এসএসসিতে অংক পরীক্ষা দিয়ে বের হয়েছি। বাবা গেইটের বাইরে দাঁড়ানো। জিজ্ঞেস করলেন,” কেমন পরীক্ষা হয়েছে?’ আমি ভাব নিয়ে বললাম,”চমৎকার”। বাবা বেশ খুশি হয়ে আমাকে পনেরো টাকার ঝালমুড়ি কিনে দিলেন। পর মুহূর্তে কোত্থেকে পরীক্ষার হলে পাশে বসা আঁতেল বন্ধু দৌড়ে এসে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরে বলল,”দোস্ত আমাদের তো ‘মনে হয়’ দুইটা অংক ভুল হয়েছে!” দুটো অংক মানে দশ-দশ করে বিশ মার্ক। পিছনে বাবা দাঁড়ানো। কিচ্ছুক্ষনের জন্য আমার আর বাবার চোখাচোখি হলো। আমি দৃষ্টি নামিয়ে ফেললাম। পুরো রাস্তা বাবা রিকশায় কোনো কথা বললেন না। শখের ঝালমুড়ি আমার গলা দিয়ে নামলনা। বাসায় পৌঁছানোর পর বাকিটা ইতিহাস। বড়াই করছিনা,কিন্তু সেবার রেজাল্ট দেয়ার পর আমার অংকে নিরানব্বই মার্ক এসেছিল।
মানুষের এই “মনে হয়” আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। বেশির ভাগ সময় যখন পরীক্ষার হলে খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে কিছু একটা লিখতে গিয়েছি, আশেপাশে কোথা থেকে জানি কিভাবে কিভাবে “মনে হয় এটা হবে না” বলে কেউ না কেউ লাফিয়ে উঠেছে। সাথে সাথে বিচার বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গিয়েছে আমার। পরে দিয়ে দেখা গিয়েছে , হয় উত্তর ভুল লিখে দিয়ে এসেছি,আমারটাই ঠিক ছিল নয়তো শুধু শুধুই সময় নষ্ট করেছি জানা জিনিসের পিছে।
“মনে হয় “কথাটা খুব ভয় পাই আমি । দাদির কাছে শুনেছি ,আমার জন্মের আগে নাকি বাবা মা একবার “মনে হয় ছেলে হবে বলে”,আরেকবার “মনে হয় মেয়ে হবে” বলে বিশাল ঝগড়া করেছিলেন। আর জন্মানোর পর থেকেই তারা “মনে হয়” মেয়ে হলে ভালো হতো বলে পচানি খাওয়াচ্ছেন আমাকে। কলেজে উঠার পর একদিন মার পাশের বাসার ভাবি চুপি চুপি এসে মার কানে কানে বলে গেলেন, “ভাবি আপনার ছেলেকে তো মনে হয় সিগারেট টানতে দেখেছি বাইরে। চেহারাটা ওর মতোই ছিল ‘মনে হয়’।ছেলের উঠতি বয়স। খেয়াল রাখবেন।”
মা এরপর বহুদিন যাবৎ আমার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলেননি এবং সিআইডির রূপ ধারণ করেছিলেন। আমি কিভাবে হাঁটছি কিভাবে ঘুমাচ্ছি সব দেখতেন। এমনকি আমি বাথরুমে বেশিক্ষন থাকলেও মা বাইরে থেকে “কি করছি” বলে ডাক দিতেন। আমি তখন উত্তর দিতাম- “বিরিয়ানি খাচ্ছি। তুমি খাবে?” এই “মনে হয়” এর জোরে মানুষের মুখে মুখে আমার ক্ষুদ্র জীবনে চার পাঁচটা প্রেম হয়ে গেছে। কিন্তু সেসব প্রেম আমার করা হয়নি,সবসময় শুধু সব কাহিনী “মনে হয় অমুকের সাথে প্রেম করে” তেই সীমাবদ্ধ ছিল।
কলেজ জীবনে একবার এক বোন সমতুল্য বান্ধবীর সাথে রিকশায় করে বাসা পর্যন্ত এসেছিলাম। সন্ধ্যা নাগাদ “মনে হয়” এর জোরে মা-বাবার কানে এসে সে খবর পৌঁছালো। বাবা-মা ভাবলেন ছেলে ‘মনে হয়’ বিগড়িয়ে গেছে। মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ভার্সিটিতে উঠার পর শহরের বাইরে চলে গেলাম।কিছুদিন শান্তিতে ছিলাম। তাও বাঙালি জীবনে মনে হয় এর জোরে কানাঘুষা হবেনা তা তো হয়না।অনেক রাজনৈতিক চক্রে পর্যন্ত পড়েছি আমি। শুধু পরিবারের চাপ ছিলোনা, এটাই সান্তনা।
