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।সে ও কান পেতে থাকে কিছু শুনবার অথবা শুনাবার। কিন্তু ভাবনা আর বাস্তব রূপায়নের মধ্যে যে আকাশ পাতাল ফারাক !! কোনো এক বিকেলে নিলয়ের বন্ধুরা ওর বাসায় যেয়ে দেখে মাইকেল জ্যাকসন , ম্যাডোনা , বনিয়েমের ভক্ত নিলয় রবীন্দ্র সংগীতে বিভোর , মগ্ন হয়ে ডেকসেটে গান শুনছে আমি কান পেতে রই কারো মধ্যে আর কোনো দ্বিধা বা সন্দেহ রইলো না যে , নিলয় মৌমিতা নামের জালে আটকে গেছে ।
ঘরের মধ্যে একটা উত্তেজনাপূর্ণ চাপা হাসি ক্রমশ সংক্রমিত হতে লাগলো ইংরেজি শিক্ষককে ডাকতে যেয়ে , একদিন টিচার্সরুমে নিলয় খুব লাজুক হাসিতে মৌমিতাকে তার হবু বরের সাথে সবাই কে পরিচয় করিয়ে দিতে দেখে । নিলয়ের পা দুটো যেন ক্রমশ ভারী হয়ে যাচ্ছিল ; বোধশক্তি হারিয়ে ফেলছিল । টিচার্সরুমে আসার কারণ মাথা থেকে উড়ে যায় । মৌমিতার সাথে চোখাচোখি হতেই কি এক অভিমানে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় তিনদিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকে । তবে বন্ধুরা বলাবলি করছিল ভীষন রকম নাকি জ্বর বঁধিয়ে বসেছিল নিলয় !! আজ মৌমিতারা সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে । ওদের বেঁধে দেওয়া সময় শেষ । ক্লাসে কোথাও মৌমিতার খুঁজে ফেরা চোখ দুটো নিলয়কে দেখতে পায় না । ক্লাস থেকে বের হয়ে বারান্দার শেষ প্রান্তে ওকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে যেয়ে বিদায় নিয়ে মৌমিতা বলে : তুমি অনেক ভালো আর মেধাবী ছেলে । মাথা ঠান্ডা রেখে মন দিয়ে অংক করবে কেমন ।
চোখের কোনে জল নিয়ে নিলয় , পিছনে লুকিয়ে রাখা দশটি টকটকে লাল গোলাপের কলির তোড়াসহ একটা প্যাকেট হাতে দিয়ে ভীষন আবেগে , সজোরে চেপে ধরে মৌমিতার হাত দুটো । কিছু বলা হয় না এক ছুটে স্কুল কম্পাউন্ড পেরিয়ে যায় । পিছন ফিরে আর তাকায় না নিলয় । মৌমিতা প্যাকেট খুলে তাতে পুরুষ কন্ঠের ছয়টি রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্যাসেট দেখতে পায় ; সাথে একটা চিরকুটে লেখা আপনি আমার অংকের টিচার হবেন , শুধু আমার একার ? কেন যেন মৌমিতার গলাটা ধরে আসে ; বিড়বিড় করে আপনমনে বোকা ছেলে একটা !!!
অনেক বছর পর মৌমিতার ছোট ছেলে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ গ্রহণের জন্য সিলেক্টেড হয়েছে ; রাশিয়া যাবে । সকাল ন’টার মধ্যেই একাডেমীতে পৌঁছাতে হবে । ” ইন্টারন্যাশনাল ম্যাথ অলিম্পিয়াড” এর ডিরেক্টরের কাছে বাচ্চাদের হ্যাণ্ডওভার করতে হবে ; বাকীটা ওদের দায়িত্ব । ঢাকা শহরে জ্যামের যে অবস্থা !! তাই খুব সকালেই ওরা বাসা থেকে বের হয় ভালো ঘুম হয়নি । সারারাতই প্রায় ছেলের জন্য গোছগাছ করতেই কেটে গেছে । মৌমিতা গাড়ি থেকে নেমে একাডেমীর গেটে অপেক্ষমান ডিরেক্টর সাহেবকে দেখে বেশ অবাক হয়ে যায় । এতদিন ওর বাবাই ছেলেকে আনা নেওয়া করতো । মৌমিতা এলেও এই ভদ্রলোকের সাথে কখনো দেখা হয়নি । আস্তে আস্তে এগিয়ে যেয়ে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে : কেমন আছো নিলয় ? বাহ! নিরস অংকটাকেই তবে বেছে নিলে !!
বহু বছর পর নিলয় তার একদা হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের মানসকন্যা , প্রথম ভালো লাগাকে সৌভাগ্যবশে , এতো কাছে দেখে কিছুটা সময় নির্বাক হয়ে যায়। নিশ্চুপ নিলয় নিজের সাথে নিজে কথা বলে : সূত্রের সাথে সূত্রের গাঁথুনিতে অংকের হিসাব মিলেছে ঠিকই কিন্তু জীবনের হিসাব কেন মিললো না ম্যাডাম ? পাল্টা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে নিরবতা ভেঙে নিলয় বলে : অংকের ভিতটা সযত্নে মগজে এমন ভাবে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন ম্যাডাম , ওখান থেকে আর বেরুনো আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি ।