১.
মরিয়ম বেগম পান খাচ্ছেন | এসময়টা তার দিনের মধ্যে একটা অমূল্য সময় বলা যায় | যে পরিমাণে পান খায়,তাতে যা মনেহয় মাসে ১০০০ টাকা খরচই হয় তার পানসামগ্রীর পিছনে | যদিও তার টাকার কোন চিন্তা নেই |
দরজা ঠেলে অর্নবের উকি দেয়া মাথাটা দেখে একটু বিরক্তিস্বরে বললেন,কিছু চাও?
– আম্মা আমি কি ভিতরে আসব?
– বাইরে দাড়াইয়া কথা বলা আমার অপছন্দ,জানোনা?
অর্নব দরজাটা আগের মত চাপা দিয়ে এসে মায়ের পায়ে কয়েকবার সালাম করে হেসে দিল |
– হাসো কেন,কি ঘটনা?
– আম্মা আমার একটা চাকরি হইছে,তবে ততটা সুবিধার না | যেকোন সময় ছেড়ে দিতে পারি |
– শুরুর আগেই ছাড়াছাড়ির কথা বলতেছ কেন,গাধা কোথাকার ! বাপের মত হইছ !
অর্নব হাসিটা এখনো থামায়নি,ভালই লাগছে হাসতে |
– বোকা ছেলে,খালি হাসে | আমার এইপাশে পা উঠাইয়া ভালমত বস |
কথামত অর্নব তাইই করল | মায়ের গা ঘেষে একটু আদুরে ভঙ্গিতে |
– পান খাবা আব্বা? নতুন এক মশলা আনাইছি,খুব মজা | দাড়াও একবার খাও,তাইলেই মজা বুঝবা |
অর্নব কেবল মাথা দুলিয়ে চলেছে |
ওর খুব জানতে ইচ্ছে করছে,কতদিন পর মা ওকে ‘আব্বা’ বলে ডেকেছে | ডাকটা শুনলেনা গলা কেমন ভার হয়ে আসে | অতি আবেগেই হয়ত |
– অর্নব,তোমার দু’ভাইদের খবর কি,তারা কেমন আছে?
– আম্মা আপনি সারাদিন বাসায় থেকে আমাকে এই প্রশ্ন করতেছেন কেন |
– তারা তো আমার সামনেই আসে না | চাকরি বাকরি,বউ পোলাপান নিয়ে ভারি ব্যস্ত | আমার কাছে আসার সময় কই? তুমিও কি বাসায় থাকো না?
– আগামী ৭ দিন মানে ১ সপ্তাহ ধরে আমি বাসায় আসি নাই | কারণ এইরকম বাজারের মত বাসায় থাকতে একদম ভাল্লাগেনা |
– ও,ভাল বলছ |
– আম্মা আমার টিউশনি আছে, গেলাম |
– পানটা খাবা না?
– জ্বি দেন,খেতে খেতে যাই |
শুধুমাত্র বসার ঘরটাই এত্ত সুন্দর করে কেউ সাজাতে পারে বিশ্বাস করাই কষ্টকর | বাব্বাহ্,এইনা হল বড়লোকি বাসা |
টানা কয়েক মাসেও এই রুমের উপর একটুও বিস্ময় কমেনি অর্নবের | পড়াতে এলেই মনে ওলটপালট লেগে যায় রুমের প্রতিটা বস্তু দেখে |
তবে টাশকি খাওয়া কথা হল,বড়লোক সাহেবের একমাত্র সন্তান এবং মেয়ে মানে তাশফি | এই মেয়ের কথাবার্তা,চালচলন তো পুরাই উল্টা |
ক্লাস টেন পড়ুয়া এই মেয়ের সাথে চললে কে বুঝবে,এযে বিরাট রাজার একমাত্র রাজকন্যা | তবে অর্নবের অতটা টাশকি খেতে হয়নি |
কারণটা ওর স্বভাবের | ওর খালি ঐ জড় চাকচিক্যের প্রতিই মনোযোগ অত্যধিক | চাকচিক্যের ভেতরের জীবদের নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই |
“স্যার বসে আছেন কেন,রুমে আসেন”
তাশফির ডাকে ঘোর ভাঙল অর্নবের,হ্যা আসছি |
তাশফিকে দেখে অর্নব এক নিরব ঝামেলায় পড়ে গেছে |
ঝামেলার কথাটা তো আর সরাসরি বলা যাবেনা,চুপ করে থাকাই নিরাপদ | তাই একে নিরব ঝামেলাই আখ্যা দিয়ে ফেলল অর্নব |
আজ হঠাৎ এরকম কেন হয়ে গেল কে জানে | আসোলেই চোখ সামাল দেয়ার মত কঠিন কাজ,পৃথিবীতে খুব কমই আছে | ধ্যত্তরি যত্তসব !
