গন্তব্যহীন গন্তব্যে

গন্তব্যহীন গন্তব্যে

মিতুর বিয়ে হয়ে গেলো এক শীতের সন্ধ্যায়।আমি তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু,তাই আমাকে সব কাজে থাকা লাগলো। সকাল থেকে এদিক সেদিকের সব ব্যাপার দেখছিলাম। মিতুরা হলো হুলস্থুল টাইপ বড়লোক। কিছু বড়লোক আছে ছুটিতে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ঘুরতে যায়, কিছু বড়লোক আছে বাথরুমে যাবার মত ইউরোপ আমেরিকা চষে বেড়ায়। মিতুর বাবা হলো এই দ্বিতীয় শ্রেণীর মধ্যে পড়েন,এক কথায় খাইছে আমারে টাইপ বড়লোক।
বিয়ের ব্যাপারটাও তাই খাইছে আমারে না,মাইরালচে আমারে টাইপ হলো। মেয়েপক্ষের সব মেয়েরা একই জামা,ছেলেরা একই পাঞ্জাবী, নাচ গান,আলো,হুল্লোড়। এক কথায় ইন্ডিয়ান সিরিয়ালে দেখানো গুজরাটি কায়দার বিয়ে আর কী, আমি যদিও জানতাম না বিষয়টা, কারণ আমি কোনদিন ইন্ডিয়ান সিরিয়াল দেখি নি। মিতুই আমাকে বলেছিলো তার ইচ্ছে এইভাবে তার বিয়ে হবে। আমার আসলে এসব নিয়ে তেমন মাথাব্যাথা নেই,আমার সমস্যা হলো কোন বদমাশ ছেলেদের পাঞ্জাবীর রঙ পছন্দ করেছে। সকালে পাঞ্জাবী গায়ে দিয়েই মনে মনে শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দিয়েছি একটা। ক্যাটকেটে হলুদ রঙা পাঞ্জাবী,গল্পের হিমু যেমন পরে তেমনটা। মনে হচ্ছে গায়ে গু মাখিয়ে ঘুরছি।
শীতকালে আগে আগেই সন্ধ্যে নামে, শীতের সন্ধ্যে গুলো কেমন জানি বিষণ্ণ ও হয়। সে কারণেই কী না কবুল বলার আগে মিতুকে একটু বিষণ্ণ, একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো।বিয়েটা হয়ে গেলো সন্ধ্যা ৭ টার মাঝেই।ছেলের নাম ইমরুল কায়েস। নামের সাথে ভিমরুলের মিল থাকলেও চেহারা দেখে আমার অবশ্য মনে হয়েছিলো বান্দর থেকে যে মানুষের উতপত্তি কথাটা ১০০ ভাগ সত্যি কথা,যে একথা বলেছেন তাকে নোবেল দেয়া উচিত। রাত ৯ টার মাঝে ভিমরুল বাবাজী বউ নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিলেন,যাবার আগে কান্নাকাটির রোল পড়ে গেলো। মিতুর ছোটভাই, মিতুর মা বাবা সবাই ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। আমার বিরক্ত লাগতে লাগলো। এত নাটকের কী আছে বাবা,সবার ইচ্ছেতেই তো বিয়ে হয়েছে।
যাবার আগে সবার শেষে মিতু আমার কাছে এলো,আমি তখন ওদের বাসার সামনের বকুল গাছটার নিচে দাঁড়ানো।আমার কাছে এসে আস্তে করে বললো,ভালো থেকো অভি।বলে চলে গেলো।
মিতুর গাড়ি চোখের আড়ালে যেতে লাগলো,আমার হুট করে কেমন যেনো একটু খারাপ লাগতে লাগলো।আমি জানি না কেনো,কিন্তু অদ্ভুত একটা বিষণ্ণতা। হঠাত কেনো এমন শুরু হলো আমি বুঝলাম না।পকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বালাতে গিয়ে দেখলাম আমার হাত কাঁপছে।আগুন জ্বালাতে পারছি না আমি,কেমন অদ্ভুত ব্যাপার।
