সকালটার শুরু কিছুটা উৎফুল্লতা দিয়ে। সেদিন মনে হচ্ছিলো যেন প্রেমিকার সাথে প্রথম দেখা। আমি যখন দাঁত ব্রাশ করছিলাম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তখন বার বার ভাবতেছিলাম চুলের সিতিটা কিভাবে করবো। হ্যা এটাও ঠিক ছোট ছোট কোকড়া চুলের সুন্দর কোনো সিতি হয় না। মুখে ব্রাশ আর দু হাত দিয়ে যখন চুল নাড়ছিলাম তখন পিছন থেকে আম্মু বলে উঠলো…
-তোর এক্সাম আজ। সেই খেয়াল আছে?? আম্মুর কথা শুনে কিছুই বললাম না। কারণ আম্মু খুব চালাক। এমনিতেই আমার নামে অলরেডি কত কিছু আম্মুর কানে এসেছে। আমি ফ্রেশ হয়ে যখন জামাকাপড় পড়ে রেডি হয়ে আম্মুকে বললাম…
-তাড়াতাড়ি খেতে দাও। সময় হয়ে গেছে।
আম্মু আমার কান ধরে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকাতে বলল। তাকিয়ে যেন জীবনের সবচেয়ে বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলাম। কারণ তখন সবে মাত্র সাড়ে ছয়টা। আমি সাথে সাথে আম্মুর সামনে থেকে চলে আসলাম। আম্মু হয়ত ভাবছে ‘যে ছেলে পরীক্ষার সময় ও আটটার আগে ঘুম থেকে উঠে না। সে কেন আজ এত তাড়াহুড়ো করছে।’ যদি আম্মুকে বলতে পারতাম কেন এরকম তাড়াহুড়ো করছি তাহলে বলতাম…
-আম্মু আজ তোমার ছেলে তোমার বৌমাকে ভালবাসা দিবস উপলক্ষে ফুল দিবে। লাল টুকটুকে একটা গোলাপ।
কিন্তু সে আশা আমার গুড়েবালি। আম্মু আমার রুমে এসে যখন দেখলো আমি আবারো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি তখন বলল…
-এত মুখ দেখিস না নিজের। পড়তে বস। আর নয়ত পরীক্ষার খাতায় নিজের মুখ ছাড়া কিছুই দেখবি না। একটু পড়।
আমি বই নিয়ে বসে পরলাম। কিন্তু ভাবতে লাগলাম কিভাবে ফুলটা দিবো। হাটুগেড়ে,নাকি দাঁড়িয়ে,নাকি ডিল মেরে দিবো! এত রোমান্স যে মাথায় কি করে আসলো বুঝিনি। আমি যখন ফুল কিনতে গেলাম ততক্ষণে দোকানের ভাল ফুল গুলো প্রায় শেষের পথে। দোকানদার আমার দিকে হলুদ কালারের দাঁত দেখিয়ে বলল…
-স্যার কয়টা লাগব? দশটা নাকি পনেরোটা? আমি হেসে একটা ছোটখাটো ফুল নিয়ে বললাম…
-এটা কতো? উনি বলল…
-আপনারে দেইখা মনে হইতাছে আমার খালাতো ভাই মতিনের মতো। আপনার জন্য এটা পঞ্চাশ রাখুম।
-একটা গোলাপ পঞ্চাশ? পঁচিশ টাকা দিলে হবেনা? লোকটা ভ্রু কুচকে বলল…
-আপনারে দেইখাই বুঝছি আপনে ভালা কাস্টমার না। আরে মিয়া ভালবাসার মানুষের জন্য পঞ্চাশ টাকা খরচ করতে না পারলে আর কি করবেন?? এরকম ফইন্নি গুলা কই থাইকা যে আসে! আমি আর কিছু না বলে চল্লিশ টাকা দিয়ে কিনে রওনা করলাম।
