ছোটবেলায় বড় মামি আমাকে জামাই বাবাজী বলে ডাকতো। কিন্তু আমি সে ডাকের মানে বুঝে উঠতে পারতাম না। আর যখন বুঝতে পারলাম তখন আমি ওনার মেয়েকে আই লাভ ইউ বলতাম। আই লাভ ইউ এর মানে যে “আমি তোমাকে ভালবাসি” সেটা তখন আমি মুভি দেখে বুঝেছিলাম কিন্তু আমার মামাতো বোনের সেটা বুঝার বয়স হয়নি।
ওর নাম দিপা। সময়ের পরিবর্তনে মামি এখন আর আমাকে জামাই বাবাজী বলে ডাকে না। কারণ এখন আমি আর দিপা দুজনেই বড় হয়ে গেছি। কিন্তু মামি ওনার অভ্যাস পরিবর্তন করলেও আমি করতে পারলাম না। যেখানে সেখানে বড় হয়েও দিপাকে আই লাভ ইউ বলাটা আমার কাছে যেন খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। যেমন ধরেন, দিপাদের বাড়ি আসলে ওকে দিয়ে কাজ করানোটা খুব বেশি আনন্দঘন লাগে আমার কাছে। আমি ওকে বলতাম…
-দিপা এক গ্লাস পানি এনে দিতে পারবি??
-আচ্ছা আনছি। যখন পানি এনে হাতে দিলো আমি বললাম পানি আনতে বলায় শুধু পানি?? তোদের বাড়িতে খাবার নেই??
-হুম বিস্কুট আছে।
-নিয়ে আয়। বিস্কুট আনলে বলতাম…
-তুই জানিস না বিস্কুটের সাথে চা খেতে অনেক মজা। যা চা নিয়ে আয়।
-ভাইয়া মানে কি?? তুমি আমাদের বাসায় আসলেই আমাকে খাটাও।
দিপার রাগ দেখে আমার পাশে সবাই হাসছে। আমি হাসছি না কারণ তাহলে বেশি রেগে যাবে। তাই ওর রাগ কমানোর জন্য সবার সামনেই বলতাম…
-তোকে তো আমি অনেক বেশি আই লাভ ইউ করি তাই এত কিছু করতে বলি। আচ্ছা চা লাগবে না। সরি। কথাগুলো একটু মনমরা হয়েই বলতাম আর এতেই ওর রাগ কমে পানি হয়ে যেত আর বলতো…
-আরে আমি রাগ করিনি। আমি নিজের হাতে তোমার জন্য চা করে নিয়ে আসতেছি।
-না না থাক থাক।
-ধ্যাত। তুমি বসো তো।
এটা বলেই ও চলে যেত চা আনতে। আর আমার কার্যকলাপ দেখে বড় মামি ছোট মামি হাসতো। লেখাপড়া শেষ হতেই চাকরী পেয়ে যাই। আম্মু তো আমার জন্য পাঁচ ঘটকের কাছে পাত্রীর খোঁজ লাগিয়েছে। একদিন আম্মু বলল মেয়ে দেখতে যাবে তাই বলল দিপাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতে। দিপাদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিট লাগে যেতে। আমিতো ওদের বাড়িতে গিয়েই ডাকাডাকি শুরু করে দেই।
-দিপা। ওই দিপা।
-আরে ভাইয়া। তুমি??
-হুম। চল তো আমাদের বাসায়।
-কেন??
-আরে আম্মু কই নাকি মেয়ে দেখতে যাবে। আমি যাবো না তাই তোকে নিয়ে যাবে।
-কার জন্য??
-কার জন্য মানে?? আমার। কথাটা শুনে একটু চুপ থেকে বলল…
-আমার শরীর টা ভাল লাগছে না। ফুপিকে বলো একলাই যেতে।
-না চল তুই।
অনেক জোর করেই নিয়ে গেলাম। মেয়ে দেখে আসতে আসতে একটু রাত হয়ে যায়। আসার পর তো আমি নির্লজ্জের মতো গিয়ে আম্মুকে জিজ্ঞাসা করতে পারি না যে মেয়ে কেমন দেখলো। তাই আমি গেলাম দিপার কাছে। দিপা আমার রুমেই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আস্তে আস্তে গিয়ে ওর পিছনে দাঁড়িয়ে বললাম…
-কিরে কেমন দেখলি তোর হবু ভাবিকে?? ও ঘুরে তাকাতেই দেখলাম ওর চোখে পানি। প্রচন্ড কান্না করে মুখ লাল হয়ে আছে। আমি বললাম…
-কিরে কান্না করছিস কেন?? ও চোখ মুছে বলল…
-না কিছু না। আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসবে একটু??