***
আমার মা মারা যায় আমার বয়স যখন ২ বছর।মা কে নিয়ে তাই আমার কিছু মনে নেই। আমাকে কোলে নিয়ে যে অল্প কিছু ছবি ছিলো তাই আমার ব্রেইনে জমে থাকা মা কে নিয়ে একমাত্র স্মৃতি। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী মানুষ, আমাকে দেখাশোনা করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। মা মারা যাবার ৪ মাস পর তিনি একদিন বিয়ে করে আমার জন্যে মা নিয়ে এলেন। দুই বছর বয়সে কিছুই বুঝতাম না,কিন্তু কেনো জানি সেই বয়সেও আমি বুঝেছিলাম এই মহিলা আমার কেউ না,একদম কেউ না। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো সেই মহিলা আমাকে ভালোবেসেছিলেন। বসার ঘরে আমার মা বাবার বিয়ের একটা বড় ছবি লাগানো ছিলো। দ্বিতীয় বার বিয়ে করলে সাধারণত প্রথম পক্ষের সব স্মৃতি মুছে ফেলা হয়। কিন্তু সেই অচেনা অজানা মহিলাটি আমার মায়ের সব স্মৃতি তার পাশাপাশি রেখে সহাবস্থান গ্রহণ করেছিলো। আমার মায়ের গহনা,শাড়ী,, ছবি সব অতি যত্নে আলমারিতে তুলে রেখেছিলো।কোনদিন হাত দিতেন না।
আমার বাবা ব্যস্ত মানুষ ছিলেন,সারাদিন পার করে রাতে যখন ফিরতেন তখন আমি হয়তো ঘুমিয়ে যেতাম, আমি তখন নিতান্তই বাচ্চা ছিলাম।বাবা আমার কাছে আসতেন,কপালে চুমু খেতেন।ভালোবাসা বোঝা যায়,ভালোবাসা টের পাওয়া যায়।আমি অবুঝ ছিলাম।আমার কেনো জানি অসহ্য লাগতো,বাবাকে।সেই নতুন মাকে।অথচ তারা দুজনেই ভালোবাসতেন আমাকে।
আমি বড় হতে লাগলাম,বাবার সাথে আমার দূরত্ব বাড়তে লাগলো।আর সেই মহিলার সাথে আমার দূরত্ব কোনদিন কমেই নি,বাড়বে কী? আমি এদের অপছন্দ করতাম তেমন না,কিন্তু আমি বুঝতাম আমি এদের ভালোও বাসি না।স্কুল কলেজ পাশ করলাম,পাশ করে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম,চান্স হলো না।বাবাকে গিয়ে বললাম আমার ২০ লাখ টাকা চাই,বাইরে গিয়ে পড়বো।বাবা কিচ্ছু বললেন না,শুধু জিজ্ঞেস করলেন কবে লাগবে? বাবার সাথে আমার সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিলো টাকার সম্পর্ক,আমার কিছু লাগতো,আমি চাইতাম।বাবা আমার চাওয়া পূরণ করতো।আর কিচ্ছু না।
লন্ডনের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম,চলে আসার আগের রাতে বাবা আমার রুমে এলো।আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম,এরপর জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা বাবা,আমাকে ভালোবাসো? কেন ভালোবাসো?
বাবা চুপচাপ বসে উঠে যেতে লাগলো,যাবার আগে আস্তে করে বললো,বাবা হও,বুঝতে পারবে। আমি বুঝিনি সেদিন,আমি সেদিন তার চশমার গ্লাস এর ঝাঁপসা হয়ে যাওয়াও দেখি নি। আমি চলে এলাম সব কিছু ফেলে,আমি আসলে পালিয়ে এলাম বোধকরি।
এয়ারপোর্টে ঢুকবার সময় বাবাকে দেখলাম শান্ত হয়ে আছে,আমার ছোট বোনটা,ওই মহিলার মেয়ে-অবনী ঠোট কামড়ে ফুপাচ্ছে,আর ওই মহিলা? তাকে দেখলাম কাঁদছে।কেন কাঁদছে সে?আমি কে হই তার?