জীবনে অনেক বন্ধুকে বান্ধবীকে ফুল দিয়েছি কিন্তু প্রেমিকাকে সেটা প্রথমবার। আগে মনে হতো প্রেমিকাদের আর বান্দবীদের ফুল দেওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।ঐদিন বুঝেছি কতটা পার্থক্য। আমি ফুলটা নিয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকলাম। ফুলটাকে সযত্নে ব্যাগের ভিতর রাখলাম যাতে কেউ না দেখে। লজ্জা করছিলো খুব। কেন জানি এখন আর ফুলটা দিতে ইচ্ছা করছিলো না। ওর সামনে আমি কিভাবে ফুল দিবো?? ও কি রিয়েক্ট করবে? আমি ফুলটা দিয়ে কি বলব? এসব ভাবতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম “পুষ্পখানা আমার জুড়িতেই রহিয়া যাবে।” কিন্তু এখানে আরো একটা মূল চরিত্র আছে। যাদের মুখের উপরে কথা বলা যায় না। ওরা সবাই যা বলবে আমি সেটাই করতে বাধ্য। কারণ তারাই আমাকে প্রেম শিখিয়েছে। আজ যাকে ফুল দিবো সে আমার হয়েছে কেবল তাদের কারণেই। হ্যা, আমি আমার বন্ধুদের কথাই বলছি। ওরা যখন ফুলটা দেখে ফেলল তখন বলল প্রেমিকার কাছে গিয়ে ফুলটা দিয়ে আসতে। কিন্তু কোনোমতে আমার সাহসে বাধছিল না।
অতঃপর আমার সাহসের বাক্সখানা ক্লাস রুমের দরজার চিপায় রেখে তাদের নিয়ে গেলাম ফুল দিতে। ও অন্য রুমে পরীক্ষা দিবে। তখনো পরীক্ষা শুরু হওয়ার বেশ সময় বাকি। কিন্তু গিয়ে যখন দেখলাম ওর ক্লাসের সামনে অনেক মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে তখন আমি আবারো মত পাল্টালাম। আমার সাথে যে বন্ধু নামক আজীব প্রাণীরা ছিলো সেটা আমি হয়ত ভুলে গিয়েছিলাম। তারপর ওরা ব্যাগ থেকে ফুলটা হাতে ধরিয়ে জোর করে বলল দিয়ে আসতে। আমিও যেন কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেলাম আমি কে? মনে হচ্ছিলো কিছুটা হিরু হিরু ভাব কাজ করছে আমার মধ্যে। ক্লাসরুমে গিয়ে দেখি আমার প্রেমিকা অন্য দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ক্লাসের সব মেয়েরা বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিন্তু ও একা কেন ভিতরে সেটা বুঝতে পারছিলাম না। আমি তার পিছনে আস্তে আস্তে গিয়ে বললাম…
-এহেম। ও ঘুরে দাঁড়ালো। আমাকে দেখে খুব অবাক হয়ে গেলো। আমি ফুলটা ওর হাতে কোনোরকমে ধরিয়ে দিয়ে বললাম…
-Happy valentine’s day. I love u.
ও আমার দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসতে লাগল।আমি আর কিছু বলিনি আর দাড়াইওনি। চলে আসলাম সেখান থেকে।বারান্দায় দাঁড়ানো সব মেয়েরা বলতে লাগলো “ঐ দেখ, ছেলেটা ফুল দিয়ে যাচ্ছে ঐ মেয়েটাকে।” একটু দূরে গিয়ে আবারো পিছনে তাকাতেই দেখলাম ও এক পলকেই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। মনে হয় মনে মনে বলছে…
-তুমি এত পাগল ক্যান?? বিকালবেলা ঘুমিয়ে আছি। হঠাৎ করে ফোন বেজে উঠলো। আমি স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি প্রেমিকা। আমি ফোন রিসিভ করতেই ও বলল…
-তুমি এভাবে চলে আসলা ক্যান সেখান থেকে?? আমি হাসতে হাসতে বললাম…
-আর নয়ত কি করতাম সেখানে দাঁড়িয়ে?
