“কেমন আছো কাকী? এতো দিন এলেনা কেনো?”
মধ্যবয়সী আনোয়ারা বেগম জিজ্ঞেস করেন, বৃদ্ধা মুড়িওয়ালিকে।
মুড়িওয়ালি জাতে হিন্দু, বয়সের ভারে কোমর বেঁকে গেছে। এরপরেও খেটে খায়।
একমাত্র আপন ছেলে অজয়নাথও নাকি অর্ধবয়সী হয়ে গেছে।
বুড়ি বিধবা মা। সেই অল্পবয়সে বিধবা হয়ে, হাজার লোভী চক্ষু থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে, কখনো মাছ, কখনো মুয়া মুড়ি বিক্রি করে ছেলে মানুষ করেছে।
আজ বৃদ্ধাবস্থায়, সেই ছেলে, নাত নাতনি আর তার যত্ন নেয়না, খাওয়ায় না।
“আমি নাকি সব খেয়ে উজাড় করে দেই, তারা বলে।” অভিমানী স্বরে বৃদ্ধা বলে।
তাই বৃদ্ধা আবার এই কোমর বাঁকা শরীর নিয়ে, চেয়ে খুঁজে কিছু টাকা তুলে মুড়ি বিক্রি কাজ নিয়ে, কষ্ট করে একাই চলছে।
আনোয়ারা’র জবাবে সে বলে,
“ভালো নাই গো বউ…ভালো নাই।
মুড়ি কিনবিনা আজ?”
“কিনবো কিনবো, তাই তো জানতে চায়। এতোদিন দোকানের চুপসে যাওয়া মুড়ি খেয়ে খেয়ে মুখে অরুচি এসে গেছে।
তা কি অসুখ করেছে কাকী?”
“বাতের ব্যথা গো বউ। বাঁকা কোমর বসলে আর তুলতেই পারিনি। শেষে রাস্তার দুই একজনকে ডেকে একপাতা ব্যথার ওষুধ এনে, খেয়ে চাংগা হয়ে আবার কাজে চলে এলাম।”
“হুম, ভালো করেছো, তা সকালে কি খেলে?”
“চারটা মুড়ি মুখে দিছি, আর কিছু ছিলোনা ঘরে।”
“তবে ঘরে এসে বসো, একটু চা বিস্কুট দিই।
নাকি ভাত খাবে, এইমাত্র চুলা থেকে নামিয়ে এলাম। বেগুন ভর্তাও করেছি। খাবে নাকি কাকী?” আনোয়ারা আন্তরিকতার সাথেই জানতে চায়।
“তোদের কম পড়বে নাতো ভাতে?”
“কম পড়লে, আবার রেঁধে নেবো, গ্যাসের চুলা, তোমাকে অতো চিন্তা করতে হবেনা। আসো, বসো তক্তায়।”
আনোয়ারা গরম ভাত আর বেগুন ভর্তা বুড়ির সামনে রাখে।
“ঘরে আর যা আছে, তা তুমি খাবেনা কাকী, তাই দিলামনা।”
“নাম নিসনা বউ, যা দিলি তাতেই আমার খুব ভালো হয়ে যাবে। এটাই বা পাচ্ছি কই!”
বুড়ি খেয়ে ভগবানের কাছে, আনোয়ারার জন্য দোয়া করে।
চার সের মুড়ি কিনে আনোয়ারা, বুড়ি দুই মুঠো মুড়ি বেশি দেয়।
“দুই মুঠ যে বেশি দিলে, তোমার কম পড়বেনা?”
“তোকে দিলে বউ, আমার কম পড়বে না।
দেখিস, আজ ভালো বিক্রি হবে। সেজন্যই তো প্রতিবার তোর দুয়ারে আগে আসি। তোর ভাগ্যে তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে যায় বউ।”
“তাই নাকি কাকী!”