***
আমি চলে এলাম এক অসীম শূন্যতা নিয়ে,আসলে কিসের শূন্যতা ছিলো আমার? আমি জানি না।একদম জানি না।
মিতুর সাথে আমার পরিচয় হলো সাউথ লন্ডনের এক বাঙালী মেলায়। মিতু ও আমার মত এসেছে পড়তে।পরদেশে নিজের দেশের কোন বন্ধু পেলে কেমন আনন্দ হয় আমি বুঝলাম। আমি আর মিতু বন্ধু হয়ে গেলাম।আমি মিশতে পারতাম না তেমন,আর মিতু ছিলো উলটো। আমাকে অসামাজিক থেকে সামাজিক করার ব্রত ছিলো তার,এভাবে দিন কেটে যেতে লাগলো। আমি ভালোই আছি,দেশে সপ্তাহে, পনেরদিনে এক দুইবার কথা হতো।
একসাথে মুভি দেখতে যাওয়া,এক সাথে ঘুরে বেড়ানো,খাওয়া দাওয়া করা,শপিং করা সব ই চলতো মিতুর সাথে।
আমার শূন্যতার দিনগুলো পূর্ণতা পাচ্ছিলো,এর কারণ ছিলো অবশ্যই মিতু। পাঁচ ফিট দুই ইঞ্চির শ্যামলা গড়নের মেয়েটা কত যে কথা বলতো,আমার শুনতে ভালো লাগতো। এভাবে দিন মাস বছর গড়ালো। এক এক করে তিনবছর কাটাবার পর এক সন্ধ্যেয় মিতু আমাকে জানালো ভালোবাসে আমাকে। লন্ডনে তখন ভয়ানক তুষার পাত হচ্ছে। আমি মিতুকে বললাম গাড়িতে ওঠো,তোমাকে তোমার ডর্মে নামিয়ে দিয়ে আসি। মিতু জিজ্ঞেস করলো কথা ঘুরালে যে? উত্তরটা?
আমি বললাম আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারবো না মিতু। হয় না এটা,আমরা অসাধারণ বন্ধু,এই সম্পর্কটাই থাক?গাড়িতে করে দিয়ে আসলাম ওকে,বাইরে শ্বেত শুভ্র তুষারে ঢাকা চারপাশ,আমার পাশের মেয়েটা তার থেকেও শুভ্র,আমার হঠাত খুব বিষণ্ণ লাগলো।আমার ইচ্ছে করলো ছুঁয়ে দেই মেয়েটার গালের কান্নার দাগ,কি হবে যদি হাত ধরি? আমি পারি নি। কেন পারি নি আমি জানি না। আমি হিমু ছিলাম না,মহাপুরুষ হবার ব্রতও আমার ছিলো না, আমি শুধু জানতাম এই মেয়েটার হাত ধরলে ঠকানো হবে তাকে। আমি মিতুকে ঠকাতে চাই নি।
****
আমি রাস্তায় হাটছি,রাস্তায় একটা নেড়িকুত্তা আমার পিছ নিয়েছে,মিতুদের বাসা থেকে বের হবার পর ই।আমি ওর সাথে গল্প করছি।কুত্তা বেশ বুঝদার,লেজ নেড়ে সায় দিচ্ছে,মাঝে মাঝে হউহউ করে হালকা ডাক ও দিচ্ছে।
বুঝলি রে,আমার খারাপ লাগছে আজ, মিতুর বিয়ে হয়ে গেলো।
কি বললি? আমি ভালোবাসতাম কী না?
আমি জানি না রে,আমি আসলেই জানি না।আমি ক্লান্ত,ভালোবাসতে না পেরে ক্লান্ত।আমার মা মারা যাবার পর যে মহিলাটি আমাকে কোলে করে মানুষ করেছেন আমি কোনদিন তাকে মা ডাকি নি।তিনি তো আমাকে ভালোবেসেছেন,বিয়ের পর নিজেকে বলেছেন অভির মা।আমি তাও ভালোবাসতে পারি নি,আমি কাউকে ভালোবাসতে পারি না,আমার চারপাশে আমার ভালোবাসার মানুষগুলো,আমার খুব ইচ্ছে হয় ভালোবাসতে।আমার ক্লান্ত লাগে রে নেড়ি।খুব ক্লান্ত লাগে।
কী বললি? ভালো লাগছে না এই বকবক? খিদে পেয়েছে? চল খুঁজে দেখি কিছু পাওয়া যায় কী না।
বুঝলি রে,তীব্র ভালোবাসায় ডুবে থাকা মানুষগুলোও অনেক সময় চলে যায় ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট নিয়ে,আর কাওকে ভালো না বাসতে পারার কষ্ট তো আরো ভয়ানক।আমরা বাতাসের মাঝে ডুবে থাকি,তাই বাতাসকে বুঝি না কখনও।
হউফ হউফ
আচ্ছা আচ্ছা ঠিকাছে,আর বলবো না এসব ভারী কথা।চল,আমরা হাটি।গন্তব্যহীন গন্তব্যে,যার কোন শেষ নেই।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত