সকাল বেলা বাসি রুটি চারটে চা দিয়ে খেয়েই কাজে বেরিয়ে পড়ল রফিক। রেলপারের বস্তিগুলোর পাশে রফিকের নিজস্ব মাটির ঘর। ঠিকাদার পল্লব পালের অধীনে রাজমিস্ত্রির কাজ করে সে। যেদিন যেদিকে কাজে পাঠায় সেদিকেই যেতে হয় তাকে। এখন মাস তিন ধরে একজায়গাতেই কাজ পড়ছে তার। বেশ বড়সড় উঁচু ইমারত তৈরী হচ্ছে যে।
যাওয়ার পথে ফুটপাতের গা ঘেষে হাঁটতে হাঁটতে ফুটপাতের প্রায় ধারে সব দোকানেই সাজানো রঙ বেরং এর ফুল। কত কিশোর কিশোরী তরুনের ভীড় এত সকালে। রফিক পাশেই মনসারামের দোকান একটু ফাঁকা দেখেই জিজ্ঞেস করল, “ও মনসাভাই, আজ ও দোকানে এত ফুল কেন? তুমি যে বললে কাল গোলাপ দেওয়ার দিন ছিল। কিন্তু সে তো কাল পেরিয়ে গেল। আজ এত ফুল আমদানী কিসের ভাইয়া?” মনসারাম বলল, “আরে রফিকভাই আজ হল প্রোপোজ ডে।”
–“পোপোজ ডে টা কি আছে মনসাভাই?”
“ভালবাসার মানুষকে আজ ফুল উপহার দিয়ে প্রপোজ করতে হয়, তাহলে সে হ্যাঁ বলবেই। আজকের দিনে কেউ নাবলতে পারে না।” রফিক অবাক হয়ে গেল শুনে।
ভালবাসার মানুষ তো আজ পর্যন্ত রফিকের কপালে জুটলোই না। ছোটবেলায় আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকেই সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। পরপর চার বোনের শাদী করাতে গিয়ে নিজের কথা আর ভাবা হয়ে ওঠেনি। এই চল্লিশের দোরগড়ায় দাঁড়িয়ে কাউকে কি ভালবাসার কথা বলা যায়? কি মনে হতে একটা লাল রঙের গোলাপ কিনে পকেটে ভরে গন্তব্যের পথে পা বাড়ায় রফিক। মাস তিনেক আগে থেকে তাদের দলে মহিলা শ্রমিক হিসাবে কাজ করছে রীতা। রীতা অনাথ আশ্রমে মানুষ। আগে কাজ কর্ম তেমন করতে পারত না। স্বামী বেঁচে থাকতে তার রোজকারে রীতা আর তার মেয়ের ভালই চলে যেত। কিন্তু মাস ছয় আগের দূর্ঘটনাটা সব ছিনিয়ে নিল।
স্বামীহারা রীতা অথৈ জলে পড়ল। সঞ্চিত অর্থ শেষ হতে লাগল। কিছু একটা কাজ তো দরকার, কিন্তু কোনোরকম মাধ্যমিক পাশ করা রীতা কোনো চাকরিই জোগার করতে পারল না। শেষমেশ আর কোনো উপায় না পেয়ে মেয়েকে মানুষ করার জন্য ঠিকা শ্রমিকের কাজ নিল সে। কষ্ট করে মানুষ হলেও এতখানি পরিশ্রম করার অভ্যেস তার কোনোদিনই ছিল না। তাই প্রথম প্রথম কাজে ভুল হত, একটুতেই হাপিয়ে উঠত, আর সেই কারণে রাজমিস্ত্রীদের কাছে বকাও খেত। রীতা লক্ষ্য করে দেখেছে আর সবাই খুব বকুনি দিলেও রফিক মিস্ত্রী কিন্তু কোনোদিনই কিছু বলেনি। বরং তার চোখ দেখে রীতার মনে হয়েছে সেও তার কষ্টে সমব্যাথী। মেয়েটা এই সবে ক্লাস টুএ উঠেছে। বস্তিতে একটা ছোট্ট ঘরে জায়গা হয়েছে তাদের। মেয়ে প্রীতি সামনের সরকারী প্রাইমারী স্কুলটায় পড়তে যায়।
রাত নামলেই কষ্ট আর তার সাথে মনে একটা ভয় শুরু হয় রীতার। আশেপাশে অনেক লোকজন খারাপ নজরে দেখে তাকে। নেশা করে মদের ঘোরে রীতার ছোট্ট ঘরের টিনের দরজায় ধাক্কাও দিয়েছে বারকয়েক। কতদিন যে এভাবে রীতা নিজেকে বাঁচাতে পারবে কে জানে? রফিকের আজ কাজে তেমন মন লাগছে না। রীতা কে প্রথম প্রথম দেখার পর খুব মায়া হত, করুনা হত। আর এখন মনে হয় সে রীতা কে ভালবেসে ফেলেছে। কবে যে এই করুনা ভালবাসায় পালটে গেল সে ভেবেও পায় না। কিন্তু কারো কাছে এসব কথা বলেনি রফিক। ধর্মের বেড়াজাল আর টানাপোড়ন গুলো মনকে ঘিরে ধরে।
রীতা হিন্দুঘরের বিধবা বৌ। সেই বা এসব জানতে পারলে কি ভাববে? ছিঃ ছিঃ এসব কথা মনে আনাও পাপ। রীতা কোনোদিনই রাজী হবে না। কিন্তু আজ যে সে শুনল যে আজকের দিনে কাউকে ভালবাসার কথা বললে সে না বলতে পারবে না! তাহলে আজ কি রীতাকে মনের কথা খুলে বলা যায়? যাই হয়ে যাক একবার বলেই দেখি এসবই ভাবছিল রফিক কিন্তু মনে সাহস সঞ্চয় করতে পারছিল না। বেলা ডুবলে কাজ সেরে সবাই যখন হাত মুখ ধুয়ে তৈরী হচ্ছিল বাড়ি ফেরার জন্য তখনও একবার রফিক পকেটে গোলাপ ফুল টার অস্তিত্ব অনুভব করল। এবার কি একবার যাবে রীতার কাছে? বুকের ভেতরটা ধুকপুক করতে শুরু করল।
সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে যে যার বাড়ির পথে। রফিক শরীরের মনের সমস্ত সাহস টুকু একত্রিত করেও এগিয়ে যেতে পারছে না রীতার কাছে। শেষমেশ বাড়ির পথ ধরল। হঠাৎ এক নারীকন্ঠ শুনতে পেল। “এই সে শুনছেন?” পেছন ফিরে দেখে রীতা দাঁড়িয়ে। রফিকের হৃৎস্পন্দন আরো দ্রুত হয়। রীতা আবার বলে ওঠে, “আপনার সাথে একটু দরকার ছিল।” রফিক আমতা আমতা করে বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ বল বল কি বলবে বল।” এই বোধহয় প্রথম সে রীতার সাথে কথা বলছে। “বলছি যে আপনি একদিন আমার বাড়িতে যাবেন?” রফিকের মুখ হাঁ হয়ে গেল।
রীতা মুখ নামিয়ে বলল, “মানে আমাদের বস্তিতে অনেক ঝামেলা। অনেক লোক আছে যারা খারাপ নজর দেয়। আমাকে জ্বালাতন করে। মাথার ওপর তেমন কেউ নেই যে আমাদের রক্ষা করবে। আপনি যদি একবার যেতেন তাহলে আমি সবাইকে বলতে পারতাম যে আমদেরও গার্জেন আছে।” “কিন্তু আমাকেই কেন বলছ এসব?” রফিক বলল। রীতা মুখখানা তেমনই নামিয়ে রেখে বলল, “আসলে এখানে এতজনের মধ্যে শুধু আপনাকে দেখেই আমার মনে হয়েছে যে আপনার ওপর ভরসা করা যায়।”
–“আর তোমাকে আর তোমার মেয়েকে যদি একেবারের জন্যই আমার বাড়ি নিয়ে যেতে চাই রাজী হবে?” কথাটা বলার পর রফিকের মনে হল কিভাবে যে মুখ দিয়ে বেরোল কে জানে। রীতা মুখ তুলে বলল, “মানে?” “শাদী করবে আমায়? আমার ঘরে আমি একলা থাকি। দু’বছর আগে আম্মি মারা যাওয়ার পর রীতার নত মুখে প্রতিবাদের কোনো চিহ্ন না দেখে পকেট থেকে লাল গোলাপ বের করে রীতার সামনে দিল।
রীতা সেই ফুল হাতে নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়াল। রফিক মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বেশ কিছুক্ষন। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। সত্যিই আজকের দিনটার মাহাত্ম্য আছে বলতে হবে। রীতা বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল বেশ কিছুক্ষন। এই ক’দিনে রফিককে দেখে সত্যিই খুব ভাল লেগে গেছে তার। অন্যদের মুখেও তার প্রশংসাই শুনেছে, রফিক সম্পর্কে কোন খারাপ কথা কেউ ই বলেনি কোনোদিন। কিন্তু তাকে ভালবাসার কথা, সংসার করার কথা তো ভাবেনি রীতা। তাহলে? রফিক কি দয়া করে বিয়ে করতে চাইছে তাকে? করুনা করছে? আর সেই বা রাজী হল কেন?
সমাজের হিংস্র শ্বাপদসঙ্কুল জীবন থেকে বাঁচার এটাই হয়ত একমাত্র পথ। একসাথে থাকতে থাকতে একদিন ঠিক রফিককে ভালবাসতে পারবে রীতা। আর নিজের সমস্ত দিয়ে রফিকের করুনাকেও ভালবাসায় রূপান্তর করে নেবে সে। চোখের জল মুছে গোলাপটার দিকে তাকায় ও। গোলাপটা এখনও বেশ তাজা আর সাবলীল ভঙ্গীতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।