বুড়ি চলে যায়, অন্য দুয়ারে।
আরেকদিন এসে বুড়ি বলে,
“বউ, আজ একটু রঙ চা খাওয়াতে পারবি? গলা খুশখুশ করে…”
“বসো কাকী, তরকারি নামিয়ে করে দিবো।”
“আচ্ছা, লেবু আছে ঘরে?”
“নাই।”
“গরম মসলা আছে?”
“আছে।”
“ক’খানা লবঙ্গ এলাচ দিয়ে দিস চায়ে।”
” দেবো দেবো, তুমি একটু শ্বাস নাও দেখি আগে।”
“শ্বাস নেবার সময় কই, বিক্রি করে বাজার করতে হবে, ঘরে কিছু নাই।”
“বসো, আমি দিয়ে দেবো কিছু।”
আনোয়ারা রঙ চা, সাথে সকালে বানানো রুটি আর একটু ভাজিও দেয় বুড়িকে।
যাবার সময়, এককেজি চাল, দুইটা পেঁয়াজ, চারটা আলু আর সাথে দুই টুকরো শুটকিও দিয়ে দেয়।
আনোয়ারা যে খুব সচ্ছল, তা কিন্তু নয়। তার ছেলে নেই।
দুই মেয়ে বিদেশে সংসার পেতেছে, তাদের সংসার খরচ থেকে কিছু টাকা মাসে মাসে, মায়ের জন্য পাঠায়। তা দিয়ে কোনোরকম তার চলে যায়।
কিন্তু বুড়ির কষ্ট তার বুকে বাজে, তাই এর প্রতি এতো দয়া, এতো ভালোবাসা।
বুড়ি আবার দোয়া করে যায়, এই বলে,
মা লক্ষি যেন কখনো তার এই বউয়ের দুয়ার থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেয়।
আনোয়ারা হাসে।
“কাকী, তোমার দোয়ায় লক্ষি সবসময় আমার ঘরের আশেপাশেই থাকবে।”
তারপর প্রায় দুই সপ্তাহ হবে, বুড়ি আবার অসুখে পড়ে। আশেপাশের কেউ এইটা ঐটা এঁটোটা দেয় তাকে কখনো।
দুইসপ্তাহ পর, হাড্ডিসার বুড়ি পাড়ায় বের হয়, কিছু চেয়ে পেতে মুড়ি কিনে বেচবে বলে।
তার পাড়ায় তেমন কিছু না পেয়ে, মুসলমান পাড়ায় আসে।
আনোয়ারার ঘরের আশেপাশে আসে সে, কেমন যেন লাগে তার।
এতো মানুষের আনাগোনা কেনো তার ঘরে!
কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে কি! ঐ বউটায় বা গেলো কই?
পরিচিত মুখ পেয়ে একজনের কাছে জানতে চায়,
“বলো তো বেটি, এই ঘরের বউটা কই?”
“তুমি জানোনা!”
“কি জানবো?”
“সেতো মরে গেছে আজ দশদিন। তার মেয়েরা আসছে, কাল মেজবান। তার আয়োজন চলছে এখন…”
বুড়ি তো বাকরুদ্ধ!
কিছুক্ষণ পর চিল্লিয়ে কাঁদে সে।
“ভগবান, এ কেমন বিচার তোর? এই বুড়িকে কষ্টে মরে যেতে যেতেও বাঁচিয়ে রাখিস। ভালো মানুষ বউটারে এতো জলদি উঠিয়ে নিলি! আমার প্রতি তোর এই কেমন নিষ্ঠুর অবিচার ভগবান!? আমায় নিয়ে যেতি, তাকে বাঁচাতি।”
বুড়ি কাঁদে, চোখ মুছতে মুছতে তার ঘরে চলে যায়, উপোষ, খালি হাতে।
আজ আর কারো কাছে কিছু চাইতে মন চায় না তার।
ভালো বউটা মরে গেলো অকালে, গলা দিয়ে কি ছাই আর কিছু যাবে আজ!!
১৩.১২.১৭