– স্যার আপনার কি কিছু হয়েছে?
একটু চমকে অর্নব বলল,নাহ্ কি হবে? কিছু না |
ইচ্ছেকৃত হাসিটা দিতে গিয়েই ভালই ধরা খেল বেচারা |
– স্যার মিথ্যা বলা মহাপাপ জানেন না? আচ্ছা,আমি বলি আপনার কি হয়েছে? – বল
– আমি আজ শাড়ি পড়েছি,আপনার প্রিয় রঙের | চোখে কাজল দিয়েছি খুব যত্ন করে,এটাও আপনার পছন্দমত | আর এতে আমাকে খুব সুন্দর লাগছে তাই আপনি চোখ নামাতে পারছেন না |
অর্নবের মুখ মিডিয়াম হা হয়ে গেছে | এত নরম ভাবে চরম ধরা জীবনে এই ফাস্ট | ও খোদা, এইটা কি মেয়ে না মহিলা ফেরেশতা !
২.
হামিদ সাহেব রুমে ঘুরেঘুরে কথা বলছেন | একা একা,নিজের সাথে | যখন ভীষন একা মনেহয় এই পৃথিবীতে,তখনি তিনি এরকম করতে থাকেন |
ফলাফল, তিনি একটু একাকিত্বের মাঝেও সান্ত্বনা খুজে পান |
দরজায় খটখট শব্দ হতেই কথা থামিয়ে দিলেন | তিনি মোটামুটি অবাক আর কি |
আমার কাছে কি কারো আসার কথা ছিল,কে আসবে?
আরেকবার শব্দ হল,খট খট খট ! হামিদ সাহেব তড়িঘড়ি করে দরজার ছিটকিনি খুলে ফেললেন |
– আব্বা কেমন আছেন?
হামিদ সাহেব যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না অর্নব এসেছে |
– এতদিন পর বাপের কথা মনে হল তোর |
অর্নব টুপ করে ঘরের মধ্যে ঢুকে একদম সটাং হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায় | খুব ঘুম পাচ্ছে ওর |
– কিরে বেটা অসুস্থ নাকি?
– নাহ্
– তবে শুয়ে পড়লি যে? আচ্ছা শুয়ে থাক,তোর জন্য লেবু চা করে নিয়ে আসি | আজ সকালে বাজার থেকে কিনেছি,একদম টাটকা লেবু |
হামিদ সাহেবের ভীষন আনন্দ লাগছে | বাড়ি ছাড়ার পর একমাত্র এই ছোট ছেলেটাই তার খোজখবর রাখে | একদম ভালমত রাখে, কি লক্ষী একটা |
চায়ের কাপে টানা দু’চুমুক দিয়ে অর্নব বলল,আব্বা আপনি না একা থেকে ভালই আছেন | আমিও আর থাকব না ভাবতেছি |
– তাইলে থাকবি কই?
– খালিদের বাসায় | কয়েকদিন ধরে তো ওর বাসাতেই আছি | আমার বন্ধুরা তো আর আমার মত বোকা না আব্বা | ওরা সবাই যে যার মত টাকা পয়সা কামিয়ে একদম পেটফোলা বড়লোক |
– বাদ দে ! তুই যেমন আছিস খুব ভাল আছিস | সততাই সবকিছুর আগে |
তারপরের কয়েকমিনিট কেটে গেল অস্বাভাবিক নিরবতায় | হামিদ সাহেব গভীর মনোযোগে ছেলেকে দেখছেন | চেহারায় কার যেন ছায়া আছে |
কার হতে পারে? মরিয়মের নাকি ওর দাদির?
যার মতই হোক,অর্নবটা দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে | দেখলেই সুপুরুষত্বের তৃপ্তি এসে যায় |
৩.
বসার ঘরে চোখ পড়তেই ভ্রু কুচকে গেল অর্নবের | আজ রাতে চাদঁ এর বদলে সূর্য উঠবে নাকি | ভাই-ভাবি,পোলাপান দেখি সব একখানে |
মেজভাবি ওকে দেখা মাত্রই শুরু করে দিল সুপরিচিত ঘ্যানানি, এইযে টো টো বাবাজি বাইরে বাইরে কি কর সারাদিন? মদ জুয়া আর কত !