-যদি থাকতে তাহলে লাভ হতো তোমার। আমি কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম। ও কি সেটার কথা বলছে? আমি বললাম…
-কি দিতে তুমি?? ও লজ্জাকর স্বরে বলল…
-জড়িয়ে ধরতাম।
আমি তখন নিজের গালে নিজেই চড় মারতে লাগলাম। আমি কেবল ওর হাত ধরেছি এই কয়েক মাসে।। কখনো জড়িয়ে ধরতে পারিনি। ইচ্ছা করছিলো এখনি ওর সামনে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরি। ও বলল…
-থাক। আফসোস করে আর কি হবে? সামনের ভ্যালেন্টাইন ডে তে এরকম ভুল করিও না। হঠাৎ করে রাত আটটায় কল আসলো। আমি রিসিভ করতেই ও বলল…
-আমাদের সব সম্পর্ক শেষ। আমি হাসতে হাসতে বললাম…
-ভালবাসা দিবসে সম্পর্কের শেষ হয়না পাগলী, শুরু হয়। ও কান্না করতে করতে বলল…
-বাড়ির সবাই জেনে গেছে সম্পর্কের কথা। তুমি ভুলে যাও আমাকে। ভাল থাকিও। আমি কাঁদব না হাসব বুঝতে পারছিলাম না। কেবল একটা কথাই ভাবছিলাম….
-ভ্যালেন্টাইন ডে তেও ব্রেক আপ হয়??
পরিশিষ্টঃ গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু না। ও আমাকে পরেরদিন কল দিতেই আমি ফোন রিসিভ করতেই ওকে অনেক কিছু বললাম। কারণ যে মানুষটা ফ্যামিলির কথা শুনে এক দিনেই এত সহজে সব শেষ করে দিলো সে কিরকম ভালবেসেছিলো বুঝতেই পারছিলাম। তারপর হঠাৎ ও আমাকে ধমক দিয়ে বলল…
-অনেক হইছে। আর না। আরে আমি তোমাকে কল দিছি কালকের ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে বলতে। আম্মু আর আপু কাল আমাকে জোর করছে এটা বলতে তোমাকে।ওরা তখন আমার পাশেই ছিলো। ওদের কথা শুনেই আমি তোমাকে ভুলে যাবো ভাবলে কি করে?? আমি বললাম…
-তুমি বুঝিয়ে বলবে তো তাহলেই তো আর এত কিছু বলতাম না। সরি।
-কিসের সরি?? আর কথাই বলব না তোমার সাথে।
-তুমি পারবে আমার সাথে কথা না বলে থাকতে? বলো একবার পারবে।
-হুম পারবো। আমি ওর উত্তর শুনে ফোন রেখে দিলাম। ও আবার কল দিয়ে বলল…
-তুমি ফোন কাটলা কোন সাহসে?? আমি আবার বললাম…
-সরি আসলে ভুলে কেটে গেছে। ও ধমক দিয়ে বলল…
-তুমি ইচ্ছা করেই কেটে দিছো। তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবা তাই তো?? আমি বললাম…
-কখনোই না। ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগলো। আমি শুনতেছি ওর কান্না। ওকে বললাম…
-কান্না করিও না প্লিজ। ও বলল…
-এহহহ। তোমার জন্য কাঁদব কেন আমি?
আমি হাসতে লাগলাম। মেয়েটা কখনোই স্বীকার করবে না সে আমাকে প্রচন্ড ভালবাসে। আমার কথায় আচরণে কষ্ট পায়। ও কেন এমন সেটাই বুঝি না। আমি আস্তে করে বললাম…
-খুব ভালবাসি তোমায় প্রেমিকা! ও কান্নাজড়িত কণ্ঠেই বলল…
-আমিও।