শান্তির জীবন ছেড়ে এরপর প্রথমবার যখন বাড়িতে আসলাম,তখন একদিন বিকালে শুনলাম পাশের বাসার সেই বিখ্যাত আন্টি আমার মাকে বলছেন,” ছেলের চুল দাড়ি এত লম্বা কেন। সাবধানে রাখবেন ভাবি। মনে হয় হাওয়া লেগেছে। ছেঁকা খেয়ে পড়ে কবি হবে আর নেশা করবে। একলা ছেলে বলা তো যায়না।” ভদ্রমহিলা যাওয়ার পর আমার মা একঘন্টা যাবৎ আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। গ্রেজুয়েশন এর পর অনেক খাটাখাটুনি করে একটা ভালো চাকরি যখন হলো তখন এলাকায় শোনা গেল, আলম সাহেবের ছেলে “মনে হয়” ঘুষ দিয়ে বেতন পেয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা,আলম সাহেবের একটি মাত্র পুত্রমশাই আমি।
এই “মনে হয়” দিয়েই অর্ধেক জীবন পাড় করে ফেলেছি।এখন আপাতত একটা সোফায় বসে বসে অপেক্ষা করছি আর এগুলো ভাবছি। সামনে টি টেবিলে নানারকমের নাস্তার সমাহার। আশেপাশে মুরব্বিরা আমার বিয়ের কথা বার্তা বলছেন। আমি কনে দেখার জন্য বসে আছি। যদিও মেয়েকে দেখার কিছু নেই। সবকিছু আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। মেয়ে আমার পরিচিত। নীরা নাম তার। নীরাকে পছন্দ করেছি চাকরি সূত্রে । মেয়েটা বেশ ভদ্র,যোগ্য ও রুচিশীল। হালকা শ্যামলা বর্ণ, টানা টানা চোখ। বেশ পরিশ্রমী মেয়ে। সবকিছু বাদ দিয়ে কথাবার্তা শুনলেই মেয়েটির প্রেমে পড়া যায়। দুজনের মতেই বিয়ে ঠিক হচ্ছে।
সবকিছু যখন একদম ঠিক ঠিক তার আগে বাবা-মা একদিন আমাকে ডাকলেন। আস্তে ধীরে বললেন ,”নীরা মেয়েটার চরিত্রে মনে হয় সমস্যা আছে।তুই অন্যকাউকে পছন্দ কর।” আমি স্থির দৃষ্টিতে বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করলাম,” মেয়েটার চরিত্র খারাপ প্রমান কি?” তারা আমাকে প্রমাণ দেখাতে পারলোনা। মেয়ের দোষ একটাই মেয়ে নাকি আড়ালে চলে।তাও এগুলো শোনা কথা।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবা-মাকে বললাম,” মনে হয় দিয়ে সবকিছু বিচার করা যায়না। আমি যেমন আমার সহধর্মিণীও তেমনই হবে। আর যাই হোক ,আমি শুধু “মনে হয়” দিয়ে একজন মানুষকে বিচার করতে পারবোনা,তার জীবন ধ্বংস ও করতে পারবোনা।বিয়ে করলে আমি নিরাকেই করবো।” রাত বাড়ছে । একমাস পর আমার আর নীরার বিয়ে। অনেক অমত ঠেলে সব ঠিক হয়েছে। একটু আগে নীরার সাথে ফোনে কথা হয়েছে।
আমার “মনে হয়” এর থিউরি আর জীবন বৃত্তান্ত শুনে মেয়েটা হাসতে হাসতে শেষ। তার হাসি থামেনা। হাসতে হাসতেই বিদায় দিয়ে ফোন রেখেছে। মেয়েটার গলার স্বর যতটুকু না সুন্দর,তার চেয়েও বেশি হাসিটা সুন্দর। মেয়েটার হাসি শুনে এখন বিষাদ লাগছে আমার। বাইরে চাঁদের আলো ঘরের ভিতর এসে পড়ছে। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বাতাস হচ্ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মেঘ জমছে। একটু পড়ে চাঁদটা ঢেকে যাবে। কি অদ্ভুত সুন্দর রাত। চাঁদের আলো,বাতাস সব একসাথে।
একটু পরেই বৃষ্টি শুরু হলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, বিয়েটা ‘মনে হয়’ আরো আগে হলে ভালো হতো। এই রাতে এককাপ চা করে দেয়ার মানুষ থাকতো, হাসি দেয়ার মানুষ থাকতো,গল্প করার মানুষ থাকতো।হয়তো মনে হয় দিয়ে ঝগড়া করার মানুষ টাও থাকতো।