অর্নব খেপলো না, একদমই না | একটুতেই খেপার পাত্র ও নয়, বরং কেমন মজা লাগছে |
– তোমার আম্মাজানকে পাওয়া যাচ্ছে না দুপুর থেকে |
– হয়ত বাজারে গেছে আপকামিং পান মশলার খোজ করতে | এসে পড়বে সময়মত |
– তা হলে তো হতই, কিন্তু চিঠি লিখে গেছে একটা !
– কি লিখছে? আমি বাড়ি ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছি,আর আসব না | এই টাইপের?
– হুম
-ও, তবে আমার এসে তো কোন কাজ হল না | আম্মার কাছেই আসছিলাম,পান খেতে | হরেক মশলা দিয়ে পান, খুব খেতে ইচ্ছে করছিল | থাক,যাই |
মেজভাবি রাগে কটমট করছেন, যতসব আহাম্মকের পাল্লায় পড়েছি আমি ! বাড়ির সবগুলা একেকটা আস্ত আহাম্মক !
সোফার একপাশে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা অর্নবকে দেখছে তাশফি,অনেকক্ষন ধরে | অর্নব মাথা নামিয়ে আছে, তাশফিকে দেখতে পায়নি |
তাশফির খুব, একদম ভীষনভাবে ইচ্ছে করছে এই বোকাসোকা চেহারার ছেলেটাকে অনেক আদর করতে,ইচ্ছেমত |
হঠাৎ এরকম ইচ্ছে হওয়ার কারণটা ও নিজেই জানেনা,অত জানতে ইচ্ছেও হয় না |
সামনে দাড়িয়ে থাকা তাশফিকে দেখে একটু ঘাবড়ে অর্নব বলল,শাড়িটা এখনো পড়ে আছো?
– হুম কেন,খুব বেশি সুন্দর লাগছে?
– তোমার আব্বু কোথায়?
– আব্বু আসবে কোথ্থেকে,আব্বু তো বিদেশ |
– ওহ সরি,ভুল হয়ে গেছে | ইয়ে মানে আম্মু…
– আমার বড়খালা আজ হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়েছে তো তাই অফিস শেষে আম্মু তার বাসায় গেছে | আজ রাতে ফিরবে না বলেছে |
– তারমানে পুরা বাড়িতে তুমি একা?
– হুম | না না,কাজের মেয়েটা আছে তো |
– ভালই হয়েছে,বেশি লজ্জা পেতে হবে না |
– বিড়বিড় করে কি বলছেন স্যার?
– তাশফি আমি দু’প্লেট ভাত খাব | বাসায় আম্মা নেই তো তাই খেতে পারিনি….আর আমার ঐ বন্ধুর বাসায় গিয়ে দেখি তালা মারা | কোথায় গেছে কে জানে | দিতে পারবে, খুব খিদে লেগেছে জানো |
– এক্ষুনি আনছি |
এক দৌড়ে রান্নাঘরে এসে পড়ল তাশফি | আর এক সেকেন্ড ওখানে থাকলে,স্যার চোখের পানি দেখে ফেলত | একটা মানুষ এত সরল হয় কি করে?
অতিরিক্ত মায়ায় পড়লেও যে চোখে পানি এসে ভরে যায়,তা আজ প্রথম জানলো মেয়েটা |
রাস্তাটা এখনি কেমন খালি হয়ে গেছে | মানুষজন তেমন একটা নেই,আর কয়েকটা রিকশার এদিক ওদিক ছুটে চলা |
পিচঢালা পথটায় মানুষ,রিকশা সবকিছুর ছায়া পড়ছে | জোছনা দিয়ে গড়া একেকটা ছায়া | আকাশে যে আজ বিশাল একটা চাদঁ,তাইতো এত জোছনা !
সেসব ছায়ার উপর নিশ্চুপ হেটে চলেছে একটা বোকাসোকা চেহারার ছেলে | ছেলেটানা একটু একটু করে ঘামছে | কারণ পাশে থাকা শাড়ি পড়া মেয়েটা তার একটা হাত শক্ত মুঠোতে ধরে আছে | যে মুঠো থেকেই ডানা ঝাপটাচ্ছে শুভ্র এক মায়াপাখি |