-আজ অনেক রাত হয়ে গেছে। এখানেই থেকে যা। কিন্তু তোর কি হয়েছে বল তো।
-না কিছু হয়নি।
এটা বলেই চলে গেল মেয়েটা। আমি তো কিছুই বুঝতে পারলাম না। রাতে খেয়ে ছাদে গিয়ে দেখলাম দিপা দাঁড়িয়ে। আমি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর ও নিজে থেকেই বলল…
-মেয়েটা কেমন দেখলাম জানতে এসেছো?? আমি একটু লাজুক হেসে বললাম…
-না না। এমনিতেই। আচ্ছা মেয়েটা দেখতে ছবির মতোই সুন্দরী?
-হুম। মানাবে ভাল তোমার সাথে।
-আচ্ছা।অনেক রাত হয়েছে শুতে যা। শুভ রাত্রি।
আজ আম্মু বলল দিপাকে নাকি দেখতে এসেছে। তাই গেলাম ওদের বাড়িতে। ওদের দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে দৌড়ে আমার ছোট মামার ছেলে রিফাত ঘরের ভিতর চলে গেল। সব সময় ও আমাকে দেখলে দৌড়ে আমার কোলে আসে। কিন্তু আজ ভিতরে চলে গেল। আমি আস্তে আস্তে ভিতরে যেতেই দেখলাম মেহমানরা আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর আবোল তাবোল ভাবে মামার সাথে তর্ক করে বের হয়ে গেল। আমি আগা গোড়া কিছু বুঝতে পারছি না। আর এদিকে রিফাতকে ছোট মামি মারতে মারতে ঘরের ভেতর নিয়ে গেল। সবাই আমার দিকে কিভাবে যেন তাকালো। দিপা আমাকে দেখে ওর রুমে চলে গেল। আমি মামা কে জিজ্ঞাসা করলাম…
-মামা কিছু হয়েছে??ওনারা চলে গেলেন যে??
মামা আমার কথাটার উত্তর না দিয়ে চলে গেল। তারপর আমি ছোট মামার কাছে যাই। উনি যা বলল শুনে আমি হাসবো নাকি কাদঁবো বুঝতে পারলাম না। আসলে আমাকে যখন রিফাত দরজাতে দেখলো সে দৌড়ে গিয়ে সবার সামনে বলল…
-দিপা আপু দিপা আপু। সাজিদ ভাইয়া এসেছে। তোমাকে আবার আই লাভ ইউ বলবে। তোমার বিয়ে হতে দিবে না।
এটা শুনেই ওনারা রাগারাগি করে চলে গেছে। আসলে রিফাতের বয়স মাত্র ছয় বছর তো তাই এত কিছু বুঝার ক্ষমতা হয়নি। আমি দিপার রুমে গিয়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছি। দিপা আমার দিকে নির্ভীক ভাবে তাকিয়ে আছে। হটাৎ দিপা বলল…
-আমাকে আর কোন দিন আই লাভ ইউ বলবা না।
-কেন রে?? তোর বিয়ে ভেঙ্গে যাবে তাই??? হাহাহা
-না। এই কথাটা তুমি খুব সহজে বলে দিতে পারো।
কিন্তু এই কথার মর্ম তুমি বুঝো না। এটা সবাইকে বলা যায় না। ভালবাসার মানুষের জন্যই কেবল এটা। এক সময় তুমি সেটা বুঝবে। কথাটা বলেই দিপা চিলে গেল আমার সামনে থেকে। আজ দিপা হটাৎ করে এত বড় হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি। এটাই কি সেই দিপা যে আমার আই লাভ ইউ শুনলে সব কিছু করতে রাজি?? আসলে মানুষ তো সব সময় এক থাকে না। এখন হয়ত দিপাও পরিবর্তন হয়েছে। এভাবে এখনো আমার দুষ্টুমি করা মানায় না। তাই আমি আর ওকে আই লাভ ইউ বলি না। দিপাদের বাড়িতে গেলে দিপা আমার সাথে আগের মতো কথা বলে না। আমার বিয়ের জন্য আম্মু মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছে। দিপাকে সেটা বলার জন্য আজ আসছি ওদের বাড়িতে।
-দিপা শোন।
-হুম বলো।
-আম্মু একটা মেয়ে পছন্দ করেছে। দেখতো কেমন দেখতে?? mআমি ফোনটা ওর দিকে এগিয়ে দিলাম। কিন্তু ও না দেখেই বলল…
-অনেক সুন্দরী। বুদ্ধিমতী, অনেক ভাল, তোমাদের পরিবারের সবাইকে সুখি রাখতে পারবে। কথাগুলো ছবি না দেখে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বলল।
-আরে ছবি না দেখে বায়োডাটা বললি কিভাবে?? আর ছবিতেও তো লেখা নেই।
-আচ করতে পারি। আমি ওকে ঘুরিয়ে বললাম…
-তোর কি হয়েছে রে??
-কিছু না।
এটা বলেই ওড়না দিয়ে চোখ মুছে চলে গেল। আম্মু আর আমি দুজন অবাক হয়ে বসে আছি। আম্মু আমার রুমে আজ এসে দেখলো আমার টেবিলের উপর একটা চিঠি। আম্মু পড়ে আমার কাছে নিয়ে আসলো। এসে বলল…
-এটা পড়েছিস??
-কি এটা??
-চিঠি। আজ দিপা যখন আমাদের এখানে আসে মনে হয় তখন দিয়ে গেছে।
-কি লেখা আছে??
-তুই পড়। আমি পড়া শুরু করলাম।
প্রিয়…
সেই ছোট্টবেলা থেকে আই লাভ ইউ শুনি তোমার মুখে। আমার জীবনে এই কথাটা সবার আগে তোমার থেকেই শুনেছি। তখন বুঝতাম না এই কথার মানে কি। আমাকে অনেক ছেলেই এটা বলেছে কিন্তু আমার কোন অনুভূতি হয়নি তাদের প্রতি। কিন্তু যখন তুমি বলো মনে হয় যেন একটা মধুর বাণী আমাকে বলেছো। আই লাভ ইউ কথাটা তুমি খুব দুষ্টুমি করে বলে ফেল। কিন্তু আমার কাছে এটা দুষ্টুমি মনে হয় না। একটু একটু করে তোমার জন্য ভালবাসা সৃষ্টি হয়ে বিশালাকার হয়ে গেছে। কিন্তু বুঝতে পারিনি তোমাকে এভাবে হারিয়ে ফেলতে হবে। কিছু দিন পর তোমার বউ হয়ে আসবে অন্য কেউ। হয়ত আমাকে আর আই লাভ ইউ বলতে ইচ্ছে হবে না। এত বছর এই কথাটা শুনে আসতেছি তো তাই মায়া কাটাতে পারছি না। তোমাকে সেদিন আই লাভ ইউ বলতে বারণ করতে যে কতোটা কষ্ট হয়েছে সেটা শুধু আমি জানি। এখন আর এসব বলেই বা কি হবে। ভাল থেকো। সুখে থেকো। ইতি দিপা পড়া শেষ করে আমি আম্মুর দিকে তাকিয়ে আছি। আম্মু বলল…
-তোর দিপাকে পছন্দ হয় না??
-আম্মু আমি তো ওকে সেভাবে কখনো ভাবিনি।
-আই লাভ ইউ বলার সময় তো মুখে আটকায় না। ফাজিল। দিপাকেই তোর বিয়ে করতে হবে।
-কিন্তু…
– কিন্তু খুব শীঘ্রই বিয়ে হবে। আমি আর কিছু না বলে চিঠি না নিয়ে দিপাদের বাসায় যাই। দিপাকে কোথাও না পেয়ে ছাদে গেলাম। আমি বললাম…
-এসবের মানে কি দিপা??
-কি??
-এই চিঠি??
-কার চিঠি??
-খুব ভাল অভিনয় করতে পারিস তো। আজ আমাদের বাড়িতে গিয়ে আমার রুমে এই চিঠি রেখে আসার মানে কি??
-তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
-এটা পড়। ও পড়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল…
-বিশ্বাস করো আমি এটা লিখিনি।
-তার মানে কি আমি লিখেছি??
-না। কিন্তু আমি লিখি নাই এসব। বিশ্বাস করো ভাইয়া।
-আম্মুর হাতে চিঠি পরেছে। বাকিটা কি হয় আমি জানি না।
আমি আর কিছু না বলেই চলে আসি সেখান থেকে। আমাদের বিয়েটা হয়ে গেছে। দিপার সামনে গিয়ে বললাম…
-অতঃপর আমি সফল।
-মানে??
-তোমাকে পাওয়ার জন্য কত কিছুই না করলাম।
-বুঝলাম না।
-চিঠিটা আমার লিখা ছিল।
-কিইইই???
-হাহাহা। সাথে সাথেই দিপা চিৎকার দিয়ে বলে….
-আম্মুউউউউ। আমিতো ওর মুখে হাত দিয়ে বললাম…
-এ কী?? তোমার আম্মুকে ডাকো কেন??
-আমি আমার শাশুড়ি মাকে ডেকেছি। আম্মু চিল্লাচিল্লি শুনে এসে দরজায় কড়া নাড়ছে। আমি দরজা খুলে দিতেই আম্মু বলে…
-কিরে চিল্লাচিল্লি করছিস কেন?? দিপা বলে…
-আম্মু ওই চিঠিটা আমি লিখি নাই। এই চোরটা লিখে বুদ্ধি করে তোমার কাছে দিছে।
-না না আম্মু। এটা ওরই লেখা।
-চুপ কর তো। আমি তোর মা। তোর হাতের লিখা খুব ভাল ভাবেই চিনি। আম্মুর কথা শুনে দিপা বলে উঠলো…
-চোর চোর।
আমি লজ্জায় মাথা চুলকাতে চুলকাতে আম্মুর সামনে থেকে চলে গেলাম। মেয়েটাকে বলাই ভুল হয়েছে। নিজের পায়ে কুড়াল মারলাম। থাক প্রতিশোধ তুলে নিবো পরে।